চিনি বীট বা সুগার বীট উচ্চ ঘনত্বসম্পন্ন ও মূলজাত সুক্রোজসমৃদ্ধ উদ্ভিদ। সচরাচর চিনি উৎপাদনকল্পে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষাবাদ হয়ে থাকে। আখ চাষের উপযোগী প্রচণ্ড ঠাণ্ডা জলবায়ু অঞ্চলে চিনি বীট চাষ করা হয়। ২০২০ সালের তথ্য মোতাবেক - রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স ও তুরস্ক বিশ্বের সর্ববৃহৎ চিনি বীট উৎপাদনকারী দেশের মর্যাদা পেয়েছিল।[১] ২০১০-১১ মৌসুমে আর্কটিক অঞ্চলগুলো ছাড়া ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো চিনির অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয় ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলো চিনি আমদানী করতে বাধ্য হয়েছিল।[২] ২০০৮ সালে ১,০০৪,৬০০ একর (৪০৬,৫৪৭ হেক্টর) জমিতে চিনি বীট চাষাবাদ করে।[৩] ২০০৯ সালে বৈশ্বিক চিনি উৎপাদনের ২০%[৪] ও ২০১৩ সালে প্রায় ৩০% চিনি বীট বাজার দখল করেছিল।[৫] তবে, বাদ-বাকী চিনি আখের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়েছিল। বাংলাদেশে সুগারবিট তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি ৷
ইতিহাস
ষোড়শ শতকে ফরাসি বিজ্ঞানী অলিভিয়ের ডি সেরেস লাল বিটরুট থেকে চিনির সিরাপ তৈরির প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছিলেন। ১৫৭৫ সালে তিনি লিখেছেন, ‘বীট-রুট সিদ্ধ করা হলে চিনির সিরাপের ন্যায় শরবত পাওয়া যায় ও দেখতে সিঁদুরে রঙের মতো সুন্দর ছিল।’[৬][৭] তবে, স্ফটিকাকার চিনি ইতোমধ্যে সহজলভ্য ও অধিক স্বাদের হওয়ায় এ প্রক্রিয়াটি জনপ্রিয়তা পায়নি।
আধুনিককালের চিনি বীট অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সিলেসিয়ায় উদ্ভূত। ঐ সময়ে প্রুশিয়ার রাজা মহামতি ফ্রেডরিক চিনি নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার উত্তরণে ভর্তুকি প্রদান করেছিলেন।[৮][৯] ১৯৪৭ সালে বার্লিনভিত্তিক সায়েন্স একাডেমির পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আন্দ্রিয়াস সিগিসমন্ড মারগ্রাফ বীটরুট থেকে চিনি পৃথক করেন ও ১.৩ থেকে ১.৬% ঘনত্ব খুঁজে পান।[১০] তিনি উৎপাদিত চিনির অনুরূপ প্রক্রিয়ায় বীট থেকে চিনি বের করার বিষয়টি প্রদর্শন করেন।[৯] তিনি সব্জিজাত উৎসগুলোর মধ্যে শ্বেত বীট থেকে চিনি আহরণের সেরা উৎস খুঁজে বের করেন।[১১] তবে, মারগ্রাফের বীট থেকে চিনি বিচ্ছিন্নকরণের সফলতা বাণিজ্যিকভাবে চিনি উৎপাদনের দিকে ধাবিত করেনি।
মারগ্রাফের ছাত্র ও উত্তরসূরী ফ্রাঞ্জ কার্ল আকার্ড ১৭৮৬ সালে বার্লিনের কাছাকাছি কলসডর্ফে বীট চিনির উদ্ভিজ্জ প্রজনন কার্যক্রম শুরু করেন।[১২] আকার্ড চিনিসমৃদ্ধ বীটের ২৩ প্রজাতির উদ্ভিজ্জ প্রজনন ঘটান।[১৩] ১৮০১ সালে সিলেসিয়ার কুনার্নে ফ্রাঞ্জ কার্ল আকার্ড বিশ্বের প্রথম চিনি বীট কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।[১৪] খুব শীঘ্রই ফ্রান্সে বীট থেকে চিনি উৎপাদনের প্রক্রিয়ার প্রচলন শুরু হয়। এরপর থেকেই ইউরোপীয় দেশসমূহে চিনি বীট শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। ১৮৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৫% চিনি বীট থেকে উৎপাদিত হয়েছিল। ১৮৮০ সালের মধ্যে এ সংখ্যাটি দশগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৫০%-এর অধিক হয়।[৮] ১৮৭৯ সালে উত্তর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার আলভারাডোর একটি খামারে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়।[৯][১০] ১৮৫০ সালে চিলিতে জার্মান বসতিরা চিনি বীট চাষাবাদ করতে শুরু করে।[১০]
চাষাবাদ প্রণালী
সফলভাবে বীট চাষ করার জন্যে জমি অবশ্যই সুচারূরূপে ও সঠিকভাবে প্রস্তুত করা প্রয়োজন। সফলতম উৎপাদনের জন্যে ইক্ষুর ন্যায় চিনি বীট উৎপাদনের জন্যে বিশেষ ধরনের মাটি ও উপযুক্ত জলবায়ুর প্রয়োজন। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে মাটিতে অবশ্যই ব্যাপক পুষ্টিমান উপাদান, হিউমাসসমৃদ্ধ ও প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতা ধারণ সক্ষম হতে হবে। নির্দিষ্ট মাত্রার ক্ষার ক্ষতিকারক না হলেও চিনি বীট ক্ষারে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। মোটামুটিভাবে জমি সমতল ও সেচ নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো হতে হবে।[১৪]
বেলে ও দোআঁশ - উভয় ধরনের মাটিতেই উত্তম চাষাবাদ হলেও জৈব পদার্থ, কাদামাটি এবং বালির মিশ্রণসমৃদ্ধ বেলে-দোআঁশ মাটি উত্তম। উত্তম ফসলের জন্যে ১২ থেকে ১৫ ইঞ্চি (৩০.৫ থেকে ৩৮.১ সে.মি.) গভীরতায় খনন করা প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিস্থিতি, তাপমাত্রা, রৌদ্রকিরণ, বৃষ্টিপাত এবং বায়ু চিনি বিটের উত্তম চাষের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। ১৫°সে. থেকে ২১ °সে. (৫৯.০°ফা. থেকে ৬৯.৮ °ফা.) তাপমাত্রায় চাষাবাদের মাসগুলিতে সবচেয়ে জরুরী। পর্যাপ্ত সেচের অভাব হলে ৪৬০ মি.মি. (১৮.১ ইঞ্চি) বৃষ্টিপাত ফসল বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। প্রচণ্ড বাতাস এর জন্যে। সচরাচর এ পরিস্থিতিতে গাছগুলো নুঁইয়ে পড়ে ও চিনি বীট গাছের উত্তরণে বিরূপ প্রভাব ফেলে। ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী এলাকায় সর্বোত্তম সাফল্য পাওয়া গেছে। সেখানকার উষ্ণ আবহাওয়া, ঠাণ্ডা পরবর্তী রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, কুয়াশাচ্ছন্ন রাত চিনি বীট গাছের বৃদ্ধিতে অনুকূল প্রভাব ফেলেছে। দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যকিরণ থাকলেও চিনি বীট উৎপাদনে তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে না। বিষুবরেখার কাছাকাছি দেশগুলোয় স্বল্প সময়ের দিন ও সূর্যের অধিক তাপ বীটে চিনির পরিমাণ বৃদ্ধিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে।[১৪]
উৎপাদন ব্যবস্থা
২০২০ সালের ফাওয়ের তথ্য মোতাবেক বিশ্বের শীর্ষ-১০ চিনি বীট উৎপাদনকারী দেশ[১]
অধিকাংশ নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুসমৃদ্ধ এলাকায় বসন্তকালে চিনি বীট গাছ লাগানো হয় ও শরৎকালে ফসল তোলা হয়। এর বাইরে উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় ১০০ দিনের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের উপযোগী করা হয়। ১ কেজি (২.২ পাউন্ড) বীজে প্রায় ১০০,০০০ বীজ থাকে ও এক হেক্টরে (২.৫ একর) জমিতে ছিটানো হয়। অর্থাৎ, এক একর বা ০.৪০ হেক্টর জমিতে এক পাউন্ড বা ০.৪৫ কেজি বীজের প্রয়োজন পড়ে।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ২৫২,৯৬৮,৮৪৩ মেট্রিক টন চিনি বীট আবাদ করা হয়। রাশিয়া বিশ্বের সর্ববৃহৎ উৎপাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সেখানে ৩৩,৯১৫,০৮৬ মেট্রিক টন উৎপাদিত হয়।[১] তবে, বিশ্বব্যাপী প্রতি হেক্টরে গড়ে ৫৮.২ টন চিনি বীটের ফলন হয়। ২০১০ সালে চিলিতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল বীট চিনির খামার ছিল। সেখানে দেশব্যাপী গড় ফলন ছিল হেক্টরপ্রতি ৮৭.৩ টন।[১৫] ক্যালিফোর্নিয়ার ইম্পেরিয়াল ভ্যালির কৃষকেরা হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৬০ টন ও প্রতি হেক্টর থেকে ২৬ টনের অধিক চিনি আহরণ করে।[১৬][১৭] সেখানকার খামারগুলো পর্যাপ্ত সৌরকিরণ পায় ও সেচ ও সার ব্যবহারের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে এ সফলতা পায়।
অধিকাংশ চিনি বীট শ্বেত চিনি তৈরিকরণে ব্যবহৃত হয়। প্রায়শঃই চিনি কারখানা নামে পরিচিত চিনি বীট কারখানায় এ কার্যপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। বর্তমানে এগুলোয় অধিকাংশ সময়ই চিনি পরিশোধনাগার হিসেবে কাজ করে থাকে। তবে, অনেক আগে থেকেই চিনি বীট কারখানা থেকে অপরিশোধিত চিনি উৎপাদন করে ও চিনি শোধনাগারগুলো অপরিশোধিত চিনি থেকে শ্বেত চিনি তৈরি করে।
↑"Sugar:World Markets and Trade"(পিডিএফ)। United States Department of Agriculture: FAS Information। ২০১১। ৫ অক্টোবর ২০১১ তারিখে মূল(পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ নভেম্বর ২০২৩।