গ্রিঞ্জবারো যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যের একটি শহর ও গাইলফোর্ড কাউন্টির সদর দপ্তর। জনসংখ্যায় এটি নর্থ ক্যারোলাইনার তৃতীয় বৃহত্তম ও যুক্তরাষ্ট্রের ৬৮-তম বৃহত্তম শহর। এছাড়াও গ্রিঞ্জবারো পিয়েডমন্ট ট্রায়াড মেট্রোপলিটন এলাকার বৃহত্তম শহর। ২০১০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এর জনসংখ্যা ছিল ২,৬৯,৬৬৬। ২০১৯ সালে এর প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ২,৯৬,৭১০। [৫]
গাইলফোর্ড কাউন্টির আদালতভবন নর্থ ক্যারোলাইনার সুবিধাজনক কোনো স্থানে স্থানান্তর করার কথা চিন্তা করা হয়েছিল। এই চিন্তাধারার আলোকেই ১৮০৮ সালে গ্রিঞ্জবারো শহর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। যেহেতু অধিকাংশ নাগরিক পায়ে হেঁটে কিংবা ঘোড়ায় করে যাতায়াত করত, তাই এ সিদ্ধান্তে তারা উপকৃত হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক জন-অধিকার জাদুঘর, উইদারস্পুন শিল্প জাদুঘর, গ্রিঞ্জবারো বিজ্ঞান কেন্দ্র, গ্রিঞ্জবারো ব্যালে প্রভৃতি গ্রিঞ্জবারো শহরের মূল আকর্ষণ।
ইউরোপীয়দের বসতি স্থাপনের সূচনালগ্নে এখানে সিওয়ান-ভাষী সওরা জাতির লোক বসবাস করত। [৬]
১৭৫০ সালে কোয়েকার অভিবাসীরা পেনসিলভানিয়া থেকে মেরিল্যান্ড হয়ে কেপফেয়ারে (বর্তমান গ্রিঞ্জবারো) আগমন করে। ১৭৫১ সালে তারা স্নো-ক্যাম্প এলাকায় প্রথম ধর্মসভা আয়োজন করে। [৭] ১৭৫৪ সালে ৪০টি কোয়েকার পরিবারকে মাসিক ধর্মসভায় যোগদানের অনুমতি প্রদান করা হয়। [৮] মূলত এখান থেকেই কোয়েকার ধর্মসভা আয়োজনের সংস্কৃতি শুরু হয়। ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের নানটাকেট শহর থেকেও অভিবাসীরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে।
১৭৮১ সালের ১৫ মার্চ গাইলফোর্ড আদালতভবন যুদ্ধের নায়ক নাথানিয়েল গ্রিনের নামানুসারে শহরটির নাম হয় গ্রিঞ্জবারো। যদিও গ্রিনের বাহিনী ব্রিটিশদের হাতে পরাভূত হয়েছিল, এর সৈন্যরা লর্ড কর্নওয়ালিসের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। উক্ত যুদ্ধের পর কর্নওয়ালিস উইলমিংটন শহরে সামরিক ঘাঁটি স্থানান্তর করেন।
গ্রিঞ্জবারো শহর প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি সওরাদের কাছ থেকে ৯৮ ডলারের বিনিময়ে ক্রয় করা হয়। উত্তর-দক্ষিণে গ্রিন,এলম, ডেভি ও পূর্ব-পশ্চিমে গ্যাস্টন, মার্কেট ও সিকামোর সড়ক নির্মাণ করা হয়। এলম ও মার্কেট স্ট্রিটের সংযোগস্থলে আদালতভবন নির্মাণ করা হয়।
রাজ্য সরকার যখন রেলসড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করে, তখন তারা গ্রিঞ্জবারোকে যাত্রাবিরতিস্থল নির্ধারণ করে। পিয়েডমন্টের পরিবহনকার্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখায় এর নাম হয় "তোরণ শহর" বা গেট সিটি।
একসময় গ্রিঞ্জবারো শহরে বস্ত্রশিল্পের বিকাশ ঘটে- কিন্তু দ্রুতই সে বিকাশের গতি মন্থর হয়ে পড়ে। তবে আজও র্যাংলার, লি, নর্থ ফেস সহ অনেক বস্ত্রশিল্প কারখানা এখানে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম তামাকনির্মাতা প্রতিষ্ঠান আইটিজি ব্র্যান্ডসের সদর দপ্তর এখানে অবস্থিত।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ফলে শহরে কতগুলো নয়নাভিরাম ভবন গড়ে ওঠে। এর মধ্যে রয়েছে- ১৭৯৫ সালে নির্মিত ব্ল্যান্ডউডস ম্যানশন অ্যান্ড গার্ডেন ও ১৮৪৬ সালে নির্মিত আলেক্সান্ডার জ্যাকসন ডেভিসের বাসভবন।
নর্থ ক্যারোলাইনা কনফেডারেট আমেরিকায় যোগদান করলে গ্রিঞ্জবারো শহরের অনেকেই কনফেডারেট সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সালের মার্চ পর্যন্ত শহরটিতে গৃহযুদ্ধ তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে অধিবাসীদের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে ব্যাপক সংকট পরিলক্ষিত হয়। ১৮৬৫ সালের এপ্রিলে টেনেসি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল পি.জি.টি. ব্যুরেগার্ডকে শহরটি রক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়। এসময় কনফেডারেট যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জেফারসন ডেভিস রাজধানী রিচমন্ড থেকে পালিয়ে দক্ষিণে ড্যানভিল শহরে পৌঁছান।
১৮৬৫ সালের ১১ এপ্রিল ড্যানভিল থেকে রেলগাড়িতে পালিয়ে তিনি গ্রিঞ্জবারোতে পৌঁছান। এখানেই তিনি শেষবারের মত মন্ত্রীদের সাথে দেখা করেন। তাই একে কেউ কেউ কনফেডারেট যুক্তরাষ্ট্রের শেষ রাজধানী অভিহিত করেন।
একই সময়ে গভর্নর জেবুলন বি ভ্যান্স রাজধানী র্যালেই থেকে পালিয়ে গ্রিঞ্জবারো শহরে এসে পৌঁছান। ইউনিয়ন জেনারেল উইলিয়াম টি শেরম্যান দ্রুত গ্রিঞ্জবারো দখল করে নেন। অগত্যা ভ্যান্স ১৮৬৫ সালের ২৮ এপ্রিল শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হন।
গ্রিঞ্জবারো শহর দ্রুতই ধনে-মানে-সম্পদে সমৃদ্ধ হতে থাকে। স্থানীয় স্থপতি চার্লস হার্টম্যান ও হ্যারি বার্টন এখানকার অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ভবন প্রতিষ্ঠা করেন। ভিকস কেমিক্যাল কো. (মাথাব্যথা দূরীকরণের ওষুধ প্রস্তুতকারী),ক্যারোলাইনা ইস্পাত কর্পোরেশন ও পমোনা টেরাকোটা ওয়ার্কস সহ অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখানে গড়ে ওঠে। দ্রুত বর্ধনশীল শহর হওয়ায় আবাসিক সংকটও এখানে তীব্র হয়ে ওঠে। মহামন্দার সময়ও এর আর্থিক প্রগতি অব্যাহত থাকে।
এখানে দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত - নর্থ ক্যারোলাইনা এ অ্যান্ড টি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা।
গ্রিঞ্জবারোর কৃষ্ণাঙ্গরা জিম ক্রো আইন সহ অনেক রকম কুপ্রথা ও বৈষম্যের শিকার হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গরা হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়। গ্রিঞ্জবারোতেও এর প্রভাব পড়ে। ১৯৬০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি চারজন কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র শহরের উলওয়ার্থ রেস্তোরাঁর লাঞ্চ কাউন্টারে প্রবেশ করে খাবার পরিবেশন নির্দেশ দেন। কিন্তু সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের খাবার পরিবেশন নিষিদ্ধ ছিল। তাই তাদের নির্দেশ অমান্য করা হলে তারা ধরনা (Sit in) দেন। শত শত শিক্ষার্থী তাদের সাথে যোগদান করে। অতঃপর সেখানে এ ধরনের কুপ্রথা বন্ধ হয়ে যায়।
উলওয়ার্থ রেস্টুরেন্টে বর্তমানে আন্তর্জাতিক নাগরিক অধিকার জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [৯]
১৯৬২ ও ১৯৬৩ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের সম-অধিকার আদায়ের জন্য এখানে অনেকগুলো আন্দোলন সংঘটিত হয়। জেসি জ্যাকসন সহ অনেক অধিকারকর্মী গ্রিঞ্জবারোর বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে; এক পর্যায়ে গ্রিঞ্জবারোর ব্যবসায়ীরা তাদের দাবির সঙ্গে সংহতি জানাতে বাধ্য হন।
১৯৬৯ সালের মে মাসে জেমস বি ডাডলি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনে ক্লড বার্নস নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি না দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারপর এ অ্যান্ড টি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তারা একত্রে আন্দোলনে অংশ নেয়। [১০] আন্দোলন দমন করতে গভর্নর ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীকে এখানে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করেন। তারা শত শত শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে। নাগরিক অধিকার কমিশন শিক্ষার্থীদের উপর দমন-পীড়নের তীব্র নিন্দা জানায়।
১৯৭৯ সালের ৩ নভেম্বর মর্নিংসাইড আবাসন প্রকল্পের সামনে কমিউনিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি কু ক্লাক্স ক্ল্যান বিরোধী শোভাযাত্রা আয়োজন করে। তৎক্ষণাৎ আলোচনাসভায় নব্য-নাৎসি ও কু ক্লাক্স ক্ল্যানের সদস্যরা হামলা চালায়। ঐ হামলায় পাঁচজন কমিউনিস্ট নিহত হন। এগারোজন কমিউনিস্ট ও একজন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আহত হয়। [১১] ১৯৮০ সালের নভেম্বরে শ্বেতাঙ্গ-অধ্যুষিত জুরিবোর্ড ছয়জন অভিযুক্তকে খালাস দেয়। তখন নিহতদের পরিবার পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলায় পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তা ও দুইজন সাধারণ ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হন। ১৯৮৫ সালে জুরিবোর্ড তাদের ৩,৫০,০০০ ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেন।
আদমশুমারি ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গ্রিঞ্জবারো শহরের আয়তন ৩৪১.৪ বর্গকিলোমিটার। এর ৩২৭.৭ বর্গকিলোমিটার স্থল ও ১৩.৭ বর্গকিলোমিটার জল।
লিংকন ফিন্যান্সিয়াল টাওয়ার শহরটির উচ্চতম ভবন।
গ্রিঞ্জবারো শহরের কেন্দ্রে নতুন নতুন আবাসিক ভবন ও অনেক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শহরের দক্ষিণাঞ্চলে অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। রেস্তোরাঁ, পানশালা ও নৈশক্লাবের সমারোহে রাতের গ্রিঞ্জবারো এল ঝলমলে নগরী হয়ে ওঠে।
১৯৯৮ সালে ফেড এক্স ৩০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে গ্রিঞ্জবারো শহরে পিয়েডমন্ট। ট্রায়াড বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা করে। [১২]
গ্রিঞ্জবারোর জলবায়ু আর্দ্র উপক্রান্তীয় ধরনের। শীতকাল সংক্ষিপ্ত হলেও যথেষ্ট ঠাণ্ডা হয়। বছরে গড়ে ৭৫ রাতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায়। প্রতি শীতে এখানে গড়ে ১৯.১ সেমি তুষারপাত হয়। গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ও আর্দ্র; এ সময় গড় তাপমাত্রা থাকে ৭৮.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট। সর্বোচ্চ রেকর্ডকৃত তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট ও সর্বনিম্ন রেকর্ডকৃত তাপমাত্রা -৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
১৯৩৬ সালের ২ এপ্রিল এখানে একটি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় আঘাত করে। এতে ১৪ জন নিহত হন। শহরে আরো অনেকবার ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছে। যেমন - স্টোনভিল (১৯৯৮),ক্লিমনস ও উইনস্টন সেলাম (১৯৮৯), ক্লিমনস ও গ্রিঞ্জবারো (২০০৮), হাই পয়েন্ট (২০১০) ও গ্রিঞ্জবারো (২০১৮)।
২০১০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, শহরের জনসংখ্যা ২,৬৯,৬৬৬ ও পরিবারের সংখ্যা ৬৩,২৪৪। শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৮২২.৯ জন। শহরের বাসিন্দাদের ৪৮.৪% শ্বেতাঙ্গ, ৪০.৬% কৃষ্ণাঙ্গ, ৪% এশীয় ও ০.৫% আদিবাসী আমেরিকান।[১৩] হিস্পানিক ও লাতিনোদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৭.৫%। [১৪]
শহরের পরিবারগুলোর গড় আয় ৫৩,১৫০ মার্কিন ডলার। পুরুষ ও নারী পূর্ণবয়স্ক কর্মীদের গড় আয় ৪০,১৪৩ ও ৩৪,৭৬১ মার্কিন ডলার। শহরের মাথাপিছু আয় ২৫,৯২৯ মার্কিন ডলার। ১৪.৬% পরিবার ও ১৯.৩% বাসিন্দা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এদের মধ্যে ২৫.৯% এর বয়স ১৮ এর নিচে ও ১০.৫% এর বয়স ৬৫ এর উপরে।
<ref>
Census 2010
USCensusEst2019