গুলবাহার খাতুন বা ইংরেজিতে প্রসিদ্ধ গুলবাহার হাতুন (উসমানীয় তুর্কি: کل بھار خاتون; মৃত্যু আনু. ১৪৯২, মুকরিমে হাতুন নামেও পরিচিত; উসমানীয় তুর্কি: مکرمہ خاتون)[২] উসমানীয় সাম্রাজ্যের মুহাম্মাদ ফাতিহের প্রথম স্ত্রী এবং তাঁদের পুত্র দ্বিতীয় বায়েজীদের মা হিসেবে উসমানীয় সাম্রাজ্যের ওয়ালিদায়ে খাতুন ছিলেন।[৩][৪][৫][৬]
গুলবাহার খাতুন জন্মসূত্রে একজন তুর্কি। তিনি ছিলেন হামজা বে অথবা হালিল বে এর কন্যা এবং মুস্তাফা পাশার বোন। সম্ভবত তিনি প্রাচীন টোকাতের কোনো পরিবার থেকে উদ্ভূত, কারণ তাঁর স্মৃতিতে বায়েজীদ ১৪৮৫ সালে সেখানে একটি মসজিদ এবং স্কুল তৈরি করেছিলেন।[৭][৮]
১৪৪৬ সালে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ একজন শাহজাদা এবং আমাসিয়ার প্রশাসক থাকা অবস্থায়, গুলবাহার তাকে বিয়ে করেন। তার দুজন সন্তান ছিল, ১৪৪৭ সালে ডেমোটিকাতে জন্মগ্রহণ করা শাহজাদা বায়েজীদ (ভবিষ্যত সুলতান দ্বিতীয় বায়েজীদ) এবং শাহজাদী গেভারহান হাতুন,[৯] যিনি ১৪৭৪ সালে আক কোয়ুনলু সুলতান উযুন হাসানের পুত্র উঘুরলু মুহাম্মদকে বিয়ে করেন।[১০]
১৪৫১ সালে, মেহমেদের সিংহাসনে আরোহণের পর গুলবাহার তার সাথে এদিরনেতে যান। তুর্কি ঐতিহ্য অনুসারে, সকল শাহজাদাকেই প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে প্রাদেশিক প্রশাসক (সানজাক-বে) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৪৫৫ বা ১৪৫৬ সালে, শাহজাদা বায়েজীদকে আমাসিয়ার প্রশাসক নিয়োগ করা হয় হয় এবং গুলবাহার তার সাথে যান, যেখানে তারা দুজনই ১৪৮১ সাল পর্যন্ত ছিলেন, কেবল ১৪৫৭ সাল ব্যতীত, যখন তিনি তার ছেলে বেয়াজীদের সুন্নতে খৎনা অনুষ্ঠানে যোগদান করতে এদিরনে আসেন।[৯]
গুলবাহার স্পষ্টতই তার ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং এর সাথে তার নিজের সম্পত্তি নিয়েও। তার সম্পত্তি সুরক্ষিত করার জন্য, তিনি ১৪৪৪ সালে কয়েকটি গ্রাম এবং ইন্দেরুন মসজিদের ক্ষেতের উপার্জন অধিগ্রহণ করেছিলেন। অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তিসমূহের মধ্যে ছিল আঘিলচিক গ্রাম, যেটিকে পরবর্তীতে ১৪৭৯ সালে ভূমি সংস্কারের সময় টিমেরিয়টদের (উসমানীয় ঘোড়সওয়ার সিপাহী) গ্রামে পরিণত করা হয়। [১১]
১৪৬৮ সালে, মেহমেদ বাঘলুচা গ্রামটি গুলবাহারকে প্রদান করেন। ছয় বছর পর, ১৪৭৩ সালে, বায়েজীদের দরবারের হিসাবরক্ষক হামযা বালি (মৃত্যু ১৪৮৬)'র ছেলে তাজেদ্দিন বে'র নিকট গ্রামটি বিক্রি করে দেন। ১৪৭৮ সালে, সম্ভবত ভূমি সংস্কারের ফলেই এই গ্রামের অব্যাহতি বিলুপ্ত হয়েছিল এবং তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই আদেশটি এক বছর পরে জনৈক মৌলানা শেমসেদ্দিন আহমেদ এর অনুরোধে পুনরায় প্রকাশ করা হয়েছিল, যেটি অনুযায়ী গ্রামটি গুলবাহার খাতুনকে আর ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি এবং তিনি সম্ভবত কোনও আইনি বিবাদের শিকার হয়েছিলেন। [১২]
১৪৮১ সালে যখন গুলবাহার খাতুনের ছেলে বায়েজীদ সিংহাসনে আরোহণ করেন[১৩] তখন প্রথানুযায়ী তিনি রাজপরিবারে সর্বোচ্চ সম্মানিত পদ, ভালিদে সুলতান (ভালিদে খাতুন) এর পদমর্যাদা লাভ করেন যা তার মৃত্যু অবধি বহাল ছিল। বায়েজীদের ক্ষমতায় আরোহণের সাথে সাথেই গুলবাহার খাতুন একজন ভালিদে সুলতানের সমকক্ষীয় ভূমিকাই পালন করেন, কারণ সেসময় গদিনাসীন সুলতানের মায়ের উপাধি এবং দায়িত্বসমূহ দাপ্তরিকভাবে নির্ধারিত ছিল না। তৎকালীন সময়ে, ভালিদে সুলতান উপাধিটি ব্যবহার করা শুরু হয়নি কারণ উসমানীয় রাজবংশের নারীদের ক্ষেত্রে তখন খাতুন উপাধি ব্যবহার হতো। লেসলি পি. পিয়ার্স এর তথ্য অনুযায়ী, ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে (প্রথম সুলাইমানের রাজত্বকালে) ভালিদে অর্থাৎ সুলতান মাতা, শাহজাদী এবং সুলতানের প্রধান সঙ্গিনীদের ক্ষেত্রে খাতুন উপাধিকে প্রতিস্থাপিত করে সুলতান উপাধি ব্যবহার করা শুরু হয়। এর ফলে, ষষ্ঠদশ শতাব্দীর পূর্বে গদিনাসীন সুলতানের জীবিত মাতার ব্যবহৃত উপাধি, ভালিদে খাতুন উপাধিটি ভালিদে সুলতান-এ রূপান্তরিত হয় যেটি হাফসা সুলতান সর্বপ্রথম দাপ্তরিকভাবে ব্যবহার করেন। গুলবাহার খাতুন এবং রাজপরিবারের অন্য সদস্যরা সবাই তার ছেলে দ্বিতীয় বায়েজীদের রাজত্বকালে পুরাতন প্রাসাদে বসবাস করতেন যা সরাই-ই আতিক(তুর্কি: saray-ı atik) নামেও পরিচিত এবং তার ছেলে সাক্ষাৎ করতে আসতেন যিনি প্রতি সাক্ষাতেই তার মায়ের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করতেন। এক ঘটনায়, গুলবাহার তার ছেলের অনিয়মিত সাক্ষাতের ব্যাপারে অভিযোগ করে তার ছেলের কাছে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন:
আমার সৌভাগ্য, আমি তোমার অভাববোধ করছি, তুমি যদি আমার অভাববোধ নাও করো, তাও আমি তোমার অভাববোধ করি... এসো এবং আমাকে দেখা দাও। আমার প্রিয় বাদশাহ, যদি তুমি শীঘ্রই অভিযানে বের হও, অন্তত একবার বা দুবার এসো যাতে করে তুমি যাওয়ার পূর্বে আমি তোমার সৌভাগ্যমণ্ডিত চেহারাখানি দেখতে পাই। তোমাকে আমি শেষ দেখেছি, চল্লিশ দিন হয়ে গেছে। আমার সুলতান, দয়া করে আমার নির্ভীকতা মাফ করো। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে...?[১৪]
[১৪]
গুলবাহারের বায়েজিদের উপর যথেষ্ট প্রভাব ছিল, কারণ তিনি কিছু রাষ্ট্রীয় কূটনৈতিকদের পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতেন। বায়েজীদও তার মায়ের কথার গুরুত্ব দিতেন। বায়েজীদকে লেখা গুলবাহারের একটি চিঠিতে তিনি বায়েজীদকে হেরসেকজাদে আহমেদ পাশার বিরুদ্ধে পরামর্শ দেন, তবে তাঁর শিক্ষক আয়াস পাশা এবং হিজিরবেওগ্লু মেহমেদ পাশার পক্ষে ছিলেন।[৯]
১৪৮৫ সালে, বায়েজীদ তার মা গুলবাহার খাতুনের স্মরণে একটি মসজিদ এবং টোকাত-এ একটি বিদ্যালয় প্রদান করেছিলেন।[১৫]
গুলবাহার খাতুন ১৪৯২ সালে মৃত্যুবরণ করেন এবং ইস্তাম্বুলের ফাতিহ মসজিদে সমাধিস্থ হন।[৯]
উইকিমিডিয়া কমন্সে গুলবাহার খাতুন সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।