মেজর সৈয়দ ওয়াজির আলী (উচ্চারণⓘ; হিন্দি: वज़ीर अली; জন্ম: ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯০৩ - মৃত্যু: ১৭ জুন, ১৯৫০) তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের জলন্ধর এলাকায় জন্মগ্রহণকারী ভারতীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ছিলেন। ভারত ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৬ সময়কালে ভারতের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেছেন।
ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর ভারতীয় ক্রিকেটে মধ্য ভারত, পাতিয়ালার মহারাজা একাদশ, মুসলিম, সিন্ধু ও দক্ষিণ পাঞ্জাব দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। দলে তিনি মূলতঃ অল-রাউন্ডার হিসেবে খেলতেন। ডানহাতে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি ডানহাতে মিডিয়াম পেস বোলিং করতেন ওয়াজির আলী।
প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট
১৯২২-২৩ মৌসুম থেকে ১৯৪৭-৪৮ মৌসুম পর্যন্ত ওয়াজির আলী’র প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান ছিল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী ওয়াজির আলী চমৎকার ব্যাটসম্যান হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন ও বিভিন্নভাবে শক্তিশালী স্ট্রোক মারার অধিকারী ছিলেন।
প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটের অধিকাংশ সময়ই রঞ্জী ট্রফিতে দক্ষিণ পাঞ্জাব ও বোম্বে পঞ্চদলীয় প্রতিযোগিতায় মুসলিম দলের পক্ষে খেলতেন। ১৯৩৮-৩৯ মৌসুমের রঞ্জী ট্রফি প্রতিযোগিতায় বাংলার বিপক্ষে অপরাজিত ২২২ রান তুলেন। এটি তৎকালীন সময় প্রতিযোগিতার ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ সংগ্রহরূপে বিবেচিত ছিল। এরপূর্বে বাংলা দল ২২২ রানে গুটিয়ে যায়। পরবর্তীতে অবশ্য তার দল খেলায় পরাজয়বরণ করেছিল। ১৯৩৫ সালে ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটি অকেসনালসের পক্ষে খেলোয়াড়ী জীবনের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ অপরাজিত ২৬৮ রান করেন। এটি ঐ সময়ে ভারতীয় প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ সংগ্রহ ছিল। পরবর্তীতে ১৯৩৯-৪০ মৌসুমে বিজয় হাজারে ৩১৬ রান তুলে উভয় রেকর্ড ভঙ্গের মাধ্যমে নিজের করে নেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট
সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনে সাতটিমাত্র টেস্টে অংশগ্রহণ করেছেন ওয়াজির আলী। ২৫ জুন, ১৯৩২ তারিখে লর্ডসে স্বাগতিক ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। ১৫ আগস্ট, ১৯৩৬ তারিখে ওভালে একই দলের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্টে অংশ নেন তিনি। ১৯৩২ ও ১৯৩৬ সালে ইংল্যান্ড গমন করেন এবং ১৯৩৩ সালে সফরকারী ইংল্যান্ড দলের মুখোমুখি হয়েছিলেন। অংশগ্রহণকৃত সবগুলো টেস্টই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ভারতের পক্ষে খেলেছেন।
লর্ডসে স্বাগতিক ইংরেজ দলের বিপক্ষে ভারতের সর্বপ্রথম টেস্ট খেলার জন্যে মনোনীত হন। ইংল্যান্ড সফরে ছয়টি শতরানের ইনিংস খেলেন। ঐ সফরে প্রথম-শ্রেণীর খেলাগুলোয় ১২২৯ রান ও সামগ্রীকভাবে ১৭২৫ রান তুলেন। ১৯৩৬ সালেও ইংল্যান্ড গমন করেছিলেন। ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৪২ রান তুলেন। কিন্তু, দ্বিতীয়বারের ইংল্যান্ড সফরে হাতে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। আঙ্গুলের আঘাতে এ সাফল্যের পুণরাবৃত্তি ঘটাতে বঞ্চিত হন। প্রায় এক মাস ক্রিকেট জগতের বাইরে অবস্থান করেছিলেন। তাসত্ত্বেও, এ সফরেই ফোকস্টোনে ইংরেজ একাদশের বিপক্ষে ভারতীয়দের পক্ষে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ অপরাজিত ১৫৫ রানের মনোমুগ্ধকর ইনিংসখেলে নিজেকে স্মরণীয় করে রাখেন।
১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালে সফরকারী অস্ট্রেলীয় একাদশের বিপক্ষে ভারতীয় দলের বিজয়ে নেতৃত্ব দেন। ১৯৩৫-৩৬ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া একাদশের বিপক্ষে অনানুষ্ঠানিক দুই টেস্টে ভারত দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ওয়াজির আলী। নায়ডু সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে নেতৃত্ব দেয়ার পর ঐ দুই টেস্টে বাদ পড়লে তিনি এ দায়িত্বভার বহন করেছিলেন। ওয়াজির বেশ ভালোভাবে নায়ডুর অনুপস্থিতি সামাল দেন।[১] দৃশ্যতঃ নায়ডু প্রকৃতপক্ষেই খেলার অনুপযোগী অবস্থায় ছিলেন।
মূল্যায়ন
ক্রিকেট জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে ওয়াজির আলী তার সমসাময়িক ভারতীয় ক্রিকেটার সি.কে. নায়ডু’র তুলনায় পরবর্তী স্থানে অবস্থান করতেন। তবে, সর্বদাই তাকে নায়ডু’র তুলনায় পরে নামতে হতো।[২] ঐ সময়ে নায়ডুকে অনেকের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে হতো; তবে, প্রায়শঃই ওয়াজির আলী তাকে ধাবিত ছিলেন।[৩]
মিহির বসু এ দুজনের ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, নায়ডু ও ওয়াজির আলী সহজাত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ওয়াজির নায়ডু’র ন্যায় ডানহাতে বেশ ভালো ব্যাটিং করলেও বেশকিছু দর্শনীয় স্ট্রোক বিশেষতঃ কভার ড্রাইভ মারতেন দূর্দান্তভাবে। এছাড়াও, পরিবর্তিত বোলার হিসেবে কার্যকরী মিডিয়াম-পেস বোলিং করতেন। নায়ডু’র ন্যায় তিনিও কেবলমাত্র সাত টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। সবগুলো টেস্টই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন। কিন্তু, নিজের জাত চেনাতে কিংবা স্বীয় যোগ্যতার পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ ঘটাতে পারেননি। ওয়াজির তার তুলনায় আট বছরের ছোট ছিলেন। বয়োজ্যেষ্ঠের দৃঢ়প্রতিজ্ঞাচেতা দৃষ্টিভঙ্গী ও মনোযোগের সাথে তাল মেলাতে পারেননি। নায়ডু নিঃসন্দেহে সেরা ক্রিকেটার ছিলেন।
দেহাবসান
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পর ওয়াজির আলী পাকিস্তানে চলে যান ও দারিদ্র্যতার মধ্যে জীবনের শেষ সময় অতিবাহিত করেন। ক্যাশম্যান এক পাকিস্তানি কর্মকর্তার উদ্বৃতি দিয়ে মন্তব্য করেন যে, জীবনের শেষ দিনগুলোয় তিনি দারিদ্র্য ও রোগাক্রান্ত অবস্থা মোকাবেলায় ব্যস্ত ছিলেন।[৪]
ভারত বিভাজনের পর পাকিস্তান গঠন হলে তিন বছরের মাথায় অ্যাপেনডিসাইটিসের চিকিৎসাকালে মাত্র ছিচল্লিশ বয়সে জীবনাবসান ঘটে। ১৭ জুন, ১৯৫০ তারিখে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে সিন্ধু প্রদেশের করাচী এলাকায় ওয়াজির আলী মৃত্যুবরণ করেন। ফলে, ঐ দেশের পক্ষে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিগতভাবে খুব কমই ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন।[৫]
তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা এস নাজির আলী ভারতের পক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার সন্তান খালিদ ওয়াজির ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের পক্ষে দুইটি টেস্টে অংশগ্রহণ করার সুযোগ লাভ করেছিলেন।[৬]