ঋতুপর্ণ ঘোষ (৩১ আগস্ট ১৯৬৩ - ৩০ মে ২০১৩) ছিলেন একজন ভারতীয়বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক।[১] অর্থনীতির ছাত্র ঋতুপর্ণ ঘোষের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট হিসেবে। ১৯৯২ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম ছবি হীরের আংটি। দ্বিতীয় ছবি উনিশে এপ্রিল মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। এই ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান।
ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের অনুরাগী। দুই দশকের কর্মজীবনে তিনি বারোটি জাতীয় পুরস্কারের পাশাপাশি কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছিলেন।[২][৩] ২০১৩ সালের ৩০ মে কলকাতায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়।[৪]
ব্যক্তিগত জীবন
১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায় ঋতুপর্ণ ঘোষের জন্ম। তার বাবা-মা উভয়েই চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা সুনীল ঘোষ ছিলেন তথ্যচিত্র-নির্মাতা ও চিত্রকর। ঋতুপর্ণ ঘোষ সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রি অর্জন করেন।[৫]
ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন ভারতের এলজিবিটি সম্প্রদায়ের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। জীবনের শেষ বছরগুলিতে তিনি রূপান্তরকামী জীবনযাত্রা নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন। তিনি নিজের সমকামী সত্ত্বাটিকে খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে নেন, যা ভারতের চলচ্চিত্র জগতের খুব কম মানুষ করেছেন।[৬][৭][৮]
বিজ্ঞাপন দুনিয়ায়
চলচ্চিত্র জগতে আসার আগে ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন কলকাতার একজন "অ্যাডভারটাইসমেন্ট কপিরাইটার"। ১৯৮০-র দশকে বাংলা বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় বেশ কিছু জনপ্রিয় এক লাইনের শ্লোগান লিখে দিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় কলকাতায় ইংরেজি ও হিন্দি বিজ্ঞাপনগুলি বাংলায় অনুবাদ করে চালানো হত। ঋতুপর্ণ বাংলায় স্বতন্ত্র বিজ্ঞাপনী শ্লোগানের ধারা সৃষ্টি করেন। তার সৃষ্ট বিজ্ঞাপনগুলির মধ্যে শারদ সম্মান ও বোরোলিনের বিজ্ঞাপনদুটি বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। কোনো কোনো সমালোচকের মতে, (বিজ্ঞাপনী চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে) দর্শকদের কাছে আবেদন পৌঁছে দেওয়ার এক বিশেষ দক্ষতা তিনি অর্জন করেছিলেন, যা তার ছবি বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে জনপ্রিয় করে তোলে।[৯][১০]
চলচ্চিত্র পরিচালনা
১৯৯২-২০০৩
ঋতুপর্ণ ঘোষের কর্মজীবন শুরু হয় বিজ্ঞাপনী দুনিয়ায়। তার পরিচালনায় প্রথম ছবি হিরের আংটি ১৯৯২ সালে মুক্তি পায়। এটি ছিল ছোটোদের ছবি।[১১] ছবিটি তৈরি হয়েছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস অবলম্বনে। এতে অভিনয় করেছিলেন বসন্ত চৌধুরী, মুনমুন সেন প্রমুখেরা।[১২]
১৯৯৪ সালে তার দ্বিতীয় ছবি উনিশে এপ্রিল মুক্তি পায়। এই ছবিতে এক মা ও তার মেয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের কাহিনি দেখানো হয়েছে।[১৩] ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়। ১৯৯৫ সালে এই ছবি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পায়।[৪] এরপর দহন মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে। ১৯৯৮ সালে এই ছবি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায় এবং এই ছবির দুই অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও ইন্দ্রাণী হালদার একসঙ্গে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান।[১৪]দহন ছবির বিষয়বস্তু কলকাতার রাস্তায় এক মহিলার ধর্ষিত হওয়ার কাহিনি। অপর একটি মেয়ে সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সে এগিয়ে আসে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু সমাজ ও ধর্ষিতার পরিবার পরিজনের ঔদাসিন্যে সে হতাশ হয়।[১৫]
১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া অসুখ ছবিতে এক অভিনেত্রী ও তার আয়ের উপর অনিচ্ছুকভাবে নির্ভরশীল বাবার সম্পর্ক দেখানো হয়। এটি শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। বাড়িওয়ালি মুক্তি পায় ২০০০ সালে। এই ছবিতে এক নিঃসঙ্গ অবিবাহিত মধ্যবয়সী মহিলা (কিরণ খের) নিজের বাড়িটি এক ফিল্ম প্রোডাকশনকে ভাড়া দেন। তার অবদমিত কামনাবাসনাগুলি ছবির সুদর্শন পরিচালককে নিয়ে কল্পনার ডানা মেলে। এই ছবির জন্য কিরণ খের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান।[১৩]
২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত উৎসব শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। এই ছবির বিষয়বস্তু এক একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন। এই পরিবারের সদস্যরা তাদের পারিবারিক বাড়ি থেকে বেশি দূরে না থাকলেও বছরে শুধু একবার দুর্গাপূজার সময় একত্রিত হয়। ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি তিতলি-র গল্প এক কিশোরীকে কেন্দ্র করে। মেয়েটির প্রিয় ফিল্মস্টারের সঙ্গে এক সময় তার মায়ের প্রণয় সম্পর্ক ছিল।[১২][১৩]
২০০৪ সালে ঋতুপর্ণের প্রথম হিন্দি ছবি রেনকোট মুক্তি পায়। এই ছবিটি ও. হেনরির ছোটোগল্প "দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই" (১৯০৬) অবলম্বনে নির্মিত। এই ছবিতেও ঐশ্বর্যা রাই অভিনয় করেছিলেন; সাথে ছিলেন অজয় দেবগন। এই ছবির শ্যুটিং শেষ হয়েছিল ১৭ দিনে।[১৩] ছবিটি শ্রেষ্ঠ হিন্দি ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।[১৩]
২০০৫ সালে তার বাংলা ছবি অন্তরমহল মুক্তি পায়। এটি ব্রিটিশ আমলের এক জমিদার পরিবারের গল্প। জ্যাকি শ্রফ জমিদার চরিত্রট করেন; আর তার দুই স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন সোহা আলি খান ও রূপা গাঙ্গুলী।[১৩]
২০০৭ সালে দ্য লাস্ট লিয়ার মুক্তি পায়। এটি একটি প্রাক্তন শেক্সপিয়ারিয়ান থিয়েটার অভিনেতার জীবনের গল্প। অমিতাভ বচ্চন কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন।[১৩] এছাড়া প্রীতি জিন্টা ও অর্জুন রামপালও এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।[১৭]
মৃত্যুর আগে তিনি তার পরবর্তী ছবি সত্যান্বেষী-র শ্যুটিং শেষ করেছিলেন। এই ছবিটি গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনি অবলম্বনে তৈরি হচ্ছিল।[৫][১৮]
অভিনয় জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রথম অভিনয় করেন ওড়িয়া ছবি কথা দেইথিল্লি মা কু-তে। হিমাংশু পারিজা পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তি পায় ২০০৩ সালে।[১৯] ২০১১ সালে তিনি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়েরআরেকটি প্রেমের গল্প এবং সঞ্জয় নাগের মেমরিজ ইন মার্চ ছবিতে অভিনয় করেন। আরেকটি প্রেমের গল্প ছবির বিষয় ছিল সমকামিতা।[২০]
ঋতুপর্ণের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি চিত্রাঙ্গদা। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার কাঠামো অবলম্বনে নির্মিত।[১৩] এটি ৬০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিশেষ জুরি পুরস্কার পায়।[১৭]
ঋতুপর্ণ বাংলা ফিল্ম ম্যাগাজিন আনন্দলোক সম্পাদনা করেন ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত।
মৃত্যু
ঋতুপর্ণ ঘোষ দশ বছর ধরে ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিস মেটিলাস টাইপ ২) রোগে এবং পাঁচ বছর ধরে প্যানক্রিটিটিস রোগে ভুগছিলেন।[১১] এছাড়াও তার অনিদ্রা রোগ ছিল এবং সেই জন্য তিনি ঘুমের ওষুধ খেতেন।[২৩] ডাক্তারদের রিপোর্ট অনুযায়ী, অ্যাবডোমিনোপ্ল্যাস্টি ও ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পর প্রয়োজনীয় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করাতে গিয়ে তার শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। আরেকটি প্রেমের গল্প ছবিতে এক সমকামী চিত্রপরিচালকের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য তাকে এগুলি করাতে হয়েছিল।[১১]
২০১৩ সালের ৩০ মে তার কলকাতার বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যু ঘটে। তার দুই পরিচারক দিলীপ ও বিষ্ণু তাকে বিছানায় অচৈতন্য অবস্থায় দেখতে পান। প্রতিবেশী নীলাঞ্জনা সেনগুপ্ত ডাক্তার নিরূপ রায়কে খবর দেন। তিনি এসে ঋতুপর্ণ ঘোষকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।[২৪] মৃত্যুকালে ঋতুপর্ণের বয়স হয়েছিল ৪৯ বছর।[৪]
বাংলা চলচ্চিত্রের অভিনেতা ও পরিচালকেরা ঋতুপর্ণ ঘোষের বাড়িতে এসে তাকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বিকেলে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নন্দনে। সেখানে চত্বরের বাইরে কিছুক্ষণ তার দেহ রাখা হয় সাধারণ মানুষকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। নন্দনে বহু মানুষ এসে তাকে শ্রদ্ধা জানান।[১১] এরপর তার দেহ নিয়ে যাওয়া হয় টালিগঞ্জ টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান।[২৫] তিনি ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিবারবর্গের সঙ্গে ৪৫ মিনিট সময় কাটান। ঋতুপর্ণ ঘোষকে তিনি “বিরল প্রতিভা” হিসেবে উল্লেখ করেন।[১১] টালিগঞ্জ থেকে তার দেহ সিরিটি শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।[২৫] সৎকারের আগে কলকাতা পুলিশের তরফ থেকে তাকে গান স্যালুট দেওয়া হয়।[২৬][২৭]
প্রতিক্রিয়া
বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প
বাঙালি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে ঋতুপর্ণ আর নেই। এই খবরটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন। আমরা একজন অত্যন্ত সম্ভাবনাময় পরিচালককে অকালে হারালাম।”[২৮] ঋতুপর্ণর তিতলি ও দোসর ছবির নায়িকা কঙ্কনা সেনশর্মা বলেন, এটা তার ব্যক্তিগত ক্ষতি।[১৫] অভিনেতা অরিন্দম শীল এই দিনটাকে জাতীয় শোকের দিন হিসেবে পালন করার আর্জি জানান।[২৪]দেব বলেন, এই খবর শুনে তিনি হতবাক।
[২৪]ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বলেন, ঋতুপর্ণ ছিলেন এমন এক মহান শিল্পী যিনি আবেগ ও সাংস্কৃতিক চেতনায় বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন।[২৯]
বলিউড
অমিতাভ বচ্চন তার স্মৃতিচারণায় বলেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ একমাত্র পরিচালক যিনি বচ্চন পরিবারের সকলের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি একটি টুইটে লেখেন, ঋতুপর্ণ ছিলেন এক সংবেদনশীল শিল্পমনস্ক নরম মনের মানুষ।[৩০] অভিনেত্রী বিপাশা বসু বলেন, ঋতুপর্ণের মৃত্যুসংবাদ তার কাছে হৃদয়বিদারক; তিনি এই খবর বিশ্বাসই করতে পারছেন না।[২৪] চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল বলেন, ঋতুপর্ণের মৃত্যু এক “বিরাট ট্রাজেডি”।[৩১]সোহা আলি খান বলেন, ঋতুপর্ণ ছিলেন এক অগ্রণী চিত্র পরিচালক এবং তিনি সত্যজিৎ রায় ও নব্য শৈলীর মধ্যে যোগসূত্রের কাজটি করেছিলেন।[২৯]অর্জুন রামপাল বলেন, ঋতুপর্ণ ছিলেন এক অসামান্য দক্ষ শিল্পী এবং অসাধারণ মানুষ।[২৯] অভিনেত্রী কিরণ খের ঋতুপর্ণের শিশুসুলভ প্রাণোচ্ছ্বলতার কথা স্মরণ করে বলেন, “চলচ্চিত্র জগৎ অশিক্ষিত লোকে ভর্তি। সেখানে ঋতুপর্ণ ছিলেন একজন শিক্ষিত মানুষ। তাঁর নিজস্ব একটা লাইব্রেরি ছিল এবং তিনি ধর্মকর্ম করার মতো করে পড়াশোনা করতেন। তাঁর জ্ঞানের কোনো তুলনা নেই।[২৯]
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ পরিচালনা)- ঋতুপর্ণ ঘোষ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র) জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী) - অনন্যা চট্টোপাধ্যায়