ফেডারেশন, কনফেডারেশন এবং ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের প্রস্তাবিত "ইউরোপীয় যুক্তরাষ্ট্রের" মতো শুল্ক ইউনিয়ন গঠনের মত উদ্দেশ্য ইইউ প্রতিষ্ঠায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র গঠনের আশাবাদই ইইউ বিনির্মাণের পথ সুপ্রশস্ত করে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট শুম্যন প্রদত্ত শুম্যন ঘোষণাপত্র এবং ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ইউরোপীয় ঘোষণাপত্র অনুযায়ী এই বহুজাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যেমন যুদ্ধকে "অসম্ভব" এবং "অভাবিত"করে তুলবে, তেমনি সদস্য দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনেও ভূমিকা রাখে।[১] ইউরোপীয় অঙ্গার (কয়লা) ও ইস্পাত সংগঠন (১৯৫১ ), প্যারিস চুক্তি (১৯৫২ ), ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালনকরা রোম চুক্তি (১৯৫৮),ইউরোপীয় পারমাণবিক শক্তি সংগঠন সহ অনেক উদ্যোগ এই ধারণাকেই বিধৃত করে।
১৯৯২ সালের মাসট্রিক্ট চুক্তির ফলে "পিলারস সিস্টেম " বা স্তম্ভব্যবস্থা সমন্বিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্ম হয়। ইউরোপীয় সংঘের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো এ স্তম্ভব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়। এর হাত ধরে ১৯৯৯ সালে ইউরোপ জুড়ে ইউরো নামে একটি মুদ্রা প্রবর্তিত হয়। মাসট্রিক্ট চুক্তি অ্যামস্টারডাম (১৯৯৭), নিস (২০০১) ও লিসবন (২০০৭) চুক্তির মাধ্যমে এটি সংশোধিত হয়।
১৯৪৫ সালের পূর্বে ইউরোপীয় ঐক্যবিষয়ক মতবাদ
১৮১৮ সালের আই-লা-শাপেল সম্মেলনে জার আলেক্সান্ডার সর্বপ্রথম একটি স্থায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাব দেন। তিনি একটি আন্তর্জাতিক সেনাবাহিনী গঠনের কথা বলেন, যা যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে সহায়তা করবে।[২]
প্যান-ইউরোপা আন্দোলন যুদ্ধকালীন সময়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে ।
১৯৪৫ থেকে ১৯৫৭
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালব্যাপী চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকটে ইউরোপ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হলোকাস্ট, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার মত ঘটনা এর ভয়াবহতাকে প্রতিমূর্ত করে তুলে। তাই এরকম ঘটনার যাতে আর পুনরাবৃত্তি না হয়, সেটাই ছিল সবার আকাঙ্ক্ষা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপের দেশগুলো পরাশক্তির মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। শুধু দুটি পরাশক্তিই অবশিষ্ট থাকে : সাম্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্র।
জার্মানি যাতে বিশ্বশান্তির পথে আর বাধা হিসেবে না দাঁড়াতে পারে, সেজন্য এর ভারী শিল্পকে ধ্বংস করে দেওয়া হয় এবং এর কয়লা উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।[৩]
১৯৪৬ সালে চার্চিল ইউরোপীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের আহবান জানালে ইউরোপীয় ঐক্যের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ সালে কাউন্সিল অব ইউরোপ নামে একটি আন্তঃইউরোপীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ সালে ফ্রেঞ্চ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট শুম্যান ইউরোপের কয়লা এবং ইস্পাত শিল্পগুলোকে একীভূত করে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। [৪]
শুম্যানের ঘোষণার ভিত্তিতে ফ্রান্স, ইতালি ও বেনেলুক্স (বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড এবং লুক্সেমবার্গ) দেশগুলো ১৯৫১ সালে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষর করে। প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে গঠিত হয় "ইউরোপীয় কয়লা ও ইস্পাত সংগঠন"। এই সংগঠনের উচ্চ পরিষদ পরবর্তীতে ইউরোপীয় কমিশন এবং সাধারণ পরিষদ ইউরোপীয় সংসদে রূপ নেয়।[৫]
মার্শাল পরিকল্পনা-ও এই সংগঠন প্রতিষ্ঠায় তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। আমেরিকান পররাষ্ট্রসচিব জর্জ সি মার্শালের এ পরিকল্পনা বর্তমানের বাজারমূল্যে ইউরোপ পুনর্গঠনে ১০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য করে, যা ইস্পাত এবং কয়লা সংগঠন প্রতিষ্ঠাকে ত্বরান্বিত করে।[৬]
ইউরোপব্যাপী একটি রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংগঠনের প্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থ হলে ইউরোপের নেতৃবৃন্দ মেসিনা সম্মেলনে মিলিত হন এবং স্পার্ক কমিশন গঠন করেন। স্পার্ক কমিশনের প্রতিবেদন ১৯৫৬ সালের ভেনিস সম্মেলনে গৃহীত হয়। ভেনিস সম্মেলনে একটি আন্তঃসরকার সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাবে সবাই ঐকমত্য প্রকাশ করেন। এই সম্মেলনটি অর্থনৈতিক ঐক্য গড়ার উপর জোর দেয়, যার ফলে ১৯৫৭ সালে রোম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। রোম চুক্তি মোতাবেক ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সংগঠন (ইইসি) এবং ইউরোপীয় পারমাণবিক সংগঠনের(ইউরাটম) সৃষ্টি হয়।[৭]
১৯৫৮-১৯৭২
ইইসি এবং ইউরাটম আলাদা সংগঠন হলেও তারা একই বিচারিক আদালত এবং সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে কার্য পরিচালনা করত। এদের নির্বাহী শাখাকে উচ্চ পরিষদের পরিবর্তে কমিশন নাম দেওয়া হয়। এই কমিশনগুলোকে যথাক্রমে নেতৃত্ব দেন ওয়াল্টার হলস্টাইন, লুই আরমাদ এবং এতিয়েন হার্শ।
১৯৬০ এর দশক ফ্রান্স বহুজাতিক শক্তির ক্ষমতা সীমিত করার ইচ্ছা পোষণ এবং যুক্তরাজ্যের সদস্যপদের বিরোধিতা করলে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তে থাকে। যাহোক, ১৯৬৫ সালে একীভূতকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত করে ঐক্যবদ্ধ ইউরোপীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হলে উত্তেজনা অনেকটাই প্রশমিত হয়।[৮]
যদিও এসময় ইউরোপীয় ঐক্যের রাজনৈতিক প্রগতি মন্থর হয়ে পড়ে, এর বিচারিক প্রগতি ত্বরান্বিত হতে থাকে। ইউরোপীয় আদালত অনেক মাইলফলক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা ও এখতিয়ার সুসংহত করেন। এক্ষেত্রে ১৯৬২ সালে নিযুক্ত বিচারপতি রবার্ট লেকোয়া অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭৩-১৯৯৩
১৯৭৩ সালে নতুন ফ্রেঞ্চ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় সংঘে যোগ দেয়।[৯]
১৯৭৯ সালে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ইউরোপীয় সংসদের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইউরোপীয় সংসদের প্রথম মহিলা সভাপতি সিমোন ভ্যালিসহ ৪১০ জন সাংসদ নির্বাচিত হন।[১০]
সংগঠনে গ্রিস ১৯৮১ সালে এবং স্পেন ও পর্তুগাল ১৯৮৬ সালে যোগদান করে। তবে ডেনমার্কের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসন লাভের পর ১৯৮২ সালে গ্রিনল্যান্ড সংগঠন ছেড়ে চলে যায়। [১১]
১৯৮৬ সালে জ্যাক ডেলোর কমিশনের সভাপতি নির্বাচিত হলে ইউরোপীয় পতাকা গৃহীত হয়। এছাড়াও "একীভূত ইউরোপ আইন" ইউরোপীয় সংসদে পাস হয়, যা ১৯৮৭ সালে কার্যকর হয়। এই আইনের ফলে একীভূত ইউরোপ বাজারের সূচনা হয়।[১২]
১৯৮৭ সালে তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্যপদ লাভের জন্য আবেদন করে। ১৯৮৮ সালে পোল্যান্ডে সলিডারিটি আন্দোলন মধ্য ইউরোপে নতুন দিগন্ত সূচিত করে। ১৯৮৯ সালের ১৯ আগস্ট অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির সীমান্ত খুলে দিয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রীতি বনভোজনের আয়োজন করা হয়। এ সকল ঘটনাপ্রবাহে সোভিয়েত ইউনিয়ন নীরব ভূমিকা পালন করে। একসময় সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং জার্মানি পুনঃএকত্রিত হয়।[১৩]
এ সকল প্রেক্ষাপট সামনে রেখে ৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে মাসট্রিক্ট চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯৩-২০০৪
১৯৯৩ সালের ১লা নভেম্বর মাসট্রিক্ট চুক্তি কার্যকর হয়।[১৪] ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে বামপন্থীরা সংসদে সর্ববৃহৎ দল হিসেবে অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়। নির্বাচনের পরে ইউরোপীয় কাউন্সিল জ্যাক সাঁতেরকে কমিশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করেন । সামান্য ভোটের ব্যবধানে তিনি ইউরোপীয় সংসদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনুমোদন পান।[১৫]
১৯৯৪ সালে অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সাথে সদস্যপদ-লাভ সম্পর্কিত আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটে। ইতোমধ্যে নরওয়ে,আইসল্যান্ড এবং লিখচেনস্টাইন ইউরোপীয় অর্থনৈতিক এলাকায় যোগদান করে। ১৯৯৬ সালের ভেতরে সকল সদস্যদেশে শেনজেন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং ১৯৯৯ সালে ইউরোপীয় মুদ্রার প্রবর্তন ইউরোপে আর্থিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করে।
১৯৯০ সালে বলকান অঞ্চলে সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব হলে ইইউ "সাধারণ পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তানীতি" প্রণয়ন করে। কিন্তু বলকান অঞ্চলে সহিংসতা প্রতিরোধে এটি ব্যর্থ হয়। আমস্টারডাম চুক্তিতে এ বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। [১৬]
১৯৯৬ সালে ইউরোপীয় সংসদ অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও প্রতারণার অভিযোগ তুলে বাজেট পাস করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরিণামে সম্পূর্ণ সাঁতের কমিশন পদত্যাগ করে।[১৭]
পরবর্তী নির্বাচনে বামপন্থী দল পিপলস পার্টির কাছে তাদের বহু বছরের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। নবনির্বাচিত প্রডি কমিশন প্রতারণা দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা করে দুর্নীতি হ্রাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।[১৮] ২০০৪ সালে আরো দশটি রাষ্ট্রকে সদস্য হিসেবে কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করার অংশ হিসেবে নিস চুক্তি ২০০১ সালে স্বাক্ষরিত এবং ২০০৩ সালে কার্যকর হয়।
২০০৪-বর্তমান
২০০৪ সালে ইইউ প্রতিনিধিরা একটি সাংবিধানিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তবে এই চুক্তির বিপক্ষে ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডের ভোটাররা রায় দিলে এটি বাতিল হয়ে যায়।
প্রস্তাবিত সংবিধানটির অধিকাংশ ধারা কার্যকর করতে ২০০৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর লিসবন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ২০০৯ সালে কার্যকর হয়।
↑"EU Budget Fraud"। web.archive.org। ১৯ জুন ২০০৬। Archived from the original on ১৯ জুন ২০০৬। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০।উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: বট: আসল-ইউআরএলের অবস্থা অজানা (link)