আম্মেম্বল সুব্বা রাও পাই (১৯ নভেম্বর, ১৮৫২ – ২৫ জুলাই, ১৯০৯) ছিলেন ভারতের ম্যাঙ্গালোর শহরের এক শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী, ভারতের অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক - কানাড়া ব্যাঙ্কের এবং ম্যাঙ্গালোরে কানাড়া হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পেশায় আইনজীবী ও ব্যাঙ্ক ব্যবসায়ী হয়েও, মননে ও ভাবনায় ছিলেন একজন প্রকৃত শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী ও দূরদর্শী। দক্ষিণ কন্নড় জেলার ভবিষ্যত গড়তে এবং গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
আম্মেম্বল সুব্বা রাও পাই ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীর অন্তর্গত বর্তমানে কর্নাটক রাজ্যের দক্ষিণ কন্নড় জেলার মুল্কিতে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা উপেন্দ্র পাই মুল্কির মুন্সেফ কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। সুব্বা রাও তার সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ ছিলেন। তার পড়াশোনা স্থানীয় সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শুরু হয়। কিন্তু অল্প বয়সেই মাতৃহারা হন এবং সম্ভবত সেকারণেই যেন তিনি তার পাঠ্যাভ্যাসে অতি মনোযোগী হন। এফ.এ পাশের পর তার পিতা তাঁকে উচ্চ শিক্ষার জন্য মাদ্রাজে (বর্তমানে চেন্নাই) পাঠান। সেখানকার প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে স্নাতক হওয়ার পর ভর্তি হন মাদ্রাজ ল'কলেজে। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে বি.এল পাশ করেন। এই সময়ে তিনি প্রখ্যাত বিচারপতি হলোওয়ের সংস্পর্শে আসেন এবং সেটি ছিল তার জীবনের সবচাইতে বড় অভিজ্ঞতা।
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে পিতার জীবনাবসানের পর সুব্বা রাও ম্যাঙ্গালোরে ফিরে আসেন এবং আইন ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু প্রায়শই তিনি নিজের ক্ষতি সাধন করে বাদী-বিবাদীর মাঝে মিত্রতার মাধ্যমে বিচারশালার বাইরে মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টাই করতেন। নিঃসন্দেহে এটি এক আইনজীবীর কাছে ছিল তার এক দৃষ্টান্তমূলক মানবিক পরিচিতি। অন্যদিকে জনকল্যাণ ও সমাজসেবামূলক কাজকর্মে তার প্রবল আগ্রহ ছিল। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ সহ জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের গুণগ্রাহী ও প্রসংশক ছিলেন তিনি। অরবিন্দের "যুগান্তর" পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন। সমাজসেবায় ও জনকল্যাণে বাংলার অন্যতম সমাজসেবী শিক্ষাবিদ অশ্বিনীকুমার দত্তের অবদানের সাথে সুব্বা রাও পাই-এরও অবদান তুলনীয়। তার অফিসে অশ্বিনীকুমার দত্তের প্রতিকৃতি প্রদর্শিত হত। কেননা,তার একটি নির্দেশেই তার গ্রামের ব্যবসায়ীরা জেলা সমাহর্তাসহ ইউরোপিয়ানদের কাপড় বিক্রি করতে অস্বীকার করত। সুব্বা রাও অন্তরে ছিলেন এক মহান দেশপ্রেমিক এবং কাজে ছিলেন এক মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। সে সময়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন,একমাত্র সমাজ হতে কুসংস্কার, অজ্ঞানতা ও নিরক্ষরতা দূর করে প্রকৃত শিক্ষাদানের মাধ্যমে মানুষের সামাজিক ও আর্থিক উন্নতি সম্ভব। সেই উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে,১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজের চারজন শিক্ষকের সহায়তায় তিনি ম্যাঙ্গালোরে তার পিতার দেওয়া বাইশ একর জমিতে কানাড়া হাই স্কুল স্থাপন করেন। পুরুষদের সাথে সমানভাবে মহিলাদের মাঝেও শিক্ষার বিস্তার অত্যন্ত জরুরী। তাই প্রায় একই সময়ে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে স্থাপন করলেন কানাড়া গার্লস হাই স্কুল। প্রকৃতপক্ষে সেই সময় মহিলাদের শিক্ষার প্রতি মানুষের প্রচলিত মূল্যবোধ ও মনোভাব অনুকূল ছিল না। সুতরাং এই বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ছিল তার এক দৃষ্টান্তমূলক বিপ্লবী পদক্ষেপ। বর্তমানে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানদুটিই গুণমানে কর্নাটক রাজ্যের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ হিসাবে প্রকৃতপক্ষে, তিনি তার সময়কালের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এক 'আরবাথনট আর্থিক সংস্থার বিপর্যয়কর পতনের পর মানুষকে স্বল্প সঞ্চয়ে উৎসাহ দিতে ও আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন 'কানাড়া হিন্দু পার্মানেন্ট ফান্ড লিমিটেড' (বর্তমানে কানাড়া ব্যাঙ্ক) নামের এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। এটি বর্তমানে ভারতের বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এ ছাড়াও তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতার উপর দৃষ্টি দিয়ে জিএসবি তথা গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের দরিদ্র বালকগণের শিক্ষার জন্য 'দরিদ্র বালক শিক্ষা তহবিল' গঠনেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি কোন কল্যাণমূলক কাজে লাভক্ষতির অঙ্ক মাথায় রেখে অগ্রসর হতেন না। কেননা তার প্রজ্ঞা ও বিশ্বাস ছিল, সৎপথে যে কোন মহৎ উদ্দেশ্য নিষ্পাদিত হলে, সফলতা অবশ্যম্ভাবী। [১]
প্রকৃত দূরদর্শী ও সমাজসেবী আম্মেম্বল সুব্বা রাও পাই ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে জুলাই প্রয়াত হন।