এই নিবন্ধে আফ্রিকার ভাষা নিয়ে আলোচনা করে হয়েছে। বিশ্বের সব মহাদেশের মধ্যে আফ্রিকাতেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভাষা প্রচলিত। ভাষাবিজ্ঞানীরা ধারণা করেন আফ্রিকাতে কমপক্ষে ২১৪০টি স্বতন্ত্র ও জীবন্ত ভাষা আছে।[১] কেউ কেউ মনে করেন আফ্রিকান ভাষার সংখ্যা এর চেয়েও বেশি। এই ভাষাগুলির মধ্যে প্রায় ৫০টি ভাষাতে বক্তাসংখ্যা ৫ লাখ বা তার ঊর্ধ্বে। বেশির ভাগ আফ্রিকান ভাষাতেই বক্তাসংখ্যা খুবই কম। উদাহরণস্বরূপ, তানজানিয়ারহাদজা ভাষাটিতে মাত্র প্রায় ২০০ লোক কথা বলেন।
মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী জোসেফ এইচ গ্রিনবার্গ সর্বপ্রথম আফ্রিকান ভাষাগুলির অণুপুঙ্খ শ্রেণীকরণ করেন। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত The Languages of Africa নামের গ্রন্থে তিনি আফ্রিকান ভাষাগুলির উৎস ও ইতিহাস অণুসন্ধান করেন এবং এগুলিকে চারটি প্রধান দলে ভাগ করেন: নাইজার-কঙ্গো, আফ্রো-এশীয়, নাইলো-সাহারান এবং খোইসান। বর্তমানে নাইজার-কঙ্গো পরিবারটি ভাষাভাষীয় সংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম। এই পরিবারের অন্তর্গত ভাষাগুলিতে ৩০ থেকে ৪০ কোটি লোক কথা বলেন। আফ্রো-এশীয় পরিবারটি ২য় বৃহত্তম; এর ভাষাগুলিতে ২০ থেকে ৩০ কোটি লোক কথা বলেন। নাইলো-সাহারান ভাষাগুলিতে প্রায় ৩ কোটি এবং খোইসান ভাষাগুলিতে প্রায় ২ থেকে ৩ লাখ লোক কথা বলেন। বহু আফ্রিকান একাধিক ভাষাতে কথা বলতে পারেন।
উপরের শ্রেণীকরণ করতে গিয়ে গ্রিনবার্গ অনেকগুলি আফ্রিকান ভাষা থেকে কতগুলি প্রাথমিক শব্দের তালিকা নিয়ে সেগুলির তুলনা করেন। তিনি শব্দের রূপ এবং ব্যাকরণিক সংগঠনগুলির কাজেরও তুলনা করেন। যেসব ভাষা একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, সেগুলির শব্দভাণ্ডারে একই ধরনের শব্দ দেখতে পাওয়া যায়। এগুলির ব্যাকরণিক বৈশিষ্ট্যগুলিও একটি অভিন্ন উৎস অর্থাৎ বর্তমানে বিলুপ্ত কোন আদি প্রত্ন-ভাষা থেকে উৎসারিত। উদাহরণস্বরূপ, সোয়াহিলি ভাষাটি বান্টু ভাষা পরিবারের একটি ভাষা। সমস্ত বান্টু ভাষাই ক্যামেরুন ও পশ্চিম নাইজেরিয়াতে প্রচলিত একটি আদিভাষা থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়।
ভাষাবিজ্ঞানীরা বেশির ভাগ আফ্রিকান ভাষাকে সুরপ্রধান ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর অর্থ হল কোন সিলেবল বা একাধিক সিলেবলের কোনো দল কী সুরে উচ্চারিত হচ্ছে, তার উপর ভিত্তি করে একই শব্দের একাধিক অর্থ হতে পারে।
নাইজার-কঙ্গো ভাষাপরিবার
নাইজার-কঙ্গো পরিবারের ভাষাগুলিতে ৩০ থেকে ৪০ কোটি লোক কথা বলেন। এই ভাষা পরিবারটি সাতটি প্রধান উপপরিবারে বিভক্ত। এদের মধ্যে ছয়টি উপপরিবারের ভাষাগুলিতে পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের মানুষেরা কথা বলেন। সপ্তম উপপরিবারের একটি শাখা বান্টু পরিবারের ভাষাগুলি আফ্রিকার দক্ষিণ অঞ্চলে প্রচলিত। নাইজার-কঙ্গো পরিবারের উপপরিবারগুলি হল বেনুয়ে-কঙ্গো (এর মধ্যে আছে বান্টু শাখা), পশ্চিম আটলান্টিক, মান্দে, ভোল্টীয়, কোয়া, আদামাওয়া পূর্ব এবং কর্দোফানীয় ভাষাসমূহ। প্রায় ৫ হাজার বছর আগে প্রচলিত একটি প্রত্ন-ভাষা থেকে নাইজার-কঙ্গো পরিবারের ভাষাগুলির উদ্ভব হয়েছে।
নাইজার-কঙ্গো পরিবারের সবচেয়ে বড় শাখাটি হল বেনুয়ে-কঙ্গো উপপরিবার। বান্টু ভাষাগুলি এর একটি শাখা, এবং এই ভাষাগুলিতে প্রায় ১০ কোটি লোক কথা বলেন। প্রত্ন-বান্টু ভাষাটি পূর্ব নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুনে প্রচলিত ছিল। নৃবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে আজ থেকে ৩ থেকে ৪ হাজার বছর আগে এই আদিভূমি থেকে অভিবাসীদের তিনটি বড় বড় তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মতে প্রথম তরঙ্গটি উত্তর বান্টু ভাষা তৈরি করেছিল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তরঙ্গগুলি থেকে জন্ম নেয় পশ্চিম বান্টু ভাষাসমূহ ও পূর্ব বান্টু ভাষাগুলি। আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ভাষা সোয়াহিলি ভাষাটি একটি পূর্ব বান্টু ভাষা। অন্যান্য বান্টু ভাষার মধ্যে আছে দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকার শোনা ভাষা, ত্সোয়ানা ভাষা, জুলু ভাষা ও ক্হোসা ভাষা; পূর্বাঞ্চলীয় আফ্রিকার কিকুয়ু ভাষা, কিসুকুমা ভাষা ও লুও ভাষা; এবং মধ্য আফ্রিকাতে প্রচলিত কিকোঙ্গো ভাষা, কিনিয়ারওয়ান্দা ভাষা ও কিরুন্দি ভাষা।
পশ্চিম আটলান্টিক উপপরিবারের ভাষাগুলি আফ্রিকার আটলান্টিক মহাসাগরীয় উপকূলে, সেনেগাল থেকে চাদ পর্যন্ত, প্রচলিত। এগুলির মধ্যে ফুলফুলদে ভাষাটি প্রধান; এই ভাষায় সেনেগাল, ক্যামেরুন ও চাদের প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ লোক কথা বলেন। এই উপপরিবারের অন্যান্য ভাষার মধ্যে আছে সেনেগালের ওলোফ ভাষা ও গিনিরতেমনে ভাষা।
কোয়া উপপরিবারের ভাষাগুলির মধ্যে ঘানাতে প্রচলিত তুই ভাষা এবং নাইজেরিয়াতে প্রচলিত ইয়োরুবা ভাষা প্রধান। এর মধ্যে ইয়োরুবা ভাষার বক্তাসংখ্যা সবচেয়ে বেশি; প্রায় ২ কোটি ২০ লক্ষ লোক ইয়োরুবা ভাষায় কথা বলেন। অন্যান্য কোয়া ভাষা লাইবেরিয়া, কোত দিভোয়ার, টোগো, এবং বেনিনে প্রচলিত।
আদামাওয়া পূর্ব উপপরিবারের ভাষাগুলি ক্যামেরুন, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো (প্রাক্তন জায়ার) এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে প্রচলিত।
কর্দোফানীয় উপপরিবারের ভাষাগুলিতে ৫ লাখের বেশি লোক কথা বলেন না। এগুলি মূলত সুদানেরনুবা পর্বত অঞ্চলে প্রচলিত। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাষাটি হল মোরো ভাষা; এতে প্রায় ৩০ হাজার লোক কথা বলেন।
সোয়াহিলি ও ফুলফুলদে বাদে নাইজার-কঙ্গো পরিবারের অধিকাংশ ভাষাই সুরপ্রধান। সুরপ্রধান ভাষাতে একই বর্ণ নিয়ে গঠিত শব্দ ভিন্ন সুরে উচ্চারিত করলে এর অর্থ পালটে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ইয়োরুবা ভাষায় মধ্য সুরে bi শব্দটি উচ্চারণ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় "বাচ্চা প্রসব করা"। কিন্তু এটি নিম্ন সুরে উচ্চারণ করলে অর্থ দাঁড়ায় "বমি করা", উচ্চ সুরে উচ্চারণ করলে অর্থ হয় "প্রশ্ন করা"। বাম্বারা ভাষাতে ba শব্দটি উচ্চ সুরে বললে এর অর্থ হয় "নদী", কিন্তু নিম্ন সুরে বললে এর অর্থ হয় "ছাগল"।
বেনুয়ে-কঙ্গো উপদলের বান্টু ও অন্যান্য ভাষাগুলি ক্রিয়ামূলের সাথে আদিপ্রত্যয় বা অন্ত্যপ্রত্যয় যোগ করে ক্রিয়াপদ গঠন করে। আদিপ্রত্যয়গুলি ক্রিয়ার কর্তা, কাল, কর্ম ইত্যাদি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। অন্ত্যপ্রত্যয়গুলি পূর্বসর্গমূলক পদগুচ্ছ, কার্যকারণ সম্বন্ধ, এবং কর্মবাচ্য বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, "সে আমার জন্য রান্না করছে।"—এই বাক্যটি সোয়াহিলি ভাষায় একটি মাত্র শব্দ ananipikia দিয়ে বলা সম্ভব। শোনা নামের আরেকটি বান্টু ভাষাতে এই বাক্যটি হবে এরকম - ari kundibikira। এখানে সোয়াহিলি ভাষার pik এবং শোনা ভাষার bik ক্রিয়ামূল দুইটি একই উৎস থেকে এসেছে। "গতকাল" শব্দটি সোয়াহিলি ভাষাতে jana এবং ইয়োরুবা ভাষাতে ana দিয়ে নির্দেশ করা হয়। সোয়াহিলিতে tatu, ইয়োরুবাতে eeta, এবং ফুলফুলদে ভাষায় ati --- সবগুলি শব্দই "তিন" নির্দেশ করে। এ থেকে বোঝা যায়, এই সবগুলি ভাষাই একটি আদি প্রত্ন ভাষা থেকে উৎপন্ন হয়েছে।
বেনুয়ে-কঙ্গো উপদলের ভাষাগুলির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এগুলির বিশেষ্য পদের ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় বিশেষ্যমূলের আগে ও পরে আদিবিভক্তি ও অন্ত্যবিভক্তি বসতে পারে। বান্টু ভাষাগুলিতে সাধারণত আদিবিভক্তি ও তার পরে একটি বিশেষ্যমূল নিয়ে বিশেষ্য পদ গঠিত হয়। এই আদিবিভক্তিটি বচন নির্দেশ করতে পারে। সোয়াহিলি ভাষাতে বিশেষ্যের আগে m থাকলে একবচন বোঝায়, আর wa থাকলে বহুবচন বোঝায়। সুতরাং mtu বলতে বোঝায় "একজন ব্যক্তি" আর watu দিয়ে বোঝায় "অনেক লোক"। জুলু ভাষাতে umu/aba আদিবভক্তি দিয়ে যথাক্রমে একবচন/বহুবচন বোঝায়। সুতরাং umuntu এবং abantu দিয়ে যথাক্রমে একজন লোক ও বহু লোক বোঝায়। শোনা ভাষাতে একইভাবে বচনের জন্য mu/va আদিবিভক্তি জোড়াটি ব্যবহার করা হয়; তাই munhu/vanhu দিয়ে এক লোক, বহু লোক বোঝায়। সোয়াহিলি ভাষার বিশেষ্যমূল tu, জুলু ভাষার ntu, এবং শোনা ভাষার hu --- এই তিনটিই একই প্রত্ন-বান্টু উৎস থেকে এসেছে।
বান্টু ভাষাতে বিশেষ্য এবং অন্যান্য পদ যেমন নির্দেশক স্থানীয় পদ (এই, ওই, ইত্যাদি), ক্রিয়া এবং বিশেষণ সাযুজ্য রক্ষার্থে রূপ পরিবর্তন করে। "এই ভাল চেয়ারটি ভাঙা" --- এই বাক্যটি সোয়াহিলি ভাষাতে লেখা হয় kiti hiki kizuri kimevunijka। আর "এই ভাল চেয়ারগুলি ভাঙা" বাক্যটি সোয়াহিলিতে লেখা হয় এভাবে: viti hivi vizuri vimevunjika। অর্থাৎ বিভক্তি ki- ও vi- ক্রিয়া , নির্দেশক এবং বিশেষ্য সবগুলির সাথে বচনের সাযুজ্য রক্ষার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই ধরনের সাযুজ্য সব বান্টু ভাষাতে বিদ্যমান।
আফ্রো-এশীয় ভাষাপরিবার
আফ্রো-এশীয় ভাষাগুলিতে উত্তর আফ্রিকা, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া এবং মধ্য আফ্রিকারচাদ হ্রদের আশেপাশের এলাকার প্রায় ২০ থেকে ৩০ কোটি লোক কথা বলেন। আফ্রো-এশীয় ভাষাগুলির মৌলিক শব্দভাণ্ডার পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এগুলি মূলত পশুচারণ ও কৃষিকাজের সাথে সম্পর্কিত। আফ্রো-এশীয় ভাষাপরিবারটি পাঁচটি উপপরিবারে বিভক্ত। সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫০টির মত আফ্রো-এশীয় ভাষা আছে। উপপরিবারগুলি হল চাদীয়, বার্বার, সেমীয়, কুশীয় এবং মিশরীয়। এই ভাষাগুলির প্রত্নভাষাটি প্রাচীন সেমীয় ভাষা নামে পরিচিত; এটি প্রায় ৬০০০ বছর আগে বিভিন্ন শাখায় ভাগ হতে শুরু করে।
চাদীয় উপপরিবারের প্রায় ১০০টি ভাষাতে ৩ কোটিরও বেশি লোক কথা বলেন। এটি আফ্রো-এশীয় ভাষার বৃহত্তম উপপরিবার। হাউসা ভাষা প্রধানতম চাদীয় ভাষা এবং আফ্রো-এশীয় পরিবারেরও সবচেয়ে প্রধান ভাষাগুলির একটি। প্রায় ২ কোটি ২০ লক্ষ লোক মাতৃভাষা বা ২য় ভাষা হিসেবে স্বচ্ছন্দে হাউসা ভাষায় কথা বলতে পারেন। এদের অধিকাংশই উত্তর নাইজেরিয়া এবং দক্ষিণ নাইজারে বাস করেন। হাউসা পশ্চিমাঞ্চলীয় আফ্রিকার বাণিজ্যে, বিশেষ করে সেনেগাল ও কোত দিভোয়ারে এবং লিবিয়ার অংশবিশেষে, আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হাউসা পার্শ্ববর্তী ভাষা যেমন ইয়োরুবা ও তুয়ারেগ ভাষা থেকে বহু শব্দ ঋণ নিয়েছে। এছাড়াও এটি আরবি ভাষা থেকেও প্রচুর শব্দ ঋণ নিয়েছে।
বার্বার ভাষাগুলিতে উত্তর আফ্রিকার প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ লোক কথা বলেন। তামারশাক ভাষা প্রধানতম বার্বার ভাষা; তুয়ারেগ জাতির লোকেরা এই ভাষাতে কথা বলে।
সেমীয় ভাষাগুলির মধ্যে আছে আমহারীয় ভাষা এবং তিগ্রিনিয়া ভাষা। এই দুইটি ভাষা গেএজ নামের একটি আদি ভাষা থেকে উৎপন্ন হয়েছে; গেএজ ভাষাটি উত্তর ইথিওপিয়াতে ১০০০ থেকে ২০০০ বছর আগে প্রচলিত ছিল।
কুশীয় উপপরিবারের প্রধান ভাষার মধ্যে আছে বেজা ভাষা ও ওরোমো ভাষা। বেজা ভাষা সুদান ও ইরিত্রিয়াতে এবং ওরোমো ভাষা ইথিওপিয়াতে প্রচলিত।
মিশরীয় উপপরিবারটি কমপক্ষে ৫০০০ বছর আগ থেকে প্রচলিত। কিন্তু মিশরীয় ভাষাগুলি প্রায় ৬০০ বছর হল বিলুপ্ত হয়েছে। কপ্টীয় ভাষা নামের একটি মিশরীয় ভাষা এখনও কপ্টীয় গির্জার স্ত্রোত্রের ভাষা হিসেবে টিকে আছে।
আফ্রো-এশীয় ভাষাগুলির অনেকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। এদের মধ্যে অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল শ্বাসাঘাত বা ঝোঁকযুক্ত ব্যঞ্জন। ব্যঞ্জনে ঝোঁক দিয়ে শব্দের অর্থ পরিবর্তন করে ফেলা যায়। যেমন হাউসা ভাষাতে mana শব্দটির অর্থ "আমাদের জন্য"। কিন্তু দ্বিতীয় n ব্যঞ্জনটি জোর দিয়ে উচ্চারণ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় "চাপ দেওয়া"। তেমনি hama শব্দের অর্থ হাতুড়ি কিন্তু m-এ জোর দিলে এর অর্থ হয়ে যায় "হাই তোলা"। আফ্রো-এশীয় ভাষাগুলিতে পুং ও স্ত্রীবাচক শব্দগুলিতে রূপে পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। যেমন আমহারিক ভাষাতে পুরুষ হল sew এবং মহিলা হল setu; আবার ligu মানে ছেলে আর ligitu মানে মেয়ে।
নাইলো-সাহারান ভাষাপরিবার
নাইলো-সাহারান ভাষাগুলি পূর্ব সাহারা, নীল নদের উত্তর উপত্যকা, মধ্য-পূর্ব আফ্রিকার ভিক্টোরিয়া হ্রদের আশেপাশের এলাকা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে প্রচলিত। এই ভাষাগুলিতে ২ থেকে ৩ কোটি লোক কথা বলেন। নাইলো-সাহারান ভাষাগুলিকে আবার ছয়টি উপদলে ভাগ করা হয়: নাইলোটীয়, সংঘাই, সাহারান, মাবান, কোমান এবং ফুর। চাদ ও নীল নদের মধ্যবর্তী এলাকায় হাজার হাজার বছর আগে এখানে প্রচলিত প্রাচীন একটি ভাষা থেকে এই ভাষাগুলির উৎপত্তি হয়েছে।
নাইলোটীয় উপদলটি সবচেয়ে বড়। এই ভাষাগুলি নীল নদ ও চারি নদীর তীর ধরে প্রচলিত। এদের মধ্যে আছে কেনিয়াতে প্রচলিত লুও ভাষা, কেনিয়া ও তানজানিয়াতে প্রচলিত মাসাই ভাষা এবং সুদান ও মিশরে নীল নদের উপত্যকায় প্রচলিত নুবিয়ান ভাষা। এই দলের অন্যান্য ভাষাগুলি চাদ, ইথিওপিয়া, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে প্রচলিত।
নাইলো-সাহারান ভাষাগুলি সুরপ্রধান। কিছু কিছু নাইলো-সাহারান ভাষা ক্রিয়ার সাথে আদি- ও অন্ত্য- উভয় ধরনের বিভক্তি যোগ করে। তবে বান্টু ভাষাগুলির মত নাইলো-সাহারান ভাষাগুলিতে বিশেষ্যের সাথে বাক্যের অন্যান্য উপাদানের সাযুজ্য রক্ষিত হয় না।
খোইসান ভাষাপরিবার
খোইসান পরিবারে দুইটি উপদলে প্রায় ১২টি ভাষা আছে। উপদল দুইটি হল দক্ষিণ আফ্রিকান খোইসান এবং পূর্ব আফ্রিকান খোইসান। প্রায় ২ থেকে ৩ লক্ষ লোক এগুলিতে কথা বলেন। দক্ষিণ আফ্রিকান খোইসান ভাষার মধ্যে আছে নামা এবং নারোন ভাষা; এগুলি দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তরাংশ, বতসোয়ানার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে এবং নামিবিয়াতে প্রচলিত। পূর্ব আফ্রিকান খোইসান ভাষাগুলির মধ্যে আছে সান্দাওয়ে ও হাদজা ভাষা; দুইটি ভাষাই তানজানিয়াতে প্রচলিত।
খোইসান ভাষাগুলিতে শীৎকার ধ্বনির আধিক্য দেখা যায়। বক্তার মুখে বায়ু চুষে এই শব্দগুলি তৈরি করেন। এক ধরনের শীৎকার ধ্বনি দুই ঠোঁট বন্ধ অবস্থা থেকে শুরু করে বায়ু চুষে ঠোঁট আলাদা করে উচ্চারণ করা হয়; চুমুর শব্দের সাথে এর মিল আছে।
আফ্রিকান লিখন পদ্ধতিসমূহ
আফ্রিকার স্থানীয় লিখন পদ্ধতি তিনটি। প্রাচীন মিশরের কপ্টীয় লিপি, ইথিওপিয়ার গেএজ লিপি এবং পশ্চিম আফ্রিকার ভাই লিপি। কপ্টীয় লিপিটি গ্রিক বর্ণমালার উপর ভিত্তি করে নির্মিত। এটি খ্রিস্টীয় ৩য় শতকে প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ পদ্ধতির পরিবর্তে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়। গেএজ লিপিটিও ৩য় শতক থেকে প্রচলিত। এটি ইথিওপিয়ার সরকারি ভাষা আমহারীয় ভাষার লিখন পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি একটি সিলেবলভিত্তিক পদ্ধতি, যাতে প্রতিটি চিহ্ন একটি ধ্বনি নয়, বরং একটি সিলেবল নির্দেশ করে। ভাই লিপিটিও একটি সিলেবলভিত্তিক লিপি; এটি লাইবেরিয়া এবং সিয়েরা লিওনে প্রচলিত।
বহু আফ্রিকান ভাষা যেমন হাউসা, সোয়াহিলি, বাম্বারা, ইত্যাদি লেখার জন্য আরবি লিপি ব্যবহার করা হত। কিন্তু আরবি লিপি আফ্রিকান ভাষাগুলি লেখায় প্রকাশের জন্য তেমন উপযোগী নয়। আরবি ভাষাতে মাত্র তিনটি স্বরধ্বনি আছে, যথা আ, ই এবং উ। কিন্তু সোয়াহিলি ভাষাতে আ, এ, ই, ও, উ---এই পাঁচটি স্বরধ্বনি আছে। এছাড়াও সোয়াহিলি ব্যঞ্জন প, গ, চ, এবং ভ-এর কোন অস্তিত্ব আরবি ভাষাতে নেই। খ্রিস্টান মিশনারি এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের আগমনের পর আরবি লিপির পরিবর্তে রোমান লিপিতে ভাষাগুলি লেখার চল হয়।
তথ্যসূত্র
↑Africa, Ethnologue, সংগ্রহের তারিখ 30 July, 2019এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)