হামফ্রি ডিফরেস্ট বোগার্ট (২৫ ডিসেম্বর ১৮৯৯ - ১৪ জানুয়ারি ১৯৫৭)[১][২] ছিলেন একজন মার্কিন চলচ্চিত্র ও মঞ্চাভিনেতা। বোগার্ট তার ৩০ বছরের দীর্ঘ অভিনয় পেশায় ৭৫টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেন। ধ্রুপদী হলিউড যুগে তার কাজগুলো তাকে একজন সাংস্কৃতিক প্রতিমার আসনে অধিষ্ঠিত করে।[৩][৪] অভিনয় জীবনে তিনি তিনবার অস্কারের জন্য মনোনয়ন পান এবং একবার জয়ী হন। ১৯৯৯ সালে আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট তাকে ধ্রুপদী হলিউড চলচ্চিত্র শিল্পের সেরা পুরুষ তারকার স্বীকৃতি দেয়।[৫]
বোগার্টের অভিনয় জীবন শুরু হয় ১৯২১ সালে। এর আগে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন নৌবাহিনীতে কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর অর্থনীতি সম্পর্কিত এবং মঞ্চে কিছু কাজ করেন কিন্তু সেগুলো ছিল অসফল। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে তিনি ধীরে ধীরে নিয়মিতভাবে ব্রডওয়ে মঞ্চনাটকে অংশ নেয়া শুরু করেন। ১৯২৯ সালে মার্কিন শেয়ার বাজার ধ্বসের পর মঞ্চের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যায় তখন বোগার্ট চলচ্চিত্রের দিকে মনোযোগ দেন। ছায়াছবিতে তার সর্বপ্রথম সফলতা আসে ১৯৩৬ সালে নির্মিত দ্য পেট্রিফাইড ফরেস্ট ছবিতে যেখানে তিনি ডুক ম্যান্টি চরিত্রে অভিনয় করেন। পূর্বে ব্রডওয়ে মঞ্চে তিনি একই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ওয়ার্নার ব্রস. এই চরিত্রের জন্য এডওয়ার্ড জি. রবিনসনকে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্র দুই মাধ্যমেই মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করা লেসলি হাওয়ার্ড তাকেই এই চরিত্রে নেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। এরপর সফলতা আসে গ্যাংস্টারধর্মী "অ্যাঞ্জেলস উইথ ডার্টি ফেসেস" (১৯৩৮) ছবি দিয়ে।
বোগার্ট মুখ্য চরিত্রে প্রথম সফলতা অর্জন করেন ১৯৪১ সালে নির্মিত হাই সিয়েরা এবং দ্য মাল্টিজ ফ্যালকন ছবি দুটির মাধ্যমে এবং ছবি দুটি তাকে তারকা খ্যাতি এনে দেয়। ১৯৪৩ সালের কাসাব্লাঙ্কা ছবিতে অভিনয় করে তিনি অস্কারের জন্য মনোনীত হন এবং এর মাধ্যমেই তিনি তার গ্যাংস্টার সত্তা ত্যাগ করে তার ট্রেডমার্ক প্রণয়ধর্মী চরিত্রটি পান। এরপর একে একে তারঁ অভিনীত টু হ্যাভ অ্যান্ড হ্যাভ নট (১৯৪৪), দ্য বিগ স্লিপ (১৯৪৬), ডার্ক প্যাসেজ (১৯৪৭), এবং কি লার্গো (১৯৪৮) ছবিগুলো সফলতা পায়; এই চারটি ছবির নায়িকা ছিলেন তাঁ স্ত্রী লরেন বাকল। তার অভিনীত পরবর্তী সফল ছবিগুলো হল দ্য ট্রেজার অব দ্য সিয়েরা মাদ্রে (১৯৪৮), ইন আ লোনলি প্লেস (১৯৫০), দি আফ্রিকান কুইন (১৯৫১; এতে তিনি অস্কার বিজয়ী হন), সাবরিনা (১৯৫৪), দ্য কেইন মিউটিনি (১৯৫৪; অস্কার মনোনয়ন), দ্য বেয়ারফুট কনটেসা (১৯৫৪) এবং উই আর নো অ্যাঞ্জেলস (১৯৫৫)। তার অভিনীত সর্বশেষ ছবিটি ছিল দ্য হার্ডার দে ফল (১৯৫৬)।
প্রারম্ভিক জীবন এবং শিক্ষা
বোগার্ট ১৮৯৯ সালের বড়দিনে (২৫শে ডিসেম্বর) নিউ ইয়র্ক সিটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতামাতা বেলমন্ট ডেফরেস্ট বোগার্ট (১৮৬৭-১৯৩৪) ও মড হামফ্রির (১৮৬৮-১৯৪০) ঘরে তিনি ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ সন্তান। তার পিতা বেলমন্ট ছিলেন সরাইখানার মালিক অ্যাডাম ওয়াটকিন্স বোগার্ট ও ধনীর দুলালি জুলিয়ার অসুখী বিবাহের একমাত্র ফসল।[৬] বোগার্ট নামটির উৎপত্তি ওলন্দাজ নাম Bogaert থেকে।[৭] বেলমন্ট এবং মড বিয়ে করেন ১৮৯৮ সালের জুন মাসে। বেলমন্ট ছিলেন প্রেসবিটারিয়ান খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মিশ্র ইংরেজ ও ওলন্দাজ বংশধর এবং মড ছিলেন এপিস্কোপালিয়ান খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী ইংরেজ বংশধর। হামফ্রি বোগার্ট বড় হন এপিস্কোপালিয়ান খ্রিষ্টান ধর্ম অনুসরণ ক’রে কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি কোন ধর্মই পালন করতেন না।[৮]
তার জন্মদিন নিয়ে কিছু মতবিরোধ থাকলেও তার স্ত্রী লরেন বাকল তার আত্মজীবনীতে উল্লখ করেন যে বোগার্টের জন্মদিন সবসময় বড়দিনেই পালিত হত এবং এ নিয়ে তিনি তার সাথে রসিকতা করে বলতেন যে তার জন্মদিন বড়দিনে হওয়াতে প্রতি বছর সবাই তাকে জন্মদিনের উপহার না দিয়ে ঠকাচ্ছে।[৯]
বোগার্টের পিতা বেলমন্ট ছিলেন একজন হৃৎপিণ্ডের শল্যচিকিৎসক। তার মাতা মড ছিলেন একজন বাণিজ্যিক অঙ্কনশিল্পী যিনি তার প্রশিক্ষণ পান নিউ ইয়র্ক এবং ফ্রান্সে। পরে তিনি ফ্যাশন সাময়িকী দ্য ডিলিয়নেটরের (The Delineator) চিত্রাঙ্কন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[১০] তিনি শিশু হামফ্রির একটি অঙ্কন ব্যবহার করেন মেলিন্স শিশু খাদ্যের একটি স্বনামধন্য প্রচারে।[১১] তিনি তার পেশার শীর্ষ অবস্থানে থাকাকালে বছরে আয় করতেন ৫০,০০০ ডলার, যা সেসময়ে ছিল প্রচুর টাকা এবং তা ছিল তার স্বামীর ২০,০০০ ডলার বার্ষিক আয়ের চেয়ে অনেক বেশি।[১২] বোগার্ট পরিবার বাস করতেন নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যানহাটানের অভিজাত এলাকা আপার ওয়েস্ট সাইডে। আপস্টেট নিউ ইয়র্কের ক্যানানডেগুয়া লেকে ৫৫ একর জমির উপর বোগার্ট পরিবারের একটি অভিজাত কটেজ ছিল। হামফ্রি তার ছোটবেলায় তার বন্ধুদের নিয়ে সেখানে অভিনয় অনুশীলন করত।[১৩]
হামফ্রির দুজন ছোট বোন ছিল – ফ্রান্সেস (“প্যাট”) এবং ক্যাথেরিন এলিযাবেথ (“কে”)।[১১] তাদের পিতামাতা তাদের পেশায় ব্যস্ত থাকতেন এবং প্রায়শঃই ঝগড়া করতেন। তারা ছিলেন খুবই নিয়মনিষ্ঠ এবং খুব কম সময়ই তাদের সন্তানদের প্রতি আবেগ দেখাতেন। মড তার সন্তানদের বলতেন তাকে “মা” না বলে “মড” বলে ডাকতে, এবং তিনিও তার সন্তানদের প্রতি খুব কম সময়ই স্নেহ দেখাতেন। মা খুশী হলে “একজন পুরুষের মত আমাদের ঘাড়ে আলতো চাপড় দিতেন।“ বোগার্ট স্মরণ করেন।[১৪] “আমি বড় হয়েছি খুবই আবেগহীন পরিবেশে প্রচুর নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে। আমাদের পরিবারে চুম্বণ ছিল একটি বড় ধরনের ঘটনা। আমাদের মা-বাবা কখনো আমাদের নিয়ে স্নেহে গদগদ ছিল না।“[১৫]
বাল্যকালে বোগার্টকে তার পরিপাটি পোশাক, চুলের স্টাইল, এমনকি তার “হামফ্রি” নামের জন্য তিরস্কার শুনতে হতো।[১৬] বোগার্ট তার পিতার কাছ থেকে যে গুণগুলো পেয়েছেন সেগুলো হল সূঁচের কাজ, মাছ ধরা, নৌকা চালানো, এবং দৃঢ় সংকল্প মহিলাদের প্রতি আকর্ষণ।[১৭]
বোগার্ট বেসরকারি বিদ্যালয় ডিলেন্সি স্কুলে অধ্যয়ন করেন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত, তারপর ভর্তি হন স্বনামধন্য ট্রিনিটি স্কুলে।[১৮] সে ছিল খুব চাপা স্বভাবের এবং স্কুল শেষের কার্যকলাপের প্রতি তার কোন আকর্ষণ ছিল না। পরে সে আরেকটি স্বনামধন্য বিদ্যালয় ফিলিপ্স একাডেমীতে অধ্যয়ন করে যেখানে সে সুযোগ পায় তার প্রভাবশালী পরিবারের কারণে।[১৯] তার পিতামাতার আশা ছিল সে উচ্চ বিদ্যালয় শেষ করে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, কিন্তু ১৯১৮ সালে সে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়।[২০] বহিষ্কারের জন্য বেশ কয়েকটি কারণ দেখানো হয়, একটিতে বলা হয় সে তার প্রধান শিক্ষককে বিদ্যালয়ের খরগোশের পুকুরে ফেলে দায়। আরেকটি কারণে বলা হয় তার ধূমপান, মদ্যপান, লেখাপড়ায় খারাপ এবং বিদ্যালয়ের কর্মচারীদের প্রতি খারাপ আচরণের কথা। আরেকটি কারণে বলা হয় তার পিতাই তাকে স্কুল থেকে বের করে আনে তার খারাপ ফলের কারণে।[২১]
নৌবাহিনী
কোন কার্যকর পেশা খুঁজে না পেয়ে বোগার্ট সমুদ্রের প্রতি তার তীব্র অনুরাগ অনুসরণ করে ১৯১৮ সালে যোগ দেন মার্কিন নৌবাহিনীতে। তিনি স্মরণ করেন, “আঠারোো বছর বয়সে যুদ্ধ ছিল একটা বিশাল ব্যপার। প্যারিস! যৌন আবেদনময়ী ফরাসি নারী! দারুণ![২২] নৌবাহিনীর বিবরণিতে বোগার্টকে বর্ণনা হয়েছে একজন আদর্শ নাবিক হিসেবে যার কাজ ছিল যুদ্ধ বিরতির পর সৈনিকদের ইউরোপ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা।[২৩]
নৌবাহিনীতে থাকার সময়ই সম্ভবতঃ বোগার্ট তার ট্রেডমার্ক ঠোঁটের কাটা দাগ এবং অস্ফুট উচ্চারণ ভঙ্গি পান।
একটি ভাষ্যমতে তার যুদ্ধজাহাজ বোমার আক্রমণে পড়লে তার ঠোঁট কেটে যায়। আরেকটি ভাষ্য অনুযায়ী বোগার্ট আহত হন যখন তিনি একটি বন্দীকে পোর্টসমাথ নৌবাহিনী কারাগার থেকে মেইন অঙ্গরাজ্যের কিটারিতে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
বস্টন শহরে ট্রেন বদলানোর সময় হাতকড়া পড়া বন্দীটি বোগার্টের কাছে একটি সিগারেট চান, বোগার্ট যখন একটি ম্যাচের খোঁজ করছিলেন তখন বন্দীটি তাকে হাতকড়া দিয়ে মুখে আঘাত করে, এবং এতে তার ঠোঁট কেটে যায় এবং বন্দীটি পালিয়ে যায়। পরে বন্দীটিকে আটক করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।[২৪]
তার যুদ্ধোত্তর শারিরীক পরীক্ষায় ঠোঁটের কোন ক্ষতের কথা উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু ছোট ছোট কিছু কাটা দাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।[২৩] আভিনেত্রী লুইস ব্রুক্স যখন বোগার্টের সাথে পরিচিত হন ১৯২৪ সালে, তখন তার ঠোঁটের উপর ভাগে কিছু ক্ষত টিসু তিনি দেখতে পান এবং বলেন যে বোগার্ট সম্ভবতঃ ক্ষতটি আংশিকভাবে সারিয়ছিলেন ১৯৩০ সালে ছবিতে অভিনয় শুরু করার আগে।[২১] তার ধারণা বোগার্টের বৈশিষ্টমূলক কথা বলার ভঙ্গি ঠোঁটের ক্ষতের কারণে হয়নি।
প্রারম্ভিক পেশা
বোগার্ট দেশে ফিরে দেখতে পান যে তার পিতা খুবই অসুস্থ, তার সুষ্ঠ চিকিৎসা হচ্ছে না, এবং পরিবারের বেশিরভাগ অর্থই নষ্ট হয়ে গেছে কাঠের ব্যবসায় ভুল বিনিয়োগের কারণে।[২৫] নৌবাহিনীতে থাকাকালীন বোগার্টের চরিত্র তার পরিবারের প্রভাব ছাড়া স্বাধীনভাবে বিকশিত হয়, তাই সে তার পরিবারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেন। তিনি হয় ওঠেন একজন উদারপন্থী, যে ঘৃণা করে ভুয়া ব্যক্তিত্ব, নাক উঁচু স্বভাব এবং প্রচলিত আচরণ ও কর্তৃত্ব, এবং এটা প্রতিফলিত হয় তার জীবন ও ছবির চরিত্রে। তথাপি তিনি তার ভাল ব্যবহার, গ্রন্থিবদ্ধতা, সময়নিষ্ঠতা ও শিষ্টতা পরিত্যাগ করেননি।[২৬] নৌবাহিনীর পর তিনি কাজ করেন মালামাল পরিবহনকারী এবং বন্ড বিক্রেতা হিসেবে।[২৭]
বোগার্টি তার ছোটবেলার বন্ধু বিল ব্রেডি জুনিয়রের সাথে বন্ধুত্ব পুনঃস্থাপন করেন। বিলের পিতার ছিল ছবির জগতে ভাল যোগসূত্র। অবশেষে বোগার্ট উইলিয়াম এ ব্রেডি সিনিয়রের কোম্পানি ওয়ার্ল্ড ফিল্মস এ কাজ পান।[২৮] অফিসে কাজ করার সময় বোগার্ট ছবির চিত্রনাট্য লেখা, পরিচালনা এবং প্রযোজনা করার চেষ্টা করেন, কিন্তু কোনটিতেই সফল হননি। কিছু সময়ের জন্য বোগার্ট কাজ করেন ব্রেডির কন্যা এলাস-এর মঞ্চনাট্য এ রুইন্ড লেডির সহকারী হিসেবে। কয়েক মাস পরে তিনি মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করেন এলাস-এর ১৯২১ সালের মঞ্চনাট্যে একজন জাপানী খানসামার চরিত্রে। নাটকটিতে তিনি খুব বিচলিত ছিলেন এবং শুধু একটি লাইনের ডায়ালগ বলেন।[২৯]
যদিও বোগার্ট বড় হওয়ার সময় শিখেছেন যে অভিনয় কোন ভদ্রলোকের কাজ নয়, তিনি পছন্দ করতেন অভিনেতাদের অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করার প্রচলনটি এবং তিনি মঞ্চে তার প্রতি মানুষের আকর্ষণও পছন্দ করতেন। সেই সময়টাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মদ্যপান নিষিদ্ধ ছিল। কিছু জায়গা গোপনে অবৈধভাবে মদ বিক্রি করত এবং বোগার্ট সেসব জায়গায় প্রচুর সময় কাটাতেন এবং তার ফলে তিনি একজন কড়া মদ্যপানকারীতে পরিণত হন। এখানে তার ঠোঁট কাটার ব্যপারে আরেকটি ভাষ্য পাওয়া যায় সেটি হল পানশালায় মদ্যপদের সাথে মারামারির ফল। এবং এই ভাষ্যটি ব্রুক্সের ভাষ্যের সাথে মিল আছে।[৩০]
বোগার্টি চাইতেন সময়ের সাথে সাথে শিক্ষা নিতে, তাই তিনি কখনো অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নেননি। তিনি একনিষ্ঠভাবে কাজ করতেন এবং ১৯২২ সাল থেকে ১৯৩৫ এর মধ্যে তিনি ১৭টি ব্রডওয়ে মঞ্চনাট্যে অভিনয় করেন।[৩১] তার চরিত্রগুলো ছিল কিশোর কিম্বা রোমাঞ্চকর কৌতুকের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র। বলা হয় যে তিনিই ছিলেন সর্বপ্রথম অভিনেতা যিনি মঞ্চে বলেন, “কেউ কি টেনিস খেলতে চান?” (Tennis, anyone?)।[৩২] সমালোচক এলেক্সান্ডার উলকট বোগার্টের ব্যপারে লিখেছিলেন যে তিনি ছিলেন, “অভিনয়ের ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত।“[৩৩] কিন্তু, কিছু কিছু সমালোচক তার প্রতি সহৃদয় ছিলেন।
অভিনয় জীবনের শুরুর দিকে, ১৯২২ সালে, যখন তিনি প্লেহাউস থিয়েটারে মঞ্চায়িত ড্রিফটিং নাটকে দ্বৈত ভূমিকায় অভিন্য করছিলেন, তখন তার পরিচয় হয় অভিনেত্রী হেলেন মেনকেনের সাথে। তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মে ২০, ১৯২৬ তারীখে নিউ ইয়র্কের গ্র্যামার্সি পার্ক হোটেলে। তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয় নভেম্বর ১৮, ১৯২৭ তারীখে, কিন্তু তারা তাদের বন্ধুত্ব বজায় রাখেন।[৩৪] বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে মেনকেন বলেন যে বোগার্ট অভিনয়কে দাম্পত্য জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করতেন।[৩৫]
এপ্রিল ৩, ১৯২৮ তারীখে বোগার্ট বিয়ে করেন মেরী ফিলিপ্সকে, যাঁর সাথে তার পরিচয় হয় নার্ভস নামে একটি নাটকে অভিনয়ের সময়।
১৯২৯ সালের মার্কিন শেয়ার বাজার ধ্বসের পর নাট্যমঞ্চায়ণ অনেকটাই কমে যায়, এবং অনেক অভেনেতাই হলিউডে যোগ দেন। বোগার্টের প্রথম ছবি ছিল অভিনেত্রী হেলেন হেইসের ১৯২৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ২ রীলের ছবি দ্য ড্যান্সিং টাউন-এ; ছবিটির পূর্ণাঙ্গ কপি আজো পাওয়া যায়নি। তিনি আরো অভিনয় করেন জোন ব্লন্ডেল এবং রুথ এটিং এর সাথে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ব্রডওয়েজ লাইক দ্যাট (১৯৩০) এ, যা ১৯৬৩ সালে পুনঃআবিষ্কৃত হয়।[৩৬]
অতঃপর তিনি ফক্স ফিল্ম করপোরেশনের সাথে সপ্তাহে ৭৫০ ডলারে চুক্তিবদ্ধ হন। সেখানে তার পরিচয় হয় বিখ্যাত অভিনেতা স্পেন্সার ট্রেসির সাথে, এবং তারা হন একে অপরের বন্ধু ও মদ্যপানের সঙ্গি। ট্রেসিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রথম তাকে “বোগি” নামে ডাকেন ১৯৩০ সালে।[৩৭] ট্রেসির ছায়াছবিতে আত্মপ্রকাশ ছিল জন ফোর্ডের আপ দ্য রিভার (১৯৩০) ছবির মাধ্যমে, এবং এটিই একমাত্র ছবি যেটিতে তারা দু’জন এক সাথে অভিনয় করেছেন। দু’জনই কারাবন্দী হিসেবে বড় চরিত্রে অভিনয় করেন। ট্রেসি পান বেশি প্রচার এবং পোস্টারে শুধুমাত্র বোগার্টের ছবিই ব্যবহার করা হয়।[৩৮]
বোগার্ট ১৯৩১ সালে বেটি ডেভিসের সাথে ব্যাড সিস্টার নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেন।[৩৯] দু’দশক পর ট্রেসি এবং বোগার্ট পরিকল্পনা করেন এক সাথে দ্য ডেসপারেট আওয়ার্স ছবিটি করার, কিন্তু দু’জনই সর্বোচ্চ প্রচার আশা করলে ট্রেসি সরে পড়েন এবং তাঁর পরিবর্তে ফ্রেড্রিক মার্চকে নেয়া হয়।[৪০]
১৯৩০ থেক ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত বোগার্টকে নিয়মিতভাবে হলিউড ও নিউ ইয়র্কের মঞ্চে আসা যাওয়া করতে হয়, যার ফলে তাঁকে অনেক লম্বা সময় কাজ ছাড়া থাকতে হয়। তাঁর পিতামাতার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, তাঁর পিতা মারা যান ১৯৩৪ সালে, রেখে যান প্রচুর দেনা যা বোগার্ট শোধ করেন। উত্তরাধিকার সূত্রে বোগার্ট তাঁর পিতার আংটি পান, যা তিনি সব সময় পড়ে থাকতেন এমনকি বেশ কিছু ছায়াছবিতেও তাঁকে ঐ আংটি পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর পিতার মৃতুশয্যায় বোগার্ট তাঁকে জানান তিনি তাঁকে কতটুকু ভালবাসতেন।[৩২]
বোগার্টের দ্বিতীয় বিবাহও ছিল অসুখী, এবং তিনি তাঁর অভিনয় পেশায় সুখী ছিলেন না। তিনি হয়ে পড়েন বিষাদগ্রস্ত ও ক্রোধপ্রবণ এবং প্রচুর মদ্যপান শুরু করেন।
দ্য পেট্রিফাইড ফরেস্ট (The Petrified Forest)
১৯৩৪ সালে বোগার্ট অভনয় করছিলেন ‘মাস্ক ‘ থিয়াটারে (যা এখন গোল্ডেন থিয়েটার নামে পরিচিত) মঞ্চিত ব্রডওয়ে নাট্যমঞ্চ “ইনভিটেশান টু এ মার্ডার” –এ। প্রযোজক আর্থার হপকিন্স নাটকটি শুনতে পান মঞ্চের বাইরে থেকে, এবং বোগার্টকে ডেকে পাঠান রবার্ট শারউডের “দ্য পেট্রিফাইড ফোরেস্ট”-এ পলাতক খুনী ডুক ম্যান্টির ভূমিকায় অভিনয় করতে।[২৩]
হপকিন্স স্মরণ করেনঃ
আমি যখন অভিনেতাটিকে দেখলাম তখন আমি খুব বিস্মিত হই কারণ তাঁর প্রতি আমার তেমন কোন শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। সে ছিল একটি সেকেলে তরুণ, যে তার বেশিরভাগ মঞ্চ জীবন নিউ ইয়র্কের হোয়াইট প্লেইন্স-এ টেনিস খেলে কাটিয়েছে। তাকে দেখে মনে হ’লো সে কখনই একটি ঠান্ডা মাথার খুনীর ভূমিকায় অভিনয় করতে পারবে না, কিন্তু তার ছিল একটি বিশেষ ধরনের গলার স্বর (শুষ্ক এবং ক্লান্ত), এবং সে স্বরটি ছিল ম্যান্টি’র।
১৯৩৫ সালে ব্রডহার্স্ট থিয়েটারে “দ্য পেট্রিফাইদ ফরেস্ট” ১৯৭ বার মঞ্চায়িত হয়।[৪১] নিউ ইয়র্ক সমালোচক ব্রুস এটকিন্স বলেন, “খুউব সুন্দর...একটি মারাত্মক উত্তেজক ওয়েস্টার্ন নাটক...হামফ্রি বোগার্ট তাঁর অভিনয় জীবনের সবচেয়ে ভাল অভিনয় দেখিয়েছেন এখানে।“[৪২]
ওয়ার্নার ব্রাদার্স ছায়াছবির জন্য নাটকটির স্বত্ত্ব কিনে নেয়। চলচ্চিত্র কোম্পানিটির জন্য “দ্য পেট্রিফাইড ফরেস্ট” ছিল সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কারণ তার বিখ্যাত ছিল শহুরে, স্বল্প বাজেটের আয়াকশান ছবির জন্য। নাটকটির অভিনেতা ছিলেন বেটি ডেভিস এবং লেসলি হাওয়ার্ড। প্রযোজনার স্বত্ত্ব ছিল হাওয়ার্ডের এবং তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে তিনি চান বোগার্ট যেন তার সাথে ছবিতে থাকেন।
ওয়ার্নার ব্রাদার্স ডুক ম্যান্টি চরিত্রটির জন্য বেশ কিছু অভিনেতাকে মনোনয়ন করে এবং এডওয়ার্ড জি রবিন্সনকে বাছাই করে। বোগার্ট খবরটি স্কটল্যান্ডে থাকা হাওয়ার্ডকে টেলিগ্রাম করে জানান। হাওয়ার্ড পালটা টেলিগ্রাম করেন ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে “জ্যাক ওয়ার্নার বলেছেন বোগার্ট যেন ম্যান্টির ভূমিকায় থাকে। বোগার্ট নেই তো লেনদেন নেই।“ যখন ওয়ার্নার ব্রাদার্স দেখল যে হাওয়ার্ড তার মত পরিবর্তন করবেন না, তখন তারা বোগার্টকেই নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল।[৪৩] ওয়ার্নার ব্রাদার্সের মালিক জ্যাক ওয়ার্নার বোগার্টকে বলেছিলেন ছায়াছবির জন্য একটি সুন্দর বাছাই করতে, কিন্তু বোগার্ট তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার আসল নামেই ছবিতে অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নেন।[৪৪]
ছবিটি খুব ভাল সফলতা পায়। এটি আয় করে ৫ লক্ষ ডলার এবং বোগার্ট অধিষ্ঠিত হয় তারকার আসনে।[৪৫] বোগার্ট হাওয়ার্ডের উপকারের কথা ভুলেননি, এবং ১৯৫২ সালে তার নবজাত কন্যার নাম রাখেন “লেসলি হাওয়ার্ড বোগার্ট”। হাওয়ার্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার বিমান শত্রুর গোলার আঘাতে বিদ্ধস্ত হলে মারা যান।[৪৫]
ছায়াছবিতে প্রারম্ভিক অভিনয় জীবন
পেট্রিফাইড ফরেস্টের ছায়াছবির ভাষ্য প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। বোগার্টের অভিনয়কে অভিহিত করা হয় “উজ্জ্বল”, আকর্ষণীয় এবং “দেদীপ্যমান”। বোগার্ট তার সাফল্যে গর্বিত ছিলেন, কিন্তু সে সাফল্যে যে একজন গুন্ডার চরিত্রে অভিনয়ের ফলে এসেছে সেটা তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি বলেনঃ
"আমি একটি সাধারণ কথোপকথনে যোগ দিতে পারি না, সবসময় সেটা একটা ঝগড়ায় রূপ নেয়। নিশ্চয়ই আমার গলার স্বার, কিংবা আমার নাক উঁচু স্বভাবের চেহারায় কিছু একটা আছে যা সবাইকে শত্রুভাবাপন্ন করে তুলে। দেখা মাত্রই কেউ আমাকে পছন্দ করে না। আমার মনে হয় সে জন্যেই আমাকে এমন কঠিন চরিত্রের জন্য বাছাই করা হয়।“
বোগার্টের চরিত্রগুলোর খুব চাহিদা ছিল, তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয় এবং অনেক লম্বা সময় তাকে ঘেমে ভিজে স্টুডিওতে সময় কাটাতে হতো। তখন স্টুডিওগুলোতে এয়ার কন্ডিশন ছিল না। একজন অভিনেতার জীবন সম্বন্ধে তিনি যা ভেবেছিলেন বাস্তবে তা ছিল না।[৪৬] কিন্তু, তবুও তিনি সবসময় পেশাদারিত্ব দেখাতেন এবং সাধারণতঃ সবাই তাকে পছন্দ করতো।
চলচ্চিত্রে সফলতা সত্ত্বেও ওয়ার্নার ব্রাদার্সের কোন ইচ্ছা ছিল না বোগার্টকে একজন শীর্ষ অভিনেতায় রূপান্তর করার। ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সুযোগ-সুবিধাও ছিল স্বনামধন্য মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার-এর চেয়ে কম। বোগার্ট সবসময় মনে করতেন ওয়ার্নারের কাপড়চোপড় সর্বরাহ বিভাগ খুবই নিকৃষ্টমানের এবং বেশিরভাগ সময় তিনি ছবিতে নিজস্ব সুয়ট পড়েই অভিনয় করতেন। হাই সিয়েরা (High Sierra) ছবিটিতে বোগার্ট তার নিজের পোষা কুকুর যিরোকে ব্যবহার করেন ছবির “পার্ড” নামের কুকুরে ভূমিকায়। ওয়ার্নারা ব্রাদার্সের সাথে টাকাপয়সা নিয়ে অন্যান্য অভিনেতাদেরও বিরোধ ছিল, যেমন বেটি ডেভিস, জেমস ক্যাগনি, এরোল ফ্লিন, এবং অলিভিয়া ডে হ্যাভিল্যান্ড।[৪৭]
ওয়ার্নার ব্রাদার্সে মূখ্য অভিনেতা হিসেবে যারা বোগার্টের আগে ছিলেন তারা হলেন জেমস ক্যাগনি, এডওয়ার্ড জি রবিনসন, ভিক্টর ম্যাকলাফলেন, জর্জ র্যাফট এবং পল মুনি। স্টুডিওর ভাল ভাল ছবির লিপগুলো তারাই পেত আর বোগার্টের ভাগ্যে জুটত শুধু উচ্ছিষ্ট। তিনি সেখানে যে ছবিগুলো করেন সেগুলো হলো র্যাকেট বাস্টার্স, স্যান কুয়েন্টিন এবং ইউ ক্যান্ট গেট আওয়ে ইউথ মার্ডার। এই সময়ে তিনি শুধু একটি ভাল চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পান, সেটি হলো ডেড এন্ড (১৯৩৭) Dead End।[৪৮]
বোগার্টের বেশিরভাগ চরিত্রই ছিল হিংস্র। এছাড়া তিনি কিছু ছবিতে পার্শ্ব অভিনেতার চরিত্রে অভিনয় করেন যেমন এঞ্জেলস উইথ ডার্টি ফেইসেস (১৯৩৮) Angels with Dirty Faces ছবিতে তিনি জেমস ক্যাগনির সাথে অভিনয় করেন, যেখানে তিনি জেমসের গুলিতে মারা যান। বোগার্ট বিভিন্ন ছবিতে জেমস ক্যাগনি এবং এডওয়ার্ড জি রবিনসনের গুলিতে মারা যান। কিছু পরিবর্তন আসে ব্ল্যাক লিজিওন (১৯৩৭) Black Legion ছবিতে, যেখানে তিনি একটি ভাল মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেন; তার চরিত্রটি একটি বর্ণবিদ্বেষী দলের কারণে ধ্বংস হয়ে যায়।[৪৯]
আগস্ট ২১, ১৯৩৮ তারীখে বোগার্ট তৃতীয়বারের মত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন অভিনেত্রী মায়া মেথট এর সাথে। এটি ছিল একটি সর্বনাশা বিয়ে কারণ মায়া যদিও একজন বধুসুলভ নারী ছিলেন, মদ্যপ অবস্থায় তিনি হয়ে যেতেন একজন লক্ষণাক্রান্ত রোগী এবং খুব হীংস্র। মেথট সন্দেহ করতেন বোগার্ট অন্য নারীর সাথে সম্পর্কে জড়িত। ঝগড়ার সময় তিনি হাতের কাছে ফুলদানি, থালা-বাসন যা পেতেন তাই বোগার্টের দিকে ছুঁড়ে মারতেন। মেথট একবার সারা বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেন, বোগার্টকে ছুরি মারেন এবং তার নিজের কবজি বেশ কয়েকবার চাকু দিয়ে কেটে ফেলেন। বোগার্টও তাকে অনেক খোঁচাতেন এবং সেটা উপভোগ করতেন। কখনো কখনো তিনিও হীংস্র হয়ে পড়তেন। সাংবাদিকরা তাদের নাম দিয়েছিলেন “যুদ্ধংসি বোগার্ট দম্পতি” (the Battling Bogarts)।[৫০]
বোগার্ট সারা জীবন ছলচাতুরি এবং মেকিকে ঘৃণা করতেন। এখন তিনি নিজের ছবিও ঘৃণা করতে শুরু করেন, কারণ ছবিগুলো উন্নতমানের ছিল না। তিনি বেশিরভাগ সময় তার অভিনীত ছবি দেখতেন না।
তারকা রাজ্যে উত্তরণ
হাই সিয়েরা (High Sierra)
১৯৪১ সালে নির্মিত “হাই সিয়েরা” ছবিটির পরিচালক ছিলেন রাউল ওয়ালশ। ছবিটি ডব্লিউ আর বার্নেট-এর “লিটল সিজার” উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এবং এর চিত্রলিপি লিখেছিলেন বোগার্টের বন্ধু ও মদ্য পানের সঙ্গি জন হিউস্টন।[৫১] ছবিটির অভিনেত্রী আইডা লুপিনোর সাথে বোগার্ট খুব ভাল অভিনয় করেন এবং তাদের সম্পর্ক ছিল নিবীড়, যার কারণে বোগারটের স্ত্রী মেথট খুবই ঈর্ষান্বিত ছিলেন।[৫২]
এই ছবির মাধ্যমে বোগার্ট এবং জন হিউস্টনের পেশাদারি সম্পর্ক দৃঢ় হয়। বোগার্ট হিউস্টনের সুন্দর লেখার জন্য তাকে শ্রদ্ধা এবং মাঝে মাঝে হিংসাও করতেন। যদিও বোগার্ট ছাত্র হিসেবে খারাপ ছিলেন, তিনি সারা জীবন একজন পড়ুয়া ছিলেন। তিনি প্ল্যাটো, পোপ, এবং রালফ ওয়ালডো এমারসনের উদ্ধৃতি এবং শেক্সপিয়ারের নাট্যের হাজারো লাইন মুখস্থ বলতে পারতেন। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগ থেকে প্রকাশিত স্বনামধন্য আইন সাময়িকী হার্ভার্ড ল' রিভিউ-এর নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন।[৫৩] লেখকদের খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং অনেক চিত্রলিপি লেখকই তার সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিলেন।
দ্য মাল্টীয ফ্যালকন (The Maltese Falcon)
বর্তমানে সর্বোত্তম নোয়া চলচ্চিত্র হিসেবে পরিচিত মাল্টীয ফ্যালকন (১৯৪১) ছিল জন হিউস্টনের পরিচালক পেশার হাতেখড়ি। ড্যাশেল হ্যামেটের উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে ছবিটি নির্মিত হয়। কাহিনীটির আরো দু’টি সংস্করণ আছে, যার একটি ছিল বেটি ডেভিস অভিনীত ১৯৩৬ সালের স্যাটান মেট এ লেডী (Satan Met a Lady)[৫৪] এবং আরেকটি ছিল ১৯৩১ সালে নির্মিত দ্য মাল্টীয ফ্যালকন। প্রযোজক হাল ওয়ালিস প্রথমে মূখ্য ভূমিকায় জর্জ র্যাফটকে বাছাই করেন, কিন্তু জর্জ র্যাফট রাজি না হওয়ায় পরিচালক হিউস্টন বোগার্টকে বেছে নেন স্যাম স্পেইড চরিত্রটির জন্য।
ছবিটি ছিল একটি বড় হিট এবং হিউস্টনের জন্য একটি বড় বিজয়। বোগার্টও খুব খুশী ছিলেন ছবিটির সাফল্যে। তিনি বলেনঃ
“এটি নিঃসন্দেহে আমার সেরা কাজ। আমার গর্ব করার মত বেশি কিছু নেই, ...কিন্তু এটা আছে।“[৫৫]
কাসাব্লাঙ্কা
বোগার্টের প্রথম সত্যিকারের রোমাঞ্চকর ছায়াছবি ছিল ১৯৪২ সালের কাসাব্লাঙ্কা। ছবিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় নির্মিত। বোগার্টের চরিত্রটি ছিল রিক ব্লেইন নামে একজন বিদেশী পানশালার মালিক। ছবিটির পরিচালক ছিলেন মাইকেল কার্টিয এবং প্রযোজক ছিলেন হাল ওয়ালিস। বোগার্টের বিপরীতে অভিনয় করেন ইংরিড বার্গম্যান, ক্লড রেইন্স, সিডনী গ্রীনস্ট্রীট, পল হেনরীড প্রমুখ।
পর্দায় বোগার্ট ও বার্গম্যানের যাদুকরী অভিনয়ের কারণ ছিল তারা দু’জনই তাঁদের শ্রেষ্ঠ অভিনয় করতে চেষ্টা করেন। যদিও বোগার্টের স্ত্রী সন্দেহ করতেন, আসলে ক্যামেরার অন্তরালে তাঁরা একজন আরেকজনের সাথে কমই কথা বলতেন। বার্গম্যান, যিনি তাঁর বিপরীতে অভিনয় করা পুরুষদের সাথে সম্পর্কের ব্যপারে বিখ্যাত ছিলেন,[৫৬] তিনি পরে বলেন,
“আমি তাকে চুমু খেয়েছি, কিন্তু আমি কখনো তাকে চিনতাম না“[৫৭]
বোগার্টের তুলনায় বার্গম্যান লম্বা ছিলেন, ছবির কিছু কিছু দৃশ্যে বোগার্টকে তার জুতোর তলায় ৩ ইঞ্চি উঁচু হিল ব্যবহার করতে হয়।[৫৬]
ক্যাসাব্লাঙ্কা ১৯৪৩ সালের শ্রেষ্ঠ ছবির অস্কার জয়ী হয়। বোগার্ট শ্রেষ্ঠ অভিনেতার মনোনয়ন পান কিন্তু জয়ী হন পল লুকাস “ওয়াচ অন দ্য রাইন” Watch on the Rhine ছবির জন্য। ক্যাসাব্লাঙ্কা’র কারণে বোগার্ট স্টুডিওর চার নম্বর থেকে জেমস ক্যাগনিকে ছাড়িয়ে এক নম্বর অভিনেতার আসনে স্থান পান। ১৯৪৬ সালের মধ্যে তাঁর আয় দ্বিগুণের বেশি হয় যায়; তাঁর বাৎসরিক আয় দাঁড়ায় ৪,৬০,০০০ ডলারে, এবং তিনি অর্জন করেন পৃথিবীর সবচেয়ে দামী অভিনেতার স্থান।[৫৮]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
১৯৪৩ এবং ১৯৪৪ কিছু সময় ইউনাইটেড সার্ভিস অরগানাইজেশন - এ যোগ দিয়ে যুদ্ধের খরচ উত্তোলনের জন্য যুদ্ধের বন্ড বিক্রয় করতে তাঁর স্ত্রী মেথটের সাথে ভ্রমণে বের হন। তাঁরা ইতালি এবং উত্তর আফ্রিকার (ক্যাসাব্লাঙ্কা সহ) বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন, যা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য।[৫৯]
বোগার্ট ও বাকল
টু হ্যাভ আয়ান্ড হ্যাভ নট
লরেন বাকলের সাথে বোগার্টের পরিচয় হয় ১৯৪৪ সালের টু হ্যাভ অয়ান্ড হ্যাভ নট (To Have and Have Not) ছবিটি নির্মাণকালে। ছবিটির সাথে ক্যাসাব্লাঙ্কা ছবির অনেক সদৃশ আছে – একই শত্রু, একই ধরনের নায়ক, এমনকি একজন পিয়ানো বাদক পার্শ্ব অভিনেতাও। পরিচয়কালে বাকলের বয়স ছিল ১৯ এবং বোগার্ট ছিলেন ৪৪। বোগার্ট তাকে ‘বেবি’ নামে ডাকতেন। বাকল ১৬ বছর বয়স থেকে একজন মডেল ছিলেন। তার সবুজ আঁখি, উঁচু চিকবোন,সোনালী কেশ, কৃশকায় দেহ, পরিপক্ব ব্যক্তিত্ব, এবং সদালাপ বোগার্টকে আকৃষ্ট করেছিল।[৬০] তাদের আবেগময় এবং শারিরীক সম্পর্ক শুরু থেকেই ছিল খুব তীব্র। তাদের দু’জনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান এবং অভিনয়ের অসাম্যতা একটি ছাত্র-গুরুর সম্পর্কের সৃষ্টি করে। হলিউডে যখন ছবির নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে ব্যক্তিগত জীবনে প্রেম ছিল খুবই স্বাভাবিক, তখন বোগার্টের জীবনে ছিল কোন নায়িকার সাথে এটিই প্রথম প্রেম।[৬১] তখনও তিনি বিবাহিত ছিলেন মেথটের সাথে, এবং বাকলের সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত, তাদের বিচ্ছিন্নতার মূহুর্তগুলোর সেঁতুবন্ধন ছিল তাঁদের আবেগঘণ প্রেম পত্রগুলি।[৬২] তাঁদের নিবীড় সম্পর্ক নবাগতা লরেনকে স্বাচ্ছন্দ্যভাবে অভিনয়ে সাহায্য করে, এবং বোগার্ট তাঁর কৌতুকের মাধ্যমে চেষ্টা করতেন লরেনকে সহজ হতে।
ছবির পরিচালক হাওয়ার্ড হক্স এক পর্যায়ে অভিনেতা যুগলের প্রেম অপছন্দ করা শুরু করেন। তিনি ভাবতেন তিনিই বাকলের অভিভাবক ও পরামর্শদাতা, আর বোগার্ট তাঁর এই ভূমিকাকে অতিক্রমণ করছে। হক্স ছিলেন বিবাহিত এবং চেষ্টা করতেন তাঁর নায়িকাদের প্রতি আকৃষ্ট না হতে, কিন্তু তিনিও বাকলের প্রেমে পড়ে যান আর বাকলকে বলেন বোগার্ট তাঁকে মোটেও পছন্দ করে না, এবং এমনকি তাঁকে হুমকি দেন মনোগ্রাম স্টুডিওতে পাঠিয়ে দেয়ার, যেটা ছিল হলিউডের সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্টুডিও। বোগার্ট এটা শুনে ক্ষেপে যান। জ্যাক ওয়ার্নার ঝগড়া মিটিয়ে দেন এবং চিত্রগ্রহণ আবার শুরু হয়। হক্স বাকল সম্বন্ধে বলেছিলেনঃ
“বোগি প্রেমে পড়েছিলেন বাকলের অভিনীত চরিত্রটির প্রতি, তাই তো বাকলকে সারাজীবন সেই চরিত্রটি বাস্তব জীবনেও অভিনয় করে যেতে হয়।“[৬৩]
দ্য বিগ স্লীপ
ছবিটি শেষ হওয়ার কয়েক মাস পর বোগার্ট এবং বাকল আবার একসাথে অভিনয় শুরু করেন নোয়া চলচ্চিত্র দ্য বিগ স্লীপ-এ। ছবিটির কাহিনী লেখা হয় রেমন্ড চেন্ডলারের উপন্যাস অবলম্বণে।
ছবিটির কাজ শেষ হলে মুক্তি দেয়ার কথা ছিল ১৯৪৫ সালে, কিন্তু তা প্রত্যাহার করে পুনঃসম্পাদনা করা হয় বোগার্ট-বাকল যুগলের কিছু রসালো দৃশ্য সংযোজন করতে যা “টু হ্যাভ অয়ান্ড হ্যাভ নট” এ দীপ্তমান ছিল।
চিত্রগ্রহণের পুরো সময় জুড়ে বোগার্ট উভয় সঙ্কটে ভুগছিলেন তার নতুন পাওয়া ভালবাসা ও বিবাহ জীবনের প্রতি তার কর্তব্য নিয়ে এবং তিনি এই সঙ্কট থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিলেন। পরিশেষে ছবিটি সফলতা পেলেও কিছু কিছু সমালোচকের মতে কাহিনীটি ছিল বিভ্রান্তিকর ও অধিক জটিল।
বিবাহ
১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বোগার্ট মেথটের কাছ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আদালতে আবেদন করেন। বোগার্ট এবং বাকল একটি ছোট অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মে ২১, ১৯৪৫ তারীখে।[৬৪]
তাদের নতুন আবাস হয় লস অয়াঞ্জেলেসের অভিজাত এলাকা হোম্বি হিলসে একটি সাদা ইটের অট্টালিকা, যার মূল্য ১,৬০,০০০ ডলার (২০১৭ সালের হিসেবে ২,১৭০,০০০ ডলার)।[৬৫] এই বিয়েটি ছিল একটি সুখী বিয়ে, যদিও মাঝে মাঝে সমস্যা হত তাদের মতানৈক্যের কারণে। বোগার্টের মদ্য পান মাঝে মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি করত।[৬৬] বোগার্ট পছন্দ করত বাসায় থাকতে আর বাকল ভালবাসত নৈশপ্রমোদ। বোগার্ট সমুদ্র ভালবাসত কিন্তু, সমুদ্র বাকলকে দিত সমুদ্রপীড়া।[৬৭]
ডার্ক প্যাসেজ
উত্তেজনাপূর্ণ ১৯৪৭ সালের "ডার্ক প্যাসাজ" ছিল তাদের পরবর্তী যুগল ছবি।[৬৮] ছবিটির প্রথম ১/৩ ভাগ চিত্রায়িত হয় সমস্ত মুখমন্ডলে ব্যান্ডেজ বাঁধা বোগার্টের চরিত্রটির দৃষ্টিকোণ থেকে, ক্যামেরা দেখায় যা তিনি দেখছেন। প্লাস্টিক সার্জারির পরে ছবিটি স্বাভাবিকভাবে চিত্রায়িত হয়।
কী লার্গো
বোগি-বাকল দম্পতির পরের ছবিটি ছিল “কী লার্গো”। জন হিউস্টন পরিচালিত ছবিটিতে এডওয়ার্ড জি রবিন্সনের চরিত্রটি ছিল জনি রকো নামে একটি গুন্ডার। চরিত্রগুলি একটি আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে একটি হোটেলে আটকা পড়ে। ক্লেয়ার ট্রেভর পার্শ্ব-অভিনেত্রীর অস্কার বিজয়ী হন।
সন্তান সন্ততি
বোগার্ট প্রথমবারের মত পিতা হন ৪৯ বছর বয়সে যখন বাকলের ঘরে জন্ম নেয় তার পুত্র স্টিভেন হামফ্রি বোগার্ট জানুয়ারি ৬, ১৯৪৯ তারিখে। বোগার্ট তখন কাজ করছিলেন “টোকিও জো” ছবিতে।[৬৮] শিশুর নাম নেয়া হয় টু হ্যাভ অয়ান্ড হ্যাভ নট ছবিতে বোগার্টের চরিত্র “স্টীভ” থেকে।[৬৯] স্টিফেন ছিলেন একজন লেখক ও আত্মজীবনী লেখক, পরে তিনি তারঁ পিতার ওপর নির্মিত একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন। তিন বছর পর জন্ম নেয় তাদের কন্যা লেসলি হাওয়ার্ড বোগার্ট আগস্ট ২৩, ১৯৫২ তারীখে।
পরবর্তী কর্মাবলী
ক্যাসাব্লাঙ্কার বিশাল সফলতা বোগার্টের চরিত্রকে পরিশোধিত করে। সুনামের পরও কোন চুক্তি অনুযায়ী কোন ছবি তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন না।
ট্রেযার অফ দ্য সিয়েরা মাদ্রে
১৯৪৭ সালে একটি নতুন চুক্তি অনুযায়ী বোগার্ট তার নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চালু করার অনুমতি পান, এবং আবার জন হিউস্টনের সাথে এক হন “দ্য ট্রেজার অফ দ্য সিয়েরা মাদ্রে” ছবিটিতে। ছবিটির কাহিনী তিনজন স্বর্ণ সন্ধানীর অতি লোভ।
হাউয আন-আমেরিকান অয়াক্টিভিটিয কমিটি
১৯৩৮ সালে মার্কিন সরকার হাউজ আন-আমেরিকান অয়াক্টিভিটিয কমিটি House Un-American Activities Committee (HUAC) নামে একটি কমিটি গঠন করে, যার কাজ ছিল দেশটির কোন নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের সাথে সাম্যবাদীদের যোগসাজশ আছে কিনা তা তদন্ত করতে। এতে মার্কিন ছায়াছবির জগৎএর বহু মানুষকেও তদন্তের আওতায় আনা হয়। বোগার্ট বিশ্বাস করতেন উদারনীতিতে এবং ছিলেন একজন উদারনীতিবান ডেমোক্র্যাট।[৭০] তিনি একটা সংগঠন গড়ে তোলেন হাউজ আন-আমেরিকান অয়াক্টিভিটিয কমিটির কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কারণ কমিটিটি হলিউডের অনেক লেখক ও অভিনেতাকে হয়রানি করছিল। তিনি একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডি সে যান হাউজ আন-আমেরিকান অয়াক্টিভিটিয কমিটির বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে।
স্যান্টানা প্রোডাকশন্স
১৯৪৮ সালে বোগার্ট তার নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান “স্যান্টানা প্রোডাকশন্স” গঠন করেন। প্রতিষ্ঠানটি কলাম্বিয়া পিকচার্সের মাধ্যমে ছবি মুক্তি দিত। নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বোগার্ট যেসব ছবিতে অভিনয় করেন সেগুলো হলঃ নক অন এনি ডোর (১৯৪৯), টোকিও জো (১৯৪৯), ইন এ লোনলি প্লেইস (১৯৫০), সিরোকো (১৯৫১) এবং বীট দ্য ডেভিল (১৯৫৩)। স্যান্টানা প্রোডাকশন্স আরো দু’টি ছবি করে বোগার্টকে ছাড়াঃ অয়ান্ড বেবি মেইক্স থ্রী (১৯৪৯) এবং দ্য ফ্যামিলি সিক্রেট (১৯৫১)।
দ্য অয়াফ্রিকান কুইন
এই ছবিটি ছিল বোগার্টের অস্কার বিজয়ী ছবি এবং ছিল তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের বাইরে। পরিচালক ছিলেন জন হিউস্টন এবং প্রযোজক ছিলেন স্যাম স্পিগেল। বোগার্টের বিপরীতে অভিনয় করেন ক্যাথরীন হেপবার্ন। স্পিগেল যখন হেপবার্নকে ছবির চিত্রলিপি পাঠান, তখন হেপবার্ন তাঁর বিপরীতে বোগার্টের নাম প্রস্তাব করেন, এবং বলেনঃ “তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে পারবেন।“[৭১] বোগার্ট ও বাকল তাদের আরামদায়ক হলিউড ছেড়ে আফ্রিকার দুর্গম অঞ্চল বেলজিয়ান কঙ্গোতে পাড়ি জমান ৪ মাসের জন্য। ছবিটির জন্য বোগার্টের প্রাপ্য মুনাফার ৩০% এবং হেপবার্নের জন্য ১০% সাথে দু’জনের জন্য স্বল্প পারিশ্রমিক।
বাকল তাঁর শিশুকে আত্মীয়ের তত্ত্বাবধানে রেখে বোগার্টের সফর সঙ্গি হন। তাঁরা ইউরোপ হয়ে, পোপ পাইয়াসের সাথে সাক্ষাৎ ক’রে[৭২] আফ্রিকা যান। বাকল নিজেকে কাজে লাগান রাঁধুনী, নার্স এবং ধোপানী হিসেবে। তাঁ স্বামী তাঁর অনেক প্রশংসা করেন, বোগার্ট বলেনঃ
“আমি জানি না সে না থাকলে আমাদের কি হত। সে অন্ধকারাচ্ছন্ন আফ্রিকায় আমার অন্তর্বাস ধুয়েছে।“[৭৩]
ছবির সাথে জড়িত প্রায় সবারই পেটের অসুখ ডিসেন্ট্রি দেখা দেয়, শুধু বোগার্ট এবং হিউস্টন, কারণ তারা খেতেন ক্যানজাত খাদ্য বীন, অয়াস্পারাগাস, ইত্যাদি আর আর হুইস্কি। হেপবার্নের ওজন অনেক কমে যায় এবং তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছবিটি শেষ করতে সকলকে অনেক বাধা পার হতে হয় যেমন, অসুস্থতা, পিঁপড়ের আক্রমণ, নৌকোর ফুটো, নিম্নমানের খাদ্য, জলহস্তির আক্রমণ, নিম্নমানের জল বিশোধন যন্ত্র, প্রচন্ড তাপ, একাকিত্ব, এবং একটি নৌকোয় আগুন।
বদমেজাজি কাপ্তান চার্লি অলনাটের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য বোগার্ট শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার পান। বোগার্টের মতে এই ছবিতে তার অভিনয় ছিল সমগ্র অভিনয় জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। অস্কার গ্রহণের পর বোগার্ট তার ভাষণে বলেনঃ
“এই মঞ্চটি বেলজিয়ান কঙ্গো থেকে অনেক অনেক দূরে। আমি আনন্দ সহকারে বলতে চাই যে এ জায়গাটি ঐ জায়গাটির চেয়ে অনেক ভাল। আমি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই জন হিউস্টন এবং ক্যাথরিন হেপবার্নকে, কারণ তাঁরা আমাকে সাহায্য করেছেন আমি এখন যেখানে আছি সেখানে পৌঁছুতে। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।“
শেষের দিকের চরিত্রগুলি
অস্কার বিজয়ের ৩ বছর পর বোগার্ট তার পারশ্রমিক অনেক কমিয়ে দেন শুধুমাত্র ক্যাপ্টেন কুইগ-এর চরিত্রে ১৯৫৪ সালের “দ্য কেইন মিউটিনি” ছবিতে অভিনয়ের জন্য। তার শক্তিশালী অভিনয়ের জন্য তিনি তৃতীয়বারের মত অস্কারের জন্য মনোনয়ন পান, এবং টাইম সাময়িকীর জুন ৭, ১৯৫৪ তারীখের সংখ্যায় তিনি প্রচ্ছদে স্থান পান।
এরপর তার উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলোঃ সাব্রিনা (১৯৫৪), দ্য বেয়ারফুট কন্টেসা (১৯৫৪), উই আর নো এঞ্জেলস (১৯৫৫), দ্য ডেস্পারেট আওয়ার্স (১৯৫৫), দ্য লেফট হ্যান্ড অফ গড (১৯৫৫) এবং দ্য হার্ডার দে ফল (১৯৫৬)।
টেলেভিশন ও বেতার
যদিও বোগার্ট খুব কম সময় টেলিভিশনে অভিনয় করতেন, তিনি বাকলের সাথে “পারসন টু পারসন” অনুষ্ঠানটি করতেন। এছাড়া তিনি “জ্যাক বেনি শো”-তেও অংশ নেন।
বোগার্ট তার বিখ্যাত ছবিগুলোর বেতার সংস্করণও করেন যেমন “কাসাব্লাঙ্কা” এবং “দ্য মাল্টীয ফ্যালকন”।
ব্যক্তিগত জীবন
র্যাট প্যাক (Rat Pack)
বোগার্ট ছিলেন হলিউডের কথিত “র্যাট প্যাক”-এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫৫ সালের বসন্তের এক রাতে বোগার্ট যখন লাস ভেগাসে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন যেখানে আরো ছিলেন গায়ক ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা, জুডি গার্ল্যান্ড, ডেভিড নিভেন প্রমুখ, তখন বাকল তাকে দেখে বলেন, “তোমাকে দেখতে লাগছে র্যাট প্যাকের মত।“ সেই থেকে এই দলটির নাম হয়ে যায় “র্যাট প্যাক।“
মৃত্যু
প্রচন্ড ধূমপায়ী ও মদ্যপায়ী বোগার্ট অন্ননালীর ক্যান্সারে আক্রন্ত হন। তিনি কখনই তার স্বাস্থ্যহানীর ব্যপারে কারো সাথে আলোচনা করতেন না এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিতে অসম্মতি জানাতেন। বাকলের অনেক অনুরোধের পর তিনি ১৯৫৬ সালের জানুয়ারী মাসে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। মার্চ ১, ১৯৫৬ তারীখে ডাক্তার তার শরীরে অস্ত্রোপচার করেন। তার পুরো অন্ননালী, দু’টি লিম্ফ নোড এবং একটি পাজরের হাড় অপসারণ করা হয়। কিন্তু, সেটা রোগ সারানোর জন্য খুব দেরী হয়ে গিয়েছিল, এবং কিমোথেরাপিও কাজ করছিল না। ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে তাঁর শরীরে আবারো অস্ত্রোপচার করা হয়। সময়ের সাথে তিনি দুর্বল হতে থাকেন। ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা, ক্যাথেরিন হেপবার্ন এবং স্পেন্সার ট্রেসি তাঁকে নিয়মিত দেখতে যেতেন। ক্যাথরিন হেপবার্ন এবং স্পেন্সার ট্রেসি তাঁদের বন্ধুকে শেষবার যখন জীবিত অবস্থায় দেখেন সেটা ছিল ১৩ই জানুয়ারী, ১৯৫৭। হেপবার্ন এক আলোচনায় বলেনঃ
“বিদায় নেয়ার সময় স্পেন্স তাঁর ঘাড়ে আলতোভাবে ছুঁইয়ে বলেছিলেন, ‘শুভরাত্রি বোগি।‘ বোগি স্পেন্সের দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাঁর হাত স্পেন্সের হাতের উপর রেখে একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে নিচু স্বরে বলেন ‘বিদায় স্পেন্স।‘ স্পেন্সের হৃৎপিণ্ড থেমে যায়। সে বুঝতে পেরেছিল।“
পরদিন বোগার্ট কোমায় চলে যান এবং তাঁর বিছানায় ঘুমন্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৭ বছর এবং ওজন হয়েছিল ৩৬ কেজি। তাঁর সাদামাটা শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয় অল সেইন্টস এপিস্কোপালিয়ান গীর্জায়। অনুষ্ঠানে হলিউডের সব বিখ্যাত তারকারা উপস্থিত ছিলেন যেমন হেপবার্ন, ট্রেসি, জুডি গার্ল্যান্ড, ডাভিড নিভেন, রোনাল্ড রেগেন (পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি), জেমস মেসন, বেটি ডেভিস, ড্যানি কে, জোন ফন্টেইন, মারলেইনা ডীট্রিক, জেমস ক্যাগনি, এরোল ফ্লিন, গ্রেগোরি পেক, গ্যারি কুপার, বিলি ওয়াইল্ডার এবং জ্যাক ওয়ার্নার। শেষকৃত্যের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর্বে জন হিউস্টন বলেনঃ
“নিজেকে নিয়ে সে কখনই গভীরভাবে ভাবত না – তার কাছে কাজ ছিল সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। সে শ্রদ্ধা করত জাঁকালো চরিত্র বোগার্টকে।...ভারসেইয়ের প্রতিটি ফোয়ারায়একটি করে পাইক মাছ আছে যেটা সব কার্প মাছগুলোকে ব্যস্ত রাখে; তা না হ’লে কার্প মাছগুলো খুব মোটা হয়ে যেত এবং মৃত্যুবরণ করত। বোগার্ট খুব আনন্দ সহকারে হলিউডের ঝর্ণাগুলোতে একই কাজ করতেন। কিন্তু তার শিকার কদাচিৎ তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করত, আর করলেও তা ছিল ক্ষণস্থায়ী...বোগার্ট ছিল অপূরণীয়। আমরা কখনই তাঁর মত আরেকজনকে পাব না।“
শবদাহের পর বোগার্টের ভস্ম প্রোথিত করা হয় গ্লেন্ডেল, ক্যালিফোর্নিয়ার ফরেস্ট লন মেমোরিয়াল পার্ক সমাধিক্ষেত্রে। তাকে সমাহিত করা হয় একটি স্বর্ণের শিস দেয়ার বাঁশির (whistle) সাথে, যেটা তিনি বিয়ের আগে বাকলকে উপহার দিয়েছিলেন। হুইসলটিতে “টু হ্যাভ অয়ান্ড হ্যাভ নট” ছবির একটি লাইন লেখা ছিলঃ “কিছু প্রয়োজন হ’লে শিস দিও।“
কিংবদন্তি
১৯৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগ বোগার্টের স্মরণে একটি ডাকটিকেট মুদ্রণ করে, যাতে তার ছবি ছিল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লরেন বাকল, এবং তাদের সন্তান স্টিফেন এবং লেসলি।
জুন ২৪, ২০০৬ তারীখে নিউ ইয়র্কের সিটির ম্যানহাটনের ব্রডওয়ে ও ওয়েস্ট এন্ড এভিনিউয়ের মধ্যবর্তী ১০৩ সড়কটি পুনঃনামকরণ করা হয় "হামফ্রি বোগার্ট প্লেস।"
এছাড়া হলিউড ওয়াক অফ ফেইমে আছে বোগার্টের নাম খচিত একটি তারকা।
১৯৮১ সালে বার্টি হিগিন্সের গান “কী লার্গো”-তে বোগী আর বাকলের কথা বলা হয়।
তথ্যসূত্র
↑"Ontario County Times birth announcement" (ইংরেজি ভাষায়)।|ইউআরএল= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য); |সংগ্রহের-তারিখ= এর |ইউআরএল= প্রয়োজন (সাহায্য)
↑"Phillips Academy - Notable Alumni: Short List"। www.andover.edu। Archived from the original on October 27, 2016। Archived from the original on অক্টোবর ২৭, ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ November 1, 2016।এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: বট: আসল-ইউআরএলের অবস্থা অজানা (link)