সেতসুকো হারা (১৭ জুন ১৯২০ - ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫) ছিলেন একজন জাপানি অভিনেত্রী। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অন্যতম জনপ্রিয় জাপানি অভিনেত্রী। ইয়াসুজিরো ওজুরবানশুন (১৯৪৯) ও তোকিও মনোগাতারি (১৯৫৩) চলচ্চিত্রে তার অভিনয়ের জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিতি অর্জন করেন।[১] ওজুর পরিচালনায় অভিনয়ের পূর্বে তিনি আরও ৬৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
প্রারম্ভিক জীবন
সেতসুকো হারা ১৯২০ সালের ১৭ই জুন ইয়োকোহামার হোদোগায়া-কু শহরে জন্মগ্রহণ করেন।[২] তার জন্মনাম ছিল মাসাই আইদা।[৩] তার তিন ভাই ও চার বোন ছিল। তার বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাতোরা কুমাগাইয়ের সাথে, এতে তার চলচ্চিত্র জগতে আগমন সহজ হয়ে ওঠে। কুমাগাইয়ের অনুপ্রেরণায় তিনি বিদ্যালয়ের পড়াশোনা ত্যাগ করেন এবং ১৯৩৫ সালে টোকিওর অদূরবর্তী তামাগাওয়ায় নিক্কাৎসু স্টুডিওজের চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। ১৫ বছর বয়সে তামেরাফু নাকারে ওয়াকোদো ইয়ো চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে তার অভিষেক হয় এবং স্টুডিও তাকে এই নামটি প্রধান করে।[২]
কর্মজীবন
প্রারম্ভিক কর্মজীবন
হারা ১৯৩৭ সালে জার্মান-জাপানি যৌথ-প্রযোজনায় আর্নল্ড ফাঙ্খ ও মান্সাকু ইতামির পরিচালনায় ডিয়ে টোখটার ডেস সামুরাই (জাপানি ভাষায় আতারাশিকি ৎসুচি নামে পরিচিত) চলচ্চিত্রে অভিনয় করে অভিনেত্রী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।[৪] এই চলচ্চিত্রে হারা এক জাপানি স্কুলবালিকা চরিত্রে অভিনয় করেন, যে একটি প্রাচীন জাপানি রীতির চর্চা করে এবং এমন একজনকে বিয়ে করার প্রস্তুতি নিচ্ছে যে ইউরোপীয় এক তরুণীকে ভালাবাসে, ফলে সে আগ্নেয়গিরিতে নিজেকে বলি দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়।[৩] এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে একাধিক চলচ্চিত্রে বিয়োগান্ত চরিত্রে তার অভিনয় তাকে আদর্শ তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।[৫] তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল তাদাশি ইমাইয়ের দ্য সুইসাইড ট্রুপস অব দ্য ওয়াচটাওয়ার (১৯৪২) এবং কুনিও ওয়াতানাবের দ্য গ্রিন মাউন্টেন (১৯৪৯) ও টুওয়ার্ড দ্য ডিসিসিভ ব্যাটল ইন দ্য স্কাই।[২]
যুদ্ধ-পরবর্তী কর্মজীবন
১৯৪৫ পরবর্তী সময়ে হারা জাপানেই রয়ে যান এবং কমিউনিস্ট-বিরোধী চলচ্চিত্রে কাজ করতে থাকেন। তিনি আকিরা কুরোসাওয়ার প্রথম যুদ্ধ-পরবর্তী চলচ্চিত্র ওয়াগা সেইশুন নি কুইনাশি (Waga seishun ni kuinashi, ১৯৪৬) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। কুরোসাওয়ার নারীবাদী এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ওজুর চিত্রিত সাধারণ নারীর বাইরে হারা যে আরও বিস্তৃত ধারার চরিত্রে কাজ করতে পারেন তার সেই সক্ষমতা প্রদর্শিত হয়েছে। ১৯৩০-এর দশকের শেষভাগে সামরিক শাসিত অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে একজন নারীর জীবনের এক যুগের ঘটনাবলিতে দেখা যায় হারা একজন বেখেয়ালি স্কুলবালিকা থেকে শ্রমজীবী নারী, কারাবন্দীর উদ্বিগ্ন স্ত্রী এবং অবশেষে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কৃষাণীতে পরিণত হয়েছেন।[৩] এরপর তিনি কিমিসাবুরো ইয়োশিমুরার আঞ্জো-কে নো বুতোকাই (Anjō-ke no butōkai, ১৯৪৭) চলচ্চিত্রে এবং কেইসুকে কিনোশিতার হিয়ারস টু দ্য গার্ল (১৯৪৯) চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এই চলচ্চিত্রসমূহে তিনি "নব্য" জাপানি নারী চরিত্রে অভিনয় করেন, যারা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান হতে যাচ্ছে।[১]আঞ্জো-কে নো বুতোকাই চলচ্চিত্রে তাকে এক সংস্কৃতিমনা পরিবারের কন্যা চরিত্রে দেখা যায়, যারা যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বাড়ি ছেড়ে দিয়ে নতুন জীবনের সন্ধান করছে; অন্যদিকে হিয়ারস টু দ্য গার্ল চলচ্চিত্রে তাকে প্রায় ধ্বংসের নিকটবর্তী এক অভিজাত পরিবারের কন্যা চরিত্রে দেখা যায়, যে এক ফ্যাক্টরি শ্রমিকের সাথে প্রণয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়।[২]
ইয়াসুজিরো ওজুর পরিচালনায় হারা অভিনীত ছয়টি চলচ্চিত্রের প্রথম চলচ্চিত্রটি হল বানশুন (১৯৪৯)। তাদের এই যুগলবন্দী আরও ১২ বছর অক্ষুণ্ণ ছিল। বানশুন চলচ্চিত্রে তিনি নোরিকো চরিত্রে অভিনয় করেন, যে তার পরিবারের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও বিয়ে না করে বাড়িতে থেকে পিতার দেখাশুনা করে। এতে নোরিকো তার বিবাহের বয়স পার করেছেন এবং তার বিপত্নীক পিতার সাথে বসবাস করছেন। তার পিতা মনে করেন সে তিনি তাকে বিবাহ থেকে দূরে রেখেছেন, তাই তিনি তাকে স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য পুনরায় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন।[৩] তিনি একই চরিত্রে আরও দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন এবং তার এই চরিত্রের নামানুসারে এই চলচ্চিত্র ধারবাহিকের নাম রাখা হয় নোরিকো ত্রয়ী। এই ত্রয়ী চলচ্চিত্রের পরবর্তী চলচ্চিত্র বাকুশু, এই চলচ্চিত্রের চরিত্রটি পূর্ববর্তী চলচ্চিত্রটির সাথে সম্পর্কিত নয়। এতে দেখা যায় ২৮ বছর বয়সী নোরিকো তার বৃদ্ধ পিতামাতা, বড় ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী ও তাদের দুই পুত্রের সাথে বসবাস করে। তাকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে কিন্তু সে পরিবারের অনুমতি ছাড়াই তার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে।[৩] এই ত্রয়ীর শেষ চলচ্চিত্র তোকিও মনোগাতারি (১৯৫৩) পরিচালক ওজু ও তার সর্বাধিক স্মরণীয় কাজ। এতে তিনি একজন বিধবার চরিত্রে অভিনয় করেন, যার স্বামী যুদ্ধে মারা গেছেন। তার শ্বশুর-শাশুড়ী তাকে পুনরায় বিয়ে করতে বললেও তাদের প্রতি গভীর অনুরাগের কারণে তিনি পুনরায় বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানান।[৪]দ্য নিউ বায়োগ্রাফিক্যাল ডিকশনারি অব ফিল্ম-এ ডেভিড টমসন লিখেন, "গার্বোর মত হারাও নারীত্ব, অভিজাত্য ও সুহৃদত্যার আদর্শ মান প্রদর্শন করেছেন। এবং গার্বোর মত তিনিও জনগণকে দূরে রেখেছেন।"[২] এই তিনটি চলচ্চিত্রে তার অভিনয়ের জন্য হারা "চিরন্তন কুমারী" (Eternal Virgin) ডাকনামে পরিচিতি লাভ করেন।[৩]