মৌলভী আব্দুল করিম (১৮৬৩-১৯৪৩) হলেন একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয়তাবাদী কর্মী ।[১][২]
বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষাবিস্তারে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সমাজসেবক হিসেবে তাঁকে হাজী মোহাম্মদ মুহসিনের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
প্রারম্ভিক জীবন
১৮৬৩ সালে সিলেটের পাঠানটোলায় মৌলভী আবদুল করিমের জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন মহম্মদ নাদির। তিনি ১৮৮১ সালে সিলেট সরকারি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং ১৮৮৬ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন।[১] তাঁর ভাতিজা হলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামীদ এবং তাঁর ভাতিজি হাফিজা বানু ছিলেন আইনজীবি আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ সাহেবের মা এবং বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল কালাম আব্দুল মোমেন ও জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাঁতুনের দাদী।[৩]
কর্মজীবন
কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক [১][২][৪] হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে তিনি ১৮৮৯ সালে ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট ইন্সপেক্টর অব স্কুল ফর মহামেডান এডুকেশন’ নিযুক্ত হন এবং পরে বিভাগীয় ‘স্কুল ইন্সপেক্টর’ পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ব্রিটিশ আমলে মুসলমানদের মধ্যে তিনি এবং মোহাম্মদ ইব্রাহিম প্রথম এরূপ পদমর্যাদার অধিকারী হন।[১]
মুসলমানদের শিক্ষাবিস্তারে অবদান
ওই সময়ে বাংলার মুসলিম সমাজ শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে ছিল। তাই স্বসম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার তাঁর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ছিল। দেশের বিদ্যালয়গুলোতে মুসলমান শিক্ষকের অভাব এবং পাঠ্যসূচিতে ইসলামী বিষয় অন্তর্ভুক্ত না থাকায় মুসলমান ছাত্ররা পড়াশোনায় অনীহা প্রকাশ করে Mohammedan Education in Bengal (১৯০০) গ্রন্থে আবদুল করিম এরূপ চিত্র তুলে ধরে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি এ বিষয়ে অনেকটা সফলতাও অর্জন করেন। পাঠ্যপুস্তকের অভাব দূর করার জন্য তিনি নিজেই গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্বের ইতিবৃত্ত (১৮৯৮) তাঁর এরূপ একটি গ্রন্থ, যা স্কুলের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি গ্রন্থখানি জনশিক্ষা ডাইরেক্টর সি.এ মার্টিনের নামে উৎসর্গ করেন। রবীন্দ্রনাথ ভারতী (শ্রাবণ ১৩০৫) পত্রিকায় এর প্রশংসাসূচক সমালোচনা লেখেন। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আবদুল করিম বাঙালি মুসলমানদের নবজাগরণের একজন কর্মী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার করে নিউ স্কিম পদ্ধতি প্রবর্তন আবদুল করিমের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি। ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষাদান ছিল এ পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এতে মাদ্রাসায় শিক্ষিত ছাত্রদের চাকরি ও বৈষয়িক জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়। Prophet of Islam and His Teachings এবং Islam: Universal Religion of Peace and Progress নামে তিনি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর মহত্ত্ব ও ইসলামের গৌরবসূচক দুটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এ ছাড়া তাঁর আরও কয়েকখানা গ্রন্থ হলো: ভারতবর্ষের ইতিহাস, মক্তব ও মাদ্রাসার বর্তমান শিক্ষাপ্রণালী ও তার সংস্কার, Hints on English Pronunciation, Hints on Class Management and Method of Teaching, History of Hindu-Muslim Pact ইত্যাদি। তিনি বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ও আরবিতে সমান দক্ষ ছিলেন।
কলকাতায় আবদুল করিমের দুটি বাড়ি ছিল। সেখানে তিনি সেসব দরিদ্র মুসলিম ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন, যাদের কলকাতায় থাকার সামর্থ্য ছিল না। তিনি ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী নেতা। তিনি মুসলিম ছাত্রদের সংগঠিত হওয়া এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছিলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ১৯১৯ সালে মুসলিম ছাত্র সম্মেলন এবং ১৯৩০ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি মুসলিম লীগ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি বেঙ্গল মুসলিম কনফারেন্সেের সভাপতি হন।
আবদুল করিম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো (১৮৯৫), এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সদস্য (১৮৯৬), বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সভাপতি (১৯১৫) এবং কাউন্সিল অব স্টেটের সদস্য ছিলেন। ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট এর তিনি ছিলেন অন্যতম স্থপতি। এতে সেকালের বৌদ্ধিক সমাজে তাঁর প্রভাব ও মর্যাদা স্বীকৃত হয়।[১]
রচিত গ্রন্থ
- ভারতবর্ষের ইতিহাস
- ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্বের ইতিবৃত্ত
- ইসলামিক কন্ট্রিবিউশান টু সাইন্স এন্ড সিভিলাইজেশ্যন
- মোহামেডান এডুকেশন ইন বেঙ্গল
- হিস্ট্রি অব হিন্দু- মুসলিম প্যাক্ট
- প্রফেট অব ইসলাম এন্ড হিজ টিচিংস
- ইসলামঃ ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন অব পিস এন্ড প্রোগ্রেস
- উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমানের চিন্তা চেতনার ধারা
- মক্তব ও মাদ্রাসার বর্তমান শিক্ষাপ্রণালী ও তার সংস্কার ইত্যাদি
মৃত্যু
১৯৪৩ সালে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।[১]
তথ্যসূত্র