মুশতাক মোহাম্মদ (উর্দু: مشتاق محمد; জন্ম: ২২ নভেম্বর, ১৯৪৩) তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জুনাগড় ও মনবদর (বর্তমান: গুজরাত, ভারত) এলাকায় জন্মগ্রহণকারী পাকিস্তানের সাবেক ও বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তারকা এবং অধিনায়ক। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৯ সময়কালে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। দলে তিনি মূলতঃ অল-রাউন্ডার হিসেবে খেলতেন। ডানহাতি ব্যাটসম্যান ও লেগ স্পিনার ছিলেন তিনি।
সাম্প্রতিককালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেট দলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এরপর পাকিস্তান টেলিভিশনে ধারাভাষ্য কর্মে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে দেশে ফিরে আসেন।
শৈশবকাল
শৈশবে করাচির চার্চ মিশন স্কুলে (সিএমএস) ভর্তি হন।[১] মা ‘আমির বি’ ভারতের স্বাধীনতার পূর্বেকার জাতীয় ব্যাডমিন্টন ও টেবিল টেনিসের শিরোপাধারী ছিলেন। ভারত বিভাগের পর তাদের পরিবার করাচিতে চলে যায়। হানিফ, সাদিক এবং ওয়াজির - ভাইত্রয় সকলেই পাকিস্তানের দলের হয়ে খেলেছেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মুশতাকের অবস্থান তৃতীয়। ভাইপো শোয়েব মোহাম্মদ ও ভাই রইছ মোহাম্মদ একসময় পাকিস্তান দলের দ্বাদশ খেলোয়াড় ছিলেন। তার চার ভাইপো প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট খেলেছেন।
প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট
১৩ বছর ৪১ দিন বয়সে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে মুশতাক মোহাম্মদের অভিষেক ঘটে। ঐ খেলায় তিনি ৮৭ রান সংগ্রহের পাশাপাশি ৫/২৮ লাভ করেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে করাচি ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
এছাড়াও, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ সময়কালে নর্দাম্পটনশায়ারের সদস্যরূপে প্রথম-শ্রেণীর ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে অংশ নেন। প্রত্যেক মৌসুমেই সহস্রাধিক রান তুলেছেন। ইংল্যান্ডে পাকিস্তানের সফরকালীন কাউন্টি দলে অবস্থান করেন। এ সময়ে সফরকারী দলের পক্ষে কেবলমাত্র টেস্ট খেলাগুলোয় অংশ নিতেন ও অল্প কিছু অন্যান্য খেলায় অংশগ্রহণ ছিল তার।
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সময়কালে নর্দাম্পটনশায়ারের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন মুশতাক মোহাম্মদ। তন্মধ্যে, ১৯৭৬সালে জিলেট কাপের শিরোপা জয়ের মাধ্যমে কাউন্টির ইতিহাসের প্রথম ট্রফি লাভের স্মরণীয় জয়ে প্রভূতঃ ভূমিকা রাখেন। ঐ বছরই কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপে দ্বিতীয় স্থান দখল করে সেরা অবস্থানে ভাগ বসান।
তবে তার অধিনায়কের দায়িত্বকাল কিছুটা বিতর্কের মাধ্যমে শেষ হয়। ১৯৭৮ সালের উইজডেন সংস্করণে উল্লেখ করা হয় যে, মুশতাক পদত্যাগ করেছেন। এতে তিনি তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কথা তুলে ধরেন ও কিছুটা গুজব রয়েছে যে, সাবেক অধিনায়কের দায়িত্ব পালনকারী জিম ওয়াটসকে পুনরায় দায়িত্ব দেয়া হবে।
মুশতাক মোহাম্মদ অস্ট্রেলিয়ায় খেলার জন্য কেরি প্যাকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু, কাউন্টি দলের সভাপতি বিশ্রাম কক্ষে রাজনীতি করার বিষয়ে কটাক্ষ করেন। এরপর নর্দান্টসের পক্ষে আর খেলেননি তিনি।
সমগ্র প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবনে ৫০২ খেলায় অংশ নিয়ে ৭২টি শতক হাঁকিয়েছেন মুশতাক মোহাম্মদ। প্রথম পাকিস্তানি হিসেবে ২৫,০০০ রান তুলেন ও অবসর গ্রহণ শেষে এ রান দাঁড়ায় ৩১,০৯১। অর্ধেকেরও অধিক রান তুলেছিলেন নর্দাম্পটনশায়ারে খেলে। তন্মধ্যে, অপরাজিত ৩০৩ রানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল। রিস্ট স্পিনার হিসেবে লেগ ব্রেক, গুগলি ও ফ্লিপার বোলিং করতেন।
টেস্ট ক্রিকেট
সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনে ৫৭ টেস্ট ও ১০টি একদিনের আন্তর্জাতিকে অংশ নেয়ার সুযোগ হয় তার। ২৬ মার্চ, ১৯৫৯ তারিখে লাহোরে সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয় তার। এরফলে টেস্ট ক্রিকেট আঙ্গিনায় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ওয়াজির মোহাম্মদ ও হানিফ মোহাম্মদের পর খেলার সুযোগ পান।
১৫ বছর ১২৪ দিন বয়সে তিনি তৎকালীন সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট ক্রিকেটারের সম্মাননা লাভ করেন। তবে, প্রকৃত বয়স নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়ে গেছে। খেলায় তিনি মাত্র ১৮ রান তুলতে সমর্থ হন। খেলায় তার দল ইনিংস ও ১৫৬ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজয়বরণ করে। সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনে ১০টি টেস্ট শতক হাঁকান। নিজস্ব ৬ষ্ঠ টেস্টে স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠে ১০১ রান তুলে প্রথম সেঞ্চুরি করেন। তার মতে, তখন তার বয়স ছিল ১৭ বছর ৭৮ দিন। ফলে এটি তৎকালীন রেকর্ডের পর্যায়ে গড়ায় তার সেঞ্চুরিটি। এ রেকর্ডটি ৪০ বছরের অধিককাল টিকে থাকে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের কৃতী ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ আশরাফুল রেকর্ডটি নিজের করে নেন।
পরবর্তী সেঞ্চুরিটি করেন ১৯৬২সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। এর পরেরটি করার জন্য তাকে নয় বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৯৭০ সালে বহির্বিশ্ব একাদশের সদস্যরূপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ খেলেন। পরবর্তীকালে এ সিরিজের টেস্ট মর্যাদা কেড়ে নেয়া হয়।
১৯৭৩ সালের শুরুতে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১২১ ও এক মাস পর নিজের পরেে খেলায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১ রান তুলেন। পরের খেলাটিতে ডেনিস অ্যাটকিনসনের পর দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে টেস্টে দ্বি-শতক ও পাঁচ উইকেট লাভের বিরল কৃতিত্বের দাবীদার হন। ঐ বছর ৮৬.৩৩ গড়ে ৭৭৭ রান সংগ্রহ করেন তিনি।
১৯৭০-এর দশকে রিভার্স সুইপ ব্যবহারে অন্যতম প্রথম ক্রিকেটার ছিলেন মুশতাক মোহাম্মদ। তবে কখনো কখনো জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হানিফ মোহাম্মদকে এর আবিষ্কারকরূপে চিত্রিত করা হয়ে থাকে। বিখ্যাত ক্রিকেট কোচ বব উলমার স্ট্রোকটিকে বৈশ্বিকভাবে জনপ্রিয় করে তোলেন।[২][৩]
অধিনায়কত্ব লাভ
পাকিস্তানের অন্যতম সেরা ও সফলতম অল-রাউন্ডার হিসেবে জাতীয় দলকে উনিশ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রথম ও অদ্যাবধি একমাত্র পাকিস্তানি হিসেবে একই টেস্টে দুইবার সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট পেয়েছেন।[৪]
১৯৭৬-৭৭ মৌসুম থেকে ১৯৭৮-৭৯ মৌসুম পর্যন্ত পাকিস্তান দলের অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে ১৯ টেস্ট খেলেন। এ সময়েই ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে পোর্ট অব স্পেনের কুইন্স পার্ক ওভালে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১২১ ও ৫৬ রান তোলার পাশাপাশি ৮ উইকেট লাভ করে দূর্লভ জয় তুলে নেন। দীর্ঘ আঠারো বছর পর ১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে ভারতের বিপক্ষে প্রথম সিরিজে পাকিস্তানকে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়ে নেতৃত্ব দেন।
অবসর
সত্তরের দশকের শেষদিকে কেরি প্যাকারের বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে যোগ দেন। এরপর পাকিস্তান দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন ও দলকে ১৯৯৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের চূড়ান্ত খেলায় দলকে পরিচালনা করেন।