লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী হলেন ২০০৭-০৮-এ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের (এক-এগারো নামে পরিচিত) সময়কার একজন আলোচিত সাবেক সেনা কর্মকর্তা[১][২][৩] ও একাদশ জাতীয় সংসদ সদস্য। তিনি ফেনী-৩ আসন থেকে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯ম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তিনি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
প্রারম্ভিক জীবন
মাসুদ উদ্দিন ১৯৫৪ সালের ৩০ জুন ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের সুলাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[৩][৪] তার পিতার নাম এন এ চৌধুরী ও মাতার নাম নূর-উন-নেছা খানম।[৫] শিক্ষাজীবনে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন
মাসুদ উদ্দিন ১৯৭৫ সালের ১ মে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয় এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট (এক-এগারো নামে পরিচিত) শুরু হয়। এ সময় মাসুদ উদ্দিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯ম পদাতিক ডিভিশনের প্রধান (জিওসি) ছিলেন।[৩] একই বছর তিনি মেজর জেনারেল থেকে পদোন্নতি পেয়ে লেফট্যানেন্ট জেনারেল হন। বাংলাদেশের এ রাজনৈতিক সংকটে মাসুদ উদ্দিন অন্যতম একজন সংগঠক ছিলেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে।[১][৬] অভিযোগ রয়েছে, সে সময় তিনি তার অধীনস্থ ব্যাটালিয়নের সহযোগিতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ভবন, বঙ্গভবনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন।[২] তিনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।[২]
তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করতে গুরুতর অপরাধ দমন সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করে যার প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পান মাসুদ উদ্দিন।[৩] ২০০৮ সালের ২ জুন তাকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার থেকে ডিফেন্স সার্ভিসেস কম্যান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের কমান্ড্যান্ট পদে ও ৮ জুন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।[৬] এরপর একই বছর ২ সেপ্টেম্বর তাকে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হয়।[৬] ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর তিনি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১১ সালের ২৯ জুন তার চাকুরীর মেয়াদ শেষ হলেও পরবর্তীতে তার মেয়াদ বাড়ানো হয় এবং ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর অবসর গ্রহণ করেন।[৬]
রাজনৈতিক জীবন
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে মাসুদ ফেনী-৩ (সোনাগাজী-দাগনভূঞা) আসনে নির্বাচনে আগ্রহী প্রার্থী হিসেবে প্রথমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করেন।[৭] তবে আওয়ামী লীগ আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়ার গুঞ্জন উঠলে তিনি আওয়ামী লীগের পরামর্শে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন ও জাতীয় পার্টির হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন।[৩] এ সময় তাকে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করা হয় এবং তিনি পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান।[৮] পরে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে তিনি ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে ফেনী-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।[৯][১০]
২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে ফেনী-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে অসহযোগ আন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারত পালিয়ে গেলে পরদিন ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙ্গে দিলে তিনি সংসদ সদস্য পদ হারান।[১১][১২][১৩]
ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন
মাসুদ উদ্দিন ব্যক্তিগত জীবনে জেসমিন মাসুদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।[১৪] এই দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ভাই মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দার মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর বোনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।[১][৭]
সমালোচনা
মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেনা প্রধান মঈন উদ্দিন আহমেদকে সামনে রেখে ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তত্বাবধায়ক সরকার বসানোর মূল পরিকল্পনা ছিলো তারই ছিল।[৩][১৫][১৬][১৭]
সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগদানের পূর্বে তিনি রক্ষী বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি চট্টগ্রামে কসকরের ট্যালী ক্লার্ক ছিলেন। দুর্ভিক্ষের সময় তিনি রিলিফ হিসাবে আসা ২ ট্রাক নারিকেল তৈল চোরাকারবারীদের কাছে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দেন, যা ময়মনসিংহে খালাস হয়। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় মাসুদসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলা হতে বাঁচার জন্যই রক্ষী বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পরে রক্ষী বাহিনী বিলুপ্ত করে এ বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিগ্রেডে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ষষ্ঠ জেআরবি হতে মাসুদের অন্তর্ভুক্তি হয় সেনাবাহিনীতে।[৩][১৬]
তথ্যসূত্র