বনবিবি

বনবিবি
বনবিবি মন্দির, দোবাঁকি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ
অন্তর্ভুক্তিদেবী (লৌকিক)
বাহনবাঘ বা মুরগি
অঞ্চলসুন্দরবন (পশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশ)

বনবিবি হলেন বাংলাদেশভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত সুন্দরবন অঞ্চলে মৎস্যজীবী, মধু-সংগ্রহকারী ও কাঠুরিয়া জনগোষ্ঠীর দ্বারা পূজিত এক লৌকিক দেবী তথা পিরানি। উক্ত জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বনবিবির পূজা করে।[] বনবিবি বনদেবী, বনদুর্গা, ব্যাঘ্রদেবী বা বণচণ্ডী নামেও পরিচিত।

কোনও কোনও মন্দিরে তিন ব্যাঘ্র-দেবদেবী বনবিবি, দক্ষিণরায় ও কালুরায় একসঙ্গে পূজিত হন। আবার কোথাও বনবিবি-শাজঙ্গুলির যুগ্ম বিগ্রহও পূজিত হতে দেখা যায়।[] জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর গভীর ফরেস্টের প্রতি বছর শীতে এই বন দুর্গা পুজো তথা মেলার আয়োজন হয়

ইতিহাস

দয়াপুর বনবিবি মন্দির, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা

ভারতবাংলাদেশ উভয় দেশের সুন্দরবন অঞ্চলেই মৎস্যজীবী, মধু-সংগ্রহকারী ও কাঠুরিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেতে বনবিবির পূজা করেন। ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোহর খুলনার ইতিহাস গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী, ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সুন্দরবন এলাকায় দক্ষিণরায়, বণিক ধোনাই ও মোনাই এবং গাজীর অস্তিত্বের কথা জানা যায়। বনবিবি ছিলেন ইব্রাহিম (মতান্তরে বেরাহিম) নামে এক আরবের কন্যা। ইব্রাহিমের স্ত্রী গুলাল বিবি সতীনের প্ররোচনায় সুন্দরবনে পরিত্যক্ত হলে সেখানেই বনবিবির জন্ম হয়। কথিত আছে, গুলাল বিবি মদিনা এবং ইব্রাহিম মক্কা হতে আগত ছিলেন। দক্ষিণরায় ছিলেন যশোহরের ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের অধীনস্থ ভাটির দেশের সামন্ত। দক্ষিণরায়ের সঙ্গে বনবিবির একাধিক যুদ্ধ হয়। শেষে দক্ষিণরায় পরাজিত হয়ে সন্ধি করেন। দক্ষিণরায়ের পরাজয়কে এই গ্রন্থে বাঘ বা অপশক্তির পরাজয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে উভয় দেশের সুন্দরবন অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেন বনবিবি।[]

বনবিবির মাহাত্ম্যবিষয়ক কাব্যের নাম "বনবিবির জহুরানামা"। এই কাব্য মঙ্গলকাব্যের শৈলীতে রচিত হলেও এতে আল্লাহ্-রসুল, মক্কা, পির-পিরানি ইত্যাদি প্রসঙ্গ যুক্ত হয়েছে। অরণ্যচারী মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও জীবনযাত্রার একটি চিত্র এতে পাওয়া যায়।[] গবেষকদের মতে, বনবিবি প্রকৃতপক্ষে হিন্দু দেবী বনদুর্গা, বনচণ্ডী, ষষ্ঠী বা বিশালাক্ষী। বাংলায় ইসলামি প্রভাবে তিনি বনবিবিতে পরিণত হয়েছেন।[]

কিংবদন্তি

বনবিবির কিংবদন্তিগুলি "বনবিবির কেরামতি" (বনবিবির অলৌকিক কার্যাবলি) ও "বনবিবির জহুরানামা" (বনবিবির গৌরবগাথা) নামে কয়েকটি লোককাব্যে পাওয়া যায়। এই কাব্যের কবিদের মধ্যে বায়ানউদ্দীন ও মোহাম্মদ খাত্তর বিশেষ পরিচিত এবং উভয়ের গ্রন্থের বিষয়বস্তুর মধ্যে অনেক সাদৃশ্য দেখা যায়।[] এই কাহিনির দু’টি প্রধান পর্ব: দক্ষিণরায়ের সঙ্গে যুদ্ধ ও দুখের বিবরণ।

দক্ষ‌িণরায়ের সঙ্গে যুদ্ধ

কিংবদন্তি অনুযায়ী, বনবিবি হলেন মক্কা থেকে আসা ইব্রাহিম ফকিরের (স্থানীয় নামে বেরাহিম) কন্যা। ইব্রাহিমের প্রথমা পত্নী ফুলবিবি নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি এক শর্তে স্বামীকে পুনরায় বিবাহের অনুমতি দেন। ইব্রাহিম বিবাহ করেন গুলালবিবিকে। এই সময় আল্লাহ্ বিশেষ উদ্দেশ্যে স্বর্গ থেকে বনবিবি ও শাহ জঙ্গলীকে গুলালবিবির সন্তান রূপে জন্মগ্রহণের নির্দেশ দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। গুলালবিবি গর্ভবতী হলে ইব্রাহিম ফুলবিবির শর্তানুসারে তাঁকে বনভূমিতে ফেলে আসেন। এই বনেই বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী জন্মগ্রহণ করেন। তাদের যত্ন নেওয়ার জন্য আল্লাহ্ স্বর্গ থেকে চারজন দাস প্রেরণ করেন। গুলালবিবি শাহ জঙ্গলীর হাতে বনবিবিকে রেখে চলে গেলেন। বনবিবি বনেই বড়ো হতে থাকেন। সাত বছর পর ইব্রাহিম নিজের ভুল বুঝতে পেরে দুই সন্তানসহ গুলালবিবিকে মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে যান।

একবার প্রার্থনার সময় বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী দু’টি জাদু-টুপি পেয়েছিলেন। ওই টুপির সাহায্যেই তাঁরা হিন্দুস্তানে আঠারো ভাটির দেশে (সুন্দরবন) চলে যান (অপর বর্ণনা অনুসারে, তাঁদের জিব্রাইলের আঠারো জনের দেশে আনা হয়েছিল)। সেখানে পৌঁছে শাহ জঙ্গলী প্রার্থনায় বসেন। আঠারো ভাটির দেশে সেই সময় দানবরাজ দক্ষিণরায়ের নিয়ন্ত্রণে ছিল। শাহ জঙ্গলীর প্রার্থনার শব্দ পেয়ে তিনি বন্ধু সনাতন রায়কে খোঁজ নিয়ে পাঠান। পরে সনাতনের বনবিবি ও শাহ জঙ্গলীর কথা শুনে দক্ষিণরায় তাঁদের এলাকা থেকে বিতাড়ণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যখন যুদ্ধে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর মা নারায়ণী তাঁকে বাধা দেন এবং নিজেই ভূত-প্রেতের সেনাবাহিনী নিয়ে বনবিবির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাত্রা করেন। দীর্ঘ যুদ্ধের পর বনবিবি নারায়ণীকে পরাজিত করেন। কিন্তু করুণাবশত তিনি নারায়ণীকে রাজ্যের অর্ধেক ও পুত্রকে ফিরিয়ে দেন। এরপর নারায়ণীর সঙ্গে বনবিবির সখ্যতা স্থাপিত হয়।[] সুন্দরবনের অধিবাসীরা এখানকার জনবসতি অঞ্চলকে বনবিবির রাজ্য হিসেবে স্বীকার করলেও দক্ষিণরায়কে তাঁরা গভীর জঙ্গলের শাসক মনে করেন।

দুখের বিবরণ

বারিজহতি গ্রামে ধনাই ও মানাই নামে দুই ‘মৌলি’ (মধু-সংগ্রহকারী) বাস করত। তারা ছিল দুই ভাই। আঠারো ভাটির দেশের একটি ‘মহলে’ (ঘন জঙ্গল) মধ্য সংগ্রহের জন্য ধনাই সাতটি নৌকা নিয়ে এক অভিযানের ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু মানাই তাকে বাধা দেয়। অবশেষে গরিব মেষপালকের ছেলে দুখেকে সঙ্গে নিয়ে ধনাই অভিযান করে। নৌকা ছাড়ার আগে দুখের মা দুখেকে বিপদে পড়লে বনবিবিকে স্মরণ করতে বলেছিলেন। ডাকাত রায়ের রাজত্বের অংশ কেন্দুখালির চরে পৌঁছে তারা দক্ষিণরায়কে উপঢৌকন দিতে ভুলে গিয়েছিল। তাই তিন দিন তারা মধু সংগ্রহে অসমর্থ হয়। তৃতীয় রাতে দক্ষিণরায় স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাদের নরবলির নির্দেশ দেয়। দক্ষিণরায়ের সঙ্গে কিছু কথা-কাটাকাটির পর লোভী ধনাই মধু ও মোমের বিনিময়ে দুখেকে উৎসর্গ করতে রাজি হয়। তারপর প্রচুর পরিমাণে মোম ও মধু সংগ্রহ করে সে দুখেকে ফেলে রেখে গ্রামে ফিরে আসে। এদিকে বাঘের ছদ্মবেশে দক্ষিণরায় দুখেকে হত্যা করতে গেলে সে দেবীকে স্মরণ করে। দুখের প্রার্থনা শুনে বনবিবি ও তাঁর ভাই জঙ্গলী এসে উপস্থিত হন। দক্ষিণরায়কে পরাজিত করেন জঙ্গলী। পরাজিত দক্ষিণরায় খান গাজীর (গাজী পীর) আশ্রয় নেন। বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী দক্ষিণরায়কে ধাওয়া করে খান গাজীর কাছে উপস্থিত হন। অবশেষে গাজী দক্ষিণরায়ের ক্ষতি না করার জন্য বনবিবিকে রাজি করান। পরিবর্তে গাজী দুখেকে সাতটি মূল্যবান কার্টুলি দিয়েছিলেন এবং দক্ষিণরায় তাকে দিয়েছিলেন প্রচুর মো ও মধু। বনবিবির আদেশে তাঁর পোশাক মুরগিরা দুখেকে তার গ্রামে রেখে আসে। গ্রামে ফিরে দুখে বনবিবির পূজাকে জনপ্রিয় করে তোলে। পরবর্তীকালে সে ধনাইয়ের মেয়ে চম্পাকে বিয়ে করে এবং গ্রামের ‘চৌধুরী’ (প্রধান) হয়।[]

বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার সুন্দরবন অঞ্চলে বনবিবিকে নিয়ে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে:[]

এক সওদাগরের দুই সুন্দরী স্ত্রী ছিলেন। ছোটো বউয়ের চক্রান্তে সন্তানসম্ভবা বড়ো বউ গুলালবিবি সুন্দরবনে নির্বাসিতা হন। কয়েকদিন পর সেখানেই যমজ পুত্র-কন্যার জন্ম দিয়ে তার মৃত্যু হয়। সদ্যোজাত শিশু দু'টির কান্না শুনে বনের বাঘ, কুমির, হরিণ, অজগর, বানস সবাই ছুটে আসে। তারাই দুই ভাইবোনকে লালনপালন করে বড়ো করে তোলে। ছেলেটি বড়ো হয়ে বাঘের রাজা এবং মেয়েটি বনবিবি নামে পরিচিত হয়। স্থানীয় বিশ্বাসে এই বনবিবি হলেন মানুষের রক্ষাকর্ত্রী। তারা মনে করেন, বনের বাওয়ালি-মৌলেরা বাঘের মুখে পড়লে বনবিবির নাম স্মরণ করে মন্ত্র পড়ে আর সঙ্গে সঙ্গে বাঘও দৌড়ে পালিয়ে যায়। অদ্যাবধি স্থানীয় মানুষ বনে কাজে যাওয়ার আগে বনবিবির পূজা করে।

মূর্তি

বনবিবি হিন্দুসমাজে বনদুর্গা, বনচণ্ডী বা বনদেবী নামেও পূজিতা হন। তিনি মাতৃদেবতা, ভক্তবৎসলা ও দয়ালু। তাঁর মূর্তিও সুশ্রী ও লাবণ্যময়ী। হিন্দুদের পূজিতা মূর্তিতে তাঁর গায়ের রং হলুদ, মুকুট, কণ্ঠহার ও বনফুলের মালা পরিহিতা এবং লাঠি অথবা ত্রিশূলধারিণী। মুসলমান সমাজে বনবিবি পিরানি হিসেবে পরিচিত। ইসলামি-প্রভাবান্বিত মূর্তিগুলিতে তিনি টিকলির সঙ্গে টুপি পরিধান করেন, চুল বিনুনি করা, ঘাগরা-পাজামা বা শাড়ি এবং জুতো পরিহিতা। তবে উভয় মূর্তিকল্পেই তাঁর কোলে পুত্র রূপে দুখেকে দেখা যায়। বনবিবির বাহন বাঘ বা মুরগি।[]

পূজা

জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর ফরেস্টে বনদুর্গার পূজা ও মেলা

শিলিগুড়ি শহর লাগোয়া ডাবগ্রাম ফুলবাড়ি বিধানসভার অন্তর্গত বৈকন্ঠপুর জঙ্গলে প্রায় দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার ভেতরে গেলে দেখা মিলবে বনদুর্গা মন্দিরের। অথবা জলপাইগুড়ির বেলাকোবা থেকে 21 কিমি দূরে গাজোলডোবা সংলগ্ন জঙ্গলের এলাকা পথ দিয়ে যাওয়া যায় এখানে।এই পুজোয় লক্ষাধিক ভক্তের সমাগম হয়। এই বনদূর্গা পূজো দেখতে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, কোচবিহার এমনকি পার্শ্ববর্তী রাজ্য আসাম এবং বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ এসে থাকেন এই পুজো দেখতে।

দিল্লি ভিটা, চাঁদের খাল জায়গাটি সকলের কাছে অপরিচিত হলেও বন দুর্গার মন্দির হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। পৌষ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে, এই মন্দিরে বনদুর্গা পূজা হয়ে থাকে। কথিত রয়েছে দেবী চৌধুরানী নৌকা করে করতোয়া নদী হয়ে এখানে আসতেন। ভবানী পাঠক এবং দেবী চৌধুরানীর গোপন আস্তানা ছিল এই জায়গা। তখন অবশ্য ঠুনঠুনি মা বলে এখানে দেবী পুজিত হতো। এখন এটি বনদুর্গা বলেই সকলের কাছে পরিচিত। বৈকুন্ঠপুর এর জঙ্গলের মাঝে এর অবস্থান।

জানা গিয়েছে, ব্রিটিশ আমলে এই পুজোর সূচনা করেছিলেন দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠক। সেই থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি বছর বৈকুন্ঠপুরের গভীর জঙ্গলে এই পুজো হয়েছে আসছে।প্রথমে এই পুজোকে ঠুনঠুনির পুজো বলা হতো।পরবর্তীতে ৪১ বছর ধরে একটি নতুন কমিটি গঠন করে মা বনদূর্গা পূজোর নাম করে পুজোর আয়োজন করে আসছেন উদ্যোগতারা। তবে বর্তমানে একে বনদুর্গা মায়ের পুজো বলে এখানে প্রতি বছর পৌষমাসে এর পুজো করা হয়। রাজগঞ্জে বৈকন্ঠপুর জঙ্গলে দিল্লী ভিটা চাঁদের খালে অনুষ্ঠিত হয় বনদুর্গা পুজো।

বনবিবি অরণ্যের দেবী রূপে কল্পিত এবং অরণ্যচারী মানুষের দ্বারা পূজিত। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, তিনি কখনও মুরগি বা কখনও বাঘের রূপ ধারণ করেন। ভক্তবৎসলা এই দেবীর কারও প্রতি আক্রোশ নেই বলেই কথিত। সুন্দরবনের মৎস্যজীবী, ‘বাউয়ালি’ (কাঠুরিয়া) ও ‘মৌলে’রা (মধু-সংগ্রহকারী) তাঁকে রক্ষয়িত্রী জ্ঞানে পূজা করেন। তাঁদের ধারণা, বনের বাঘ ও ভূত-প্রেত প্রভৃতি অপশক্তির উপর কর্তৃত্ব করেন বনবিবি। তাই গভীর বনে কাঠ, গোলপাতা, মধু ও মোম সংগ্রহ করতে বা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে তাঁরা বনবিবির উদ্দেশ্যে সিন্নি, ক্ষীর ও অন্নভোগ নিবেদন করেন। প্রতি বছর মাঘ-ফাল্গুন মাস নাগাদ বনবিবির বাৎসরিক পূজা হয়। এই পূজায় ব্রাহ্মণেরা পৌরোহিত্য করেন না, করেন নিম্নবর্ণীয় হিন্দুরা। বনবিবির পূজায় নিরামিষ নৈবেদ্য নিবেদনের রীতি আছে, বলি হয় না; কখনও বা তাঁর নামে জীবন্ত মুরগি ছেড়ে দেওয়া হয়।[]

ড. দেবব্রত নস্করের মতে, বৃহত্তর চব্বিশ পরগনার পার্শ্ববর্তী মেদিনীপুর অঞ্চল এবং সেই সঙ্গে বাঁকুড়াহুগলি প্রভৃতি জেলার আদিবাসী ও উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা পৌষ সংক্রান্তি বা ১ মাঘ যে বড়াম বা বড়ামচণ্ডীর পূজা করেন, তার সঙ্গে চব্বিশ পরগনার বনবিবি-পূজার সাদৃশ্য পাওয়া যায়। হাতি ও বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষালাভের উদ্দেশ্যে বড়ামচণ্ডীর পূজা প্রচলিত এবং এই পূজাতেও ঘুড়ি ওড়ানোর চল রয়েছে। বনবিবির পূজা করা হয় বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এবং এই পূজাতেও ঘুড়ি ওড়ানোর প্রথা রয়েছে। বড়ামচণ্ডীর সঙ্গে চব্বিশ পরগনার অপর দেবী নারায়ণীর সাদৃশ্যও লক্ষিত হয়। বড়ামচণ্ডী ও নারায়ণী উভয়েরই লতাপাতা আঁকা মুণ্ডমূর্তির পূজা প্রচলিত। উভয় পূজাতেই পশুপাখি বলি ও নাচগানের আয়োজন করা হয় এবং উভয় পূজায় আয়োজিত হয় পৌষ সংক্রান্তি বা ১ মাঘ। এছাড়া পশ্চিম রাঢ় অঞ্চলে রঙ্কিনী দেবীর পূজার সঙ্গেও বনবিবি, নারায়ণী ও বড়ামচণ্ডীর পূজার সাদৃশ্য রয়েছে।[]

চাঁপাতলার বনবিবি মেলা

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বারুইপুর থানার অন্তর্গত বেগমপুর মৌজার একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মেলা হল চাঁপাতলার বনবিবি মেলা। পিয়ালি নদীর তীরে প্রফুল্ল সরোবরের কাছে একটি অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় বনবিবির থানটি অবস্থিত। স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস, চাঁপাতলার বনবিবির থানটি ২০০-২৫০ বছরের প্রাচীন। বারুইপুরের চৌধুরী পরিবারকে এই থানের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করা হলেও উক্ত পরিবারের দেবোত্তর সম্পত্তি দানের নথিপত্রে এই থানের উল্লেখ পাওয়া যায় না। পূর্বে এখানে থান বলতে দু’টি অনাচ্ছাদিত মাটির ঢিপি ছিল। বর্তমানে এটি ১০/৬ ফুট, ইটের দেওয়াল ও টালির ছাউনি-যুক্ত একটি পূর্বদ্বারী ঘর। ১৯৯০-এর দশকে জনৈক মুসলমান ভক্ত এই ঘরটি নির্মাণের জন্য সমস্ত ইট দান করেন এবং গ্রামবাসীরা চাঁদা তুলে টালির চালটি তৈরি করেন। ১ মাঘ বাৎসরিক পূজার দিন একটি অস্থায়ী খড়ের চাল তৈরি করে বেদীর কাছে বনবিবি-শাজঙ্গুলীর মূর্তি স্থাপন করে পূজা করা হয়। বর্তমানে নতুন মূর্তি গড়ে পূজা প্রচলিত হয়েছে। তবে পূজার দিন শতাধিক ‘দেবী ছলন’ (মানতকারীদের দান করা মূর্তি) আসে। সেগুলিকে মন্দিরের মধ্যে প্রায় ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়। পূজার পর উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে সেগুলি ঘরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। পার্শ্ববর্তী মাছ চাষের লভ্যাংশের একাংশ দেবীর বাৎসরিক পূজায় ব্যয় করা হয়।[]

বনবিবির ‘ছলন’গুলিতে দেবীর রূপের ভিন্নতা লক্ষ্যতা করা যায়। মূর্তিগুলি মাটির এবং মূর্তির অলংকারগুলিও কৃত্রিম। কোনও মূর্তিতে দেবী দ্বিভূজা ও ব্যাঘ্রবাহিনী, কোনও মূর্তিতে সিংহবাহিনী। ব্যাঘ্রবাহিনী বনবিবির কোলে শিশু এবং একই কাঠামোয় মুগুর বা গদা হাতে মুসলমানী পোষাকে দাড়িওয়ালা এক পুরুষের মূর্তিও দেখা যায়। বনবিবির পালায় এই শিশুটিকে দুখে ও পুরুষটিকে দেবীর ভাই শাহ জঙ্গুলী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সিংহবাহিনী দেবীমূর্তিটিকে সাধারণত বনবিবির সখী নারায়ণী মনে করা হয়। কোনও মূর্তিতে বনবিবিকে বাহনহীন মুসলমান কিশোরীর বেশে কল্পনা করা হয়; তাঁর পরনে ঘাগরা, পায়ে জুতো, কানে কুণ্ডল, গলায় হার, মাথায় মুকুট ইত্যাদি অলংকার থাকে। আবার কোনও কোনও মূর্তিতে তাঁকে পদ্মের উপর দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখা যায়। ড. দেবব্রত নস্করের মতে, স্থানীয় শিল্পীরা নিজস্ব খেয়ালখুশি মতো এই মূর্তিগুলি গড়েন বলেই এগুলির মধ্যে এহেন ভিন্নতা দেখা যায়। তবে ১ মাঘের বাৎসরিক পূজার দিন এই সকল মূর্তিই বনবিবির মূর্তি হিসেবে পূজিত হয়।[]

চাঁপাতলার বনবিবির পূজা-হাজত করেন পুঁড়ির শুবেদালী মোল্লা। স্থানীয় হিন্দুরা এই পূজার আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা করেন। দেবীর পূজায় মন্ত্রতন্ত্রের কোনও বিধি নেই, নামাজের কলমা পড়ে ভক্তদের জন্য ‘দোয়াদরিত মাঙা’ হয়। ভক্তেরা ধূপ জ্বেলে এবং ফলমূল, বাতাসা, সন্দেশ ও দক্ষিণা দিয়ে পূজা করেন। গণ্ডি দেওয়া ও চন্দন মৃত্তিকা গ্রহণ পূজার একটি বিশেষ অঙ্গ। স্থানীয়দের বিশ্বাস, দেবী জাগ্রত এবং ভক্তের সকল প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই এখানে পূজা-হাজত দেন ও ‘দোয়াদরিত’ প্রার্থনা করেন। এছাড়া ভক্তেরা রোগমুক্তির জন্য দেবীর থানে ঢিল বেঁধে মানত করেন। পরে রোগমুক্তি ঘটলে থানে গণ্ডি দেওয়া, বাতাসা লুট, বুক চিরে রক্ত দেওয়া ইত্যাদি আচার পালন করা হয়। অধিক ফলনের জন্য মানত করলে খেতের প্রথম ফসল ধানের আঁটি বা বিচালি, মুলো, বেগুন ইত্যাদি থানে দেওয়া হয়। আবার হাঁস-মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য মানত করে কৃতকার্য হলে পূজাস্থানে হাঁস-মুরগির বাচ্চা ছেড়ে দেওয়ারও রীতি আছে। এছাড়া জমি বা কৃষি যন্ত্রপাতি কিনে তা থেকে ভালো পরিষেবা পাওয়ার আশায় মানত করলে মানতপূর্তিতে ছলন ও বাজনা-সহ বনবিবির পূজা দেওয়া হয়।[]

চাঁপাতলার বনবিবির মেলার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল ঘুড়ি ওড়ানো ও ঘুড়ি লোটার প্রথা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় সরস্বতী পূজার দিন এবং পার্শ্ববর্তী কলকাতা ও শহরতলি অঞ্চলে বিশ্বকর্মা পূজায় ঘুড়ি ওড়ানোর প্রথা থাকলেও, চাঁপাতলায় স্থানীয় কিশোর ও যুবকেরা বনবিবির মেলা উপলক্ষ্যে ১ মাঘ দিনের বেলা এই আচার পালন করেন। ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে এখানে প্রচুর দর্শনার্থীরও সমাগম হয়। রাতে গান, নাটক, যাত্রা ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। মেলায় মনিহারি, লোহার কৃষি যন্ত্রপাতি, গৃহস্থালির জিনিসপত্র থেকে শুরু করে রেডিমেড পোষাক, মিষ্টি, ফুচকা, তেলেভাজা খাবার ইত্যাদির দোকান বসে। সারা রাত ‘ফড়’-এর (জুয়া) আসর চলে।[]

ধোপাগাছির বিবি মার মেলা

বারুইপুর শহরের নিকটবর্তী ধোপাগাছিতেও ১ মাঘ বনবিবির বাৎসরিক পূজা ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলাটি ‘বিবি মার মেলা’ নামে পরিচিত। এখানে বিবি মার পূজা উপলক্ষ্যে পরিবার, পাড়া বা গ্রামভিত্তিক বনভোজন আয়োজিত হয়। বনভোজনে সাদা বেগুন ও আলুসিদ্ধ ভাত খাওয়া হয়। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ এই উৎসবে যোগ দেন। পূজা উপলক্ষ্যে দুশোরও বেশি বনবিবির ‘ছলন’ আসে। আশেপাশের গ্রামের মানুষজন এখানে দেবীর থানে পূজা-হাজত দেন এবং পূজা উপলক্ষ্যে মেলার আয়োজন করা হয়।[১০]

মন্দির

দুই বাংলার সুন্দরবনের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় অধিবাসীরা বনবিবির মন্দির স্থাপনা করেছেন। সজনেখালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, দো বাঁকি অভয়ারণ্য ও দয়াপুর গ্রামে বনবিবির মন্দির চোখে পড়ে।

সাহিত্য

  • অমিতাভ ঘোষের দ্য হ্যাংরি টাইডে বনবিবির গল্পটি বিখ্যাত, এবং একই লেখকের দ্য গ্রেট ড্রেঞ্জমেন্ট: ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য অচিনেবলে তার উল্লেখ করা হয়েছে
  • বনবিবির কেরামতি
  • বনবিবির জহুরানা

পপুলার কালচারে বনবিবিঃ

  • কোক স্টুডিও বাংলা বনবিবির কিংবদন্তি ও খনার বচন নিয়ে ব্যান্ড মেঘদলের সাথে Bonobibi নামের গান গেয়েছে [১১]

তথ্যসূত্র

  1. Sufia Uddin (২০১১)। "Beyond National Borders and Religious Boundaries: Muslim and Hindu Veneration of Bonbibi"। Mathew N. Schmalz and Peter Gottschalk ed। Engaging South Asian Religions: Boundaries, Appropriations, and Resistances। New York: State University of New York Press। পৃষ্ঠা 61–82। আইএসবিএন 978-1-4384-3323-3 
  2. বাংলার লোকদেবতা ও সমাজসংস্কৃতি, দেবব্রত নস্কর, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ (অক্টোবর, ২০১৮), পৃ. ৪১
  3. লোকসংস্কৃতি, আহাদ হায়দার (১৮ জানুয়ারি ২০১৫)। "বনবিবি"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ৬.০১.২০১৭  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  4. "বনবিবির জহুরনামা"। বাংলাপিডিয়া। সংগ্রহের তারিখ ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ 
  5. গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু (২০০৮) [১৯৬৬]। বাংলার লৌকিক দেবতা, কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, আইএসবিএন ৮১-৭৬১২-২৯৬-৩, পৃ. ২৯–৩৪
  6. সুকুমার সেন (১৯৯৩)। ইসলামী বাংলা সাহিত্য, কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, আইএসবিএন ৮১-৭২১৫-৩০১-৫, পৃ. ৭৩–৮২
  7. বাংলার কিংবদন্তি, শীলা বসাক, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ (জানুয়ারি, ২০১৩), তৃতীয় মুদ্রণ (মে, ২০১৭), পৃ. ১২৬-২৭
  8. চব্বিশ পরগনার লৌকিক দেবদেবী: পালাগান ও লোকসংস্কৃতি জিজ্ঞাসা, ড. দেবব্রত নস্কর, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ৩৪৯-৩৫০
  9. "বনবিবি মেলা: একটি রূপরেখা"। ড. দেবব্রত নস্কর (২০১৭)। সুন্দরবন সভ্যতা ও লোকসংস্কৃতি অন্বেষণ, কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-২৯৫-৩১৪৩-৮, পৃ. ২৮০–২৮৬
  10. ড. দেবব্রত নস্কর (২০১৮)। বাংলার লোকদেবতা ও সমাজসংস্কৃতি, কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, আইএসবিএন ৯৭৮-৯৩-৮৮০১৪-০৪-৫, পৃ. 2২৫-২২৬
  11. "Coke Studio Bangla drops second song of the season"The Business Standard (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৩-০৩-০৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-০৩ 

Read other articles:

Catur padaPekan Olahraga Nasional XIX Standar Perorangan putra putri Beregu putra putri campuran Cepat Perorangan putra putri Beregu putra putri campuran Kilat Perorangan putra putri Beregu putra putri campuran Catur kilat perorangan putri pada Pekan Olahraga Nasional XIX berlangsung di Hotel Savoy Homan, Kota Bandung, pada tanggal 15 September 2016.[1] 19 atlet dari 15 provinsi berlaga. Kualifikasi Jenis Kualifikasi Tanggal Tempat Perorangan Tuan Rumah 27 April 2010  Jakarta ...

Microsoft Pocket PaintPocket Paint on Windows CEDeveloper(s)MicrosoftOperating systemWindows CELicenseFreeware Pocket Paint is the Windows CE version of the raster graphics editor Microsoft Paint accessory commonly included with the Windows operating system. Because it is written to run on the leaner Windows CE operating system, it lacks a few of the features found in its bigger brother for the desktop. The only image format supported is BMP. Pocket Paint was bundled as part of Microsoft's Ha...

Perhimpunan Palang Merah Republik Rakyat Demokratik KoreaBendera Perhimpunan Palang Merah DPRKSingkatanDPRK RCSTanggal pendirian18 Oktober 1946TipeOrganisasi nirlabaTujuanKemanusiaanKantor pusatPyongyang, Korea UtaraLokasiRyonhwa 1 dong, Distrik Tengah, Pyongyang[1]Wilayah layanan  Republik Demokratik Rakyat KoreaSekretaris JenderalRi Ho-rimPresidenKang Su-rinWakil ketua eksekutifPaek Yong-hoWakil ketuaKim Hyong-hunWakil ketuaRi Chung-bokAfiliasiFederasi Internasional Perhimpunan...

Indian high-speed rail service This article includes a list of references, related reading, or external links, but its sources remain unclear because it lacks inline citations. Please help to improve this article by introducing more precise citations. (December 2022) (Learn how and when to remove this template message) Sealdah - PuriDuronto ExpressOverviewService typeDuronto ExpressFirst serviceFebruary 12, 2012; 11 years ago (2012-02-12)Current operator(s)Eastern RailwaysRo...

This article does not cite any sources. Please help improve this article by adding citations to reliable sources. Unsourced material may be challenged and removed.Find sources: List of number-one singles of 2009 Ireland – news · newspapers · books · scholar · JSTOR (March 2011) (Learn how and when to remove this template message) The X Factor winner Joe McElderry's debut single The Climb (song) was the Christmas number one of 2009 The Black Eyed P...

Neighborhood in Montgomery County, Maryland, United States Census-designated placeFour Corners, MarylandCensus-designated placeIntersection of MD 193 and its western turnaround in Four CornersFour CornersShow map of MarylandFour CornersShow map of the United StatesCoordinates: 39°1′13.44″N 77°0′46.0794″W / 39.0204000°N 77.012799833°W / 39.0204000; -77.012799833Country United StatesState MarylandCounty MontgomeryUnincorporated communitySilver Sprin...

artikel ini tidak memiliki pranala ke artikel lain. Tidak ada alasan yang diberikan. Bantu kami untuk mengembangkannya dengan memberikan pranala ke artikel lain secukupnya. (Pelajari cara dan kapan saatnya untuk menghapus pesan templat ini) Hawker Hunter adalah pesawat jet subsonik Inggris dikembangkan pada tahun 1950. Hunter satu kursi memasuki layanan sebagai pesawat tempur bermanuver, dan kemudian dioperasikan dalam tempur-pembom dan pengintai peran dalam berbagai konflik. Varian dua kursi...

米山 赤館公園より標高 351 m所在地 日本福島県東白川郡塙町・棚倉町位置 北緯36度57分47.9秒 東経140度23分59.2秒 / 北緯36.963306度 東経140.399778度 / 36.963306; 140.399778座標: 北緯36度57分47.9秒 東経140度23分59.2秒 / 北緯36.963306度 東経140.399778度 / 36.963306; 140.399778山系 阿武隈高地 米山の位置 北緯36度57分47.9秒 東経140度23分59.2秒 / 北緯36.9...

Untuk kegunaan lain, lihat Kawin Kontrak (disambiguasi). Kawin KontrakSutradara Ody C. Harahap Produser Raam Punjabi Ditulis oleh Ody C. Harahap Joko Nugroho SkenarioOdy C. HarahapJoko NugrohoCeritaOdy C. HarahapGunnar NimpunoPemeranDimas AdityaDinda KanyadewiRicky HarunMasayu AnastasiaHerichanLukman SardiMieke AmaliaUnangWiwid GunawanPenata musikJoseph S. DjafarSinematograferIcal TanjungPenyuntingAline JusriaPerusahaanproduksiMulti Vision PlusDistributorMulti Vision PlusTanggal rilis9 ...

Костянтин Буценко Народився 10 березня 1969(1969-03-10) (54 роки)м. Харків Зріст 182 см Позиція нападник Проф. клуби «Динамо» (Харків)«Сокіл» (Київ)«Авангард» (Омськ)«Нафтохімік»«Спартак» (Москва)СКА (Санкт-Петербург)«Мостовик» (Курган)«Чиксереда»«Мотор» (Барнаул)«Динамо» (Мінськ)«...

SalamisΣαλαμίνα Pemandangan Salamina Letak Koordinat 37°56′N 23°30′E / 37.933°N 23.500°E / 37.933; 23.500Koordinat: 37°56′N 23°30′E / 37.933°N 23.500°E / 37.933; 23.500 Zona waktu: EET/EEST (UTC+2/3) Pemerintah Negara: Yunani Periferal: Attika Statistik penduduk (pada 2001[1]) Kotamadya  - Jumlah penduduk: 38.022  - Luas: 96,09 km² (37 sq mi)  - Kepadatan: 396 /km²...

Notting Hill GatePintu masukLua error in package.lua at line 80: module 'Modul:Location map/data/United Kingdom Central London' not found.Letak Notting Hill Gate di Central LondonLetakNotting HillOtoritas lokalRoyal Borough of Kensington and ChelseaPengelolaLondon UndergroundJumlah peron4Zona tarif1 dan 2Jumlah penumpang tahunan London Underground2008 16.850 juta[1]2009 17.365 juta[1]2010 17.880 juta[1]1868Dibuka (MR)1900Dibuka (CLR)Daftar stasiun DLR Underground Natio...

Second highest mountain in the United Kingdom For the mountain in South Africa, see Ben Macdhui, Eastern Cape. Ben MacduiBeinn MacDuibhBen Macdui from the southHighest pointElevation1,309 m (4,295 ft)[1]Prominence950 m (3,120 ft)Ranked 9th in British IslesParent peakBen NevisIsolation86.5 km (53.8 miles) [2]ListingMarilyn, Munro, Hardy, Council top (Aberdeenshire, Moray), County top (Aberdeenshire, Banffshire)NamingEnglish translationMacDuff's mountain...

Meråkerbanen Trondheim - Storlien Totale lengte102 kmSpoorwijdte1435 mmAangelegd doorNSBGeopend17 oktober 1881Huidige statusin gebruikGeëlektrificeerdneeAantal sporen1Baanvaksnelheid90 / 100[1] km/uTreindienst doorSJ, CargoNet Traject Legenda Dovrebanen van Oslo Steinbergsporet (stilgelegd 1997) Steinberget (611 m) Nidareid Møllehaugen (90 m) regiotram Trondheim 551,67 Skansen (1893) Sandgatasporet Ilsviklinja (1884-1995) Skansenbrua (1918) Fagervika Ravnkloløpet (31 m) Brattøra ...

Metro station in Delhi, India Dwarka Sector 13द्वारका सेक्टर 13 Delhi Metro stationGeneral informationLocationSector 13, Dwarka, New Delhi, 110078Coordinates28°35′49.646″N 77°2′0.146″E / 28.59712389°N 77.03337389°E / 28.59712389; 77.03337389Owned byDelhi MetroOperated byDelhi Metro Rail Corporation (DMRC)Line(s)Blue LinePlatformsSide platformPlatform-1 → Noida Electronic City / VaishaliPlatform-2 → Dwarka Sector 21Tracks2Constr...

2002 film Full FrontalTheatrical release posterDirected bySteven SoderberghWritten byColeman HoughProduced byGregory JacobsScott KramerStarring David Duchovny Nicky Katt Catherine Keener Mary McCormack David Hyde Pierce Julia Roberts Blair Underwood Edited bySarah FlackMusic byJacques DavidoviciDistributed byMiramax FilmsRelease date August 2, 2002 (2002-08-02) Running time101 minutesCountryUnited StatesLanguageEnglishBudget$2 million[1]Box office$3.4 million[1]...

Grande Prêmio de Las Vegas de 2023 Corrida 21 de 22 no Campeonato Mundial de Fórmula 1 de 2023 Grande Prêmio de Las Vegas de 2023. Detalhes da corrida Categoria F1 Data 19 de novembro de 2023 Nome oficial Formula 1 Heineken Silver Las Vegas Grand Prix 2023 Local Circuito Urbano de Las Vegas Las Vegas, Estados Unidos Total 50 voltas / 310.050 km Pole Piloto Charles Leclerc Ferrari Tempo 1:32.726 Volta mais rápida Piloto Oscar Piastri McLaren-Mercedes Tempo 1:35.490 (na volta 47) Pódio Pri...

Beaver Brook Falls WaysideLocation432 Route 145, ColebrookCoos County, New HampshireCoordinates44°55′12″N 71°27′53″W / 44.92004°N 71.46480°W / 44.92004; -71.46480Area7.3 acres (3.0 ha)Elevation1,122 ft (342 m)[1]Administered byNew Hampshire Division of Parks and RecreationWebsiteBeaver Brook Falls Wayside Beaver Brook Falls Wayside is a 7.3-acre (3.0 ha) park in Colebrook, New Hampshire, along Route 145. It features a roadsi...

51st Battalion, CEFLt-Col Harwood and staff of the battalionActive1914–1917Disbanded1920CountryCanadaBranchCanadian Expeditionary ForceTypeInfantryMobilization headquartersEdmontonBattle honoursThe Great War, 1916–17Military unit The 51st Battalion (Edmonton), CEF, was an infantry battalion of the Canadian Expeditionary Force during the Great War. The 51st Battalion was authorized on 7 November 1914 and embarked for Great Britain on 18 April 1916. It provided reinforcements for the C...

Thoroughfare in Brussels, Belgium Avenue de Tervueren (in French)Tervurenlaan (in Dutch)The start of the Avenue de Tervueren at the Cinquantenaire/Jubelpark, looking east towards Marshal Montgomery SquareLocation within BrusselsShow map of BrusselsAvenue de Tervueren (Belgium)Show map of BelgiumLocationBrussels-Capital Region, BelgiumCoordinates50°50′12″N 04°24′42″E / 50.83667°N 4.41167°E / 50.83667; 4.41167ConstructionCompletion1897 The Avenue de Tervueren...