পৌভা (দেবনাগরী: पौभा) হলো নেপালের নেওয়ার জাতির ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় চিত্রকলা।[১] পৌভায় দেবতা, মণ্ডল বা কোনো স্থাপনার চিত্র আঁকা হয়, যা অনুশীলনাকারীদের মনোনিবেশে সহায়তা করে। তিব্বতীয় সমতুল্য চিত্রকলাকে থাঙ্কা বলা হয়।[২][৩]
অধিকাংশ পৌভায় বৌদ্ধ ধর্মীয় বিষয়বস্তু অঙ্কিত হয়, তবে কদাচিৎ হিন্দু বৈষয়িক পৌভা-ও দেখা যায়। শিল্পী ও পৃষ্ঠপোষকেরা ধর্মীয় পুণ্য লাভের নিমিত্তে পৌভা অঙ্কন করে থাকেন। নেওয়ার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় উৎসব ও অন্যান্য বিশেষ উদযাপনে প্রদর্শিত পৌভা আঁকানোর জন্য শিল্পী নিযুক্ত করে থাকেন। পৌভার ঐতিহাসিক শিল্পীরা চিত্রকার নামে পরিচিত, যাদের নেপাল ভাষায় পুন (पुं) নামে অভিহিত করা হয়।[৪]
লস অ্যাঞ্জেলস কাউন্টি মিউজিয়াম অব আর্টসে রক্ষিত একাদশ শতাব্দীতে (৪৮৫ নেপাল সংবৎ) অঙ্কিত অমিতাভ বুদ্ধের একটি পৌভা এই প্রকার শিল্পকর্মের সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত।[৫] এই ধরনের শিল্পকলায় নেওয়ার জাতির দক্ষতা প্রতিফলিত হয়, যার কারণে হিমালয় অঞ্চল এমনকি সুদূর চীনেও এই ধরনের শিল্পকলার অমুসন্ধান করা হয়।[৬] নেওয়ার শিল্পী এবং বণিকেরা তিব্বতে পৌভা নিয়ে যান, যার থেকে তিব্বতের থাঙ্কা বিবর্তিত হয়।[৭]
পৌভা সাধারণত আয়তাকার ক্যানভাসে আঁকা হয়ে থাকে। মহিষের আঠা এবং সাদা কাদামাটি মিশিয়ে এই ক্যানভাস তৈরি করা হয়। ক্যানভাসের তল মসৃণ করার জন্য এর উপরিতলে মসৃণ পাথর দ্বারা ঘষা হয়। এই প্রক্রিয়া প্রজন্ম ধরে একইভাবে পালিত হয়ে আসছে এবং শিল্পীরা এক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব সত্তার প্রতিফলন ঘটাতে পারেন না।[৮]
চিত্রের রং বিভিন্ন খনিজ এবং উদ্ভিদ থেকে সংগ্রহ করা হয়। সোনালি ও রৌপ্য রঙও পৌভায় ব্যবহৃত হয়। সম্পূর্ণ চিত্র অঙ্কনের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর পটের দেবতার চোখ আঁকা হয়, যা "মিখা চায়েকেগু" (চক্ষুদান) নামে পরিচিত।[৯] প্রদর্শনের জন্য কাঠামো হিসেবে পৌভার চারদিকে জরি সেলাই করা হয়।
পৌভার কৃতি ও দৃশ্যপট সাধারণত নির্দিষ্ট, কেন্দ্রে বিশাল আকারে সৌধের অভ্যন্তরে মূল আরাধ্যের চিত্র এবং আশেপাশে ক্ষুদ্রাকারে অনুসারীদের আঁকা হয়। প্রেক্ষাপটে সাধারণত প্রাকৃতিক সংগঠন, যেমন শিলা ইত্যাদি আঁকা হয়। রং সাধারণত গাঢ় এবং কাঠামোর আশেপাশে সূক্ষ্ম ছায়াপাত করা হয়। বিষয়বস্তুর সূক্ষ্ম বিবরণে নেপালের আদি পৌভার ছাপ ফুটে উঠে।[১০]
প্রতি বছর কাঠমান্ডু উপত্যকার পবিত্র দরবারে দীপঙ্কর বুদ্ধের মূর্তি এবং পৌভার প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। গুনলা মাসে অনুষ্ঠিত এই উৎসব বহিদ্যঃ বোয়েগু (बहीद्यः ब्वयेगु) নামে পরিচিত। নেওয়ার বৌদ্ধদের পবিত্র মাস হিসেবে বিবেচিত গুনলা আগস্ট মাসের সাথে সমাপতিত হয়। উপাসকেরা সঙ্গীতদলের অনুসরণে দরবারে উপস্থিত হয়ে সেই প্রদর্শনী উপভোগ করে। সাম্প্রতিককালে শিল্পকলা অপহারকদের কারণে প্রদর্শনীর সময় স্বল্প এবং একই সাথে কম চিত্র প্রদর্শিত হয়।[১১]
২০শ শতাব্দীর প্রচলিত নেপালি ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা অনুসারে শিলাজ রঙে বুদ্ধের সাথে হিন্দু ও বৌদ্ধ দেবতাদের চিত্র আঁকা হয়ে থাকে। ২০শ শতাব্দীর শেষার্ধে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণে বাস্তবানুগ অভিব্যক্তির প্রকাশ হতে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রচলন আরও বেশি পরিমাণে অনুসৃত হতে থাকে, বিশেষ করে তেল রঙ ও সাম্প্রতিক ঢঙের বিচিত্র রঙের গয়নার ব্যবহারে।
অধিকাংশ পৌভায় ধর্মীয় কারণে শিল্পীর স্বাক্ষর ও তারিখ থাকে না। তবে কাঠমান্ডুর ইতুম-বহালের বৌদ্ধ মন্দিরের পাশে পুরান বাজার এলাকায় জন্ম নেওয়া আনন্দমুনি শাক্য (১৯০৩ - ১৯৪৪) এই ক্ষেত্রে নতুন ধারার সূচনা করেন। তার পৌভায় সাম্প্রতিক সময়ের প্রতিফলন লক্ষ্যণীয়। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে কাঠমান্ডুতেই জন্ম নেওয়া উদয় চরণ শ্রেষ্ঠ নেওয়ার শ্রেষ্ঠদের আচার ও প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিফলনের পাশাপাশি আনন্দমুনির ধারার অনুসরণ করেন। তিনি সাম্প্রতিক ধারার অলঙ্কার ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি সাম্প্রতিক রীতি ও গতিশীল কম্পোজিশন প্রয়োগ করেন, যা তার চিত্রকলাকে অনন্য করে।