পোস্টমাস্টার ৭১বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাংলাদেশীবাংলা যুদ্ধ-নাট্য চলচ্চিত্র।[১] ছবিটির পরিচালনা করেছেন আবির খান ও রাশেদ শামীম জুটি।[২] মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন স্বাধীনতাকামী পোস্টমাস্টারের বাস্তব চরিত্রকে কেন্দ্র করে এটির কাহিনি, চিত্রনাট্য রচনা ও মূল চরিত্রে অভিনয় করেন ফেরদৌস আহমেদ। ছায়াছবিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে পাবনার এক পোস্টমাস্টার মুক্তিযুদ্ধের জন্য যোদ্ধা সংগ্রহ, যুদ্ধে গমন ও যুদ্ধে জড়িত নিজের ব্যক্তিগত প্রণয়ের পরিণতির গল্প চলচ্চিত্রায়ণ ঘটেছে। ফেরদৌস ছাড়াও চিত্রনাট্যের মূল চরিত্রসমূহে অভিনয় করেছেন মৌসুমী, শহীদুল আলম সাচ্চু, অমিত হাসান, দিলারা জামান, নিঝুম রুবিনা ও অনিক রহমান অভি।
২০১৫ সালের ১১ অক্টোবর থেকে নুজহাত ফিল্মসের ব্যানারে[৩] ছায়াছবির মুখ্য চিত্রগ্রহণ শুরু হয়। ধাপে ধাপে বাংলাদেশের পাবনা, ময়মনসিংহ ও গাজীপুরের বিভিন্নস্থানে চিত্রগ্রহণ শেষ হয় ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারি। মুক্তির পূর্বে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম চলচ্চিত্রটির স্বত্ব কিনে নেয়। ২০১৮ সালে ১৪ ডিসেম্বর ইমপ্রেসের পরিবেশনায় বাংলাদেশের দুটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটি একই বছর সেরা চিত্রগ্রহণ বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করে।
কাহিনি
১৯৭১ সালের আগস্ট মাস। পাবনার ইশ্বরদীর সরিষাবাড়ি গ্রামে এক বৃষ্টি ভেজা রাতে পাকশী সাব-পোস্টঅফিসের পোস্টমাস্টার আরিফ আসেন ডাক পিয়ন ফরিদ ও তার স্ত্রী জোহরার বাড়িতে। রাতের খাবার খেয়ে সকালে ডাকঘরে আসেন। ডাকপিয়ন ফরিদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর শহরে তাণ্ডব চালানো নিয়ে আলাপ চলে, অনেকগুলি চিঠির মাঝে আরিফের নামে তার বন্ধু সালাহউদ্দিনের ২২শে আগস্টে লেখা চিঠি আসে। একইদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুই গাড়ি সৈন্য সরিষাবাড়িতে আসে, পুরোনো এক দালানে ক্যাম্প করে। গুলজার মাতবর তাদের সাথে দেখা করতে যায়। পোস্টমাস্টার আরিফ তার ডাকপিয়ন ফরিদের স্ত্রীর উকিল বাবা। রাতে জোহরা আরিফের জন্য পায়েস দিতে গেলে জানা যায় আরিফ বাগমারা গ্রামে রমজান ডাকাতের সাথে দেখে করতে গিয়েছেন। আরিফ রমজান ডাকাতকে তার বন্ধু মুকবুল মিয়ার চিঠি আসলে পড়ে শোনান। চিঠিতে মকবুল পাকিস্তানি মিলিটারি হতে রমজানকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দেয়। একই সাথে নিজের বন্ধু সালাহ উদ্দিন চিঠিতে পোস্টমাস্টারকে দেশে পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরুর খবর ও গ্রামের যুব সমাজকে একত্রিত করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে উৎসাহ দেওয়ার আহ্বান জানায়। পরদিন ডাকঘর থেকে বাড়ি ফেরার পথে গুলজার মাতবরের সাথে আরিফের দেখা হয়। গুলজার আরিফকে দেশের যুদ্ধ-পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত হতে না করে, বরং সবকিছু ভাল চলছে বলে সান্ত্বনা আশ্বস্ত করে। ভীত আরিফের শঙ্কিত আচরণ দেখে গুলজারের সন্দেহ হয় যে আরিফ হয়ত গেরিলা যুদ্ধ শুরুর বার্তা পেয়েছে। স্বপ্নে নিজ বাড়িতে মিলিটারি নিয়ে গুলজারকে হানা দিতে, আর তাদের গুলিতে নিজেকে মরতে দেখে আরিফ। ঘুম থেকে উঠে সালাহউদ্দিনের সেই যুদ্ধ বার্তা সম্বলিত চিঠি পুড়িয়ে ফেলে। আরিফ সকলকে যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য বেনামে চিঠি লেখা শুরু করে, ফরিদ সেই চিঠিগুলি বিলি করে। গুলজার বেনামি চিঠির ঘটনা ধরে ফেলে, ডাকঘরে গিয়ে সে আরিফকে বেনামি চিঠি বিলির বিষয়ে জানতে চায়। আরিফ কৌশলে তাকে পাকিস্তানের পক্ষে লেখা একটা বেনামি চিঠি দিয়ে নিবৃত করে। গুলজার পোস্ট অফিসে পাকিস্তানের পতাকা টানিয়ে বিদায় নেয়।
গ্রামের যুবকরা বুঝতে পারে, একজনকে নয়, সবাইকে এই চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা রাতের আঁধারে ফরিদের সাথে মশাল মিছিল বের করে। মিলিটারিদের ভয়ে আরিফ তাদের মিছিল আটকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বলে। সরকারি চাকুরির কারণে আরিফ যুদ্ধে যেতে পারে না, ফরিদকেও নিয়মের মধ্যে নেপথ্যে থেকে যুদ্ধের জন্য কাজ করতে বলে। গুলজারের অগোচরে সবাইকে সংগঠিত করে। সবাই নিজের পরিবার, প্রেমিকাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়। ফুলঝরি গ্রামের মাস্টারের নেতৃত্বে আরিফ একদল লোককে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পাঠিয়ে দেয়।
গ্রামের পুরাতন জমিদার বাড়িতে মিলিটারি ক্যাম্প করে। এরই মাঝে রমজান ডাকাতের নামে পিয়ারি বেগমের চিঠি আসে। পিয়ারি বেগম মকবুলের স্ত্রী। চিঠিতে জানা যায় মকবুলকে মিলিটারিরা তার দোকানের ভিতরে পুড়িয়ে মেরেছে। রমজান জানায় তার বন্ধু খাটি মুসলিম ছিল। তবুও তাকে মরতে হলো। আরিফ তখন রমজানকে বোঝায় এটা শুধু হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ নয়, পাকিস্তানিরা তাদের কাউকে ছাড়বে না। রমজান প্রতিশোধ নিতে চায়। গ্রামের যুবকদের হঠাৎ গ্রাম ছাড়া হতে দেখে গুলজারের সন্দেহ হয়। এলাকার যুবক সবুজের বাড়িতে গিয়ে চিঠি খুঁজে বের করে আরিফকে ধরতে যায়। গুলজার আর মিলিটারিদের তাড়া খেয়ে আরিফ ও ফরিদ যুদ্ধে যোগ দিতে গ্রাম থেকে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে চলে যায়। পথিমধ্যে একজন বৃদ্ধার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। প্রশিক্ষণ নিয়ে আরিফের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নিজ গ্রামের আশেপাশের এলাকায় অভিযান চালানো শুরু করে। সবুজ ধরা পরার পর আরিফের নেতৃত্বে মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমণ করে। বন্দি সবুজকে গুলজার গুলি করে হত্যা করে। মিলিটারি ক্যাম্পের যুদ্ধে মিলিটারিদের পরাস্ত করা হয়, যুদ্ধে রমজান ডাকাত মারা যায়। ক্যাম্পে ফরিদের সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে অনেকের সাথে মৃতবস্থায় পাওয়া যায়। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা ফুলঝরি গ্রামের মাস্টারের বাড়িতে আশ্রয় নেয়, সেই রাতে বৃষ্টির মাঝে ডুমুরিয়া থানারইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টের অস্ত্রভান্ডার লুট করতে আরিফের দল নৌকায় করে এলাকা ত্যাগ করে। নয়ন ও সালাম তাদের স্বাগত জানায়। সুরেশ বাহিনীর সাথে থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। থানা উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র লুট করে। সেই রাতে মিলিটারিরা আরিফদের পালটা আক্রমণ করে। আরিফকে বাঁচাতে গিয়ে ফরিদ নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে। ফরিদকে কবর দেওয়ার পরপর মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিটারিরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। গ্রেনেডের আঘাতে আরিফ আহত হয়। নয়ন ও সালাম এসে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে অজ্ঞান আরিফকে উদ্ধার করে, নয়নের বাড়িতে নিজঘরে লুকিয়ে রাখে।
নয়ন মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তার বড়ভাই শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার। নয়ন তার ভাবি গোলাপজানের কাছ থেকে অসুস্থ আরিফের জন্য কাঁথা চায়। নয়নের ভাবি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে। প্রচন্ড জ্বরে কাতর আরিফের গায়ে কাঁথা দিতে গিয়ে গোলাপজান আবিস্কার করে, অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা আর কেউ নন, তার প্রাক্তন প্রেমিক আরিফ। ১৯৬৫ সালে গোলাপজানের সাথে পালিয়ে প্রেম করতে গিয়ে আরিফ তার ভাইয়ের হাতে ধরা পরেছিল। বহুদিন বাদে তাদের আবার দেখা হলো। নিজের রাজাকার স্বামীর নজর থেকে গোলাপজান আর নয়ন আরিফকে লুকিয়ে রাখে। গোলাপজানের সেবাযত্নে আরিফ সুস্থ হয়। সুস্থ আরিফ আবার যুদ্ধে যাওয়ার দিন গোলাপজান ভাল খাবারের আয়োজন করতে চায়। স্বামীকে বলে ভাল আয়োজনের বাজার করাতে বলে। বাজার করে আনা কর্মচারী গোলাপজানের কাছে বাজার রেখে নয়নের ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের আলাপ শুনে ফেলে। সে গিয়ে নয়নের রাজাকার ভাইকে ডেকে আনে। বাড়িতে এসে গোল্পাজানের রাজাকার স্বামী আরিফ নয়ন সহ মুক্তিযোদ্ধাদের নয়নের ঘরে তালাবদ্ধ করে মিলিটারিদের খবর দেয়। গোলাপজান তাদের ছেড়ে দেওয়ার আকুতি করলেও তার স্বামী ভ্রূক্ষেপ করে না। দেশের স্বাধীনতার স্বার্থে রাজাকার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করে নয়নের ঘর থেকে আরিফ সহ সবাইকে মুক্ত করে গোলাপ। মিলিটারি আসার আগে সবাই একসাথে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। স্বাধীন বাংলাদেশে আরিফ ও গোলাপজান একসাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ব্যবহৃত পতাকা হাতে হাসিমুখে দৌড়ায়।
কুশীলব
বেশিরভাগ অভিনয়শিল্পী নির্মাণঘোষণার আগে নির্বাচিত হলেও গোলাপজানের ভূমিকায় মৌসুমী যুক্ত হন, প্রাথমিক চিত্রগ্রহণ শুরুর পর।[৪] ছায়াছবির শ্রেষ্ঠাংশের অভিনয়শিল্পীরা হলেন-
এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্য, গ্রামের যুবকসহ বিভিন্ন গৌণ চরিত্রে পরিচালক যুগল রাশেদ শামীম ও আবির খান সহ আল মনসুর, শাহজাদ খান, জামিল আক্তার, অর্নব খান, জুয়েল জহুর, কাশ্মিরি প্রসাদ দিবা, রেদোয়ান রাশেদ প্রফর, সানজিদ খান প্রিন্স , শোভন, আতিকুল্লাহ লিটু, নিলা ইস্রাফিল, আদিত্য আলম, শৌর্য দীপ্ত সূর্য, রাজু সরকার, মোঃ নুরুজ্জামান, স্নিগ্ধা, জুঁই, সোহেল, বাহাদুর আলি টিক্কা, মনোয়ার,আব্দুল্লাহ আল মামুন, আবির, বাবু ও আনিস প্রমুখ অভিনয় করেছেন।
প্রযোজনা
পোস্টমাস্টার ৭১ চলচ্চিত্রটি ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া এক কাপ চায়ের পর নুজহাত ফিল্মসের দ্বিতীয় প্রযোজনা। প্রফুল্ল রায়ের গল্প অবলম্বনে বিয়ের ফাঁদ বানানো পিছিয়ে গেলে পোস্টমাস্টার ৭১ প্রযোজনার পরিকল্পনা শুরু হয়।[৪] মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনার সাঁথিয়াতে চিঠি দিয়ে মুক্তিকামী যুবকদের সংগঠিত করা আরিফ নামের একজন পোস্টমাস্টারের বাস্তব চরিত্র আছে। এঘটনা নিয়ে ২০১৩ সালে রাশেদ শামীম ‘৭১ এর পোস্ট মাস্টার’ শিরোনামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।[৫] আরিফের চরিত্র ঘিরে গল্প ও চিত্রনাট্য লিখেন ফেরদৌস।[২] আর পরিচালনায় রাশেদের সাথে জুটি বাধেন নবাগত আবির খান।[৩]
২০১৫ সালের ৭ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রটির নির্মাণের ঘোষণা আসে। ১১ অক্টোবর থেকে পাবনার ইশ্বরদীতে প্রথম ধাপে জেড এইচ মিন্টুরচিত্রগ্রহণে দৃশ্য ধারণ শুরু হয়।[১][৪] ইশ্বরদী ছাড়াও ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা ও গাজীপুরের পাতার দরগায় দৃশ্য ধারণ হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারি চিত্রগ্রহণ শেষ হয়।[১] একই বছর জুন মাসের পর মমর রুবেল রচিত সংলাপের ডাবিং যুক্ত হয়।[৬][২]
এছবিতে ব্যবহৃত গানগুলির সুরারোপ, সঞ্চালন এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেন ইমন সাহা। কবির বকুল ও রাশেদ শামীমের গীতিতে গানে কন্ঠ দিয়েছেন কুমার বিশ্বজিৎ, সাহিনা ও সারগাম ফাইভ ব্যান্ড।[২]
মুক্তি
পোস্টমাস্টার ৭১-এর চিত্রগ্রহণ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে মুক্তির লক্ষ্যে। তবে ২০১৬ তে মুক্তি পায়নি।[৩] ২০১৬ ও ২০১৭ তে একাধিকবার মুক্তির তারিখ ঘোষণা হলেও পিছিয়ে যায়।[৭]বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড ২০১৮ সালের পহেলা এপ্রিল চলচ্চিত্রটিকে প্রদর্শনের ছাড়পত্র দেয়।[৮] নুজহাত ফিল্মস ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর মুক্তির প্রস্তুতি নেয়।[৭] মুক্তির আগেই ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ছবির স্বত্ব কিনে নেয়[৯] এবং সহ-প্রযোজক হিসেবে মুক্তির তারিখ এগিয়ে আনে।[১] ইমপ্রেসের পরিবেশনায় ২০১৮ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে বাংলাদেশের দুটি প্রেক্ষাগৃহ- যমুনা ব্লকবাস্টার ও বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্সে চলচ্চিত্রটির বাণিজ্যিক মুক্তি দেওয়া হয়। একই বছর বিজয় দিবসে ছবিটি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়।[১০]