পল অ্যান্থনি গিব (ইংরেজি: Paul Gibb; জন্ম: ১১ জুলাই, ১৯১৩ - মৃত্যু: ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭৭) ইয়র্কশায়ার নর্থ রাইডিংয়ের অ্যাকম্ব এলাকায় জন্মগ্রহণকারী ইংরেজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ছিলেন। ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৬ সময়কালে ইংল্যান্ডের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেছিলেন।[১]
ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়র্কশায়ার ও এসেক্স দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দলে তিনি মূলতঃ ব্যাটিং উদ্বোধন করতেন কিংবা মাঝারিসারিতে ব্যাটিংয়ে নামতেন। এছাড়াও মাঝে-মধ্যে উইকেট-রক্ষকের দায়িত্ব পালন করতেন পল গিব।
অক্সফোর্ডের সেন্ট এডওয়ার্ডস স্কুলে পড়াশোনা শেষে কেমব্রিজের ইমানুয়েল কলেজে অধ্যয়ন করেছেন। অক্সফোর্ডের সেন্ট এডওয়ার্ডস একাদশে খেলতেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সময়কালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। ১৯৩৫ সালের প্রথম বছরে ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে থাকেন।
প্রথম বর্ষে তিনি শুধুই ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু, দ্বিতীয় বর্ষে এস. সি. গ্রিফিথ আহত হলে উইকেট-রক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ তার উপর বর্তায়। কেমব্রিজে অবস্থানকালে ১৯৩৬ সালে নিজস্ব দ্বিতীয় বছরে মাঝে-মধ্যেই উইকেট-রক্ষকের ভূমিকায় আবির্ভূত হন। এ সময়ে তিনি বিলি গ্রিফিথের সহকারী ছিলেন। গ্রিফিথ পরবর্তীতে ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ সালে নিজের তিন টেস্টের দুটিতে ইংল্যান্ডের উইকেট-রক্ষক ছিলেন। তৃতীয় বর্ষে এ দায়িত্ব তাকে একাকী নিতে হয় ও গ্রিফিথকে খেলা থেকেই বাদ দেয়া হয়। এরফলে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। ১৯৩৭ সালে নিজস্ব তৃতীয় বছরে বিতর্কিতভাবে গ্রিফিথকে পাশ কাটিয়ে উইকেট-রক্ষক হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি খেলায় ৫৪ গড়ে রান তুলেছিলেন। শেষ বর্ষে থাকাকালীন সেঞ্চুরি করেন। এর পূর্বেকার বছরে ৮৭ রানে বাজেভাবে রান আউটের শিকার হন।
১৯৩৭-৩৮ মৌসুমে লর্ড টেনিসনের নেতৃত্বাধীন দলের সদস্যরূপে ভারত গমন করেন। আহমেদাবাদে অপরাজিত ১৩৮ রানের নিজস্ব তৃতীয় প্রথম-শ্রেণীর সেঞ্চুরি করেন। ১৯৩৮ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্যরূপে ফ্রি ফরেস্টার্সের বিপক্ষে ২০৪ রানের নিজস্ব একমাত্র প্রথম-শ্রেণীর দ্বি-শতকটি হাঁকিয়েছিলেন। ঐ বছরে সংগৃহীত চারটি প্রথম-শ্রেণীর শতরানের এটি ছিল প্রথমটি।
১৯৩৫ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ইয়র্কশায়ারের সদস্য ছিলেন পল গিব। ছয় মৌসুম এসেক্সের পক্ষে পেশাদারী পর্যায়ে খেলেন। তন্মধ্যে, চারবার সহস্রাধিক রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার পাশাপাশি ইয়র্কশায়ারের পক্ষে খেলতে শুরু করেন। ইয়র্কশায়ারের পক্ষে প্রথম ইনিংসেই করেছিলেন অপরাজিত ১৫৭ রান। ১৫৭ রানে অপরাজিত থেকে নিজস্ব প্রথম প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে সেঞ্চুরি হাঁকান। ১৯৩৫ সালে ইয়র্কশায়ারের সদস্যরূপে তার এ সেঞ্চুরিটি পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইনিংসের মর্যাদা পায়। ১৯৩৫-৩৬ মৌসুমে ইয়র্কশায়ার দলের নেতৃত্বে থেকে জ্যামাইকা গমন করেন।[২]
১৯৪৬ সালে ইয়র্কশায়ারের সদস্যরূপে ওয়ারউইকশায়ারের বিপক্ষে নিজস্ব দ্বিতীয় প্রথম-শ্রেণীর শতক হাঁকান। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চারবছর কোন প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অংশগ্রহণ করেননি পল গিব। তবে, ১৯৫১ সালে এসেক্সের পক্ষে খেলার জন্যে চুক্তিবদ্ধ হন। এরফলে, প্রথম ব্লুধারী খেলোয়াড় হিসেবে পেশাদারী পর্যায়ের দিকে ধাবিত হন তিনি। ফলশ্রুতিতে, মেরিলেবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) কর্তৃপক্ষ তার সদস্যপদ বাতিল করে।[৩]
তাসত্ত্বেও, এসেক্সের পক্ষে নিজের প্রথম মৌসুমেই চারটি শতরানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে সর্বমোট চারবার সহস্র রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। ১৯৫৩-৫৪ মৌসুমে কমনওয়েলথ দলের সদস্যরূপে ভারত গমন করেন। আসামভিত্তিক জোড়হাটের বিপক্ষে ১৫৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনে আটটিমাত্র টেস্টে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। আট টেস্টে ৪৪.৬৯ গড়ে রান তুলেছেন। ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৩৮ তারিখে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছিল পল গিবের।
জুলাই, ১৯৩৮ সালে ইংল্যান্ডের নিয়মিত উইকেট-রক্ষক লেস অ্যামিস আহত ছিলেন। ফলশ্রুতিতে, ওল্ড ট্রাফোর্ডে অনুষ্ঠিত অ্যাশেজ সিরিজের তৃতীয় টেস্টে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে উইকেট-রক্ষণে অগ্রসর হতে হয়েছিল পল গিবকে। এ পর্যায়ে ইয়র্কশায়ারে সচরাচর ও অতি পরিচিত উইকেট-রক্ষক আর্থার উডকে পাশ কাটিয়ে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। তবে, ঐ টেস্টে বৃষ্টিবিঘ্নিত হলে কোন বল মাঠে গড়ানো বাদেই খেলাটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়। জুলাইয়ের শেষদিকে হেডিংলিতে চতুর্থ টেস্টে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু পল গিব নিজেই আঘাতপ্রাপ্ত হলে ফ্রেড প্রাইস উইকেট-রক্ষক হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন। তবে, এটিই ফ্রেড প্রাইসের একমাত্র টেস্টে অংশগ্রহণ ছিল। পঞ্চম টেস্টে আর্থার উডকে নেয়া হলে এবারো উপেক্ষার শিকারে পরিণত হন। ১৯৩৯ সালে আর্থার উড নিজ দেশে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন টেস্টে খেলেছিলেন।
তাসত্ত্বেও, ১৯৩৮-৩৯ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা গমনের উদ্দেশ্যে লেস অ্যামিসের সহকারী হিসেবে তাকে রাখা হয়। পাঁচ টেস্টের ঐ সিরিজে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে লেন হাটনের সাথে খেলেন তিনি। ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৩৮ তারিখে জোহেন্সবার্গে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে অভিষেক ঘটে তার। অভিষেক ঘটা প্রথম টেস্টে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিনি ৯৩ ও ১০৬ রানের ইনিংস উপহার দেন।[৩] ডারবানে ঐ সিরিজের পঞ্চম ও শেষ টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ১২০ রানের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরি হাঁকান। কিন্তু, অসীম সময়ের ঐ টেস্টটি ১০দিনেও শেষ না হলে তা ড্রয়ে পরিণত হয়।
পরের মৌসুমে লেস অ্যামিস আহত হলে গিবকে তৃতীয় ও চতুর্থ টেস্টে আর্থার উডের ন্যায় অভিজ্ঞ উইকেট-রক্ষককে বাদ দিয়ে তাকে ইংরেজ দলে রাখা হয়। ঐ সময়ে আর্থার উড ইয়র্কশায়ারে থাকাকালে তার চেয়েও এগিয়ে ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পল গিব কাতালিনা ও সান্ডারল্যান্ডের চলন্ত জাহাজে রয়্যাল এয়ার ফোর্সের পাইলট হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।[৪]
যুদ্ধ শেষ হবার পর ১৯৪৬ সালের পূর্ব-পর্যন্ত ইংল্যান্ডের পক্ষে খেলতে পারেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ৬০ রান তুলেন। তন্মধ্যে, পঞ্চম উইকেট জুটিতে হার্ডস্টাফের সাথে ১৮২ রান যুক্ত করেছিলেন। নিজদেশে সফরকারী ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম দুইটি টেস্টে উইকেট-রক্ষক হিসেবে খেললেও তৃতীয় টেস্টে বাদ পড়েন। ওভালের তৃতীয় টেস্টে গডফ্রে ইভান্স তার স্থলাভিষিক্ত হওয়াসহ টেস্টে অভিষিক্ত হন।
১৯৪৬-৪৭ মৌসুমের শীতকালে এমসিসি দলের সদস্যরূপে অস্ট্রেলিয়া গমন করেন। ব্রিসবেনে সিরিজের প্রথমে টেস্টে উইকেট-রক্ষণে অগ্রসর হলেও সিডনির দ্বিতীয় টেস্টে আবারও গডফ্রে ইভান্সের কাছে স্থানচ্যুত হন। এরপর থেকেই ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত ইভান্স দলের নিয়মিত সদস্য হিসেবে খেলতে থাকেন। অন্যদিকেও, পল গিবকে আর ইংল্যান্ড দলের পক্ষে খেলতে দেখা যায়নি।
সবমিলিয়ে আট টেস্টে অংশ নিয়ে তিনটি অর্ধ-শতরান ও দুইটি শতরানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে এসেক্স দল থেকে বাদ পড়েন। ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণের পর ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে আম্পায়ার হিসেবে খেলা পরিচালনা করেছিলেন পল গিব। পরবর্তীতে সারের গিল্ডফোর্ডে বাসচালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল পল গিবকে। সেখানেই ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭৭ তারিখে আকস্মিকভাবে পল গিবের দেহাবসান ঘটে। ১৯৭৯ সালের উইজডেন সংস্করণে তারও মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল।[৫]
খেলোয়াড়ী জীবনের শুরুতে বলে হুক মারার অভ্যাস ছিল যা প্রায়শঃই তার দূর্দশা ডেকে আনতো। এরপর তা থেকে উত্তরণ ঘটানোর পর আউট করার বেশ দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। তার ধৈর্য্যধারণ বেশ প্রশংসনীয় পর্যায়ের ছিল।