পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা মূলতঃ নির্দিষ্ট কোন দেশ কর্তৃক পারমাণবিক অস্ত্রের কার্যকারিতা সম্পাদন, ধ্বংসাত্মক সক্ষমতা অর্জন এবং বশীভূত সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পরীক্ষণ বিশেষ।
প্রকারভেদ
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা মূলতঃ চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত। এ ধরনের পরীক্ষাগুলো কোন মাধ্যমের সাহায্যে কিংম্বা নির্দিষ্ট জায়গায় করা হয়েছে।
পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১৬ জুলাই, ১৯৪৫ সালে। ঐদিন ম্যানহাটন প্রকল্পের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের অ্যামোগোর্দো'র কাছে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। প্রকল্পের কোড নেম ছিল ট্রিনিটি।
পরীক্ষাটি ছিল প্রকৃতপক্ষে পরমাণু অস্ত্র গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা এবং ধারণা সম্বন্ধে অবগত ও নিশ্চিত হওয়া যে উক্ত পরীক্ষার প্রকৃত আকার-আয়তন কিরূপ হবে। পাশাপাশি এর বিরূপ প্রতিক্রিয়াই বা কিরূপ হবে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম অক্ষশক্তিজাপানের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার পূর্বেই কিঞ্চিৎ ধারণা অর্জন করা।
এ পরীক্ষণের ফলে পরমাণু অস্ত্র বিস্ফোরণের অনেক প্রতিক্রিয়ার প্রায় সঠিক ফলাফল সম্পর্কে অবগত হন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা। কিন্তু পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের ফলে বায়ুবাহিত তেজস্ক্রিয় কণাসমূহের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাননি তারা। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরই প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে অবগত হন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার ও উন্নয়নের জন্য উদ্যোগী হয়। যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে তারাই একমাত্র দেশ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি নগরীতে পৃথক দু'টি আণবিক বোমা পতনপূর্বক বিস্ফোরণ ঘটায়। সরকারী হিসেব মোতাবেক স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ের পূর্বে ও পরবর্তী সময়ে ১০৫৪টিরও অধিক পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা কার্য পরিচালনা করে। এছাড়াও তারা অনেক দূরপাল্লার অস্ত্র নির্মাণে প্রভূতঃ উন্নয়ন ঘটায়।[১]
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের তৈরীকৃত প্রথম আণবিক বোমা (আরডিএস-১) ২৯ আগস্ট, ১৯৪৯ সালে আবিষ্কার করে। কিন্তু এর পূর্বেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছয়টি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করে ফেলে। ১৯৪৬ সালে অপারেশন ক্রসরোড নামে দুইটি পরমাণু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায় যা ছিল তাদের ঐসময়কার তুলনায় ২০% বেশি। ১৯৫০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু পরীক্ষার জন্য তাদের নিজস্ব এলাকা হিসেবে নেভাদা টেস্ট সাইট এবং মার্শাল দ্বীপপুঞ্জেরপ্যাসিফিক প্রোভিং গ্রাউন্ড গড়ে তোলে।
নভেম্বর, ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ব্যাপক, বিস্তৃত ও বৃহৎ মার্কিন পারমাণবিক পরীক্ষাগুলো স্থলভাগে সম্পন্ন হতো। পরবর্তীতে আংশিক পরীক্ষা বন্ধ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে তারা আত্মরক্ষার্থে ভূ-গর্ভে পরীক্ষা কার্যসম্পন্ন করে মূলতঃ পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয়তা বন্ধের লক্ষ্যে।
১৯৪০ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে পরমাণু অস্ত্র উন্নয়নে মার্কিন প্রশাসন প্রায় $৮.৬৩ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে।[২] ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ সাল পর্যন্ত $১.২ বিলিয়ন ডলারেরও অধিক পরিমাণ অর্থ পারমাণবিক দূর্ঘটনাজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন নাগরিকদেরকে প্রদান করতে বাধ্য হয়। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত $৭৫৯ মিলিয়ন ডলার অর্থ মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদেরকে পরমাণু পরীক্ষাজনিত কারণে প্রদান করে।[৩][৪]
সোভিয়েত ইউনিয়ন
১৯৪০-এর দশকে নতুন ধরনের পরমাণু বোমা হিসেবে হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কারের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষণের স্থল হিসেবে তারা প্রশান্ত মহাসাগরকে বেছে নেয়। এছাড়াও তারা পরমাণু বিভাজন বা ফিসন করে একের পর এক নিত্য নতুন ও উন্নততর পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার করতে থাকে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন সীমিত মাত্রায় বিশেষ করে কাজাখিস্তানে পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা শুরু করে। এরই প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে শৈথিল্যের সূত্রপাত হয়, যা ইতিহাসে স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা শীতল যুদ্ধ নামে পরিচিত। কিন্তু উভয় দেশই পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা কার্য অব্যাহত গতিতে চালাতে থাকে। তারা বিংশ শতকের অর্ধেকেরও বেশি সময়কাল শত শত পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তা ও সক্ষমতা যাচাই করেছে।
১৯৪২ সালের দিকে আলিয়ানোভস্কের একটি গবেষণাগারে কাজ করেছেন আন্দ্রে শাখারভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণা করেন তিনি। ১৯৪৮ এর মাঝামাঝি সময়ে ইগোর কুর্চাতোভ এবং ইগোর ট্যামকে সাথে নিয়ে সোভিয়েত আণবিক বোমা প্রকল্পে অংশ নেন। ২৯ আগস্ট, ১৯৪৯ সালে প্রথমবারের মতো সোভিয়েত আণবিক অস্ত্র পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। ১৯৫০ সালে সারোভে তিনি প্রথমবারের মতো মেগাটন-দূরত্বের সোভিয়েত হাইড্রোজেন বোমা নক্সার মান উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা নেন। এ নক্সাই পরবর্তীকালে শাখারভের তৃতীয় চিন্তা নামে রাশিয়া এবং টেলার-উলাম নক্সা নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৫৫ সালে আরডিএস-৩৭ নামে প্রথম পরীক্ষা চালানো হয়। এরচেয়েও ব্যাপক মাত্রায় ও একই নক্সায় শাখারভ কাজ করেছিলেন। ৫০ মেগাটন ওজনের জার বোম্বা নামে অক্টোবর, ১৯৬১ সালে পরীক্ষা চালানো হয়। স্মরণাতীতকালের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিশ্বের সর্ববৃহৎ পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা হিসেবে এর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বিস্ফোরণ পরবর্তী সময়ে মাশরুম আকৃতির বিরাট কৃত্রিম মেঘমালা ১৬০ কি.মি. দূর থেকেও দৃশ্যমান হয়েছিল। এছাড়াও, ৫৬ কি.মি. উঁচু স্থান থেকে স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল এ মেঘমালা।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের প্রেক্ষাপটে আন্দ্রে শাখারভ হাইড্রোজেন বোমা'র জনক হিসেবে ইতিহাসে চিত্রিত হয়ে আছেন তাঁর স্ব-মহিমায়।
প্রতিক্রিয়া
আণবিক ও পারমাণবিক বোমা পরীক্ষণের প্রেক্ষাপটে অনেক ধরনের ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। ১৯৫৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাসল ব্র্যাভো এলাকায় পরিচালিত আণবিক পরীক্ষার প্রেক্ষাপটে একগুচ্ছ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছিল। এতে ক্ষতির মাত্রা অত্যন্ত বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে এবং ১০০ মাইলেরও অধিক আয়তনবিশিষ্ট জনবসতিপূর্ণ দ্বীপ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি আশপাশের অনেকগুলো জনবসতিপূর্ণ এলাকায়ও এর প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। যদিও এর প্রতিক্রিয়া দ্রুত ঘটে থাকে; তবুও অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আক্রান্ত হয়ে দ্বীপবাসীরা ভুগতে থাকেন। তন্মধ্যে ছিল - তেজস্ক্রিয়তাজনিত কারণে পুড়ে যাওয়া, ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পাওয়া এবং জন্ম বিকলাঙ্গতা।
এ অস্ত্রের পরীক্ষাসহ নতুন ধরনের হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কার ও পরীক্ষার ফলে বিজ্ঞানীমহল কল্পনাও করতে পারেননি যে মনুষ্য সমাজের জন্য কত বিপজ্জনক হতে পারে এটি। বিস্ফোরণের ফলাফল ছিল ১৫ মেগাটন বা টিএনটি সমমানের যা পূর্বেকার পরীক্ষণের তুলনায় দ্বিগুণ ক্ষমতাসম্পন্ন। এছাড়াও এটি বিপুল পরিমাণে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে ফেলতে সক্ষম যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আবহাওয়া স্তরের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে যা আগাম চিত্র পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়।
দাইগো ফুকুরিও মারু নামীয় জাপানেরমৎস্য আরোহণকারী একটি নৌকা তখন আশেপাশেই ছিল। ঐ নৌকার একজন নাবিক তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে বন্দরে প্রত্যাবর্তনের পরপরই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এরফলে জাপানের খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় তেজস্ক্রিয় পরিবাহী মাছ বহন ও বাজারজাতকরণের প্রেক্ষাপটে ভীতিকর ও উদ্বেগজনক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
Gusterson, Hugh. Nuclear Rites: A Weapons Laboratory at the End of the Cold War. Berkeley, CA: University of California Press, 1996.
Hacker, Barton C. Elements of Controversy: The Atomic Energy Commission and Radiation Safety in Nuclear Weapons Testing, 1947-1974. Berkeley, CA: University of California Press, 1994.
Schwartz, Stephen I. Atomic Audit: The Costs and Consequences of U.S. Nuclear Weapons. Washington, D.C.: Brookings Institution Press, 1998.
Weart, Spencer R. Nuclear Fear: A History of Images. Cambridge, MA: Harvard University Press, 1985.