বিভিন্ন আকারের ও প্রক্রিয়ার পয়ঃশোধনাগার। ঘড়ির কাঁটার দিকে উপরে বাম থেকে: রাশিয়ার মস্কো নগরীর কুরিয়ানভো সক্রিয়কৃত পয়ঃকর্দম পয়ঃশোধনাগারের বিমান থেকে তোলা আলোকচিত্র; পোল্যান্ডের গদানস্ক শহরের কাছে নির্মিত জলাভূমিভিত্তিক পয়ঃশোধনাগার; ফ্রান্সের দক্ষিণভাগের একটি বর্জ্য সুস্থিতকরণ পুকুর; কলম্বিয়ার বুকারামাংগা শহরের ঊর্ধ্বপ্রবাহ অবাত পয়ঃকর্দম আবরণ হজমভিত্তিক পয়ঃশোধনাগার
পয়ঃশোধন (বানানভেদে পয়োশোধন) বলতে এমন এক ধরনের বর্জ্যপানি শোধনকে বোঝায় যার লক্ষ্য পয়ঃবর্জ্য থেকে দূষক পদার্থ দূর করে এমন একটি নির্গম পানিপ্রবাহ উৎপাদন করা যেটি চারপাশের পরিবেশে নিরাপদে নির্গমনযোগ্য কিংবা যেটিকে কোনও উদ্দীষ্ট পুনর্ব্যবহারমূলক কাজে প্রয়োগ করা যায়, এবং এভাবে অশোধিত পয়ঃবর্জ্যের নির্গমনের ফলে সৃষ্ট পানি দূষণ প্রতিরোধ করা যায়।[২] পয়ঃবর্জ্যতে বাসভবন ও ব্যবসায়িক ভবনগুলি থেকে আগত বর্জ্যপানিসহ প্রাক-শোধিত শিল্পজাত বর্জ্যপানিও থাকতে পারে। এগুলির উপর অনেকগুলি পয়ঃশোধন প্রক্রিয়া থেকে একটি নির্বাচন করে প্রয়োগ করা সম্ভব। একদিকে বিকেন্দ্রীকৃত বর্জ্যপানি ব্যবস্থা (যার মধ্যে স্ব-স্থানিক শোধন ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত) থেকে শুরু অন্যদিকে বৃহৎ কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাগুলি পর্যন্ত বহু ধরনের ব্যবস্থা বিদ্যমান। বৃহৎ ব্যবস্থাগুলিতে নল, নালা ও উত্তোলক-নিষ্কাশক যন্ত্র তথা পাম্পযন্ত্রের কেন্দ্রসমূহের একটি জালিকাব্যবস্থা থাকে (যাকে পয়ঃপ্রণালীব্যবস্থা বলে) যেগুলি তরল পয়ঃবর্জ্যকে একটি পয়ঃশোধনাগারে প্রেরণ করে। যেসব নগরীতে একটি সংযুক্ত পয়ঃপ্রণালীব্যবস্থা থাকে, সেগুলিতে পয়ঃপ্রণালীগুলি (নালা-নর্দমাগুলি) পৌর গড়িয়ে-পড়া পানিও (নালানর্দমায় গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানি) পয়ঃশোধনাগারে বহন করে নিয়ে যায়। পয়ঃশোধন প্রক্রিয়াটিতে প্রায়শই দুইটি ধাপ থাকে, যেগুলিকে প্রাথমিক ও দ্বিতীয়-পর্যায়ের শোধন বলে। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত উন্নততর শোধন প্রক্রিয়াগুলিতে একটি তৃতীয়-পর্যায়ের শোধন ধাপ থাকে, যেখানে পালিশকরণ প্রক্রিয়াসমূহ ও পুষ্টিমৌল নিষ্কাশন অন্তর্ভুক্ত থাকে। দ্বিতীয়-পর্যায়ের শোধনে সবাত বা অবাত জৈব প্রক্রিয়াসমূহ ব্যবহার করে পয়ঃবর্জ্য থেকে জৈব পদার্থের পরিমাণ হ্রাস করা যায় (যেটিকে প্রাণরাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা হিসেবে পরিমাপ করা হয়)।
পয়ঃশোধনের বহুসংখ্যক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে, যেগুলির সিংহভাগই জৈব শোধন প্রক্রিয়াসমূহ ব্যবহার করে। প্রকৌশলী ও সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদেরকে কারিগরি ও অর্থনৈতিক মানদণ্ডগুলিকে বিবেচনায় নিতে হয় এবং এর পাশাপাশি প্রতিটি বিকল্পের গুণবাচক ও পরিমাণবাচক দিকগুলি বিবেচনা করে তবেই যথাযথ প্রযুক্তিটি নির্বাচন করতে হয়।[৩]:২১৫ প্রায়শই সঠিক প্রযুক্তি নির্বাচনের জন্য যে মানদণ্ডগুলিকে ব্যবহার করা হয়, সেগুলি হল: নির্গম পানিপ্রবাহের অভীষ্ট গুণমান, নির্মাণ ও কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রত্যাশিত ব্যয়, ভূমির সহজলভ্যতা, শক্তির আবশ্যকতা ও দীর্ঘস্থায়িত্ব-সংক্রান্ত দিকসমূহ। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ও গ্রামীণ অঞ্চলগুলিতে যেখানে জনঘনত্ব কম, সেখানে পৌরবর্জ্য প্রায়শই যথাস্থানিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ব্যবহার করে শোধন করা হয় এবং এগুলিকে পয়ঃপ্রণালীতে প্রেরণ করা হয় না। এইসব ব্যবস্থার মধ্যে আছে মলশোধনী (Septic tank), যথাস্থানিক পয়ঃশোধন ব্যবস্থা, কেঁচো-পরিস্রাবক ব্যবস্থা ও আরও বহু ধরনের ব্যবস্থা। অন্যদিকে যেসমস্ত নগরী উন্নততর ও আপেক্ষিকভাবে ব্যয়বহুল পয়ঃশোধনাগার ব্যবহার করার আর্থিক সামর্থ্য রাখে, সেই শোধনাগারগুলিতে তৃতীয়-পর্যায়ের শোধন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে, যাতে সংক্রমণ-নিবারণ করা হয়। এগুলিতে এমনকি একটি চতুর্থ-পর্যায়ের শোধন ধাপও থাকতে পারে, যে ধাপে অণুদূষকগুলিকে দূর করা হয়।
বৈশ্বিক স্তরে প্রায় ৫২% পয়ঃবর্জ্য শোধন করা হয় বলে হিসাব করা হয়েছে।[৪] কিন্তু বিভিন্ন দেশের পয়ঃশোধনের হারের মধ্যে বিশাল ফারাক থাকতে পারে। যেমন উচ্চ-আয়ের অর্থনীতিবিশিষ্ট দেশগুলি তাদের পয়ঃবর্জ্যের প্রায় ৭৪% শোধন করে থাকে, কিন্তু এর বিপরীতে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে গড়ে মাত্র ৪.২% পয়ঃবর্জ্য শোধন করা হয়।[৪]
পয়ঃশোধন ঘটনাটি পয়ঃনিষ্কাশন বা নির্মলীকরণ ক্ষেত্রের একটি অংশবিশেষ। নির্মলীকরণ ব্যবস্থার মধ্যে মানব বর্জ্য, কঠিন বর্জ্য ও ঝোড়োপানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার মতো ব্যাপারগুলিও অন্তর্ভুক্ত থাকে।[৫] "পয়ঃশোধনাগার" পরিভাষাটিকে প্রায়শই "বর্জ্যপানি শোধনাগার" পরিভাষাটির একই অর্থে ব্যবহার করা হতে পারে, যদিও শেষোক্তটি অপেক্ষাকৃত ব্যাপকতর একটি ধারণা।[৬][৩]