নেল্লোর জেলা (সরকারি নাম: শ্রীপোট্টি শ্রীরামুলু নেল্লোর জেলা; তেলুগু: శ్రీ పొట్టి శ్రీరాములు నెల్లూరు జిల్లా, প্রতিবর্ণী. শ্রী পোট্টি শ্রীরামুলু নেল্লূরু জিল্লা)) হল ভারতেরঅন্ধ্রপ্রদেশরাজ্যেরউপকূলীয় অন্ধ্র অঞ্চলে অবস্থিত রাজ্যের ১৩টি জেলার অন্যতম। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, এই জেলার জনসংখ্যা ২,৯৯৬,০৮২। এর মধ্যে ২৯.০৭% শহরবাসী। এই জেলার সদর শহর নেল্লোর। নেল্লোর জেলার পূর্ব দিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিম দিকে রয়েছে কাডাপা জেলা, উত্তর দিকে রয়েছে প্রকাশম জেলা এবং দক্ষিণ দিকে রয়েছে চিত্তুর জেলা ও তামিলনাড়ু রাজ্যের তিরুভেলুর জেলা।[২]
নামকরণ
নেল্লোর জেলার নাম জেলাসদর নেল্লোর শহরের নামানুসারে রাখা হয়েছে। ২০০৮ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবী পোট্টি শ্রীরামালুর নামানুসারে এই জেলার নামকরণ করে 'শ্রীপোট্টি শ্রীরামালু নেল্লোর জেলা'। উল্লেখ্য, পোট্টি শ্রীরামালু তেলুগু জাতির জন্য পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ রাষ্ট্রের দাবিতে আমরণ অনশন করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।[৩]
ইতিহাস
বাঁ দিকে: অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের নেল্লোর জেলায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ ধর্মকেন্দ্র অবস্থিত, ডান দিকে: অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের নেল্লোর জেলার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জৈন ঐতিহ্যবাহী স্থান
মৌর্য, আদি চোল ও পল্লব
মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থানের পর অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের অনেক অঞ্চল এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। অধুনা নেল্লোর জেলার ভূখণ্ডটিও খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে মৌর্য সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। নেল্লোরের কাছে গুহাগুলিতে অশোকের ব্যবহৃত ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে।
দক্ষিণ ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশ ছিল চোল রাজবংশ। আদি চোলেরা খ্রিস্টীয় ১ম থেকে ৪র্থ শতাব্দী পর্যন্ত এই অঞ্চল শাসন করেছিলেন। জুম্মালুরুতে ১০৯৬ খ্রিষ্টাব্দের একটি প্রাচীন চোল শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। কারিকালান ছিলেন চোল রাজবংশের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। তিনি তার বাস্তুকলার নিদর্শনগুলির জন্য খ্যাত। নেল্লোর জেলা তার সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।
পল্লব, চের ও পাণ্ড্যদের ঘন ঘন আক্রমণের ফলে চোল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। কিন্তু ৯ম শতাব্দীতে তাদের পুনরুত্থান ঘটে। ৪র্থ ও ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে সিংহবিষ্ণু পল্লব চোলদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। তারপর এই অঞ্চল পল্লবদের অধিকারভুক্ত হয়। ৭ম শতাব্দীতে পল্লবদের ক্ষমতাকেন্দ্র আরও দক্ষিণে স্থানান্তরিত হয়। ফলে উত্তরাঞ্চলে তাদের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। উদয়গিরি গ্রামে কয়েকটি প্রাচীন পল্লব ও চোল মন্দির দেখা যায়। অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর-নেল্লোর অঞ্চলে পল্লবদের সম্পর্কে অনেকগুলি শিলালিপিও পাওয়া গিয়েছে। বুন্ডাবল্লির চারতলা গুহা ও ভৈরবকোন্ডার ৮টি গুহামন্দির পল্লব স্থাপত্যের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এগুলি মহেন্দ্রবর্মার শাসনকালে নির্মিত।
নেল্লোর চোল রাজবংশ
নেল্লোর চোল রাজবংশের শাসনকালে নেল্লোরের রাজশক্তি মধ্যগগনে উদীত হয় এবং পরে তার পতন ঘটে। এই রাজবংশের মন্ত্রী তথা তেলুগু ভাষায় মহাভারত অনুবাদকারী বিশিষ্ট কবি টিক্কানা সোমযজুলু তার অপর গ্রন্থ নির্বাচনোত্তর রামায়নলুতে এই রাজবংশের ইতিহাস বিবৃত করেছেন। কল্যাণীর পশ্চিম চালুক্যদের সামন্ত তেলুগু চোল রাজবংশের একটি শাখা এঁদের পাকানাডুর শাসক নিযুক্ত করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল চোল ও চালুক্যদের মধ্যে যুদ্ধে সাহায্য লাভ করা। অধুনা নেল্লোর, কাডাপা, চিত্তুর ও চেঙ্গলপুট জেলা এঁদের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা ছিল। এঁদের রাজধানী ছিল বিক্রমসিংহপুরী (আধুনিক নেল্লোর)।
টিক্কা (১২২৩-১২৪৮) হোয়সল ও পাণ্ড্যদের পরাজিত করে তোন্ডাইমণ্ডলম অঞ্চল অধিকার করেন এবং চোলস্থাপনাচার্য উপাধি গ্রহণ করেন। টিক্কার পুত্র ও উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় মনুমসিদ্ধির (১২৪৮-১২৬৩) শাসনকালে অন্য চালুক্য ও পাণ্ড্যরা নেল্লোর আক্রমণ করেছিল। টিক্কানা কাকতীয় রাজা গণপতিদেবের কাছে গিয়ে তার প্রভুর হয়ে সামরিক সাহায্য লাভে সমর্থ হন। ১২৫০ সাল লাগাদ মনুমসিদ্ধি ও কানিগিরি অঞ্চলের এররাগাড্ডাপাডুর প্রধান কাটামারাজুর মধ্যে একটি তৃণভূমিতে গবাদিপশু চারণের অধিকার নিয়ে মারাত্মক বিবাদ বাধে। এই বিবাদের ফলে পেন্না নদীর তীরে মুট্টুকুরুর কাছে পঞ্চলিঙ্গলে এক ভয়ানক যুদ্ধ হয়। টিক্কানার জ্ঞাতিভাই খেডগা টিক্কানার নেতৃত্বে মনুমসিদ্দির বাহিনী এই যুদ্ধে জয়লাভ করে। এই বিবাদ ও বিবাদপ্রসূত যুদ্ধ পরবর্তীকালে জনপ্রিয় গাথাকাব্য "কাটামারাজু কথা"র উপজীব্য হয়েছি। এই যুদ্ধের কিছুকাল পরেই মনুমসিদ্ধি মারা যান এবং নেল্লোর তার গুরুত্ব হারায়।
কাকতীয়, পাণ্ড্য ও বিজয়নগর সাম্রাজ্য
কল্যাণীর পশ্চিম চালুক্যদের সামন্ত কাকতীয়রা প্রোলার প্রভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এই রাজবংশের প্রথম রাজা গণপতি দেব প্রায় সমগ্র তেলুগু দেশকে নিজের রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। ১৩শ শতাব্দীতে নেল্লোর কাকতীয় রাজ্যের অধীনে ছিল। পরে কিছুকালের জন্য এই অঞ্চল পাণ্ড্যদের অধিকারভুক্ত হয়। পরে প্রতাপরুদ্র পাণ্ড্যদের পরাজিত করেন। কাকতীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর এই অঞ্চল প্রথমে তুঘলক ও পরে কোন্ডাবিডি রেড্ডিদের রাজ্যভুক্ত হয়।
১৪শ শতাব্দীতে এই জেলার অধিকাংশ অঞ্চল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সঙ্গম রাজবংশ কর্তৃক অধিকৃত হয়। উদয়গিরি প্রভৃতি অবশিষ্টাংশ ১৫১২ সালে এই সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক অধিকৃত হয়। ১৪শ শতাব্দীতে উদয়গিরিতে বিজয়নগর সম্রাটদের দ্বারা নির্মিত দুর্গের ধ্বংসাবশেষ এখনও দেখা যায়।
নবাব ও ব্রিটিশ যুগ
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতনের পর নেল্লোর জেলার ভূখণ্ডটি নবাবদের শাসনাধীনে আসে। ১৭৫৩ সালে আরকোট নবাবের ভাই নাজিবুল্লা এই অঞ্চলের শাসক হন। মছলিপত্তনমের ফরাসি ও মাদ্রাজের ব্রিটিশ শক্তির সাহায্যে নাজিবুল্লা ও নবাবদের মধ্যে এই অঞ্চলে একাধিক যুদ্ধ হয়েছিল। ১৭৬২ সালে কর্নেল ক্যালিয়াড নেল্লোর দুর্গ জয় করে সেটি নবাবদের হাতে তুলে দেন। ১৭৮১ সালে নবাব আজিম উদ্ দৌলা রাজস্ব হিসেবে নেল্লোর ফিরিয়ে দেন। ১৮০১ সালে তিনি এই জেলার অবশিষ্টাংশ তুলে দেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ডাইটনকে এই জেলার প্রথম কালেক্টর নিযুক্ত করেন। নেল্লোরকে জেলার রেভিনিউ ইউনিট ঘোষণা করা হয়।[৪]
ব্রিটিশ যুগে এই জেলা শান্তই ছিল। শুধু ১৮৩৮ সালে উদয়গিরির জায়গির বাজেয়াপ্ত করার ঘটনাটি রাজনৈতিক গুরুত্ব পায়। উদয়গিরির জায়গিরদার কুর্নুলের নবাবের সঙ্গে শাসক শক্তির বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে আসার পর এই জেলার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। শুধু ১৯০৪ সালে ওঙ্গোল তালুকটি নবগঠিত গুন্টুর জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।
স্বাধীনোত্তর যুগ
১৯৫৩ সালের ১ অক্টোবর পর্যন্ত নেল্লোর জেলা মাদ্রাজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর ভাষার ভিত্তিতে ভারতের রাজগুলির সীমানা পুনর্নির্ধারিত হলে, এই জেলাটি অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠনের ক্ষেত্রে এই জেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তেলুগু দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী পোট্টি শ্রীরামুলু অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠনের দাবিতে আমরণ অনশন করেছিলেন।
নেল্লোর জেলার অধিবাসীরা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই জেলার বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীরা হলেন মুত্থারাজু গোপালরাও ও পোট্টি শ্রীরামুলু। অন্ধ্রপ্রদেশের দুই জন মুখ্যমন্ত্রী এই জেলার বাসিন্দা ছিলেন। এঁরা হলেন ড. বেজাওয়াড়া গোপাল রেড্ডি ও নেদুরুমল্লি জনার্জন রেড্ডি। এই জেলার প্রধান রাজনৈতিক দল হল ওয়াইএসআর কংগ্রেস ও তেলুগু দেশম পার্টি। পার্শ্ববর্তী কাডাপা ও ওঙ্গোল জেলার তুলনায় এই জেলায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির সদস্য-সংখ্যা বেশি। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য পুচালাপল্লি সুন্দরাইয়া এই জেলায় কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিলেন।
১৯৭০ সালে নেল্লোর জেলার কিয়দংশ বিভাজিত করে প্রকাশম জেলা গঠন করা হয়।[৫]
ভূগোল
নেল্লোর জেলার পূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগর, দক্ষিণ দিকে অন্ধ্রপ্রদেশের রায়ালসীমা অঞ্চল, পশ্চিম দিকে কাডাপা জেলা এবং উত্তর দিকে প্রকাশম জেলা অবস্থিত। জেলার পূর্ব দিকের অংশটি নিম্নভূমি অঞ্চল। এই অঞ্চলটি পূর্বঘাট পর্বতমালার পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগরের দিকে নেমে গিয়েছে। জেলার পশ্চিম দিকে বেলিগোন্ডা পর্বতমালা এই জেলাকে কাডাপা জেলা থেকে পৃথক থেকে। পেন্নার নদ এই জেলাকে উত্তর-দক্ষিণে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে।
নেল্লোর জেলার আয়তন ১৩,০৭৬ বর্গকিলোমিটার (৫,০৪৯ মা২)।[৬] আয়তনের দিক থেকে এই জেলা ফিলিপিনসেরনেগ্রোস দ্বীপের প্রায় সমান।[৭] জেলার গড় উচ্চতা ১৯ মিটার (৬২ ফুট)
নেল্লোর জেলার প্রায় অর্ধেক জমি কৃষিজমি। বাকি অর্ধেক জমি পতিত জমি।[৮] কারণ, এই জমি পাথুরে এবং ঝোপঝাড়ে ঢাকা। পেন্নার, স্বর্ণমুখী ও গুন্ডলাকাম্মা এই জেলার প্রধান নদনদী। জেলার অধিকাংশ অঞ্চল এই নদীগুলির অববাহিকায় অবস্থিত। এই নদীগুলি পরিবহনযোগ্য নয়। এগুলি মূলত সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। কান্ডালেরু ও বোগ্গেরু প্রভৃতি নদী পেন্নারের উপনদী। জেলার অবশিষ্টাংশ এই নদীগুলির অববাহিকায় অবস্থিত। এই জেলায় প্রচুর পরিমাণে কোয়ার্টজাইট নামে এক ধরনের ফ্লিন্ট পাওয়া যায়। কোয়ার্টজাইট দিয়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ অস্ত্রশস্ত্র ও যন্ত্রপাতি তৈরি করত।