নবপত্রিকাবাংলা, অসম ও ওড়িশারদুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। নবপত্রিকা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। তবে বাস্তবে নবপত্রিকা নয়টি পাতা নয়, নয়টি উদ্ভিদ।
অর্থাৎ: কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু ও ধান।
একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেল সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়; স্ত্রীরূপের জন্য দু’টি বেল দিয়ে করা হয় স্তনযুগল। তারপর সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম কলা বউ।[১]
নয়টি উদ্ভিদের অধিষ্টাত্রী দেবী
নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়ঃ
কদলী বা রম্ভা (কলা গাছ): কদলি গাছ এর অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী;
দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী
”
আচার
[সপ্তমীর] দিন সকালে নিকটস্থ নদী বা কোনো জলাশয়ে (নদী বা জলাশয়ে না থাকলে কোনো মন্দিরে) নিয়ে যাওয়া হয়। পুরোহিত নিজেই কাঁধে করে নবপত্রিকা নিয়ে যান( অথবা কোন কোন সময় বাড়ি কিংবা ক্লাবের সদস্যরা)। তার পিছন পিছন ঢাকীরা ঢাক বাজাতে বাজাতে এবং মহিলারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি করতে করতে যান। শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয়। তারপর পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে নবপত্রিকাকে দেবীর ডান দিকে একটি কাষ্ঠসিংহাসনে স্থাপন করা হয়। পূজামণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকে।[২] বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল, নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়। পত্রিকাস্থ অপর কোনো দেবীকে পৃথকভাবে পূজা করা হয় না।[৩]
গবেষকদের মতে, নবপত্রিকার পূজা প্রকৃতপক্ষে শস্যদেবীর পূজা।[১] ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত লিখেছেন,
"এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্য-দেবীরই পূজা। পরবর্তীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। ... বলাবাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে।"[৪]
ডঃ জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে,
(ইংরেজি)
«“Another important aspect of the Devi is her concept as the personification of vegetation spirit, which is emphasised by her name Sākambhari already noted. This finds clear corroboration in the present day Navapatrikāpraveśa ceremony in autumnal worship of Durgā in Bengal.” [৫]»
(বাংলা)
«"দেবীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল উদ্ভিদের আত্মস্বরূপ হিসাবে ধারণা, যা তার নাম শাকম্ভরী দ্বারা জোর দেওয়া হয়েছে যা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলার শারদীয় দুর্গাপূজায় নবপত্রিকা প্রবেশ অনুষ্ঠানে এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।»
তবে হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য দুর্গাপূজার সঙ্গে শস্যদেবীর পূজার অনুষঙ্গটি স্বীকার করলেও, শাকম্ভরী তত্ত্বটিকে নবপত্রিকার উৎসরূপে মানেননি। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি লিখেছেন,
“আমি নবপত্রিকার উৎপত্তি ও প্রয়োজন বিন্দুমাত্র বুঝিতে পারি নাই। নবপত্রিকা নবদুর্গা, ইহার দ্বারাও কিছুই বুঝিলাম না। দেবীপুরাণে নবদুর্গা আছে, কিন্তু নবপত্রিকা নাই।... নবপত্রিকা দুর্গাপূজার এক আগন্তুক অঙ্গ হইয়াছে।... বোধ হয় কোনও প্রদেশে শবরাদি জাতি নয়টি গাছের পাতা সম্মুখে রাখিয়া নবরাত্রি উৎসব করিত। তাহাদের নবপত্রী দুর্গা-প্রতিমার পার্শ্বে স্থাপিত হইতেছে।” [৬]
উল্লেখ্য, মার্কণ্ডেয় পুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ নেই। কালিকাপুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ না থাকলেও, সপ্তমী তিথিতে পত্রিকাপূজার নির্দেশ রয়েছে।[১][৭]কৃত্তিবাস ওঝা বিরচিত রামায়ণে রামচন্দ্র কর্তৃক নবপত্রিকা পূজার উল্লেখ রয়েছে – “বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।”[১]
পাদটীকা
↑ কখগঘঙহিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, তৃতীয় খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ২০০৭ মুদ্রণ, পৃ. ২৩২-৩৫
↑Durga Puja: Yesterday, Today and Tomorrow, Sudeshna Banerjee, Rupa & co, Kolkata, 2006, p. 22