টেরেন্স জেমস জেনার (জন্ম: ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৪ - মৃত্যু: ২৫ মে, ২০১১) পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মাউন্ট ললি এলাকায় জন্মগ্রহণকারী অস্ট্রেলীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ও কোচ ছিলেন।[১]অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সময়কালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেছেন।
ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া ও সাউথ অস্ট্রেলিয়া এবং ইংরেজ ক্রিকেটে কেমব্রিজশায়ার দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। দলে তিনি মূলতঃ লেগ ব্রেক বোলিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে নিচেরসারিতে কার্যকরী ব্যাটিং করতেন টেরি জেনার।
শৈশবকাল
পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মাউন্ট ললি এলাকায় জন্মগ্রহণকারী টেরি জেনার অল-রাউন্ডার হিসেবে পার্থের গ্রেড ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো খেলার জন্যে মনোনীত হন। এ পর্যায়ে তার বয়স ছিল ১৭ বছর। দুই বছর গ্রেড ক্রিকেট খেলার পর ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে অভিষেক ঘটে তার।
প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট
১৯৬৩-৬৪ মৌসুম থেকে ১৯৭৬-৭৭ মৌসুম পর্যন্ত টেরি জেনারের প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান ছিল। ৭০-এর দশকের সূচনালগ্নে অস্ট্রেলিয়া দলে নিয়মিত সদস্যের মর্যাদা লাভে ব্যর্থ হন। কেমব্রিজশায়ারের পক্ষে মাইনর ক্রিকেটে এক মৌসুম অতিবাহিত করেন। মূলতঃ লেগ স্পিন বোলার ছিলেন। আক্রমণাত্মক ঢংয়ে ফিল্ডিং সাজিয়ে বোলিং করতেন তিনি। এছাড়াও, নিচেরসারির কার্যকরী ব্যাটসম্যান ছিলেন।[২]
১৯৬৩-৬৪ মৌসুমে মূলতঃ বোলিং অল-রাউন্ডার হিসেবে এ অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। তবে, ওয়াকা গ্রাউন্ডে স্পিনের উপযোগী পরিবেশ ছিল না। ইংল্যান্ডের লেফট-আর্ম অর্থোডক্স স্পিনার টনি লক দলে খেলতেন। ফলে খুব কমই প্রথম একাদশে খেলার সুযোগ পেতেন। চার মৌসুমে তিনি মাত্র ৩৪ উইকেট লাভ করেছিলেন।
১৯৬৭-৬৮ মৌসুমে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার দিকে ধাবিত হন। অ্যাডিলেড ওভালের স্পিনবান্ধব পিচে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। দলটিতে তিনি নিয়মিত সদস্যের মর্যাদা লাভ করেন। তিন মৌসুম খেলার পর ১৯৭০ সালে অস্ট্রেলীয় দলের সদস্যরূপে নিউজিল্যান্ড গমনের সুযোগ লাভ করেন। তবে, কোন টেস্টে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাননি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট
সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনে নয়টিমাত্র টেস্ট ও একটিমাত্র ওডিআইয়ে অংশগ্রহণ করেছেন টেরি জেনার। ২৭ নভেম্বর, ১৯৭০ তারিখে ব্রিসবেনে সফরকারী ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। ২৮ নভেম্বর, ১৯৭৫ তারিখে একই মাঠে সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্টে অংশ নেন তিনি।
১৯৭০-৭১ মৌসুমে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন। এ মৌসুমে ইংল্যান্ড দল অস্ট্রেলিয়ায় পদার্পণ করে। ব্রিসবেন টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারেননি। ০ ও ২ রান তুলেন এবং ২/৯৫ বোলিং পরিসংখ্যান গড়েন। ফলশ্রুতিতে তাকে দলের বাইরে রাখা হয়। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের স্পিনবান্ধব পরিবেশে সিরিজের সপ্তম ও চূড়ান্ত টেস্টে তাকে খেলার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ৩/৪২ লাভ করেন। প্রথম দিনেই সফরকারী ইংরেজ দল ১৮৪ রানে গুটিয়ে যায়। ব্যাটিংয়ে নেমে জন স্নো’র শর্ট বলে শূন্য রানে বিদেয় হন।[৩] এরফলে দর্শকের হাঙ্গামায় লিপ্ত হয় ও ইংরেজ অধিনায়ক রে ইলিংওয়ার্থ খেলোয়াড়দের নিরাপত্তাকল্পে মাঠ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৩৫/৮ থাকা অবস্থায় টেরি জেনার মাঠে নামেন। দৃঢ়চিত্তে সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ৩০ রান করেন ও শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন। অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ২৬৪ হলে সফরকারীদের জয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৮০ রান নির্ধারিত হয়। দ্বিতীয় ইনিংসে ১/৩৯ পান। অস্ট্রেলিয়া দলে টেস্টে পরাজিত হবার পাশাপাশি অ্যাশেজ খোঁয়ায়।[২][৪]
ওয়েস্ট ইন্ডিজ গমন
এরপর এক মৌসুম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে থাকেন। ১৯৭২-৭৩ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গমনার্থে তাকে দলের সদস্য করা হয়। পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজের শেষ চারটিতে তার অংশগ্রহণ ছিল। ২৬.৭০ গড়ে ১৩ উইকেট পান। তন্মধ্যে, ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনে সিরিজের পঞ্চম টেস্টে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ব্যক্তিগত সেরা বোলিং পরিসংখ্যান ৫/৯০ দাঁড় করান। ব্যাট হাতে নিয়ে একই খেলায় ৩৮ রানে অপরাজিত ছিলেন। এ ধরনের অবদান রাখা সত্ত্বেও পরবর্তী মৌসুমে দল নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক উপেক্ষিত হন।
১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পরবর্তী টেস্ট খেলার জন্যে মনোনীত হন। দুইটি খেলায় অংশ নেন। বল হাতে নিয়ে খুব কমই সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। ৪৮.৫০ গড়ে দুই উইকেট পান। তবে, অ্যাডিলেড ওভালে ব্যক্তিগত সেরা ৭৪ রান তুলে স্বার্থক টেস্ট অল-রাউন্ডার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। গুরুত্বপূর্ণ এ ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়াকে ৮৪/৫ থেকে উত্তরণ ঘটান ও দলকে জয়ে ভূমিকা রাখেন। পরের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটিমাত্র টেস্ট খেলেন। ২/৯০ বোলিং পরিসংখ্যান গড়েন। এটিই তার সর্বশেষ টেস্টে অংশগ্রহণ ছিল।[৪]
দলে নিয়মিতভাবে খেলার সুযোগ পাননি তিনি। ফলে, চার বছরের খেলোয়াড়ী জীবনে মাত্র নয় টেস্ট খেলতে পেরেছিলেন। কেবলমাত্র একবারই অস্ট্রেলিয়ার বাইরে বিদেশের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলেন। একটিমাত্র ওডিআইয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ হয়েছিল টেরি জেনারের। ১২ রান সংগ্রহ করেন। বল হাতে নিয়ে মিতব্যয়ীতার স্বাক্ষর রাখলেও কোন উইকেটের সন্ধান পাননি। ৮ ওভারে ২৮ রান খরচ করেন।[২]
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে উপেক্ষিত হবার পর আরও দুই বছর প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রাখেন। ১৯৭৬-৭৭ মৌসুম শেষে খেলার জগৎ থেকে বিদেয় নেন। অফ-স্পিনার অ্যাশলে মলেটের সাথে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বোলিং আক্রমণে নেতৃত্ব দিতেন। সামগ্রিকভাবে ১৩১টি প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অংশ নিয়ে ৩২.২০ গড়ে ৩৮৯ উইকেট পান। তন্মধ্যে, চৌদ্দবার পাঁচ-উইকেট ও একবার দশ উইকেটের সন্ধান পান। এছাড়াও, নিয়মিতভাবে ব্যাট হাতে নিয়ে মাঠে নামতেন। দশটি অর্ধ-শতরানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।[২]
ব্যক্তিগত জীবন
জুয়া খেলায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ফলে, নিয়োগকর্তার তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেন ও ১৯৮৮ সালে সাড়ে ছয় বছর কারাভোগ করতে বাধ্য হন। এ ঘটনাটি সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য, আঠারো মাস পর তাকে কারামুক্তি দেয়া হয়।[২][৫] এরপর অ্যাডিলেডভিত্তিক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট একাডেমিতে স্পিন বোলিং কোচের দায়িত্ব পালন করেন।
ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণের পর বিশ্বের অনেক খেলোয়াড়কে লেগ স্পিন বোলিংয়ের উপর প্রশিক্ষণ দেন। তন্মধ্যে, শেন ওয়ার্ন অন্যতম। অত্যন্ত সম্মানীয় কোচ হিসেবে শেন ওয়ার্নের খেলোয়াড়ী জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেন। এছাড়াও, বিশ্বের অনেক ধীরগতিসম্পন্ন বোলারের পরামর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি।[৬] এছাড়াও, অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনে ক্রিকেটে বেতার ধারাভাষ্যকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন।[২]
দেহাবসান
এপ্রিল, ২০১০ সালে টেরি জেনার হৃদযন্ত্রক্রীয়ায় আক্রান্ত হন।[৬] দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ২৫ মে, ২০১১ তারিখে নিজ গৃহে ৬৬ বছর বয়সে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড এলাকায় তার দেহাবসান ঘটে। এরপর, ৩০ মে, ২০১১ তারিখে অ্যাডিলেড ওভালে তার অন্তেষ্টিক্রীয়া সম্পন্ন হয়।[১]