মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসারঅ্যাপোলো কর্মসূচি সফলভাবে চাঁদে মানুষকে অবতরণ করানোর একমাত্র উদ্যোগ এবং এই কর্মসূচি সফলভাবে ৬ বার মানব চন্দ্রাভিযান চালিয়েছিল। চাঁদে মানুষের প্রথম অবতরণ ঘটেছিল ১৯৬৯ সালে, যখন দুজন অ্যাপোলো ১১ নভোচারী চাঁদে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করেছিলেন এবং পৃথিবীতে চন্দ্রশিলা ও বিভিন্ন নমুনা এনেছিলেন।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক আনাক্সাগোরাস (মৃত্যু: ৪২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) যুক্তি দিয়েছিলেন যে, সূর্য এবং চন্দ্র উভয়ই অতিকায় শিলাখণ্ড, এবং চাঁদ সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে। তার এ ধর্মবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তাকে কারাবাস করতে ও শেষ পর্যন্ত নির্বাসিত হতে হয়েছিল।[১]
প্লুতার্ক তার "অন দ্য ফেস ইন দ্য মুনস অর্ব" বইয়ে বলেন, চাঁদের বুকে গভীর গর্ত রয়েছে যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না এবং এই গর্তগুলো নদী বা গভীর খাদের ছায়া ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি চাঁদে বসতি থাকার সম্ভাবনাও উল্লেখ করেছিলেন। অ্যারিস্টার্কাস আরও এক ধাপ এগিয়ে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব গণনা করেছিলেন।
এতে তিনি পৃথিবীর ব্যাসার্ধের ২০ গুণ একটি মান পেয়েছিলেন। (প্রকৃত মান ছিল পৃথিবীর ব্যাসার্ধের প্রায় ৬০ গুণ।) পৃথিবীর ব্যাসার্ধ মোটামুটিভাবে ইরাটোস্থেনিসের সময়কাল থেকে জানা ছিল।
যদিও হান রাজবংশের চীনারা (২০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-২০২ খ্রিস্টাব্দ) চাঁদকে কুই এর শক্তি বলে বিশ্বাস করত, তাদের 'বিকিরণকারী প্রভাব' তত্ত্ব দ্বারা স্বীকৃত ছিল যে, চাঁদের আলো শুধুমাত্র সূর্যের প্রতিফলন (যা আনাক্সগোরাস দ্বারা উল্লিখিত হয়েছে)।[২]
এটি জিং ফাং[২] এর মতো মূলধারার চিন্তাবিদদের দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল যিনি চাঁদের গোল আকৃতির কথা উল্লেখ করেছিলেন।[২] সং রাজবংশের (৯৬০-১২৭৯) শেন কুয়ো (১০৩১-১০৯৫) চাঁদের দশার বৃদ্ধি পাওয়া এবং ক্ষয় হওয়াকে প্রতিফলক রূপার একটি গোলকের সাথে তুলনা করেছিলেন। যাকে সাদা পাউডার দিয়ে মাখিয়ে দিয়ে পাশ থেকে দেখলে অর্ধচন্দ্র মনে হয়।[২]
৪৯৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে, ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট তার আর্যভট্টীয় গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে প্রতিফলিত সূর্যালোকই চাঁদকে আলোকিত করে।[৩]
হাবাশ আল-হাসিব আল-মারওয়াজি, একজন পারস্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বাগদাদের আল-শাম্মিসিয়া মানমন্দিরে ৮২৫ এবং ৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ পরিচালনা করেছিলেন।[৪] এই পর্যবেক্ষণগুলি ব্যবহার করে, তিনি চাঁদের ব্যাস অনুমান করেছেন ৩০৩৭ কি.মি. (যা ১৫১৯ কি.মি. ব্যাসার্ধের সমতুল্য)। তার হিসেবে চাঁদ হতে পৃথিবীর দূরত্ব ছিল ৩,৪৬,৩৪৫ কিমি (২,১৫,২০৯ মা)।[৪]
১১ শতকে, ইসলামি যুগের পদার্থবিজ্ঞানী আলহাজেন অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চাঁদের আলো নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে চাঁদের নিজস্ব আলোক ও সূর্যের আলোর সমন্বয় বিদ্যমান এবং চাঁদের সূর্যালোক শোষণ ও বিকিরণ করার ক্ষমতা রয়েছে।[৫][৬]
মধ্যযুগে দূরবীক্ষণ আবিষ্কারের আগে, ব্যাপকভাবে মানুষ চাঁদকে একটি গোলক হিসেবে জানতে শুরু করে, যদিও অনেকের বিশ্বাস ছিল যে চাঁদ "সম্পূর্ণ মসৃণ"।[৭] ১৬০৯ সালে, গ্যালিলিও গ্যালিলি তার বই সাইডেরাস নানসিয়াস এ চাঁদের প্রথম টেলিস্কোপিক চিত্র আঁকেন এবং উল্লেখ করেন যে, চন্দ্রপৃষ্ঠ মসৃণ নয় বরং তাতে পাহাড় এবং গর্ত রয়েছে।
১৭ শতকে, জিওভান্নি বাত্তিস্তা রিকিওলি এবং ফ্রান্সেস্কো মারিয়া গ্রিমাল্ডি চাঁদের একটি মানচিত্র আঁকেন এবং অনেক খাদের নামকরণ করেন যা আজও প্রচলিত। মানচিত্রে, চাঁদের পৃষ্ঠের অন্ধকার অংশগুলিকে মারিয়া (একবচনে মারে) বা সমুদ্র, এবং আলোকিত অংশগুলিকে টেরা বা মহাদেশ বলা হয়েছিল।
টমাস হ্যারিয়ট, সেইসাথে গ্যালিলি, চাঁদের প্রথম টেলিস্কোপিক উপস্থাপনা আঁকেন এবং কয়েক বছর ধরে চাঁদ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তার আঁকা চিত্রগুলো অপ্রকাশিত রয়ে যায়।[৮] ১৬৪৫ সালে বেলজিয়ান কসমোগ্রাফার এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্লোরেন্ট ভ্যান ল্যাংরেন চাঁদের প্রথম মানচিত্র তৈরি করেছিলেন।[৮] দুই বছর পরে জোহানেস হেভেলিয়াস অনেক বেশি প্রভাবশালী প্রচেষ্টা চালান।
১৬৪৭ সালে হেভেলিয়াস সেলেনোগ্রাফিয়া প্রকাশ করেন, যা সম্পূর্ণরূপে চাঁদকে নিয়ে লেখা প্রথম গ্রন্থ। হেভেলিয়াসের নামকরণগুলো, অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রোটেস্ট্যান্ট দেশগুলিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। যা ১৬৫১ সালে জেসুইট জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওভান্নি বাতিস্তা রিকসিওলি দ্বারা প্রকাশিত পদ্ধতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল, যিনি চন্দ্রপৃষ্ঠের খালিচোখে দেখা দাগগুলোকে সমুদ্র এবং দূরবীক্ষণিক খাদগুলোকে দার্শনিক এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নামে নামকরণ করেন।[৮]
১৭৫৩ সালে ক্রোয়েশিয়ান জেসুইট এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী রজার জোসেফ বসকোভিচ চাঁদে বায়ুমণ্ডলের অনুপস্থিতি আবিষ্কার করেছিলেন। ১৯২৪ সালে ফ্রাঞ্জ ফন গ্রুইথুইসেন বলেন চন্দ্রপৃষ্ঠের গর্ত উল্কার আঘাতের ফলে উদ্ভুত।[৯]
চাঁদে গাছপালা এবং জীবের বসবাসের সম্ভাবনাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ১৯ শতকের প্রথম দশকেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছিলেন। ১৯৩৪-১৮৩৬ সালে, উইলহেম বিয়ার এবং জোহান হেনরিখ ম্যাডলার তাদের চার খণ্ডের ম্যাপা সেলেনোগ্রাফিকা এবং ১৯৩৭ সালে ডার মন্ড বই দুটি প্রকাশ করেন, যা দৃঢ়ভাবে এই সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত করে যে চাঁদে কোন জল বা উল্লেখযোগ্য বায়ুমণ্ডল নেই।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
১৯৫৯ সালে লুনা ৩ থেকে তোলা চাঁদের বিপরীত অংশের চিত্র
সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান স্নায়ুযুদ্ধ অনুপ্রাণিত "মহাকাশ প্রতিযোগিতা" এবং "চন্দ্র প্রতিযোগিতা" ত্বরান্বিত হয়েছিল যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল চাঁদ। এর ফলে বৈজ্ঞানিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে, যেমন ১৯৫৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক চাঁদের বিপরীত অংশের প্রথম আলোকচিত্র ধারণ এবং ১৯৬৯ সালে চাঁদে প্রথম মানুষের অবতরণ যা কেবল ২০ শতকের নয়, মানব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচ্য।
চাঁদের পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার প্রথম কৃত্রিম বস্তু ছিল ৪ জানুয়ারি, ১৯৫৯ এ সোভিয়েত প্রেরিত একটি মানবশূন্য মহাকাশযান লুনা ১। এটি প্রথম যান হিসেবে সূর্যের চারদিকের সূর্যকেন্দ্রিক কক্ষপথে পৌঁছায়।[১১] খুব কম মানুষই জানত যে লুনা ১ চাঁদের পৃষ্ঠে আছড়ে পড়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য নকশা করা হয়েছিল।
চাঁদের পৃষ্ঠে আছড়ে পড়া প্রথম পর্যবেক্ষক মহাকাশযানটি ছিল সোভিয়েত মহাকাশযান লুনা ২, যেটি ১৯৫৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ২১:০২:২৪ সসস সময়ে চাঁদে পৌঁছেছিল। ১৯৫৯ সালের ৭ অক্টোবর সোভিয়েত মহাকাশযান লুনা ৩ চাঁদের অন্ধকার দিকের প্রথম ছবি তুলতে সক্ষম হয়। যদিও আজকের মানদণ্ডে ছবিগুলো অস্পষ্ট, তবুও চিত্রগুলোতে দেখা যায় যে চাঁদের দূরবর্তী অংশে মারিয়া একেবারেই নেই।
মার্চ ৪, ১৯৫৯ সালে প্রথম মার্কিন মহাকাশযান হিসেবে পাইওনিয়ার ৪ চাঁদের পাশ দিয়ে উড়ে যায়। এটি লুনা ১ এর কিছুদিন পরেই উৎক্ষেপিত হয়। চাঁদের জন্য মার্কিন মহাকাশযান উৎক্ষেপণের ৮টি প্রচেষ্টার মধ্যে এটিই একমাত্র যা সফল হয়।[১২]
এই সোভিয়েত সাফল্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রয়াসে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি "জরুরি জাতীয় প্রয়োজনে কংগ্রেসের কাছে বিশেষ বার্তা"-তে মনুষ্যবাহী যান চাঁদে অবতরণের প্রস্তাব করেছিলেন:
এখন সময় এসেছে বৃহত্তর পদক্ষেপ নেওয়ার - সময় এসেছে একটি মহান আমেরিকান নবউদ্যোগের - এই জাতির জন্য এখন সময় মহাকাশ বিজয়ে স্পষ্ট অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার, যা অনেক উপায়ে পৃথিবীতে আমাদের ভবিষ্যত অর্জনের চাবিকাঠি হতে পারে। ...যদিও আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারি না যে আমরাই একদিন প্রথম হব, আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারি যে এই প্রচেষ্টা করতে ব্যর্থতাই একদিন আমাদের ‘চুড়ান্ত’ করবে।
...আমি বিশ্বাস করি যে এই জাতির একটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করা উচিত, তা হল, এই দশক শেষ হওয়ার আগে, একজন মানুষকে চাঁদে অবতরণ করানো এবং তাকে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা। এই সময়ের মধ্যে কোন একক মহাকাশ প্রকল্প মানবজাতির জন্য এর চেয়ে বেশি চিত্তাকর্ষক হবে না, বা মহাকাশের দীর্ঘ পরিসরের অনুসন্ধানেও এত গুরুত্বপূর্ণ হবে না; এবং তা এত কঠিন বা ব্যয়বহুলও হবে না।
...এটা পরিষ্কার করা উচিত যে আমি কংগ্রেস এবং দেশকে একটি নতুন কর্মপন্থার প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করতে বলছি- এমন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া এবং খুবই ব্যয়বহুল।...[১৩]
রেঞ্জার ১ রাষ্ট্রপতি কেনেডির ভাষণের মাত্র ৩ মাস পরে ১৯৬১ সালের আগস্টে উৎক্ষেপিত হয়েছিল। এটি আরও ৩ বছর চলে এবং ছয়টি ব্যর্থ রেঞ্জার অভিযান পরিচালনা করে। অবশেষে রেঞ্জার ৭, ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে চন্দ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ার পূর্বে চাঁদের ছবি পাঠায়। উৎক্ষেপণ যান, গ্রাউন্ড ইকুইপমেন্ট এবং মহাকাশযানের যান্ত্রিক বেশ কিছু সমস্যা রেঞ্জার প্রোগ্রাম এবং সাধারণভাবে প্রাথমিক অনুসন্ধান অভিযানগুলোকে জর্জরিত করে। এই সমস্যা, ব্যর্থতা ও এর শিক্ষা, কংগ্রেসে কেনেডির বিখ্যাত বক্তৃতার পরে এবং ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে তার মৃত্যুর আগে একমাত্র সফল মার্কিন মহাকাশ অনুসন্ধান মেরিনার ২ অভিযানে সাহায্য করেছিল।[১৪] মার্কিন সাফল্য রেঞ্জার ৭ অভিযানের পর থেকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
১৯৬৬ সালে ইউএসএসআর চন্দ্রপৃষ্ঠে প্রথম সফল অবতরণ সম্পন্ন করে এবং লুনা ৯ এবং লুনা ১৩ অভিযানের সময় ‘চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে’ চাঁদের প্রথম ছবি তোলা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রেঞ্জার অভিযানের পর সার্ভেয়ার প্রোগ্রাম এর সূচনা করে[১৫] যা চাঁদের পৃষ্ঠে সাতবার রোবোটিক মহাকাশযান পাঠায়। সাতটি মহাকাশযানের মধ্যে পাঁচটি সফলভাবে অবতরণ করে ও নিশ্চিত করে যে চন্দ্রপৃষ্ঠের ধুলো নভোচারীদের চাঁদে দাঁড়ানোর জন্য যথেষ্ট অগভীর।
২৪ ডিসেম্বর, ১৯৬৮-এ, অ্যাপোলো ৮ এর অভিযাত্রী ফ্রাঙ্ক বোরম্যান, জেমস লাভেল এবং উইলিয়াম অ্যান্ডার্স চন্দ্রের কক্ষপথে প্রবেশকারী প্রথম মানুষ হয়ে ওঠেন এবং ব্যক্তিগতভাবে চাঁদের দূরবর্তী দিকটি দেখেন। মানুষ প্রথম চাঁদে অবতরণ করেছিল ২০ জুলাই, ১৯৬৯ সালে। চন্দ্রপৃষ্ঠে হাঁটা প্রথম মানুষ ছিলেন অ্যাপোলো ১১ এর কমান্ডার নিল আর্মস্ট্রং।
চাঁদে অবতরণকারী প্রথম রোবট চন্দ্ররোভার লুনোখড ১ ছিল লুনোখড প্রোগ্রামের অংশ যা ১৭ নভেম্বর, ১৯৭০ সালে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করে। আজ অবধি, চাঁদে দাঁড়ানো শেষ মানুষ ছিলেন ইউজিন সারনান, যিনি অ্যাপোলো ১৭ অভিযানের অংশ হিসাবে, ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে চাঁদে হেঁটেছিলেন।
তিনটি লুনা অভিযান (লুনা ১৬, ২০ এবং ২৪) এবং অ্যাপোলো অভিযান ১১ থেকে ১৭ (অ্যাপোলো ১৩ বাদে, যা তার পরিকল্পিত চন্দ্র অবতরণ বাতিল করেছিল) দ্বারা চন্দ্রশীলার নমুনা পৃথিবীতে আনা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে লুনা ২৪ ও ১৯৯৪ সালে ক্লেমেন্টাইন ছিল যথাক্রমে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা শেষ চাঁদে অনুসন্ধান। এর পর মূলত দেশগুলো অন্যান্য গ্রহে অনুসন্ধান, মহাকাশ স্টেশন ও শাটল প্রোগ্রামে আগ্রহী।
চন্দ্র প্রতিযোগিতার পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈজ্ঞানিক এবং সামরিক চন্দ্রঘাটির জন্য প্রাক-প্রকল্প ছিল: লুনেক্স প্রজেক্ট এবং প্রজেক্ট হরাইজন। ক্রু অবতরণ ছাড়াও, সোভিয়েত মনুষ্যবাহী চন্দ্র অভিযানসহ একটি বহুমুখী চন্দ্রবেইজ "জভেজদা" নির্মাণ বাতিল করে, এটি ছিল একটি বিশদ প্রকল্প, যা অভিযাত্রী যানবাহন[১৬] এবং চন্দ্রপৃষ্ঠের মডিউলগুলির উন্নত সংস্করণ সম্পন্ন।[১৭]
১৯৯০ সালের পর
১৯৯০ সালে জাপান চাঁদের চারপাশে একটি বস্তুকে কক্ষপথে স্থাপনকারী তৃতীয় দেশ হিসেবে "হিটেন" মহাকাশযানের সাহায্যে চাঁদ পরিদর্শন করে। মহাকাশযানটি হাগোরোমো নামক কৃত্রিম উপগ্রহ চন্দ্র কক্ষপথে স্থাপন করে, কিন্তু এর ট্রান্সমিটার ব্যর্থ হওয়ায় এটি আর কাজ করে নি। জাক্সা-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট অনুসারে, ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে, জাপান "চন্দ্রের উৎপত্তি এবং বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করা এবং ভবিষ্যতের চন্দ্র অন্বেষণের জন্য প্রযুক্তি বিকাশের উদ্দেশ্যে" "সেলেন" মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করে।[১৮]
ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইসা) ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৩-এ স্মার্ট ১ নামে একটি ছোট, কম খরচের চন্দ্রযান উৎক্ষেপণ করেছিল। স্মার্ট ১-এর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল রঞ্জন ও অবলোহিত রশ্মিতে চন্দ্রপৃষ্ঠের ত্রিমাত্রিক ছবি তোলা। স্মার্ট ১, ১৫ নভেম্বর ২০০৪ তারিখে চন্দ্রের কক্ষপথে প্রবেশ করে এবং ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৬ পর্যন্ত চন্দ্র পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এরপর "চন্দ্রপৃষ্ঠের প্রতিক্রিয়া" অধ্যয়ন করার জন্য এটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে চন্দ্র পৃষ্ঠে বিধ্বস্ত করা হয়।[১৯]
দ্য ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স অর্গানাইজেশন এবং নাসা ১৯৯৪ সালে ক্লিমেন্টাইন অভিযান এবং ১৯৯৮ সালে লুনার প্রোসপেক্টর চালু করে। নাসা ১৮ জুন, ২০০৯-এ লুনার রিকনেসান্স অরবিটার চালু করে, যা চাঁদের পৃষ্ঠের চিত্র সংগ্রহ করেছে। এটি লুনার ক্রেটার অবজারভেশন অ্যান্ড সেন্সিং স্যাটেলাইট (এলসিআরওএসএস) বহন করে, যা চন্দ্রপৃষ্ঠে অবস্থিত "ক্যাবিউস খাদ" এ জলের সম্ভাব্য অস্তিত্বের তদন্ত করেছিল। জিআরএআইএল হল আরেকটি অভিযান যা ২০১১ সালে চালু করা হয়েছে।
চাঁদে প্রথম বাণিজ্যিক অভিযানটি ছিল ম্যানফ্রেড মেমোরিয়াল মুন অভিযান (৪এম), যার নেতৃত্বে ছিল লাক্সস্পেস। সহযোগিতায় ছিল জার্মান ওএইচবি এজি। অভিযানটি ২৩ অক্টোবর ২০১৪-এ লং মার্চ থ্রি সি/জি২ রকেটের উপরের পর্যায়ে সংযুক্ত চীনা চ্যাং'ই ৫ টি১ পরীক্ষামূলক মহাকাশযানের সাথে চালু করা হয়েছিল।[২০][২১] ৪এম মহাকাশযানটি ২৮ অক্টোবর ২০১৪ এর এক রাতে চাঁদের পার্শ্বআবর্তন করে, তারপরে এটি পৃথিবীর উপবৃত্তাকার কক্ষপথে প্রবেশ করেছিল, এটি তার পরিকল্পিত জীবনকালের চার গুণ সময় স্থায়ী হয়।[২২][২৩]
ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ এবং স্পেসআইএল দ্বারা পরিচালিত বেরেশিট ল্যান্ডারটি ১১ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে একটি ব্যর্থ অবতরণ প্রচেষ্টার পরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।[২৪]
চীন
চীন চাঁদে অনুসন্ধানের জন্য তাদের নিজস্ব কর্মসূচি শুরু করেছে এবং চাঁদে খনির সম্ভাবনা তদন্ত করছে, বিশেষত পৃথিবীতে শক্তির উৎস হিসাবে ব্যবহারের জন্য এটি চন্দ্রপৃষ্ঠে হিলিয়াম-৩আইসোটোপ বা সমস্থানিক অনুসন্ধান করেছে।[২৫] চীন ২৪ অক্টোবর, ২০০৭-এ ছাং-ও ১ নামক রোবোটিক চন্দ্র প্রদক্ষিণকারী যান উৎক্ষেপণ করেছিল৷ যা মূলত এক বছরের অভিযানের জন্য পরিকল্পনা করা হয়। ছাং-ও ১ অভিযানটি খুবই সফল অভিযান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং আরও চার মাসের জন্য এর মেয়াদ বাড়ানো হয়৷ ১ মার্চ, ২০০৯-এ, ছাং-ও ১ কে, ১৬ মাসের অভিযান সম্পূর্ণ করে চন্দ্র পৃষ্ঠে ধ্বংসপ্রাপ্ত করা হয়। ১ অক্টোবর, ২০১০-এ, চীন ছাং-ও ২ চন্দ্রপ্রদক্ষিণকারী যান উৎক্ষেপণ করে। চীন ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৩ তারিখে তৃতীয় দেশ হিসেবে চাঁদে রোভার ছাং-ও ৩ অবতরণ করায়।[২৬] চ্যাং'ই ৩, ১৯৭৬ সালে উৎক্ষিপ্ত লুনা ২৪ এর পর প্রথম মহাকাশযান যা চন্দ্রপৃষ্ঠে নিরাপদ অবতরণ করেছিল। যেহেতু চ্যাং'ই ৩ অভিযান সফল হয়েছিল, তাই পুনরায় ব্যাকআপ ল্যান্ডার ছাং-ও ৪ কে নতুন অভিযানের লক্ষ্যে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। চীন ৭ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে ছাং-ও ৪ কে চাঁদের দূরবর্তী অংশে প্রেরণ করে।[২৭] ৩ জানুয়ারি ২০১৯-এ, ছাং-ও ৪ চাঁদের দূরবর্তী দিকে অবতরণ করে।[২৮] এই যানটি ইউটু-২ নামক চন্দ্র রোভার চন্দ্রপৃষ্ঠে মোতায়েন করেছিল, যা পরবর্তীকালে চন্দ্র পৃষ্ঠ ভ্রমণের জন্য বর্তমান রেকর্ড দূরত্ব-ভ্রমণকারী হয়ে ওঠে।[২৯] এই অভিযানের অন্যান্য আবিষ্কারগুলোর মধ্যে, ইয়ুটু ২আবিষ্কার করেছে যে, চাঁদের দূরবর্তী কিছু স্থানে ১২ মিটার গভীর ধুলো বিদ্যমান।[৩০]
চীন ২০১৭ সালে তার ছাং-ও ৫ মহাকাশযানের মাধ্যমে চন্দ্রনমুনা সংগ্রহ করার অভিযান পরিচালনা করার পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু সেই অভিযানটি স্থগিত করা হয়।[৩১] এর কারণ ছিল ছাংচেং ৫ এর উড্ডয়নযানের ব্যর্থতা।[৩২] যাইহোক, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে লং মার্চ ৫ রকেটের ফ্লাইটের সফল প্রত্যাবর্তনের পর, চীন তার ছাং-ও ৫ নমুনা ফেরত অভিযানকে ২০২০ সালের শেষের দিকে পরিচালনার লক্ষ্যস্থির করে।[৩৩] চীন ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ এ প্রায় ২ কিলোগ্রাম চন্দ্রনমুনা ফেরত আনার মাধ্যমে এই অভিযানটি সম্পন্ন করে।[৩৪]
২২ অক্টোবর ২০০৮-এ ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) চন্দ্রযান-১ নামে একটি মানববিহীন চন্দ্র প্রদক্ষিণকারী মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করেছিল।[৩৫] চাঁদে অনুসন্ধানটি আসলে দুই বছরের জন্য চাঁদকে প্রদক্ষিণ করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল। এর বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের উভয় পিঠের ত্রিমাত্রিক মানচিত্র গঠন এবং চন্দ্রপৃষ্ঠের রাসায়নিক এবং খনিজের অবস্থান বিশ্লেষণ।[৩৬] যানটি চন্দ্রপৃষ্ঠে মুন ইমপ্যাক্ট প্রোব নিক্ষেপ করে যা ১৪ নভেম্বর ২০০৮ ১৫:০৪ জিএমটি সময়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে আঘাত করে[৩৭] যা ভারতকে চন্দ্রপৃষ্ঠে পৌঁছানো চতুর্থ দেশ করে তোলে। চন্দ্রযান-১ এর অনেক কৃতিত্বের মধ্যে ছিল চন্দ্রের মাটিতে পানির অণুর ব্যাপক উপস্থিতি আবিষ্কার।[৩৮] এই অভিযানের পর ২২ জুলাই ২০১৯-এ চন্দ্রযান-২ উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং তা ২০ আগস্ট ২০১৯-এ চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করেছিল। চন্দ্রযান-২ ভারতের প্রথম চন্দ্র অবতরকবিক্রম এবং রোভার প্রজ্ঞান বহন করেছিল, কিন্তু এইগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে ব্যর্থ হয়। তবে অর্বিটারটি অক্ষত অবস্থায় আছে।[৩৯]
১৪ জুলাই ২০২৩-এ ভারত চন্দ্রযান-৩ উৎক্ষেপণ করেছিল এবং এর উদ্দেশ্য চাঁদে অবতরণ করা।[৪০]
মার্কিন কনস্টেলেশন প্রোগ্রাম স্থগিত হওয়ার পর, রাশিয়া, ইএসএ, চীন, জাপান এবং ভারত চাঁদে মানুষ প্রেরণের অভিযান করার ঘোষণা দেয়। বর্তমানে তাদের সকলেরই আরও মানুষবিহীন মহাকাশযানের সাহায্যে চাঁদের অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে।
ভারত ২০২২ সালে চন্দ্রযান-৩ অবতরণ অভিযান চালু করার পরিকল্পনা করছে। তাছাড়াও ভারতের ২০২৪ সালে চন্দ্রমেরু অনুসন্ধান অভিযান জাপানের সাথে যৌথভাবে পরিচালনা করার সম্ভাবনা রয়েছে।
রাশিয়াও পূর্বে স্থগিত হওয়া প্রকল্প "লুনা-গ্লোব" ২০২১ সালে পুনরায় শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। লুনা-গ্লোব ছিল মনুষ্যবিহীন একটি কক্ষপথ প্রদক্ষিণকারী ও অবতরণকারী যান।[৪১] ২০১৫ সালে, রসকসমস জানিয়েছে যে, রাশিয়া ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে নভোচারীদের স্থাপন করে মঙ্গল গ্রহের অভিযানগুলো নাসা'র হাতে ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। এর উদ্দেশ্য নাসা'র সাথে যৌথভাবে কাজ করা এবং মহাকাশ প্রতিযোগিতা এড়ানো।[৪২] একটি রাশিয়ান লুনার অরবিট স্টেশন বর্তমানে প্রস্তাবিত হয়েছে যা ২০৩০ সাল নাগাদ চাঁদের কক্ষপথে স্থাপন করা হবে।
২০১৮ সালে নাসা তাদের "মহাকাশ নীতি নির্দেশিকা" সমর্থনে একটি সামগ্রিক অনুসন্ধান অভিযানের অংশ হিসাবে বাণিজ্যিক এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে চাঁদে পুনরায় অভিযান পরিচালনা করার পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে, যার অংশ হিসেবে তারা "আর্টেমিস প্রোগ্রাম" এবং "বাণিজ্যিক লুনার পেলোড পরিষেবা (সিএলপিএস)" এর সূচনা করেছে। নাসা চন্দ্রপৃষ্ঠে রোবোটিক অভিযান, সেইসাথে মনুষ্য-পরিচালিত চন্দ্র প্রারম্ভিকা শুরু করার পরিকল্পনা করেছে। ২০১৯ সাল থেকে, নাসা নতুন ছোট চন্দ্র পেলোড ডেলিভারি পরিষেবা তৈরি করতে, চন্দ্রের ল্যান্ডার তৈরি করতে এবং মানুষের প্রত্যাবর্তনের আগে চাঁদের পৃষ্ঠে আরও গবেষণা পরিচালনা করার জন্য চুক্তি জারি করছে।[৪৩] আর্টেমিস প্রোগ্রামে ওরিয়ন মহাকাশযানের বেশ কয়েকটি ফ্লাইট এবং ২০২২ থেকে ২০২৮ পর্যন্ত চন্দ্র অবতরণে কাজ করবে।[৪৪][৪৫]
৩ নভেম্বর, ২০২১-এ নাসা ঘোষণা করেছে যে এটি একটি মানববিহীন মহাকাশযানের জন্য শ্যাকেলটন ক্রেটারের কাছে চন্দ্র দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে একটি অবতরণ স্থান বেছে নিয়েছে যাতে নাসা'র পোলার রিসোর্সেস আইস-মাইনিং এক্সপেরিমেন্ট-১ অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুনির্দিষ্ট অবস্থানটিকে শ্যাকেলটন কানেক্টিং রিজ বলা হয়, যা যোগাযোগের জন্য পৃথিবীর সাথে কাছাকাছি-অবিচ্ছিন্ন সৌর এক্সপোজার এবং দৃষ্টিরেখার সুবিধা দেয়।[৪৬]
↑O'Connor, J.J.; Robertson, E.F. (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯)। "Anaxagoras of Clazomenae"। University of St Andrews। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-১২।
↑ কখগঘNeedham, Joseph (১৯৮৬)। Mathematics and the Sciences of the Heavens and Earth। Science and Civilization in China। 3। Taipei: Caves Books। পৃষ্ঠা 227; 411–416। আইএসবিএন978-0-521-05801-8।
↑Kennedy, John F. (মে ২৫, ১৯৬১)। Special Message to Congress on Urgent National Needs (Motion picture (excerpt))। Boston, MA: John F. Kennedy Presidential Library and Museum। Accession Number: TNC:200; Digital Identifier: TNC-200-2। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১, ২০১৩।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)