ঘূর্ণিঝড় সিডর (সুপার ঘূর্ণিঝড় সিড্র, ইংরেজিতেSuper Cyclonic Storm Sidr) হচ্ছে ২০০৭ সালে বঙ্গোপসাগরে এলাকায় সৃষ্ট একটি ঘূর্ণিঝড়। ২০০৭ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে এটি ৪র্থ নামকৃত ঘূর্ণিঝড়। এটির আরেকটি নাম ট্রপিক্যাল সাইক্লোন ০৬বি (Tropical Cyclone 06B)। শ্রীলংকান শব্দ 'সিডর' বা 'চোখ'-এর নামের এর নাম করণ করা হয়েছে।[১] ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সকাল বেলা পর্যন্ত বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিমি/ঘণ্টা এবং ৩০৫ কিমি/ঘণ্টা বেগে দমকা হাওয়া বইছিলো। একারণে সাফির-সিম্পসন স্কেল অনুযায়ী একে ক্যাটেগরি-৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আখ্যা দেয়া হয়।[২] এই ঝড়ে কমপক্ষে ৩,৪৪৭ জন মানুষ মারা যায়,[৩] তবে কিছু ধারণা অনুযায়ী এই সংখ্যা ১৫,০০০ পৌঁছেছে।[৪] বাংলাদেশ সরকার এ ঘটনাকে জাতীয় দূর্যোগ বলে ঘোষণা করেছে। এ ঘূর্ণিঝড়ে ৮.৯ মিলিয়ন হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।[৫]
আবহাওয়ার ইতিহাস
সিডর এর ইতিহাস
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ২০০৭ সালের ৯ নভেম্বর একটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। ১১ নভেম্বর আবহাওয়ায় সামান্য দুর্যোগ এর আভাস পাওয়া যায়, এবং এর পরেরদিনই এটি ঘূর্ণিঝড় সিডর-এ পরিণত হয়। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে এটি দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে এবং বাংলাদেশে একটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি করে।[৬]
মোকাবেলার প্রস্তুতি
নভেম্বর ১৭ তারিখে ক্যাটাগরি-৪ সমতুল্য ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কার সাথে সাথে কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবক পূর্বাঞ্চলীয় ভারত এবং বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অগ্রিম মোতায়েন করা হয়েছে। বাংলাদেশের ১১টি উপকূলীয় জেলায় ৪২ হাজার ৬৭৫ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে।[৭] লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়েছে। যদিও উপকূল অঞ্চল থেকে জনগনকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে কিন্তু উপকূলের ১০ মিলিয়ন লোকের জন্য মাত্র ৫০০,০০০ লোকের আশ্রয়ের ব্যবস্থা আছে।[৮] আইএমডি ওড়িশা এবং পশ্চিম বঙ্গেনভেম্বর ১৪ তারিখে বিপদ সংকেত ঘোষণা করেছে।[৯]নভেম্বর ১৪ তারিখ রাত ৮টার পর মংলা বন্দরের সকল কার্যক্রম এবং রাত ১০টায় চট্টগ্রামেরশাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান উঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।[৭] ঝড়ের আশঙ্কায় ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বিশেষ সতর্ক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল[১০] এবং নভেম্বর ১৫ তারিখে ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় অঞ্চলে নৌ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল।[১১]
ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রীয় অংশ নভেম্বর ১৫ তারিখ সন্ধ্যা ৬টার পর বাংলাদেশের পাথরঘাটায় বালেশ্বর নদীর কাছে উপকূল অতিক্রম করে। ঝড়ের তান্ডবে উপকূলীয় জেলা সমূহে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ঝড়ো হাওয়া বইছে সাথে বিপুল পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের দেশের বিদ্যুত ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিদ্যুত বিপর্যয়ের ফলে ঢাকা সহ সাড়া দেশেই দেখা দিয়েছে পানি সমস্যা।[১২][১৩]কৃষি মন্ত্রনালয়ের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের প্রায় ৬০০,০০০ টন ধান নষ্ট হয়েছে যার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হয়েছে।[১৪] সুন্দর বনের পশুর নদীতে বেশ কিছু হরিণের মৃত্য দেহ ভাসতে দেখা গেছে এবং বিপুল সংখ্যক প্রাণীর মৃত্যুর আশঙ্কা করা হয়েছে।[৫] ঝড়ের প্রভাবে প্রায় ৯৬৮,০০০ ঘরবাড়ী ধ্বংস এবং ২১০,০০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এ ঝড়ে প্রায় ২৪২,০০০ গৃহপালিত পশু এবং হাঁসমুরগী মারা গেছে।[১৫]
পরিণাম
ঝড়ের পরেই বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর ৫টি জাহাজ খাদ্য, ঔষধ এবং ত্রাণ সামগ্রীসহ সর্বাধিক ঘূর্ণি ঝড় কবলিত এলাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। ইউরোপীয়া কমিশন €১.৫ মিলিয়ন ইউরো($২.৪ মিলিয়ন ইউএসডি) সমপরিমাণ ত্রাণ সামগ্রি বাংলাদেশকে প্রদান করেছে।[১৬] যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড স্টেট নেভী প্রায় ৩,৫০০ জন নৌ সেনা ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রমে সাহায্যের জন্য প্রেরণ করেছে।[১৭]
অন্যান্য সংস্থাও সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে ওয়ার্ল্ড ভিশন ২০,০০০ ঘড়ে গৃহহীন লোকজনের গৃহ নির্মানে সাহায্যের জন্য স্বেচ্ছাসেবক প্রেরণ করেছে। সাথে রেড ক্রশ এ উদ্ধার তৎপরতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।[১৭] দুর্গত এলাকায় উদ্ধার তৎপরতা চালানোর জন্য ইউএসএস এসেক্স ও ইউএসএস কিয়ারসার্জ নামে দুটি নৌযান বাংলাদেশের পথে রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের সাহায্যের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ২১ লাখ ডলার অর্থ সহায়তা পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। [১৮]ফিলিপাইন সরকার বাংলাদেশে ত্রাণ তৎপরতায় সাহায্যের জন্য মেডিকেল টিম পাঠাবে।[১৯] পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শ রবিবারের প্রার্থনায় বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের ত্রাণসহ সব রকমের সাহায্যের আহ্ববান জানিয়েছেন।[২০]ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, যুক্তরাজ্য সরকার, ইউএসএইড, ইসলামিক রিলিফ-ইউকে এবং স্পেন ৩০ মিলিয়িন মার্কিন ডলারের সাহায্যের অঙ্গিকার করেছে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডাব্লএফপি) দুর্গত মানুষের জন্য ১০,০০০ মেট্রিক টন চাল এবং ২০০ টন উচ্চ প্রোটিন সম্মৃদ্ধ বিস্কুটের অনুমোদন দিয়েছে।[১৫]
তথ্যসূত্র
↑"আমাদের দেশ পত্রিকা"। ১৪ নভেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ নভেম্বর ২০০৭।