১৭৭৬ সালে তিনি মাদ্রাজ জেনারেল হাসপাতালে সহকারী সার্জন হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।[৩] সেখানেই তিনি লিনিয়াসের (Linnaeus) এক বিশিষ্ট ছাত্র যোহান জেরহার্ড কোয়েনিগ (Johan Gerhard Koenig, ১৭২৮-১৭৮৫) কর্তৃক উদ্ভিদবিজ্ঞান চর্চায় বিশেষভাবে অণুপ্রাণিত হন। ১৭৮০ সালে রক্সবার্গ সার্জন হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। এ সময়ে তার চাকরির প্রথম ভাগ অতীবাহিত হয় মাদ্রাজ থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার উত্তরে সামালকোট-এর (Samalkot) গ্যারিসন ˆস্টশন (garrison station) বা সেনা কেন্দ্রে। সামালকোটে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে এক উদ্যান প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে কফি, মরিচ , দারচিনি, নীল এবং ব্রেডফ্রুট (breadfruit) চাষ করেন এবং সে সঙ্গে লাক্ষাজাতিয় পতঙ্গের (cochineal insect) পোষক উদ্ভিদ Opuntia-এর ওপর পরীক্ষা পরিচালনা করেন। ১৭৯০ সালে তিনি এবারডীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমডি ডিগি্র লাভ করেন এবং এডিনবার্গের রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস (Royal College of Physicians, Edinburgh)-এর ফেলো নির্বাচিত হন। রক্সবার্গ ভারতের কয়েকজন চিত্রশিল্পীকে উদ্ভিদের চিত্র আঁকার প্রশিক্ষণ দেন। এসব শিল্পী স্থানীয় গাছপালার প্রায় ৫০০টি চিত্র আঁকেন। তাদের চিত্রের সঙ্গে সংযোজিত হয় প্রতিটি উদ্ভিদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, ব্যবহার এবং আনুষঙ্গিক তথ্যাদি। রক্সবার্গের এ কাজগুলি পরবর্তীতে Plants of the Coast of Coromandel নামে নিজ দেশের কোম্পানি কর্তৃক ১৭৯৫, ১৮০২ এবং ১৮১৯ সালে কয়েকটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
কলকাতার জীবন
কলকাতা বটানিক্যাল গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট কিড (Robert Kyd, ১৭৪৬-১৭৯৩)-এর মৃত্যুর পর রক্সবার্গ ১৭৯৩ সালের নভেম্বর মাসে এ উদ্যানের সুপাররিনটেনডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার অদম্য উৎসাহ এবং নিরলস প্রচেষ্টায় বোটানিক গার্ডেন অল্প দিনের মধ্যেই এক বিশিষ্ট উদ্যানরূপে গড়ে ওঠে।রক্সবার্গ তার এই নতুন পদ ও দায়িত্বকে এক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সেগুন , বেঙ্গল হেম্প (Bengal hemp), ভার্জিনিয়া তামাক (Virginia tobacco), অ্যারাবিয়ান কফি (Arabian coffee) এবং নীলের (indigo) চারা সংগ্রহ করে পরীক্ষামূলকভাবে তিনি বাগানে চাষাবাদ শুরু করেন। ১৭৯৪ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যেই তিনি ২০০০-এর বেশি চারা অথবা বীজ ভারতের বিভিন্ন স্থানে, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং সেন্ট হেলেনায় পাঠান। যেসব বিদেশী নতুন গাছপালা তিনি কলকাতার বাগানে জন্মাবার চেষ্টা করেছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফেঞ্চ ওলিভ (French olive) এবং জ্যামাইকার মসলা (Jamaican spice)। এছাড়া তিনি ফসল উৎপাদনের জন্য মাত্র গুটিকয়েক শস্যজাতের ওপর সাধারণ কৃষকের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালান। ১৭৯৭ সালের অক্টোবর মাসে রক্সবার্গ জায়ফলের (nutmeg) কয়েকটি চারা নমুনা হিসেবে আদালত প্রাঙ্গণে রোপণ করেন যা দীর্ঘদিন টিকে ছিল। নভেম্বরে তিনি প্রায় ১৭০টি উদ্ভিদের চারা এবং প্রায় ১২০টি উদ্ভিদ প্রজাতির বীজ রোপণের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন। পরীক্ষামূলকভাবে উদ্ভিদ জন্মাবার প্রচেষ্টার মধ্যে ভারতীয় শন (Indian hemp), তিসি এবং আঁশবিশিষ্ট আরও কয়েকটি ফসল উল্লেখযোগ্য।এসব উৎসাহী এবং গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ ইংল্যান্ডের সোসাইটি অব আর্টস (Society of Arts) তিন বার তাকে স্বর্ণপদক প্রদান করে।
কর্মকাণ্ড
রক্সবার্গ যখন উদ্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন সেখানে প্রায় ৩০০ প্রজাতির গাছপালা ছিল। ১৮১৩ সালে তার অবসর গ্রহণকালীন সময়ে ঐ বাগানে উদ্ভিদের প্রজাতি সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫০০। এছাড়া ২৫৩৩টি বিজ্ঞানসম্মত চিত্র তিনি রেখে যান। এসব চিত্র এবং তার তৈরি অসংখ্য উদ্ভিদের শুষ্প নমুনা (dry specimens) পরবর্তীকালে এ উপমহাদেশের অন্যতম এক বিশিষ্ট হার্বেরিয়াম (herbarium) প্রতিষ্ঠার সূচনা করে। রক্সবার্গ ভারত ত্যাগের পরে উইলিয়ম কেরী (William Carey) বোটানিক গার্ডেনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ১৮১৪ সালে ১৫১০টি উদ্ভিদ প্রজাতির ওপর Hortus Bengalensis নামে এক ক্যাটালগ (catalogue) প্রকাশ করেন। সবগুলি উদ্ভিদই ঐ সময় বাগানে ছিল। এছাড়া রক্সবার্গ Flora Indica নামে এক পাণ্ডুলিপি উইলিয়ম কেরীর হাতে দিয়ে যান। ১৮২০ সালে উইলিয়ম কেরী এটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রকাশের পূর্বে অবশ্য উদ্যানের এক কর্মকর্তা ন্যাথানিয়েল ওয়ালিক (Nathaniel Wallich) আরও কিছু উদ্ভিদের বর্ণনা এতে সংযোজন করেন। বইটির প্রথম খণ্ড ১৮২০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় খণ্ডে ওয়ালিক নতুন আরও অনেক তথ্য ও বর্ণনা যোগ করেন এবং এটি প্রকাশিত হয় ১৮২৪ সালে।১৮৩২ সালে কেরী রক্সবার্গের Flora Indica কোন পরিবর্তন ছাড়াই তিন খণ্ডে পুনর্মুদ্রণ করেন। এই সংস্করণ একটি দুর্লভ এবং মূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। রক্সবার্গ নিঃসন্দেহে এ উপমহাদেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানের পথিকৃৎ এবং তিনিই প্রথম ভারতীয় উদ্ভিদের একটি ধারাবাহিক ও সুশৃঙ্খল বিবরণী প্রকাশ করেন। প্রকৃতপক্ষে তার রচিত Flora Indica-এর মাধ্যমেই সূচিত হয় এ উপমহাদেশে উদ্ভিদসংক্রান্ত গবেষণা কাজ। এই মহান বিজ্ঞানী এডিনবার্গেরপার্ক প্লেস (Park Place)-এ ১৮১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র
↑Bole, P. V. 1976. Review of Flora Indica or Descriptions of Indian Plants. by William Roxburgh, William CareyThe Quarterly Review of Biology, Vol. 51, No. 3:442-443
↑Grove, R. H. (1997) Ecology, Climate and Empire The White House Press, UK, p.128