ইরানের সংস্কৃতি, পারস্যের সংস্কৃতি হিসেবেও পরিচিত, বিশ্বের অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী সংস্কৃতি। ইরানকে সভ্যতার দোলনা হিসেবে অভিহিত করা হয়।[১][২][৩][৪] বিশ্বে ইরানের আধিপত্য বিস্তারকারী ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও সংস্কৃতির কারণে ইরান পশ্চিমে ইতালি, ম্যাসিডোনিয়া, ও গ্রিস,[৫] উত্তরে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণে আরব উপদ্বীপ এবং পূর্বে ভারত উপমহাদেশ ও পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতি ও জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করে।[১][২]
ইরানের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও তার ঐতিহাসিক দীর্ঘস্থায়িত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সারগ্রাহী সাংস্কৃতিক স্থিতিস্থাপকতা।[৬]
শিল্পকলা
ইরানের শিল্প-ঐতিহ্য বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন, সমৃদ্ধ ও সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী এবং এর আওতায় রয়েছে সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, স্থাপত্যকলা, চিত্রাঙ্কন, বুনন, মৃৎশিল্প, হস্তলিপিবিদ্যা, ধাতব ও পাথুরেকর্ম সহ অসংখ্য শাখা।
ইরানি শিল্পকলা একাধিক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়েছে, যা ইরানের অদ্বিতীয় নান্দনিকতার প্রমাণ। এই পর্যায়সমূহ এলামাইট চোগা জানবিল থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় ও পার্সেপোলিসের হাখমেনীয় কারুশিল্প থেকে বিশাপুরের মোজাইক পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভাষা
ইরান জুড়ে জনগণ কয়েকটি ভাষায় কথা বলে থাকেন। ইরানে ইরানি, তুর্কি ও সেমিটিক ভাষা পরিবারের বিভিন্ন ভাষা ব্যবহৃত হয়। সিআইএ ফ্যাক্টবুক অনুসারে, মাতৃভাষা হিসেবে ইরানের ৭৮% জনগণ ইরানি ভাষা, ১৮% জনগণ তুর্কি ভাষা ও ২% জনগণ সেমিটিক ভাষা ব্যবহার করে, বাকি ২% জনগণ বিভিন্ন ভাষা পরিবারের ভাষা ব্যবহার করে।[৭] উল্লেখ্য যে আজারবাইজানিরা তুর্কি ভাষা পরিবারের একটি ভাষায় কথা বললেও তাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও বংশধারার কারণে তাদেরকে প্রায়ই ইরানিদের সাথে সম্পর্কিত বলে গণ্য করা হয়।
ইরানের প্রধান ও জাতীয় ভাষা হল পার্সি, যা সারা দেশ জুড়েই ব্যবহৃত হয়। আজারবাইজানি ভাষা উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে, কুর্দি ও লুরি ভাষা পশ্চিমে, মাজান্দারানি ও গিলাকি ভাষা কাস্পিয়ান সাগর অঞ্চলে, আরবি ভাষা পার্সি উপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে, বালোচি দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে, এবং তুর্কমেন ভাষা উত্তর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তৃত ছোট ভাষাসমূহ হল তালিশ, জর্জীয়, আর্মেনীয়, আসিরীয়, এবং সির্কাসীয়।
এথনোলগের হিসাব অনুযায়ী ৮৬টি ইরানি ভাষা রয়েছে, তন্মধ্যে বৃহৎ ভাষাসমূহ হল পার্সি, পশতু ও কুর্দি উপভাষা। বিশ্বব্যাপী ১৫০-২০০ মিলিয়ন লোক মাতৃভাষা হিসেবে এসকল ইরানি ভাষা ব্যবহার করে থাকে।[৮][৯][১০] পার্সি উপভাষা চীন থেকে শুরু করে সিরিয়া ও রাশিয়ার অঞ্চলসমূহে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে ইরানি প্লাতোতে।
সাহিত্য
ইরানের সাহিত্য বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ সাহিত্য, যার ব্যাপ্তি ২৫০০ বছরের অধিক, তন্মধ্যে রয়েছে অসংখ্য হাখমানীয় লিপি, যেমন বেহিস্তুন লিপি, থেকে শুরু করে ইসলামি স্বর্ণযুগ ও আধুনিক ইরানের প্রখ্যাত কবিগণ।[১১][১২][১৩] ইরানি সাহিত্যকে মানবতার অন্যতম সেরা সাহিত্য ও বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম প্রধান চারটি সাহিত্যের একটি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।[১৪][১৫] প্রসিদ্ধ অধ্যাপক এল পি এলওয়েল-সাটন পার্সি ভাষার সাহিত্যকে "বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ কাব্যিক সাহিত্য" বলে অভিহিত করেন।[১৬]
হাখমানেশি সময়কালে মহান আলেকজান্ডার কর্তৃক পার্সেপোলিসের গ্রন্থাগারসমূহ ধ্বংস এবং ৬৪১ সালে আরব কর্তৃক ইরান আক্রমনকালে সকল অ-কুরআনীয় লেখনীসমূহ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কারণে প্রাক-ইসলামি ইরানের খুব অল্প সাহিত্যকর্মই এখনো পাওয়া যায়।[১৭] এই দুটি আক্রমণে ইরানি গ্রন্থাগারসমূহ ধ্বংস হয়ে যায়, বইগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয় অথবা নদীতে ছুড়ে ফেলা হয়। এই বইসমূহ রক্ষার একমাত্র উপায় ছিল সেগুলো মাটিতে পুঁতে রাখা, কিন্তু অনেকগুলো লেখনীর কথা সময়ের ব্যবধানে লোকজন ভুলে যান। তবে গুপ্ত বইসমূহের উত্তোলনের পর বই ও গ্রন্থাগারের প্রতি ইরানিদের ভালোবাসা ও মোহের প্রকাশ পায়। আরবরা ইরানিদের এই উদ্দীপনাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। ধীরে ধীরে চাহিদা অনুসারে ইরানিরা বই লিখতে শুরু করে এবং গ্রন্থাগারে তা একত্রিত করতে থাকে।[১৭]
সঙ্গীত
ইরানি সঙ্গীত পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া, ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতিকে সরাসরি প্রভাবিত করেছে।[১৮] এটি পার্শ্ববর্তী তুর্কি ও আরবি সংস্কৃতির সঙ্গীত পরিভাষাকে প্রভাবিত করেছে এবং ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সাম্রাজ্য সময়কালে ভারতে পৌঁছায়। মুঘল রাজদরবার ইরানি সঙ্গীতজ্ঞদের এনে নতুন সাঙ্গীতিক ধরনের প্রচার করে।[১৮]
ইরান জটিল বাদ্যযন্ত্রের উৎপত্তির স্থান, যেগুলোর উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে।[১৯] রূপা, সোনা ও কপারের তৈরি অসংখ্য তূর্য পূর্ব ইরানে পাওয়া যায়, যা অক্সাস সভ্যতার এবং এগুলোর উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ থেকে ১৭৫০ অব্দে।[১৯]
নৃত্য
ইরানের সমৃদ্ধ ও প্রাচীন নৃত্যের সংস্কৃতি রয়েছে, যার উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ সহস্রাব্দ। ইরানের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাগৈতিহাসিক স্থানসমূহ খনন করে পাওয়া প্রাচীন উপকরণের নৃত্যের চিত্র থেকে সকল উদ্যাপনে বিভিন্ন ধরনের নৃত্যের সংস্কৃতি পাওয়া যায়। এইসব উপকরণসমূহে সঙ্গীত সহযোগে অভিনয়শিল্পী, নৃত্যশিল্পী ও সাধারণ মানুষকে মঞ্চনাটক, নাটক, উদ্যাপন, শোক এবং ধর্মীয় রীতিনীতিতে বিভিন্ন উপাদান, তথা প্রাণী বা উদ্ভিদের পোশাক, মুখোশ ও অন্যান্য বস্তু নিয়ে নাচতে দেখা যায়। সময়ের সাথে সাথে নৃত্যের এই সংস্কৃতি আর উন্নত ও বিস্তৃত হতে শুরু করে।[২০]
সাধারণত দলগত নৃত্য প্রায়ই ভিন্ন এবং ধর্ম ও জাতীগত গোষ্ঠীর নামানুসারে হয়ে থাকে। এই নৃত্যগুলো শৃঙ্খল নৃত্য হতে পারে, যেখানে একটি দল অথবা আরও প্রচলিত নৃত্য দল হতে পারে যা মূলত বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে, যেমন বিবাহ বা নরুজ উদ্যাপনে পরিবেশিত হয়।[২১] একক নৃত্য মূলত বিভিন্ন ইরানি রাজবংশের ঐতিহাসিক ও রাজদরবারের নৃত্যগুলোর পুনঃসংস্করণ, তন্মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত হল সাফাভি ও কাজার রাজবংশ সময়ের নৃত্যশৈলি কারণ এগুলো তুলনামূলক নতুন। এগুলো উন্নত ধরনের নৃত্য যেখানে হাত ও বাহুর সাবলীল বিচরণ দেখা যায়, যেমন কবজির ঘূর্ণন।[২১]
স্থাপত্য
ইরানি স্থাপত্যের ইতিহাসের শুরু খ্রিস্টপূর্ব ৫,০০০ অব্দে এবং এর বৈশিষ্টসমূহ তুরস্কের বিশাল অঞ্চল, ইরাক, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান থেকে দক্ষিণ ককেশাস ও জাঞ্জিবারে বিস্তৃত। বর্তমানে ইরানিদের নকশাকৃত ও নির্মাণকৃত ইউনেস্কো ঘোষিত ১৯টি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে, তন্মধ্যে ১১টি ইরানের বাইরে অবস্থিত। ইরানি স্থাপত্যে গঠনগত ও নান্দনিক ভিন্নতা রয়েছে। তাছাড়া ইরান আক্রমণকারী তথা গ্রিক থেকে শুরু করে আরব ও তুর্কিদের মধ্যে ইরানের স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ্যণীয়।[২২][২৩]
ইরানে ধর্ম
আরবদের বিজয়ের পূর্বে প্রায় এক সহস্রাব্দের বেশি সময় জরুথ্রস্ট্রুবাদ ছিল ইরানের জাতীয় ধর্মবিশ্বাস। ইরানের জনগণ ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার পরও ইরানি দর্শনে এই ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার ব্যাপক প্রভাব ছিল।[২৪]
বর্তমানে ইরানে মুসলিমের সংখ্যা শতকরা ৯৮ ভাগ, তন্মধ্যে ৮৯% শিয়া এবং মাত্র ৯% সুন্নী। বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম জনবহুল দেশের তুলনায় শিয়া ও সুন্নীদের অনুপাত সম্পূর্ণ বিপরীত।
সমকালীন শিল্পকলার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ হলেন শিরিন আলিয়াবাদি, মোহাম্মদ এহসাই, রামিন হায়েরিজাদে, রোকনি হায়েরিজাদে, গোলনাজ ফাতহি, মনির হাহরুদি ফারমানফারমাইয়ান, পারাস্তু ফরোহার, পুরান জিঞ্চি, ফরহাদ মোশিরি, শিরিন নেশাত, পারভিজ তানাভোলি, ওয়াই. জে. কামি ও চার্লস হোসেন জেন্দারুদি।[২৫]
সঙ্গীত
ইরানের সঙ্গীতের বিভিন্ন ধরনের মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী লোক ও ধ্রুপদী সঙ্গীত। এছাড়াও পপ ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য ধরন, তথা জ্যাজ, রক, হিপহপও ইরানের সঙ্গীতের অংশ হয়ে গেছে।
স্থাপত্য
১৯২০-এর দশকে পাহলভির শাসনামল থেকে সমকালীন স্থাপত্যের সূত্রপাত ঘটে। এই সময়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ হলেন আন্দ্রে গোডার্ড, হায়দার ঘিয়াই, হুশাং সেহোন, দারিয়ুস বোরবর।
ঐতিহ্যবাহী উদ্যাপন
ইরানিরা চন্দ্র পঞ্জিকা অনুসারে নিম্নোক্ত দিনগুলো উদযাপন করে থাকে:
↑ কখবখতিয়ার, আফশিন (২০১৪)। Iran the Cradle of Civilization। গুয়া হাউজ অব কালচারাল আর্ট। আইএসবিএন9647610033।
↑"Iran – Cradle of Civilisation"। ড্রেন্টস মিউজিয়াম। ১২ এপ্রিল ২০১৮। ৩ জুন ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ নভেম্বর ২০১৯।
↑"Kermanshah, A Cradle of Civilization"(পিডিএফ)। ড্রেন্টস মিউজিয়াম। সেপ্টেম্বর ২৮, ২০০৭। ২৮ নভেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল(পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ নভেম্বর ২০১৯।
↑এবারহার্ড, ডেভিড এম.; সিমন্স, গ্যারি এফ.; ও ফেনিং, চার্লস ডি. (সম্পাদক)। ২০১৯। Ethnologue: Languages of the World। ২২তম সংস্করণ। ডালাস, টেক্সাস: এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল। অনলাইন সংস্করণ: http://www.ethnologue.com।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
↑স্পুনার, ব্রায়ান (১৯৯৪). "Dari, Farsi, and Tojiki". In Marashi, Mehdi (ed.). Persian Studies in North America: Studies in Honor of Mohammad Ali Jazayery. Leiden: Brill. pp. 177–178.
↑স্পুনার, ব্রায়ান (২০১২). "Dari, Farsi, and Tojiki". In Schiffman, Harold (ed.). Language policy and language conflict in Afghanistan and its neighbors: the changing politics of language choice. Leiden: Brill. p. 94.
↑ক্যামবেল, জর্জ এল.; কিং, গ্যারেথ, অন্যান্য (২০১৩)। "Persian". Compendium of the World's Languages (3rd ed.). রোটলেজ। পৃ. ১৩৩৯।
↑ভন ডেভিড লেভিনসন; ক্রিস্টেনসেন, ক্যারেন, Encyclopedia of Modern Asia, চার্লস স্ক্রিবনার্স সন্স। ২০০২। সংখ্যা ৪, পৃ. ৪৮০।
↑এলওয়েল-সাটন, এল.পি. (অনূদিত), In search of Omar Khayam by Ali Dashti, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭১, আইএসবিএন০-২৩১-০৩১৮৮-২
↑ কখকেন্ট, অ্যালেন; ল্যাঙ্কোর, হ্যারল্ড; ডেইলি, জে ই. (১৯৭৫)। Encyclopedia of Library and Information Science: Volume 13। পৃষ্ঠা ২৩, ২৪। আইএসবিএন9780824720131।
↑ কখ"IRAN xi. MUSIC"। এনসাইক্লোপিডিয়া ইরানিকা (ইংরেজি ভাষায়)। ৩০ মার্চ ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ২২ নভেম্বর ২০১৯।
↑ কখলাওয়ের্গ্রেন, বো (২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৯)। "MUSIC HISTORY i. Pre-Islamic Iran"। এনসাইক্লোপিডিয়া ইরানিকা (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২২ নভেম্বর ২০১৯।
↑ কখলরেন ভিক্টোরিয়া, গ্রে (২০০৭)। "A Brief Introduction to Persian Dance"। Central Asian, Persian, Turkic, Arabian and Silk Road Dance Culture (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৭ নভেম্বর ২০১৯।
↑পোপ, আর্থার আপহাম (১৯৬৫)। Persian Architecture। নিউ ইয়র্ক সিটি: জর্জ ব্রাজিলের। পৃষ্ঠা ২৬৬।
↑শাকেদ, শৌল (১৯৯৫)। From Zoroastrian Iran to Islam; In Henry Corbin, En Islam Iranien: Aspects spirituels et philosophiques (4 vols.), Gallimard, 1971-3.