আবদুর রহমান খান (পশতু: عبد رحمان خان) (১৮৩০ থেকে[১] ১৮৪৪ – ১ অক্টোবর ১৯০১) ছিলেন ১৮৮০ থেকে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আফগানিস্তানের আমির। তিনি মুহাম্মদ আফজাল খানের প্রথম পুত্র ও একমাত্র পুত্র এবং দোস্ত মুহাম্মদ খানের নাতি। আবদুর রহমান খান একজন শক্তিশালী শাসক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দ্বিতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের পর তিনি আফগান সরকারকে সংগঠিত করেছিলেন। তার আত্মীয়দের নেতৃত্বে পরিচালিত বিভিন্ন গোত্রের বিদ্রোহ তিনি দমন করেছিলেন। এজন্য তাকে "লৌহ আমির" বলা হত।[২]
প্রারম্ভিক জীবন
দোস্ত মুহাম্মদ খান মৃত্যুর পূর্বে তার তৃতীয় পুত্র শের আলি খানকে তার উত্তরসুরি ঘোষণা করে যান। শের আলি খানের বড় দুই ভাই ছিলেন মুহাম্মদ আফজাল খান ও মুহাম্মদ আজম খান। প্রথমে শের আলি খানকে মেনে নেয়া হলেও কয়েক মাস পরে আফজাল খান দেশের উত্তরাঞ্চলে বিদ্রোহ করেন। পিতার মৃত্যুর সময় তিনি এখানে শাসন করছিলেন। ফলে দোস্ত মুহাম্মদ খানের পুত্রদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয় এবং তা পাঁচ বছর ধরে চলে।
এই লড়াইয়ে আবদুর রহমান খান উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। তার বাবা আফজাল খান শের আলি খানের সাথে সমঝোতা করে নেন। তবে আবদুর রহমান খানের কর্মকাণ্ডে শের আলি খানের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। আবদুর রহমান খানকে কাবুলে তলব করা হলে তিনি আমু দরিয়া পার হয়ে বুখারা চলে যান। আফজাল খানকে বন্দী করা হয় এবং দক্ষিণ আফগানিস্তানে বিদ্রোহ দেখা দেয়।
আবদুর রহমান খান ও তার চাচা আজম খান ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে কাবুল অধিকার করে নেন। শের আলি খান কান্দাহার থেকে তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তবে মে মাসের ১০ তারিখ শাইখাবাদের যুদ্ধে তার বাহিনীর অনেক সৈনিক দলত্যাগ করে। আবদুর রহমান তার পিতা আফজাল খানকে গজনির কারাগার থেকে মুক্ত করে ক্ষমতায় বসান।
১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দ আবদুর রহমান খান ও আজম খান কান্দাহার অধিকার করেন। সেই বছরের শেষের দিকে আফজাল খান মারা যাওয়ার পর আজম খান নতুন শাসক হন এবং আবদুর রহমান উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশের গভর্নর হন। তবে ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে শের আলি খান পুনরায় ফিরে আসেন। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি তিনাহ খানে আবদুর রহমান খান এবং আজম খানকে তিনি পরাজিত করেন। তারা দুজন মধ্য এশিয়ায় আশ্রয় চান। আবদুর রহমান খান রুশদের অধীনস্থ সমরকন্দে আশ্রয় লাভ করেছিলেন।[৩] আজম খান অক্টোবরে কাবুলে মারা যান।
বহিষ্কার এবং সমঝোতা
আবদুর রহমান খান ১১ বছর তৎকালীন রুশ তুর্কিস্তানেরতাশখন্দে নির্বাসিত ছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে শের আলি খানের মৃত্যুর পর তাশখন্দে রুশ গভর্নর জেনারেল আবদুর রহমান খানকে ক্ষমতা লাভের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে চাপ দেন।[৩]
১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে আবদুর রহমান খান উত্তর আফগানিস্তানে পৌছেছেন এই মর্মে সংবাদ ভারতে পৌছায়। গভর্নর জেনারেল লর্ড লিটন তার সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকার তাদের বাহিনী ফিরিয়ে নিতে এবং কান্দাহার ও তার পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকা ছাড়া বাকি আফগানিস্তানের আমির হিসেবে তাকে মেনে নিতে রাজি ছিল। কিছু আলোচনার পর আবদুর রহমান খানের সাথে কাবুলে ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের প্রতিনিধি লেপেল গ্রিফিনের সাক্ষাত হয়। গ্রিফিন বর্ণনা করেছেন যে আবদুর রহমান খান মাঝারি উচ্চতার, বুদ্ধিদীপ্ত মুখাবয়বধারী, অমায়িক ও বিনীত আচরণকারী, কাজের ক্ষেত্রে বিচক্ষণ ছিলেন।
শাসনকাল
১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুলাই অনুষ্ঠিত দরবারে আবদুর রহমান খানকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমির ঘোষণা করা হয়। তিনি তার বৈদেশিক নীতি ব্রিটিশদের অণুকূলে পরিচালনা করবেন শর্তে তাকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তার নিশ্চয়তা দেয়া হয় এবং ভবিষ্যতে কোনো বিদেশি আগ্রাসনের সময় অনুরূপ অতিরিক্ত প্রয়োজন হলে তাও প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। শর্ত সাপেক্ষে ব্রিটিশরা আফগানিস্তান ত্যাগ করে। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা তার হাতে কান্দাহার সমর্পণ করে।
শের আলি খানের পুত্র আইয়ুব খান ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে আবদুর রহমান খানের বাহিনীকে পরাজিত করে হেরাত দখল করেন। আবদুর রহমান খান কাবুল থেকে অগ্রসর হন। দুই বাহিনী কান্দাহারের নিকটে মুখোমুখি হয়। এতে আবদুর রহমান খান জয়ী হন এবং আইয়ুব খান পারস্যে পালিয়ে যান। এরপর আবদুর রহমান খান আফগানিস্তানে তার শাসন সংহত করে। তিনি তার বিরুদ্ধে সংঘটিত বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। শক্তিশালী গিলজাই গোত্র তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। সে বছর আইয়ুব খান পারস্য থেকে আক্রমণের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে আমিরের চাচাত ভাই ইসহাক খান উত্তরাঞ্চলে বিদ্রোহ করেন তবে এতে তিনি সফল হননি।[৩]
১৮৮০ এর দশকের শেষের দিকে কৌশলগত কারণে বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর সদস্যদের পদ থেকে সরিয়ে দেন। এর একটি দৃষ্টান্ত হল, দুররানি ও গিলজাই গোত্রীয়দের উত্তরাঞ্চলের উজবেক ও তাজিক অধ্যুষিত অঞ্চলে পাঠানোর ঘটনা যাতে স্থানীয় দারিভাষীদের উপর অধিক গোয়ান্দা তথ্য পাওয়া যায়।[৪] ১৮৮৮ এর শেষের দিক থেকে তিনি আঠারো মাস যাবত উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে অবস্থান করেছিলেন। এখানে তিনি বিদ্রোহের কারণে সৃষ্ট অশান্ত অবস্থা প্রশমিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বিদ্রোহে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল।
সেই দশকের শেষের দিকে হাজারা গোত্র আবদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে এবং শের আলি খানের পক্ষে বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহ দমন করা হয়। এসময় কিছু হাজারা বর্তমান পাকিস্তানের কোয়েটা এবং অল্পসংখ্যক হাজারা ইরানের মাশহাদ চলে যায়। ১৮৯৫-১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আবদুর রহমান খান কাফিরিস্তানে আক্রমণ চালান। পরে এর নাম নুরিস্তান রাখা হয়।
১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে অসুস্থতার কারণে রাণি ভিক্টোরিয়ার আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড যেতে পারেননি। এর বদলে তিনি তার পুত্র নাসরুল্লাহ খানকে ইংল্যান্ডে পাঠান।
মৃত্যু
আবদুর রহমান খান ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ১ অক্টোবর মারা যান। তার পুত্র হাবিবউল্লাহ খান তার উত্তরসুরি হন।
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মর্টিমার ডুরান্ড আফাগানিস্তান ও ব্রিটিশ ভারতের সীমানা বিষয়ে ডুরান্ড লাইন নিয়ে আলোচনা করেন। মর্টিমার ডুরান্ডের নামানুসারে এই রেখার নাম হয় ডুরান্ড লাইন।[৩] এই রেখা এখনো কার্যকর রয়েছে।
এই নিবন্ধটি একটি প্রকাশন থেকে অন্তর্ভুক্ত পাঠ্য যা বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনে: চিসাম, হিউ, সম্পাদক (১৯১১)। "Abdur Rahman Khan"। ব্রিটিশ বিশ্বকোষ (১১তম সংস্করণ)। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)