২০২৪ সালের বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে বাংলাদেশ এবংভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মারাত্মক বন্যা এবং ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। জুন ও পরবর্তী মাসের বৃষ্টিপাতের কারণে পূর্ব বাংলাদেশ এবং ভারতের আসাম রাজ্যে উল্লেখযোগ্য বন্যা দেখা দেয়।[১] আগস্টে বাংলাদেশে তা ভয়াবহরূপ ধারণ করে।
ঘটনা
বাংলাদেশ
১৮-১৯ জুন সিলেট বন্যা
১৮-১৯ জুন দীর্ঘস্থায়ী ভারী বর্ষণের ফলে সৃষ্ট বন্যা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব হাওর অঞ্চলকে প্লাবিত করে, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় যথাক্রমে২৪২ মিমি এবং ২২৩ মিমি বৃষ্টিপাত হয়, যা উভয়ের মাসিক গড় বৃষ্টিপাতকে ছাড়িয়ে যায়।[২]
ফলস্বরূপ আকস্মিক বন্যা এবং ভূমিধসের ফলে সারা বাংলাদেশে কমপক্ষে ২.১ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রায় ৩০ হাজার লোককে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে হয়। উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশে, বেশ কিছু বাস্তুচ্যুত পরিবারকে আশ্রয়ের জন্য ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। সিলেট জেলার ২৩ টি ওয়ার্ড এবং ১৩ টি উপজেলার ১৫৪৮ টি গ্রাম সহ সিলেট জেলার প্রায় ৭৫% এলাকা প্লাবিত হয়, যা সরাসরি ৮২৫ হাজার জন মানুষকে প্রভাবিত করেছে। সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যায় অন্তত ৫ লাখ ৬০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।[১]ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আকস্মিক বন্যায় ৭৭২,০০০ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।[৩]ইউরোপীয় কমিশনের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে ভূমিধসে অন্তত ১৫ জন নিহত এবং ৫১,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সিলেট জেলার অর্ধশতাধিক ফসল ও ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে।[২]
১৮ এবং ১৯ জুন ২০২৪ -এ ভারী বৃষ্টিপাত দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে আঘাত হানে, যার ফলে ব্যাপক বন্যা এবং অন্তত ৭৭৩ টি ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। কমপক্ষে ১০ জন মারা গেছে, যাদের মধ্যে সাতজন রোহিঙ্গা শরণার্থী। ৩৩টি শরণার্থী শিবিরের ১২০০টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৮০০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷[১]
রাত থেকেই ফেনী জেলার পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার প্রায় বেশিরভাগ এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় মঙ্গলবার থেকে এ তিন উপজেলাসহ সোনাগাজী ও দাগনভূঞা উপজেলার কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ পুরোপুরি সংযোগ বন্ধ করা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ভারী বৃষ্টিতে ফেনী শহরে জলাবদ্ধতার কারণে দুপুর থেকে রাত অবধি বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়।[৪]
২০ আগস্ট
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এর তথ্য অনুযায়ী ২০ আগস্ট থেকে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার ৬৫ উপজেলা প্লাবিত হয়েছে।[৫]
২১ আগস্ট
কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়। সকাল থেকে উপজেলার অনেক এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার অধিকাংশ এলাকায় লাখ-লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। গ্রামীণ অধিকাংশ সড়ক ও ফসলি মাঠ পানিতে তলিয়ে যায়।[৬]
২২ আগস্ট
সন্ধ্যা ৬টায় ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ ছিল ৫১ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার। এই পয়েন্টে বিপৎসীমা ধরা হয় ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার। একই সময়ে কাউনিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ ছিল ২৮ দশমিক ৬১ সেন্টিমিটার। এই পয়েন্টে বিপৎসীমা ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার। দুপুর ৩টার তুলনায় সন্ধ্যা ৬টায় এই পয়েন্টে পানির প্রবাহ বেড়েছে দশমিক ৭ সেন্টিমিটার।[৭]
ভারত
২০২৪ সালের জুন মাসে ভারী বৃষ্টিপাত এবং বন্যা ভারতের আসাম রাজ্যকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে, যার ফলে আসামের বার্ষিক বৃষ্টি-সম্পর্কিত মৃত্যুর সংখ্যা ৩৯ জনে বেড়েছে এবং ১৯টি জেলার অন্তত ১৩২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, কপিলি, বরাক এবং কুশিয়ারার মতো বেশ কয়েকটি নদী দ্বারা পানির পরিমান আরো বেড়ে যায়। করিমগঞ্জ, দাররাং এবং তামুলপুর জেলাগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় কমপক্ষে ৪০০,০০০ মানুষ প্রভাবিত এবং ১৪,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।[৮]
ক্ষয়ক্ষতি
বাংলাদেশ
২২ আগস্ট দুপুরে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এক ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা জানান চলমান বন্যায় দেশের ৮ জেলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২৯ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[৯] বাংলাদেশের ১১টি জেলা বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬২৯টি পরিবার পানিবন্দী। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ। এখন পর্যন্ত ১৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।[১০] ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কসবার তিতাস, সিনাই, বুড়ি, বিজনা, সালদা নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। সেই পানি কসবা ৬০০ হেক্টর রোপা আমনও বিভিন্ন গ্রামের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যায়।[১১]
হতাহত
কুমিল্লায় বৃষ্টি ও বন্যার প্রভাবে দুইদিনে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।[১২] ২২ আগস্ট ফেনীতে পানিতে ডুবে ১জন মারা যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার পানিতে ডুবে সুবর্ণা আক্তার নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর মৃত্যু হয়। কক্সবাজার দুইজনের মৃত্যু হয়।[১৩]
প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ
বাম গণতান্ত্রিক জোট নেতারা অভিযোগ করেন পূর্বসতর্কতা ছাড়াই বাঁধ খুলে দিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উজানের কোনো দেশ নদীর ওপর দেওয়া বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার ৭২ ঘণ্টা আগে ভাটির দেশকে জানানোর কথা। কিন্তু এবার পূর্বসতর্কতা ছাড়াই ডুম্বুর ও কলসি বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে।[১৪] বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা জানান ভারতের ডম্বুর বাঁধ ইচ্ছাকৃত নয়, স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেছে। ২২ আগস্ট বিকেল ৪টার দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে এই কথা বলেন।[১৫]
ভারত
ভারত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দাবি করেন ত্রিপুরার গোমতী নদীতে ভারতীয় বাঁধ থেকে পানি ছাড়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।[১৬]
আন্তর্জাতিক
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বাংলাদেশে বন্যায় প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা জানিয়েছেন শুক্রবার ২৩ আগস্ট সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে একথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন বাংলাদেশে বন্যায় প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমি বাংলাদেশের জনগণ এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। বিপর্যয়ের এই সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। তিনি আরও বলেন আমি আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশের সহনশীল জনগণ তাদের চারিত্রিক অধ্যবসায় ও দৃঢ়তা দিয়েই এই কঠিন সময়কে অতিক্রম করবে।[১৭]