সুবচনী ব্রত

সুবচনী ব্রত বাংলার হিন্দুসমাজের অশাস্ত্রীয় বা মেয়েলি ব্ৰতগুলির অন্তর্গত একটি ব্ৰত। গ্রামীণ বাংলার বাঙালি হিন্দুঘরের মহিলারা গৃহে নববিবাহিত দম্পতির মঙ্গলকামনায় এই ব্রত পালন করে। এছাড়ায় কোনও বিশেষ কামনা সফল হলে তা উদযাপনের জন্যও সুবচনী পুজো করা হত। এটি বছরের বারো মাসেই পালন করা যায়। এই ব্রতকে চলতি ভাষায় বলা হয় ‘জোড়ের পুজো’। আরও একটি নাম আছে এই ব্রতের। পুরোহিত মশাই আর বাড়ির প্রবীণদের ভাষায় ‘সুবচনীর পুজো’। []

সুবচনী বাংলার এক লৌকিক দেবী। নামান্তরে তিনি শুভবাচনী, শুবুচুনী বা শুভচণ্ডী নামেও পরিচিতা।  যে কোনও শনি বা মঙ্গলবার আয়োজন করা হয় সুবচনী পুজোর।

ইতিহাস

সুবচনীর ব্রতকথা অনুযায়ী, এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ বালক রাজার খোঁড়া হাঁস মেরে খেয়ে রাজরোষে কারারুদ্ধ হলে দেবী সুবচনীর কৃপায় মুক্তিলাভ করে ও রাজার জামাই হয়।  সুবচনী দেবীর ব্রতকথাটি নিম্নরূপ: কলিঙ্গ রাজ্যে এক বিধবা ব্রাহ্মণী বাস করত। ভিক্ষাবৃত্তি করে অতিকষ্টে সে তার পুত্রের উপনয়ন সংস্কার করিয়েছিল। পাঠশালায় পড়ার সময় ব্রাহ্মণীর পুত্র অন্যান্য পোড়োদের নানাপ্রকার সুখাদ্য খেতে দেখে নিজের মায়ের কাছে সেই রকম খাবার চায়। দরিদ্র ব্রাহ্মণী উত্তম খাদ্য ক্রয় করতে তার অপারগতার কথা জানালে বালক পরদিন সকালে সারা শহর ঘুরে রাজার হংসশাল থেকে একটি খোঁড়া হাঁস চুরি করে আনে। ব্রাহ্মণী সেই হাঁসের মাংস রান্না করে দিলে বালক পরম তৃপ্তি সহকারে তা গ্রহণ করে। এদিকে হংসশালে খোঁড়া হাঁসটিকে দেখতে না পেয়ে রাজা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। রাজদূত ব্রাহ্মণীর ঘরের সামনে ছাইগাদায় হাঁসের পাখা দেখে বালককে ধরে আনে রাজার কাছে। ক্রুদ্ধ রাজা বালকের মৃতুদণ্ড দেন। সেই কথা শুনে ব্রাহ্মণীর মাথায় বজ্রাঘাত হল। সেই সময় গ্রামে এক বাড়িতে সুবচনী পূজা হচ্ছিল। ব্রাহ্মণী সেখানে গিয়ে পুত্রের মুক্তিকামনায় সুবচনীর কাছে মানত করে। রাত্রে দেবী রাজাকে স্বপ্ন দিয়ে বলেন, রাজা লোকের কথা শুনে যাকে খোঁড়া হাঁস হত্যার অপরাধে বন্দীশালে আটক করেছেন, সে দেবীর ব্রতদাস। তাছাড়া খোঁড়া হাঁসকে তো কেউ মারেনি। পরদিন সকালে হংসশালে গেলেই রাজা হাঁসটিকে দেখতে পাবেন। দেবী রাজাকে আদেশ করেন, ব্রাহ্মণবালককে মুক্তি দিয়ে তাঁকে অর্ধরাজ্য ও নিজ কন্যা শকুন্তলাকে দান করতে। পরদিন সকালে হংসশালে গিয়ে রাজা সত্যই দেখেন যে হাঁসটি নৃত্য করছে। দেবীর কৃপায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে সেটি। তখন রাজা বালককে মুক্তি দেন এবং দেবীর আদেশ মতো তাকে অর্ধরাজ্য দান করে নিজ কন্যার সহিত তার বিবাহ দেন। তারপর প্রভূত ধনরত্ন ও স্ত্রীকে নিয়ে বালক নিজের মায়ের কাছে ফিরলে ব্রাহ্মণী আশ্চর্য হয়ে যান। তখন তিনি নিজের বাড়ির আঙিনায় সুবচনীর পূজা করেন।

ব্যুৎপত্তি

দ্বিজ মাধবের ভনিতায় সুবচনীমঙ্গলের দু’টি ক্ষুদ্র পুঁথি পাওয়া গিয়েছে। সুবচনীমঙ্গল বা শুভদামঙ্গল প্রকৃতপক্ষে একটি ক্ষুদ্র পাঁচালি-কাব্য। এই কাব্যের কবিগণ কেউই তাঁদের কাব্যকে মঙ্গলকাব্য হিসেবে উল্লেখ করেননি। কিন্তু অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্য দু’টি কারণে এই কাব্যটিকে মঙ্গলকাব্যের তালিকাভুক্ত করেছেন: প্রথমত, মঙ্গলকাব্যের অনেক কবিই তাঁদের রচনাকে পাঁচালি বলে উল্লেখ করেছিলেন; এবং দ্বিতীয়ত, সুভদামঙ্গলের একটি পুথির পুষ্পিয়ার অন্তে লেখা রয়েছে "ইতি শুভদামঙ্গল সমাপ্তং"। কাব্যটির বিষয়বস্তু সুন্দর বা শুভকার্যের লৌকিক দেবী শুভচণ্ডী(শুভবাচনী)বা সুবচনীর মাহাত্ম্যকীর্তন।

কোথাও কোথাও সুবচনী দেবীর মূর্তিও দেখা যায়। হাঁসের ওপর কিংবা কাঠের পাটনে দেবী উপবিষ্টা। তাঁর গায়ের বর্ণ তামাটে। পরণে লাল শাড়ি। কোলে শিশু আর হাতে তালপাতা। এই দেবীর মূর্তি বসানো হয় চারটি নবপত্রিকার মাঝখানে।  

ব্রতের নিয়ম

ব্রতের প্রয়োজনীয় উপকরণ

ঘট, আমসরা, পদ্মফুল, নাড়ু, পান, কলা, সুপুরি, তিল, সিঁদুর এবং আল্পনার জন্য পিটুলি সংগ্রহ করতে হয়।

ব্রতের পদ্ধতি

সহজ পদ্ধতি এবং সামান্য উপাচারেই সম্পন্ন হয়। সুবচনী ব্রত পালনের প্রথম পর্যায়ে ঘরের মধ্যে বা উঠোনে অষ্টদল পদ্ম, পদ্মলতার আলপনা দেওয়া হয়। তাকে ঘিরে থাকে সারি সারি জোড়া হাঁস। ধানদূর্বা আর সিঁদুরের ফোঁটা আঁকা একটি জলপূর্ণ কলসপত্র স্থাপন করা হয় তার ওপর। ঘটের সিংহাসনে বসেন নারায়ণশিলা। এটিই সুবচনীর প্রতীক। সামনে মাটি একটি চৌকো পুকুর তৈরী করা হয়। জোড়া কড়ি দিয়ে বানানো হয় ঘাট। শেষে পুকুর এ দুধ ঢেলে একটি কাঁঠালি কলা দুপাশে সিঁদুর দিয়ে ডানা, ঠোঁট, কাজল দিয়ে চোখ, এবং নিচে পাট কাঠির টুকরো দিয়ে পা তৈরী করে পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।


দ্বিতীয় পর্যায়ে উঠোনে চারকোনা ঘর কেটে আল্পনা দিতে হয় পাশাপাশি চারজোড়া হাঁস ও একটি খোঁড়া হাঁস। এরপরে জলভর্তি ঘটে আমসরা ও পদ্মফুল রাখতে হয়। একটি গর্ত খুঁড়ে তাতে দুধ ভর্তি করে নাড়ু, খই, পান, সুপারি, তিল দিয়ে পূজা করতে হয়।

যথারীতি ধুপ ধুনো প্রদীপ জ্বেলে বাড়ির সকলের উপস্থিতেইত সুবচনী ব্রতকথা পাঠ করা হয়। ব্রতের শেষে সধবা নারীদের নাড়ু, খই, পান, কলা, সুপুরি, তিল, সিঁদুর দিতে হয়।

প্রসাদ হিসাবে খই, বাতাসা, সন্দেশ, নাড়ু, মুড়কি, ফল, মিষ্টি ইত্যাদি এবং অবশ্যই এক ফানা কাঁঠালি কলা, গোটা পান, গোটা সুপারি, বাতাসা, বাটি ভর্তি সর্ষের তেল, গোলা ও গুঁড়ো সিঁদুর থাকে। কলা, পান, সুপারি এগুলো জোড় সংখ্যায় দেওয়া হয়। যাঁদের বিয়ে উপলক্ষে ব্রতটি হচ্ছে, সেই দম্পতিকে পূজার স্থানে উপস্থিত থাকতে হয়। অনেক পরিবারে বিয়ের মুকুট ও শাড়ি-জোড় পরে, বিয়ের পিঁড়িতে বসে ব্রত কথা শোনার চল আছে।[]

তথ্যসূত্র

  1. বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, দুলাল চৌধুরী, আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা: ৭০০০৯৪, প্রথম প্রকাশ:২০০৪, পৃষ্ঠা: ২৩৫

Strategi Solo vs Squad di Free Fire: Cara Menang Mudah!