গার্দিহেওয়া শরৎ চন্দ্রলাল ফনসেকা (1950-12-18) ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫০ (বয়স ৭৪) আম্বালানগোদা, দক্ষিণাঞ্চল প্রদেশ, শ্রীলঙ্কা (তখন সিলন)
জাতীয়তা
শ্রীলঙ্কান
রাজনৈতিক দল
ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (২০১৬-বর্তমান) ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (২০১৩-২০১৬) ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল এ্যালায়েন্স (২০১০-২০১৩) নিউ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (২০০৯-২০১০) (২০১০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য)
অন্যান্য রাজনৈতিক দল
ইউনাইটেড ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফর গুড গভর্নেন্স (২০১৬-বর্তমান)
শ্রীলঙ্কান গৃহযুদ্ধ, সাম্যবাদী রাজনৈতিক দলের বিদ্রোহ বিরোধী সেনা অভিযান- (১৯৮৭-১৯৮৯)
পুরস্কার
রণবিক্রম পদক
রণসুর পদক
বিশিষ্ট সেবা বিভূষণ
উত্তম সেবা পদক
দেশ পুত্র সম্মান
গার্দিহেওয়া শরৎ চন্দ্রলাল ফনসেকা (জন্মঃ ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫০) শ্রীলঙ্কার একজন সাবেক রাজনীতিবিদ এবং সাবেক সংসদ সদস্য। এছাড়া তিনি শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এবং সক্রিয় ফিল্ড মার্শাল।[১] তিনি শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর ১৮তম কমান্ডার ছিলেন এবং তার নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কায় ১৯৮০ সালের দিকে শুরু হওয়া ভয়াবহ এলটিটিই বিরোধী যুদ্ধ ২০০৯ সালে শেষ হয়, যুদ্ধের পর তিনি প্রতিরক্ষা স্টাফ প্রধানের দায়িত্ব পান পূর্ণ জেনারেল পদে।[২] সেনাবাহিনী থেকে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপক্ষের প্রতিদ্বন্দী হিসেবে ২০১০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাচনে বিতর্কিত এক পরাজয়ের পর তিনি কারাগারে আটক হন রাজাপক্ষের নির্দেশে এবং যে এলাকার জন্য তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সেই পদটিও হারান।[৩][৪][৫] যদিও মাহিন্দা ফনসেকাকে তিন বছর কারাদণ্ড দিয়েছিলেন কিন্তু স্বদেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্যাপক চাপ সামলাতে না পেরে তিনি ফনসেকাকে দুই বছরের মাথায় মুক্তি দিতে বাধ্য হন। ২০১৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মাহিন্দা সরকারের এক মন্ত্রী মৈত্রীপাল সিরিসেনা তার প্রতিদ্বন্দী হিসেবে দাঁড়ালে ফনসেকা তাকে সমর্থন জানান, সিরিসেনা রাষ্ট্রপতি হয়ে যান এবং ফনসেকাকে তার কেড়ে নেওয়া সকল সম্মান, পদমর্যাদা, বেতন-ভাতা ফিরিয়ে দেন। পরে ২২ মার্চ ২০১৫ তারিখে রাষ্ট্রপতি সিরিসেনা ফনসেকাকে ফিল্ড মার্শাল র্যাঙ্ক ব্যাজ পরিয়ে দেন।[৬][৭] ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তাকে সংসদে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং ১৬ দিন পর তিনি শহর বিষয়ক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পদ লাভ করেন।[৮]
ফনসেকা ১৯৭০ সালে শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ক্যাডেট হিসেবে এবং পরের বছর কমিশন পেয়েছিলেন সিনহা রেজিমেন্টে। তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারত, পাকিস্তানসহ যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০০৫ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে শ্রীলঙ্কার সেনাকমান্ডারের দায়িত্ব পাওয়ার পরই এলটিটিইকে কীভাবে পরাজিত করবেন তা ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ১৫ জুলাই ২০০৯ তারিখে তিনি সেনাকমান্ডারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান এলটিটিইকে পরাজিত করে।[৯][১০][১১] ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে ফনসেকা এলটিটিইর বোমা হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হন, উগ্রবাদীরা তার গাড়িতে হামলা চালিয়েছিলো।[১২][১৩][১৪]
পূর্ব জীবন
শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাঞ্চলের এক উপকূলীয় শহর আম্বালানগোদায় ১৯৫০ সালের ১৮ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন শরৎ। তার পিতা পিটার ফনসেকা ছিলেন একজন খ্রিষ্টান এবং একজন শিক্ষাবিদ, এই পিটার পিয়াবতী (শরৎ এর মা) নামের এক বৌদ্ধ নারীকে প্রেম করে বিয়ে করেন যে তারই সঙ্গে লেখাপড়া করতেন। শরৎ প্রথমে আম্পারা এলাকার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়েন (১৯৫৫-১৯৫৭)[১৫], এরপর আম্বালানগোদা থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন (১৯৬৫ সালে) এবং কলম্বোর আনন্দ কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন ১৯৬৯ সালে। ঐ বছরই সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে যান এবং পরের বছরের জানুয়ারীতে প্রশিক্ষণ শুরু করেন।[১৬][১৭]
সামরিক জীবন
শুরুর দিকে
১৯৭০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ফনসেকার মূল সেনা প্রশিক্ষণ শুরু হয় 'সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দিয়াতালাওয়া'তে যেটি ১৯৭০-এর দশকে শ্রীলঙ্কা মিলিটারি একাডেমি নামে পুনঃনাম লাভ করে। তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন সিলন সিনহা রেজিমেন্টে (বর্তমানে নাম শ্রীলঙ্কা)। ১৯৭১ সালের ১ জুন তারিখে তাকে ঐ রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটেলিয়নে নিয়োগ দেওয়া হয়, সারা শ্রীলঙ্কায় তখন সাম্যবাদী রাজনৈতিক দল জেভিপি'র সশস্ত্র আন্দোলন তুঙ্গে।[১১]
প্রথম ব্যাটেলিয়ন, সিনহা রেজিমেন্টের প্লাটুন অধিনায়ক (সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট) হিসেবে কাজ করার পর শরৎ ১৯৭৩ সালে লেফটেন্যান্ট হন এবং ক্যাপ্টেন হন '৭৬ এ। এরই মধ্যে তিনি কমান্ডো কোর্স (১৯৭৩) পাশ করে ফেলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি ভারত থেকে জঙ্গলযুদ্ধের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। ১৯৮০ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮১ সালে পাকিস্তান যেয়ে ওখান থেকে 'কোম্পানী কমান্ডার্স কোর্স' করে আসেন। পরের বছরগুলোতে তিনি শ্রীলঙ্কা মিলিটারি একাডেমি, কমব্যাট ট্রেনিং স্কুল এবং বিশেষ পদাতিক বাহিনী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষক এবং স্টাফ হিসেবে কাজ করেন।[১১]
ইলাম যুদ্ধ ১
১৯৮৭ সালে শরৎ বাংলাদেশের ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ থেকে স্টাফ কোর্স পাশ করেন। ফিরে আসার পর তাকে ৪র্থ শ্রীলঙ্কা লাইট ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয় এবং এই ইউনিট নিয়ে তিনি 'ভাদামারাচ্চি এলাকা সামরিক অভিযান'-এ নামেন যেটি ছিলো এলটিটিইর সাথে এক ভয়াবহ যুদ্ধ।[১৮][১৯][২০] ১৯৮৯ সালে তাকে তার কমিশনের ইউনিট (১ম শ্রীলঙ্কা সিনহা রেজিমেন্ট) এ অধিনায়ক হিসেবে বদলী করা হয়। তিনি এই ইউনিটের অধিনায়ক থাকাকালীন তামিল উগ্রপন্থীদের উপর নৃশংস হামলা চালান এবং তাদের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা প্রেমকুমার গুণরত্ন তার অধীনস্থ সেনাদের হাতে ধরা পড়ে যায়।[১১][২১]
ইলাম যুদ্ধ ২
১৯৯১ সালে তাকে পূর্ণ কর্নেল পদে পদোন্নতি দিয়ে ৩য় ব্রিগেডের অধিনায়ক করা হয় এবং জাফনা এলাকায় 'অপারেশন বালাভেগায়া'তে পাঠানো হয়। এই অপারেশনের পর তাকে 'ফার্স্ট ওয়ার অব এলিফ্যান্ট পাস' এ নামানো হয়, এই যুদ্ধে তার অনেক সৈন্য মারা যায়।[৯] এরপর তাকে শ্রীলঙ্কা সিনহা রেজিমেন্টের কেন্দ্রের প্রধান অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং এরপরে তিনি সেনাসদরে অপারেশন্স পরিদপ্তরে স্টাফ অফিসার ১ হিসেবে নিয়োগ পান।
১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে শরৎ ব্রিগেডিয়ার হন এবং সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশন্স ডাইরেক্টরেট হন।
ইলাম যুদ্ধ ৩ এবং সেনাকমান্ডার
ব্রিগেডিয়ার হিসেবে ফনসেকা কমান্ডার অব মান্নার আর্মি এরিয়া হেডকোয়ার্টার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সহ সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে টাস্ক ফোর্সের পরিচালক হিসেবে ছিলেন। ১৯৯৮ সালে তিনি মেজর-জেনারেল পদ পদোন্নতি পেয়ে ২২ ডিভিশনের অধিনায়ক হন।[১৭] ২০০১ সালে তাকে জাফনা সেনা এলাকার প্রধান অধিনায়ক করা হয়। এ পদে থাকাকালীন শরৎ এলটিটিইর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।[৯][১০][২২] এরপর তাকে ওয়ান্নী সিকিউরিটি ফোর্সের অধিনায়ক করা হয়। ২০০২ সালের মে মাসে তিনি আবার জাফনা সিকিউরিটি ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে বদলী হন এবং ২০০৩ এর নভেম্বরে সেনা সদরে বদলী হন।[১০][১৭][২২][২৩][২৪][২৫]
সেনাসদরে তাকে শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনী রিজার্ভ ফোর্সের দায়িত্ব সামলাতে হয় অধিনায়ক হিসেবে। ২০০৫ সালে সেনাকমান্ডার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ঐ পদে বহাল ছিলেন। ৬ ডিসেম্বর ২০০৫ তারিখে তিনি তারই কোর্সমেট লেঃ জেনারেল শান্ত কোট্টেগোদার কাছ থেকে সেনাকমান্ডারের দায়িত্ব বুঝে নেন এবং লেঃ জেনারেল পদে উন্নীত হন।[২৬][২৭][২৮]
এলটিটিইকে শায়েস্তা
২০০৯ সালের ১৮ মে সেনাকমান্ডার লেফটেন্যান্ট-জেনারেল শরৎ ফনসেকা টিভি এবং রেডিওতে ঘোষণা দেন যে সেনাবাহিনী এলটিটিইকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে।[২৯] এই ঘোষণার পর সারা দেশে সিংহলীরা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং রাস্তায় রাস্তায় আনন্দ মিছিল বের করে।[৩০][৩১]
প্রতিরক্ষা স্টাফ প্রধানের দায়িত্ব
১৫ জুলাই ২০০৯ তারিখে রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপক্ষে শরৎকে পূর্ণ জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রতিরক্ষা স্টাফ প্রধানের (চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ) দায়িত্বে নিযুক্ত করেন এবং সেনাকমান্ডারের দায়িত্ব মেজর-জেনারেল জগৎ জয়সূর্য পান।[২][৩২]
সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ
জেনারেল শরৎ ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর কাছে তার পদত্যাগ পত্র জমা দেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গোতাবায়া রাজাপক্ষ (রাষ্ট্রপতির মাহিন্দার ভাই) তাকে সেনাবাহিনীতে আরো কিছু দিন থাকতে বললে শরৎ রাজনীতিতে ঢুকতে চান বলে জানান। ৪ দিন পর রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা এয়ার মার্শাল ডোনাল্ড পেরেরাকে এয়ার চীফ মার্শাল পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রতিরক্ষা স্টাফ প্রধানের দায়িত্ব দেন।[৩৩]
নোট
↑শ্রীলঙ্কায় সামরিক বাহিনীর পাঁচ তারকা কর্মকর্তাগণ তাদের মৃত্যু পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন।