শওকত আলী (এপ্রিল ২০, ১৯১৮ - আগস্ট ১৮, ১৯৭৫), রাজনীতিবিদ এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা। তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের একজন প্রতিষ্ঠাতা - যা পরে আওয়ামী লীগ এবং বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে পরিচিত। তিনি তিনটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদেরই সদস্য ছিলেন। এছাড়াও ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের মূখ্য সংগঠক ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার ১৫০ মোগলটুলির বাসস্থানটি ছিল ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মীবাহিনীর মিলনক্ষেত্র। ১৯৭৫ সালের ১৮ আগস্ট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।[১]
প্রারম্ভিক জীবন
শওকত আলী ১৯১৮ সালের ২০ এপ্রিল পূর্ববাংলা ঢাকার গেন্ডারিয়ার একটি বিশিষ্ট সুন্নি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শমসের আলী ছিলেন এলাকায় একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং মা মেহেরুননেসা খাতুন ছিলেন একজন গৃহিনী। দুই বছর বয়সে মাকে হারান তিনি। তিনি তার পিতা ও মামা মামীর সান্নিধ্যে বড় হয়ে ওঠেন। তিনি মুসলিম হাই স্কুল থেকে লেখাপড়া করেন। তার উচ্চ বিদ্যালয় শেষ করার পর তিনি জগন্নাথ কলেজে যোগ দেন এবং বি কম ডিগ্রীপ্রাপ্ত লাভ করেন। তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে তা সম্পন্ন করতে পারেননি।
রাজনৈতিক জীবন
শওকত আলী তমদ্দুন মজলিশের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলন।[২] রশিদ ভবনে ৩০ ডিসেম্বর ১৯৪৭ তারিখে অধ্যাপক আবুল কাশেম একটি সভার আয়োজন করেছিলেন। অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ "তমদ্দুন মজলিশের রাষ্ট্রভাষা উপ-কমিটি" নামে গঠিত হয়।[৩] শওকত আলী এই কমিটির একজন সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৩ জুনের সম্মেলনের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শওকত আলী। তার উদ্যোগে ১৫০ নং মোগলটুলিস্থ শওকত আলীর বাসভবন এবং কর্মী শিবির অফিসকে ঘিরে বেশ কয়েক মাসের প্রস্তুতিমূলক তৎপরতার পর ২৩ জুনের কর্মী সম্মেলনে দলের ঘোষণা দেয়া হয়। শওকত আলীর অনুরোধে কলকাতা থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি মামলা পরিচালনার কাজে ঢাকায় এলে তিনি শওকত আলীকে মুসলিম লীগ ছেড়ে ভিন্ন একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। শওকত আলী এ পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের নেতৃবৃন্দকে নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেন। এসময় কর্মী শিবিরের প্রধান নেতা ছিলেন শামসুল হক।[৪] কামরুদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, মো. তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, আবদুল আউয়াল, মুহম্মদ আলমাস, শামসুজ্জোহা প্রমুখ কর্মী শিবির কেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন।
মুসলিম লীগের আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগের অন্যায় কাজগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার লক্ষ্যেই এখানে কর্মী শিবির গড়ে তুলেছিলেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৪৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকা এলে তার সঙ্গে শওকত আলীর আলোচনা হয়। শওকত আলী মওলানাকে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরকেন্দ্রিক রাজনৈতিক তৎপরতার কথা জানান। এসময় মওলানা ভাসানী আলী আমজাদ খানের বাসায় অবস্থান করছিলেন। শওকত আলীর সঙ্গে তার প্রাথমিক আলোচনা সেখানেই হয়। এই আলোচনার সূত্র ধরে নতুন দল গঠনের জন্য একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন শওকত আলী। সেজন্যে ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়। মওলানা ভাসানী সেই বৈঠকে যোগদান করেন। এসময় খোন্দকার আবদুল হামিদের সঙ্গে পরামর্শ করে শওকত আলীর উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, ইয়ার মুহম্মদ খানকে সম্পাদক করে অন্যদেরসহ একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়।
উপর্যুক্ত সাংগঠনিক কমিটি ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন রোজ গার্ডেনে নতুন দল গঠনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এক সম্মেলন আহ্বান করে। রোজ গার্ডেনে ২৩ জুনের বিকেল ৩টায় সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শওকত আলী, আনোয়ারা খাতুন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুল জব্বার খদ্দর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আতাউর রহমান খান, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আলী আমজাদ খান, শামসুদ্দীন আহমদ (কুষ্টিয়া), ইয়ার মুহম্মদ খান, মওলানা শামসুল হক, মওলানা এয়াকুব শরীফ, আবদুর রশিদ প্রমুখ।
১৫০ মোগলটুলী
আওয়ামী লীগের জন্মসূত্রের সঙ্গে ঢাকা ১৫০ নম্বর মোগলটুলিস্থ পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের উদ্যোগের সম্পর্ক অনস্বীকার্য। বিভাগ-পূর্বকালে ঢাকার ১৫০ নং মোগলটুলিতে স্থাপিত হয়েছিল ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ ও মুসলিম লীগ পার্টি হাউস। তখন এখানেই সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক কর্মী মিলিত হতেন।
১৫০ নং মোগলটুলির কর্মীরা ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কার্যক্রম এখান থেকেই পরিচালিত হত। ১৫০ মোগলটুলির মূল তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন শওকত আলী। এ প্রসঙ্গে বাহাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও ১৫০ মোগলটুলি বিরোধী রাজনীতির সূতিকাগার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। কলকাতা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, জহিরুদ্দিন, নাঈমুদ্দীনের মতো নেতারা প্রথমে ১৫০ মোগলটুলি পার্টি হাউসের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে সার্বক্ষণিক বসবাসকারী পার্টি কর্মীদের খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সব ব্যবস্থাই তিনি করতেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখিছেন ‘…১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে প্রথমে উঠব ঠিক করলাম। শওকত মিয়া মোগলটুলি অফিসের দেখাশোনা করে। মুসলিম লীগের পুরনো কর্মী। আমার বন্ধুও। …. শামসুল হক সাহেব ও শওকত সাহেব আমাকে পেয়ে খুবই খুশি। শওকত আমাকে নিয়ে কি যে করবে ভেবেই পায় না। তার একটা আলাদা রুম ছিল। আমাকে তার রুমেই জায়গা দিল। আমি তাকে শওকত ভাই বলতাম।’[৫]
১৯৬১ সালে, শওকত আলীর সাথে রহিমা খাতুনের বিয়ে সম্পন্ন হয়। রহিমা ঢাকার ফজলুল হক মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষা এবং নারী অধিকার বাস্তবায়ন সংঘের সভাপতি ছিলেন। তাদের তিন পুত্র এবং একটি মেয়ে রয়েছে।
কিংবদন্তি
২০১১ সালে শওকত আলীকে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারগুলোর মধ্যে একটির পুরস্কার একুশে পদক দেয়া হয়।
ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদানের জন্য ১৭ জানুয়ারি, ২০১০ তারিখে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনধানমন্ডি ৪/এ সড়কটি তার নাম অনুসরণে নামকরণ করা হয়।