লাহোর দুর্গ

লাহোরের দুর্গ ও শালিমার উদ্যান
ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান
আলমগীর গেট
অবস্থানপাকিস্তান ইকবাল পার্ক, লাহোর, পাকিস্তান
মানদণ্ডসাংস্কৃতিক: i, ii, iii
সূত্র171
তালিকাভুক্তকরণ১৯৮১ (৫ম সভা)
বিপদাপন্ন২০০০–২০১২

লাহোর দুর্গ (উর্দু/গুরুমুখী: شاہی قلعہ) (স্থানীয়ভাবে শাহী কিল্লা বলে পরিচিত) পাকিস্তানের পাঞ্জাবের লাহোরে অবস্থিত একটি দুর্গ।[] এই দুর্গ ইকবাল পার্কে লাহোরের দেয়ালঘেরা শহরের উত্তরপশ্চিমে অবস্থিত। এই পার্ক পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় নগর পার্কের অন্যতম। ট্রাপোজয়েড আকৃতির স্থানটি ২০ হেক্টর এলাকা নিয়ে গঠিত।[] এটিতে ২১ টি উল্লেখযোগ্য স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে যার মধ্যে কয়েকটি সম্রাট আকবরের যুগে রয়েছে।[] ১৭ শ শতাব্দীতে লাহোর দুর্গটি প্রায় পুরোপুরি পুনর্নির্মাণের জন্য উল্লেখযোগ্য, যখন মুঘল সাম্রাজ্য তার জাঁকজমক ও ঐশ্বর্যের চূড়ান্ত উচ্চতায় ছিল।[]

দুর্গের উৎস প্রাচীনকাল হলেও বর্তমান স্থাপনা মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে নির্মিত হয়েছে। পরবর্তীতে মুঘল সম্রাটদের সময়ে দুর্গের বৃদ্ধি ঘটেছে। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর শিখব্রিটিশ শাসকরাও দুর্গের বৃদ্ধি ঘটান। এর দুইটি ফটক রয়েছে। এর মধ্যে একটি সম্রাট আওরঙ্গজেব নির্মাণ করেছেন। এটি আলমগিরি ফটক বলে পরিচিত এবং তা বাদশাহী মসজিদমুখী। অন্যটি আকবরের সময় নির্মিত হয় এবং এটি মাসিতি[টীকা ১] বা মসজিদি ফটক নামে পরিচিত। এটি দেয়ালঘেরা শহরের মাসিতি এলাকামুখী। বর্তমানে আলমগিরি ফটকটি প্রধান প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং মাসিতি ফটকটি স্থায়ীভাবে বন্ধ রয়েছে। দুর্গে মুঘল স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে।[] দুর্গের কিছু বিখ্যাত স্থানের মধ্যে রয়েছে শিশ মহল, আলমগিরি ফটক, নওলাখা প্যাভেলিয়নমোতি মসজিদ

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে শালিমার উদ্যানের পাশাপাশি এই দুর্গ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত হয়। এক্সপো ২০১০ এ পাকিস্তানের প্যাভেলিয়ন দুর্গের রেপ্লিকা হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।[]

ইতিহাস

মুঘল ও মুঘল-পূর্ব‌ যুগ

১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে লাহোর দুর্গ ও হাজুরি বাগ প্যাভেলিয়ন।
লাহোর দুর্গের ভূমি পরিকল্পনার মানচিত্র, ১৯১১

লাহোর দুর্গের উৎস স্পষ্ট নয় এবং তা সাধারণত বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী নির্ভর।[] কে সর্বপ্রথম এই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন তা জানা যায় না। কিছু হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীতে রামের পৌরাণিক পুত্র লোহকে এর প্রতিষ্ঠার সাথে সম্পর্কিত করা হয়।[] এ বিষয়ে প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ ১১শ শতাব্দীতে সুলতান মাহমুদ গজনভির সময় পাওয়া যায়।[] এটি ছিল একটি কাদা দিয়ে তৈরী দুর্বল দুর্গ এবং তা তখন ধ্বংস হয়ে যায়।[] পুরনো সূত্র অনুযায়ী ১২৪০ এর দশকে মঙ্গোলরা এই দুর্গ ধ্বংস করে। এর প্রায় ৫০ বছর পর গিয়াসউদ্দিন বলবন এখানে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন।[] ১৩৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তৈমুরের আক্রমণে এই দুর্গ পুনরায় বিধ্বস্ত হয়। এর ২০ বছর পর সুলতান মুবারক শাহ সৈয়দ এটি পুনর্নির্মাণ করেন।[১০] ১৪৩০ এর দশকে কাবুলের শেখ আলি এই দুর্গ দখল করেন।[১১]

দুর্গের বর্তমান স্থাপনা মুঘল আমলের। ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবর দুর্গটি দখল করেন। এটি সাম্রাজ্যের উত্তরপশ্চিম সীমান্ত রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হত।[১২] তিনি ইট ও চুনাপাথর দিয়ে দুর্গ পুনর্নির্মাণ করেন। সময় পরিক্রমায় এতে প্রাসাদ নির্মিত হয় এবং এতে যুক্ত বাগান এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।[১৩] আকবর কর্তৃক নির্মিত অন্যান্য স্থাপনার মধ্যে রয়েছে দৌলত খানা-এ-খাস-ও-আম, ঝারোকা-এ-দারশান, ও মাসজিদি ফটক। পরের সম্রাটদের সময় তার স্থাপনাগুলো প্রতিস্থাপিত হয়।[১২] শাহজাহান শাহ বুরুজ, শিশ মহল ও নওলাখা প্যাভেলিয়ন নির্মাণ করেছেন। তার পুত্র আওরঙ্গজেব আলমগিরি ফটক নির্মাণ করেছেন। এর দুইপাশে গম্বুজযুক্ত প্যাভেলিয়নসহ অর্ধ‌-গোলাকার টাওয়ার রয়েছে।[১৪]

জাহাঙ্গীরের যুগ

সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১২ সালে মক্তব খানার বর্ণনা দেওয়ার সময় প্রথম দুর্গে তাঁর পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেছিলেন।  জাহাঙ্গীর কালা বুর্জ মণ্ডপও যুক্ত করেছিলেন, এতে ইউরোপীয় অনুপ্রাণিত ফেরেশতাগণের সিলিং রয়েছে।[১৫] দুর্গে ভ্রমণকারী ব্রিটিশ দর্শনার্থীরা জাহাঙ্গীর আমলে খ্রিস্টান আইকনোগ্রাফির উল্লেখ করেছিলেন, দুর্গ কমপ্লেক্সে ম্যাডোনা এবং যিশুর আঁকা চিত্র পাওয়া যায়।[১৬] ১৬০৬ সালে, শিখ ধর্মের গুরু অর্জন তাঁর মৃত্যুর আগে দুর্গে বন্দী ছিলেন।[১৭]

শিখ যুগ

১৭৫৮ রঘুনাথরাওয়ের নেতৃত্বে মারাঠা বাহিনী এই দুর্গ দখল করে।[১৮] এরপর বানগি শিখ রাজবংশ (১৭১৬-১৮১০) ১৭৬০ থেকে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত লাহোর শাসন করেছে। এরপর রণজিৎ সিং বানগিদের হাত থেকে লাহোরের নিয়ন্ত্রণ হস্তগত করেন। লাহোর দুর্গও তার হাতে আসে। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে তাকে সমগ্র পাঞ্জাবের সম্রাট ঘোষণা করা হয়।[১৯] ১৭৯৯ থেকে ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে শিখ সাম্রাজ্যের পতনের আগ পর্যন্ত এই দুর্গ রণজিৎ সিং, তার পুত্র, নাতি ও স্ত্রীদের হাতে ছিল।[২০]

সাম্প্রতিক সময়

১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে দিওয়ান-ই-আমের সম্মুখে খননকার্যের সময় ১০২৫ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ গজনভির সময়কার একটি স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়। এটি জমি থেকে প্রায় ২৫ ফুট (৭.৬ মি) নিচে পাওয়া যায়। ১৫ ফুট (৪.৬ মি) গভীর পর্যন্ত এর সাংস্কৃতিক স্তর বিস্তৃত ছিল যা থেকে বোঝা যায় যে তার বিজয় অভিযানের পূর্বে‌ও এখানে জনবসতি ছিল।

২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে আকবরি ফটকের মেঝেতে কাজ চলার সময় ব্রিটিশ, শিখ ও মুঘল যুগের তিনটি মেঝে উম্মোচিত হয়। এগুলো যথাক্রমে ইট, পোড়ানো ইট ও পাথরে নির্মিত। শেষেরটি জাহাঙ্গীর বা শাহজাহানের সময় নির্মিত হয় এবং তা মুঘল নিদর্শন।[২১]

২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে কর্মকর্তারা ইউনেস্কোকে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকা থেকে দুর্গের নাম বাদ দিতে অনুরোধ করেছেন কারণ নরওয়ে, হংকং, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এর সংস্কারের জন্য অর্থ সহায়তা দিয়েছে।[২২]

১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো দুর্গে কোনো রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান না করার জন্য পাঞ্জাব প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগকে নির্দেশ দিলেও এখানে সে বছরের ২৩ ডিসেম্বর একটি বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের পুরাতত্ত্ব আইন অনুযায়ী ঐতিহাসিক স্থানের সুরক্ষার জন্য এসব স্থানের ব্যবহার নিষেধ। কিন্তু পরের মাসে দিওয়ান-ই-খাসে একটি ভোজের আয়োজন করা হয়।[২৩]

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে দুর্গ প্রাঙ্গণে শিখ শিল্পকর্মে‌র প্রদর্শ‌নী হয়। এই প্রদর্শনীর নাম ছিল গ্লোরিয়েস শিখ হেরিটেজ আন্ডার দ্য রুফ। রণজিৎ সিংয়ের আমলের দুর্লভ শিল্পকর্ম, ব্রিটিশ ও শিখদের মধ্যকার চুক্তির দলিল, অস্ত্র ও অলংকার প্রদর্শনীতে রাখা হয়।[২৪]

কাঠামো

মুঘল অঞ্চল এবং কাবুল, মুলতানকাশ্মীরের ঘাটির মধ্যে লাহোর শহরের কৌশলগত অবস্থানের কারণে পুরনো কাদামাটি দিয়ে তৈরি দুর্গকে ভেঙে ইট নির্মিত দুর্গ তৈরীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।[২৫] দুর্গে পার্সি‌য়ান উদ্যান দেখা যায় হয় যা পরবর্তী মুঘল সম্রাটগণ সৌন্দর্যমন্ডিত করেছেন।[২৬] দুর্গটি দুইটি অংশে বিভক্ত: প্রথমে রয়েছে প্রশাসনিক অংশ। এটি মূল প্রবেশপথের সাথে সংযুক্ত এবং এতে বাগান ও রাজকীয় কাজের জন্য দিওয়ান-ই-খাস রয়েছে। দ্বিতীয় অংশে রয়েছে ব্যক্তিগত ও আবাসিক অংশ। এটি উত্তরে দরবার এবং এতে হস্তী ফটক দিয়ে প্রবেশ করা যায়। এখানে শিশ মহল, প্রশস্ত শোবার ঘর এবং বাগান রয়েছে।[২৭] বাইরের দেয়াল পারস্যের নীল কাশি টাইলসে আবৃত। মূল প্রবেশপথ মরিয়ম জামানি মসজিদমুখী এবং বৃহৎ আলমগিরি ফটক হাজুরি বাগের দিকে উন্মুক্ত হয়।[২৮] হিন্দু স্থাপত্যের কিছু প্রভাব এখানে দেখা যায়।[]

দিওয়ান-ই-আম

দিওয়ান-ই-আম হল সাধারণের দরবার। ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাহান এটি নির্মাণ করেন। এখানে সাধারণ মানুষের সাথে বাদশাহ সাক্ষাত করতেন। এর নকশা আগ্রা দুর্গের দিওয়ান-ই-আমের নকশার অনুরূপ। এখানে চল্লিশটি স্তম্ভ ও একটি বারান্দা রয়েছে। [২৯] শিখ শাসক শের সিং মহারানি চান্দ কৌরের সাথে লড়াইয়ের সময় শের সিঙের গোলার আঘাতে এটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা তা সংস্কার করে।[৩০]

শিশ মহল

শিশ মহল

শিশ মহল[টীকা ২] হল আয়নার প্রাসাদ। মুমতাজ মহলের পিতা মির্জা গিয়াস বেগ ১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাহানের শাসনামলে এটি নির্মাণ করেছিলেন। এটি প্রশস্ত হল নিয়ে গঠিত। এর পেছনে আরো কয়েকটি হল রয়েছে। এটি ছিল দুর্গের হারেম। এতে পেছনের কামরায় মার্বেলের সচ্ছিদ্র পর্দা রয়েছে। এই পর্দা লতা, ফুল ও জ্যামিতিক প্যাটার্ন দিয়ে সজ্জিত। দেয়ালে পিয়েট্রা ডুরা শিল্পকর্ম রয়েছে।[৩০]

জাহাঙ্গিরের চতুর্ভুজক্ষেত্র

এটি একটি চতুর্ভু‌জাকার ক্ষেত্র। এটি রাজপরিবারের নারীদের আবাসস্থল ও হারেম নিয়ে গঠিত। আকবর এর নির্মাণ শুরু করেছিলেন এবং ১৬১৮ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীর তা সমাপ্ত করে। এই দালানগুলো ভূগর্ভস্থ কামরার উপর নির্মিত, বিশেষত উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বের সীমানাগুলো। এর ইওয়ান আকবরের সময়কার স্থাপত্যশৈলী প্রদর্শ‌ন করে। চতুর্ভুজ ক্ষেত্রের আকার ৩৭২ x ২৪৫ মিটার। এতে চাহার বাগ নামক বাগান রয়েছে। বাগানের সীমানায় রয়েছে হাটার পথ ও ফোয়ারা। ব্রিটিশ যুগে সেনাবাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী অফিসারদের ধারণ করার জন্য এর পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল।[৩১]

খোয়াবগাহ

খোয়াবগাহ ছিল শাহজাহানের শোবার ঘর। তার শাসনামলে প্রথম লাহোর সফরের সময় ওয়াজির খানের তত্ত্বাবধানে ১৬৩৪ খ্রিষ্টব্দে এটি নির্মিত হয়।[৩০] এটি দুর্গে শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত প্রথম স্থাপনা। বর্তমানে মার্বেল ছাড়া বাকি সজ্জাগুলো অবশিষ্ট নেই।[৩১]

নওলাখা প্যাভেলিয়ন

নওলাখা প্যাভেলিয়ন

এই প্যাভেলিয়ন শাহজাহান ৯ লক্ষ রুপি ব্যয়ে নির্মাণ করেছিলেন। [৩২] এটি শিশ মহলের পশ্চিমে অবস্থিত। প্যাভিলিয়নটি আয়তাকার এবং কেন্দ্রীয় আর্চ ও বিশেষভাবে খোদাইকরা ছাদ শাহজাহানের যুগের স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে পৃথক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।[৩৩] এতে বাংলার ঢালু ছাদ ও ইউরোপের বল্ডচিনের মিশ্রণ দেখা যায়। [৩৪] ভূমি থেকে আড়ালের জন্য প্যাভেলিয়নের মার্বেলের আচ্ছাদনের শীর্ষে উপরমুখী অংশ যুক্ত রয়েছে।[৩৫]

মোতি মসজিদ

মোতি মসজিদ

মোতি মসজিদ[টীকা ৩] ১৭শ শতাব্দীতে শাহজাহানের শাসনামলে নির্মিত হয়। মাকরানার সাদা মার্বেল দিয়ে এটি নির্মিত হয়। এর বহির্ভাগ খাজযুক্ত আর্চে তৈরি। এতে তিনটি গম্বুজ, একটি কেন্দ্রীয় ইওয়ান রয়েছে। মসজিদের বহির্ভাগে পাঁচটি আর্চ রয়েছে, যা সমসাময়িক অন্য মসজিদের ব্যতিক্রম। অন্য মসজিদ্গুলোতে তিনটি আর্চ দেখা যায়। মহারাজা রণজিৎ সিঙের শাসনামলে মসজিদটিকে মোতি মন্দির নামক শিখ মন্দিরে রূপান্তর করা হয়েছিল।[৩৬]

ফটক

আকবরি ফটক
আলমগিরি ফটক

সম্রাট আকবর দুইটি ফটক নির্মাণ করেছিলেন। ১৫৬৬ খ্রিষ্টাব্দে আকবরি ফটক নির্মিত হয়। এটি বর্তমানে মাসতি ফটক বলে পরিচিত। ১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আকবরের একজন স্ত্রী ফটকের বাইরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।[৩০] আরেকটি ফটক পরবর্তীকালে আলমগিরি ফটক দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। আলমগিরি ফটকটি দুর্গের প্রবেশপথ। ১৬৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব এটি নির্মাণ করেন।[৩৭] এতে অর্ধবৃত্তাকার দুটি টাওয়ার রয়েছে। টাওয়ারের ভিত্তি পদ্মপাতার নকশায় সজ্জিত।[৩৮]

শিখ দালান

রণজিৎ সিংহের পুত্র খরক সিংহের স্ত্রী চান্দ কৌর নাগ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এটি বর্গাকার এবং ভূমি থেকে উচ্চস্থানে নির্মিত হয়েছে। এর বাইরের দেয়াল চিত্রাঙ্কিত। মন্দিরে তরমুজ আকৃতির গম্বুজ রয়েছে। চিত্রকর্মে‌র ক্ষতির আশঙ্কায় দীর্ঘদিন ধরে এতে জনসাধারণকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না।[৩৯]

মাই জিনদান হাভেলির উৎস অজ্ঞাত তবে ধারণা করা হয় যে এটি মুঘল স্থাপত্য। তবে শিখদের ব্যাপক সম্প্রসারণের কারণে একে চান্দ কৌরের সাথে সম্পর্কিত করা হয়। এই দালান দ্বিতলবিশিষ্ট। তাকে এখানে হত্যা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে একটি একটি জাদুঘর।[৩১] খরক সিং হাভেলি ছিল রণজিৎ সিংহের উত্তরসুরি খরক সিংহের প্রাসাদ। এটি জাহাঙ্গিরের চতুর্ভুজক্ষেত্রের দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত। পরে ব্রিটিশরা তা দখল করে নেয় এবং ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলা যথাক্রমে গুদাম ও কর্মচারীদের বাসস্থান এবং কমান্ড্যান্ট কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত হত। বর্তমানে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ অফিস অবস্থিত।[৩১]

অন্যান্য

খিলওয়াত খানা

খিলওয়াত খানা ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাহান নির্মাণ করেছিলেন। এটি পাইন বাগের উত্তরে অবস্থিত। এখানে রাজপরিবারের নারীরা থাকতেন।[৪০] স্তম্ভ ও দরজা কাঠামো মার্বেলে নির্মিত এবং বক্রছাদ বিশিষ্ট।[৩০] খিলওয়াত খানার উত্তরপশ্চিমে কালা বুরুজ নামক ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। এটি গ্রীস্মকালীন প্যাভেলিয়ন হিসেবে ব্যবহৃত হত। ব্রিটিশ যুগে এর সবচেয়ে উপরের তলাটি বার হিসেবে ব্যবহৃত হত। এর ছাদের কিনারা ইট দ্বারা যুক্ত[৩০]

কালা বুরুজ
মাকতিব খানা

মাকতিব খানা সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে মামুর খানের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়। এটি কর্মচারীদের জন্য দুর্গের প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হত।[৩০] এছাড়াও দুর্গে রাজপরিবারের পুরুষ ও মহিলা সদস্যদের জন্য পৃথক গোসলখানা রয়েছে।[৩১]

বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা

১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে শর্ত ১, ২ ও ৩ এর ভিত্তিতে পাকিস্তান সরকার লাহোর দুর্গকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে অন্তর্ভু‌ক্তির জন্য মনোনীত করে। এর সাথে শালিমার উদ্যানকেও মনোনীত করা হয়।[] ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে সিডনিতে অনুষ্ঠিত পঞ্চম বৈঠকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট কমিটি দুইটি স্থানকেই তালিকায় যুক্ত করে।[৪১] ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে এই দুই স্থানকে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য সংগঠনের কাছে চিঠি পাঠায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত অংশের সংস্কারের জন্য সহায়তা চায়।[৪২][৪৩] কয়েকবছর ধরে সংস্কারের পর ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে বিপন্ন তালিকা থেকে স্থান দুইটিকে বাদ দেয়া হয়।[৪৪][৪৫]

আরও দেখুন

পাদটীকা

  1. মাসিতি পাঞ্জাবি শব্দ, অর্থ মসজিদ
  2. শিশ মহল আরবি উৎসের শব্দ, অর্থ আয়নার দরবার
  3. মোতি মসজিদ আরবি উৎসের শব্দ, অর্থ মুক্তা মসজিদ

তথ্যসূত্র

  1. Google maps। "Location of Lahore Fort"। Google maps। সংগ্রহের তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩ 
  2. "International council on monuments and sites" (পিডিএফ)। UNESCO। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  3. Ruggles, D. Fairchild. (২০০৮)। Islamic gardens and landscapes। Philadelphia: University of Pennsylvania Press। আইএসবিএন 978-0-8122-0728-6ওসিএলসি 811411235 
  4. Komaroff, Linda (১৯৯২)। Islamic art in the Metropolitan Museum: The Historical Context (ইংরেজি ভাষায়)। Metropolitan Museum of Art। পৃষ্ঠা ৩৪। 
  5. M Taher (1997). Encyclopaedic Survey of Islamic Culture. Anmol Publications. আইএসবিএন ৮১-৭৪৮৮-৪৮৭-৪
  6. "Pakistan Pavilion preview"Pavilion Archive। ১৭ এপ্রিল ২০১০। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ মে ২০১৫ 
  7. G. Johnson, C. A. Bayly, and J F Richards (1988). The New Cambridge History of India. Cambridge University Press. আইএসবিএন ০-৫২১-৪০০২৭-৯
  8. lahore fort, University of Alberta, ৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ২০ নভেম্বর ২০১৫ 
  9. Hamadani, p.103
  10. Khan, p.10
  11. Punjab (India)। Punjab District Gazetteers, Volume 13। Controller of Print. and Stationery, 2002। পৃষ্ঠা 26। 
  12. Asher, p.47
  13. Neville, p.xiv
  14. Bhalla, p.81
  15. Asher, Catherine B. (Catherine Blanshard), 1946- (১৯৯২)। Architecture of Mughal India। Cambridge: Cambridge University Press। পৃষ্ঠা ৩৬৮। আইএসবিএন 0-521-26728-5ওসিএলসি 24375997 
  16. Schimmel, Annemarie, 1922-2003. (২০০৪)। The empire of the great Mughals : history, art and culture। Waghmar, Burzine K.। London: Reaktion Books। পৃষ্ঠা ৩৫২আইএসবিএন 1-86189-185-7ওসিএলসি 61751123 
  17. Singh, Pashaura; Pashaura (২০০৬)। Life and Work of Guru Arjan: History, Memory, and Biography in the Sikh Tradition (ইংরেজি ভাষায়)। Oxford University Press। পৃষ্ঠা ২১৭–১৮। আইএসবিএন 978-0-19-567921-2 
  18. "The Fall of the Moghul Empire of Hindustan"। Emotional Literacy। ১০ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মে ২০১৫ 
  19. Students’ Academy। Lahore-The Cultural Capital of Pakistan। Lulu। পৃষ্ঠা 18। আইএসবিএন 1458322874 
  20. Kartar Singh Duggal (২০০১)। Maharaja Ranjit Singh, the Last to Lay Arms। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 56আইএসবিএন 9788170174103 
  21. "Three floors revealed at Lahore Fort"। Dawn। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  22. "Unesco urged to delist Lahore Fort"। Dawn। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  23. "Another function at Lahore Fort in violation of rules"। Dawn। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  24. "Sikh artefacts on display at Lahore Fort"। Pakistan Today। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  25. Lahore Fort Complex ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ মে ২০০৮ তারিখে. Archnet Digital Library. Retrieved 7 March 2008
  26. N A Chaudhry (1999). Lahore Fort: A Witness to History. Sang-e-Meel Publications. আইএসবিএন ৯৬৯-৩৫-১০৪০-২
  27. Catherine E G Asher (1993) Architecture of Mughal India. Cambridge University Press. আইএসবিএন ০-৫২১-২৬৭২৮-৫
  28. A N Khan (1997). Studies in Islamic Archaeology of Pakistan Sang-e-Meel Publications
  29. Chaudhry p.181
  30. "Notable Buildings and Structures of Lahore Fort:"। Pakistan Tourist Guide। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  31. "Lahore Fort"। University of Alberta। ৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ মে ২০১৫ 
  32. AB Rajput। Architecture in Pakistan। Pakistan Publications। পৃষ্ঠা 9। 
  33. Koch, p.93
  34. Asher, p.180
  35. Nabi Khan, p.117
  36. "Historical mosques of Lahore"। Pakistan Today। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  37. Mohammad Abdulhai Qureshi। Muslim Rule in Spain, Muslim Rule in India, Memories of Two Failures। Author House। পৃষ্ঠা 58। আইএসবিএন 9781456776152 
  38. Ancient India by Daud Ali, p.5
  39. "Lahore Fort's Naag Temple – a no-go area for public"। Dawn। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  40. Camerapix। Spectrum guide to Pakistan। University of Michigan। পৃষ্ঠা 259। আইএসবিএন 9780816021260 
  41. "World Heritage Committee Fifth session"। UNESCO। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  42. "World Heritage Committee Twenty Fourth session"। UNESCO। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  43. "Committee Decisions"। UNESCO। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  44. "Establishment of the World Heritage List in Danger (Removed Properties)"। UNESCO। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৫ 
  45. "Shalimar Garden, Lahore Fort not in danger anymore"। Pakistan Today। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০১৫ 

উৎস

বহিঃসংযোগ

Strategi Solo vs Squad di Free Fire: Cara Menang Mudah!