লস অ্যাঞ্জেলেস (ইংরেজি ভাষায়: Los Angeles লস্ অ্যাঞ্জেলেস্, মূলত স্পেনীয় ভাষায়: Los Ángeles লোস্ আংখ়েলেস্ অর্থাৎ "দেবদূতগণ") মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমভাগে প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণাংশে লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টিতে অবস্থিত একটি বৃহৎ নগরী। শহরটি এর বিশাল আয়তন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, রৌদ্রোজ্জ্বল নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু, অধিবাসীদের জাতিগত বৈচিত্র্য, মার্কিন চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাণভোমরা হলিউড ও সংশ্লিষ্ট বিনোদন শিল্প এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা নগর অর্থনীতির অধিকারী হবার জন্য সুপরিচিত। শহরটি তার নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর এল এ (L.A.) নামেও পরিচিত।
জনসংখ্যার বিচারে লস অ্যাঞ্জেলেস ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের বৃহত্তম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম (নিউ ইয়র্ক শহরের পরে) এবং উত্তর আমেরিকা মহাদেশের ৩য় বৃহত্তম শহর (মেক্সিকো সিটি ও নিউ ইয়র্কের পরে)। উত্তর-দক্ষিণে ৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ ও পূর্ব-পশ্চিমে ৪৭ কিলোমিটার প্রশস্ত মূল শহরের আয়তন ১২১৪ বর্গকিলোমিটার এবং এখানে প্রায় ৪০ লক্ষ লোকের বাস। শহরটিকে ঘিরে রাখা লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টিতে আরও প্রায় ৯০টি নিবন্ধিত শহর আছে, যাদের মধ্যে বেভার্লি হিলস, প্যাসাডিনা এবং লং বিচ অন্যতম। গোটা লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টিটিকেই সুবিশাল লস অ্যাঞ্জেলেস মহানগর এলাকা হিসেবে গণ্য করা হয়। লস অ্যাঞ্জেলেস মহানগর এলাকাটি নিউ ইয়র্ক মহানগর এলাকার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম। এখানে প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ লোকের বাস, যার ফলে এটিকে একটি অতিমহানগরী হিসেবে গণ্য করা হয়।
লস অ্যাঞ্জেলেস শহরটি প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে একটি প্রশস্ত সমতল ভূমিতে, মেক্সিকো সীমান্তের কাছে অবস্থিত। শহরের পশ্চিমে রয়েছে অনেকগুলি সমুদ্র সৈকত। পূর্বে রয়েছে স্যান গেব্রিয়েল পর্বতমালা। অন্যান্য দিকে রয়েছে সুউচ্চ পর্বত ও মরুভূমি। স্যান্টা মনিকা পর্বতমালা মহানগরীটিকে দুইটি অংশে ভাগ করেছে: পশ্চিমে পড়েছে হলিউড, বেভার্লি হিলস, ইত্যাদি এলাকা এবং পূর্বে পড়েছে স্যান ফের্নান্ডো ভ্যালি নামক উপত্যকা এলাকাটি।
লস অ্যাঞ্জেলেস একটি বহুজাতিক, বহুসাংস্কৃতিক শহর। এখানকার মেক্সিকান, কোরীয়, সালভাদোরীয় ও গুয়াতেমালীয় প্রবাসী সম্প্রদায়গুলি উল্লেখযোগ্য। ২০১০ সালের জনগণনা অনুযায়ী শহরের প্রায় অর্ধেক অধিবাসী হিস্পানীয় বা লাতিনো (শ্বেতাঙ্গ কিংবা অশ্বেতাঙ্গ) বংশোদ্ভূত। এছাড়া ৩০% অ-হিস্পানীয় শ্বেতাঙ্গ, ১০% কৃষ্ণাঙ্গ ও ১০% এশীয় বংশোদ্ভূত লোক এখানে বাস করে। শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা ইংরেজি নয় (৪০%), বরং স্পেনীয় ভাষা (৪৪%)। তবে বেশিরভাগ অধিবাসী ইংরেজি ও স্পেনীয় উভয় ভাষায় স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারেন।
লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের জলবায়ু মৃদু ও ভূমধ্যসাগরীয় ধরনের। এখানকার গ্রীষ্মগুলি গরম ও শুষ্ক এবং শীতকালগুলি মৃদু ও বৃষ্টিবহুল। গ্রীষ্মের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা জুলাই মাসে ২৪° সেলসিয়াসে পৌঁছায় এবং শীতে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা জানুয়ারি মাসে ৯° সেলসিয়াসে নেমে আসে। প্রশান্ত মহাসাগরের উপস্থিতির কারণে জলবায়ু চরমভাবাপন্ন হতে পারে না এবং একই কারণে মাঝে মাঝে উপকূলীয় অঞ্চলে কুয়াশার সৃষ্টি হয়। উপকূলের তুলনায় পাহাড়ি অঞ্চলে বেশি বৃষ্টিপাত হয়।
লস অ্যাঞ্জেলেস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এখানকার চলচ্চিত্র শিল্প, বিমানচালনা শিল্প ও বায়বান্তরীক্ষ শিল্প বিশ্ববিদিত। হলিউড বিশ্বের প্রধানতম বিনোদন শিল্পকেন্দ্র হিসেবে সুবিখ্যাত। টোকিও ও নিউ ইয়র্ক শহরের পরে লস অ্যাঞ্জেলেস মহানগরীর স্থূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বিশ্বের ৩য় সর্বোচ্চ; ২০১৭ সালে এর স্থূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ছিল ১ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টিটি যদি একটি সার্বভৌম দেশ হত, তাহলে এর অর্থনীতির আয়তন হত বিশ্বের ১৪শ সর্বোচ্চ যা কিনা রাশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতির চেয়েও বড়।
বহু দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সুবাদে লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের এক ধরনের গৌরবময় ও চাকচিক্যমণ্ডিত মূর্তি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। পাম বৃক্ষশোভিত রাজপথ, মহাসমুদ্রপারের বহু বেলাভূমি ও হলিউডের সব মহাতারকাদের শহর লস অ্যাঞ্জেলেস মার্কিন ও অমার্কিন কোটি কোটি মানুষের কাছে “মার্কিন স্বপ্নের” এক আদর্শ রূপ হিসেবে গণ্য হয়।
আদিতে লস অ্যাঞ্জেলেস এলাকাটিতে চুমাশ ও তোংভা নামের আদিবাসী আমেরিকীয় জাতি বসবাস করত। স্পেনীয় ঔপনিবেশিক হুয়ান রোদ্রিগেস কাব্রিইয়ো ১৫৪২ সালে এলাকাটিকে বৃহত্তর আলতা কালিফোর্নিয়া (“ঊর্ধ্ব ক্যালিফোর্নিয়া”) নামক উপনিবেশের অংশ হিসেবে করায়ত্ত করেন। নতুন স্পেন নামক মহা-উপনিবেশের উত্তর প্রান্তসীমাতে ছিল এর অবস্থান। ১৮শ শতকের শেষভাগে এসে ১৭৭১ সালে একটি স্পেনীয় কুঠি স্থাপন করা হয়। এরপর ১৭৮১ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর একটি অতিক্ষুদ্র উপনিবেশ বসতি হিসেবে লস অ্যাঞ্জেলেসের যাত্রা শুরু হয়। স্পেনের ঔপনিবেশিক প্রশাসক ফেলিপে দে নেবে নবপ্রতিষ্ঠিত বসতিটির নাম দেন “এল পুয়েবলো দে নুয়েস্ত্রা রেইনা দে লোস আনহেলেস দেল রিও দে পোরসিউনকুলা” (“পোরসিউনকুলা নদীর দেবদূতদের রাণী কুমারী মেরির শহর”)। তবে শীঘ্রই শহর ও নদী উভয়েই লস অ্যাঞ্জেলেস (“দেবদূতগণ”) নাম ধারণ করে। ১৮২১ সালে মেক্সিকোর স্বাধীনতা যুদ্ধশেষে শহরটি মেক্সিকোর অংশে পরিণত হয়। ১৮৪৬ সালে মার্কিন সেনারা শহরটি দখল করে। ১৮৪৮ সালে মেক্সিকো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধশেষে গুয়াদালুপে ইদালগোর চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লস অ্যাঞ্জেলেসসহ সমগ্র ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যটি কিনে নেয়। ১৮৪৯ সালের স্বর্ণ-ধাওয়া (গোল্ড রাশ) ঘটনার পর থেকে শহরের ক্রমাগত উন্নতি হতে থাকে। ১৮৫০ সালের ৪ঠা এপ্রিল লস অ্যাঞ্জেলেস একটি পৌরসভার স্বীকৃতি লাভ করে; এর ৫ মাস পরেই ক্যালিফোর্নিয়াকে অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা দান করা হয়। ১৮৭৬ ও ১৮৮৫ সালে রেলপথের আগমনের পরে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৮৯০ সালে খনিজ তেলের আবিষ্কারের পর শহরের জনসংখ্যা আরও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯১৩ সালে পূর্ব ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা নেভাডা পর্বতমালা থেকে জলনালির মাধ্যমে সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত হলে শহরটির উত্তরোত্তর দ্রুত প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। ১৯২০-এর দশকের পর থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস শুধু ক্যালিফোর্নিয়া নয়, মিসিসিপি নদীর পশ্চিমে অবস্থিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহানগরীতে পরিণত হয়। মূল লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের জনসংখ্যা ১৯০০ সালে প্রায় ১ লক্ষ ছিল। সেটি বিংশ শতাব্দী ধরে বৃদ্ধিলাভ করে ২০০০ সালে এসে ৩৭ লক্ষে পরিণত হয়। জনসংখ্যা ও কলেবর বৃদ্ধির সাথে সাথে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন আকাশ, মহাসড়কগুলিতে অসহনীয় যানজট, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও দাঙ্গার মত নেতিবাচক দিকগুলি লস অ্যাঞ্জেলেসের সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে শুরু করে।
নিকটবর্তী স্যান অ্যানড্রেয়াস বিচ্যুতির অবস্থান লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের জন্য একটি সম্ভাব্য হুমকি। শহরটি একটি প্রধান চ্যুতিরেখার উপরে অবস্থিত এবং এখানে কখনও কখনও মৃদু ভূমিকম্প হয়, তবে এগুলিতে ক্ষতির পরিমাণ সীমিত। তা স্বত্ত্বেও অতীতে কয়েকবার শহরটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ১৯৯৪ সালের ভূমিকম্পটি উল্লেখযোগ্য। গ্রীষ্মের শেষভাগে ও শরৎকালে পাহাড়ি অঞ্চল থেকে আগত সান্তা আনা নামের উত্তপ্ত, শুষ্ক ও ঝোড়ো বায়ুপ্রবাহের কারণে দাবানলের সৃষ্টি হয়।
লস অ্যাঞ্জেলেসের কেন্দ্রীয় ব্যবসায়িক এলাকাটির কাছে যে চত্বরটি আছে, সেটিই শহরের আদি পত্তনস্থল। এখানে শহরের মেক্সিকান-মার্কিনী সম্প্রদায়টি বাস করে। এখানেই শহরের প্রাচীনতম গির্জাটি অবস্থিত। বর্তমানে গির্জাটি ৪০ একর আয়তনের এল পুয়েবলো দে লস অ্যাঞ্জেলেস রাজ্য ঐতিহাসিক উদ্যানের অংশ। চত্ত্বরের দক্ষিণে শহরের নাগরিক কেন্দ্রটি অবস্থিত, যেখানে নগর ভবন ও আরও বেশ কিছু পৌর ও কাউন্টি পর্যায়ের সরকারি ভবন অবস্থিত। নাগরিক কেন্দ্রের ১১ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে হলিউড এলাকাটি অবস্থিত যেখানে মার্কিন চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাণকেন্দ্র অবস্থিত। স্পেনের ঔপনিবেশিক বাণিজ্যকুঠি , গেটি জাদুঘর, লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টি শিল্পকলা জাদুঘর এবং সমসাময়িক শিল্পকলা জাদুঘর পর্যটকদের জন্য আগ্রহজনক স্থান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব শহরের মধ্যে লস অ্যাঞ্জেলেস মহানগরীতে শিল্পকলা-সংক্রান্ত জীবিকা নির্বাহীর (চিত্রশিল্পী, স্থপতি, লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সঙ্গীতশিল্পী ও নৃত্যশিল্পী) সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (ইউনিভার্সিটি অফ সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া), অক্সিডেন্টাল কলেজ এবং লস অ্যাঞ্জেলেস ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট লস অ্যাঞ্জেলেস) উল্লেখযোগ্য।
শহর কেন্দ্র থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এলএএক্স বা লস অ্যাঞ্জেলেস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশ্বের ৪র্থ ব্যস্ততম বিমানবন্দর। শহরকেন্দ্র থেকে দক্ষিণে ৪০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত লস অ্যাঞ্জেলেস সমুদ্রবন্দরটি (পার্শ্ববর্তী লং বিচ সমুদ্রবন্দরের সাথে একত্রে) বিশ্বের ৫ম বৃহত্তম কন্টেইনার বন্দর এবং এককভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম কন্টেইনার বন্দর। লস অ্যাঞ্জেলেসে ভালো গণপরিবহন ব্যবস্থা নেই। মহানগরীর বিভিন্ন উপশহরগুলিকে বহুসংখ্যক মহাসড়ক বা “ফ্রিওয়ে”-র জটিল আন্তর্জালিকা দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। এগুলিতে মোটরগাড়ি ব্যবহার করে চলাচল করা লস অ্যাঞ্জেলেসের অধিবাসীদের জীবনধারা ও সংস্কৃতির একটি বড় অংশ। লস অ্যাঞ্জেলেস ১৯৩২ ও ১৯৮৪ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল এবং ২০২৮ সালে আবারও আয়োজক হতে যাচ্ছে। এছাড়া এখানে ১৯৯৪ সালের পুরুষদের ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ এবং ১৯৯৯ সালের মহিলাদের ফিফা বিশ্বকাপের শিরোপা নির্ধারণী খেলাগুলি অনুষ্ঠিত হয়।
↑ কখ"Elevations and Distances"। US Geological Survey। এপ্রিল ২৯, ২০০৫। নভেম্বর ৯, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৫।