রেনেসাঁ বা পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগরণ বা নবজাগরণ যার অভিধানিক অর্থ বিপ্লব (ফরাসি: Renaissance, ইতালীয়: Rinascimento) ছিল পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে সংঘটিত ইউরোপীয় ইতিহাসে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে পদার্পনের মধ্যবর্তী সময়। এটি মধ্যযুগের সংকটের পর সংঘটিত হয়ে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন সাধিত করে। তাছাড়া রেনেসাঁ মূলত শুরু হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে এবং শেষ হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে। গতানুগতিকভাবে সবাই রেনেসাঁর প্রাথমিক সময়ের দিকে নজর দেয়, কিন্তু অনেক ইতিহাসবিদ মধ্যযুগের দিকেই বেশি মনোনিবেশ করেন এবং তারা যুক্তি দেখান যে এটি মধ্যযুগেরই বিস্তৃতি।[১] যাইহোক, সময়ের সূচনা - ১৫ শতকের প্রথম দিকের রেনেসাঁ এবং প্রায় ১২৫০ বা ১৩০০ সাল থেকে ইতালীয় প্রোটো-রেনেসাঁ - মধ্যযুগের শেষের সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে ওভারল্যাপ করে, প্রচলিতভাবে সি. ১২৫০-১৫০০, এবং মধ্যযুগ নিজেই আধুনিক যুগের মতো ধীরে ধীরে পরিবর্তনে ভরা একটি দীর্ঘ সময় ছিল; এবং উভয়ের মধ্যে একটি ক্রান্তিকাল হিসাবে, রেনেসাঁর উভয়ের সাথেই ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে, বিশেষ করে পূর্ববর্তী ও প্রথম দিকের উপ-কাল।
রেনেসাঁর বৌদ্ধিক ভিত্তি ছিল এর মানবতাবাদের সংস্করণ, যা রোমান হিউমিনিটাসের ধারণা থেকে উদ্ভূত এবং ক্লাসিক্যাল গ্রিক দর্শনের পুনঃআবিষ্কার, যেমন প্রোটাগোরাসের মত, যিনি বলেছিলেন যে "মানুষই সমস্ত কিছুর পরিমাপ"। শিল্প, স্থাপত্য, রাজনীতি, বিজ্ঞান ও সাহিত্যে এই নতুন চিন্তার প্রকাশ ঘটে। প্রাথমিক উদাহরণগুলি ছিল তৈলচিত্রে দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ এবং কীভাবে কংক্রিট তৈরি করা যায় তার পুনরুজ্জীবিত জ্ঞান। যদিও ধাতব অস্থাবর প্রকারের উদ্ভাবন 15 শতকের পরে ধারণার প্রসারকে ত্বরান্বিত করেছিল, রেনেসাঁর পরিবর্তনগুলি ইউরোপ জুড়ে অভিন্ন ছিল না: প্রথম চিহ্নগুলি ইতালিতে 13 শতকের শেষের দিকে, বিশেষ করে দান্তের লেখা এবং Giotto এর আঁকা ছবিতে দেখা যায়।
একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসাবে, রেনেসাঁ ল্যাটিন এবং আঞ্চলিক সাহিত্যের উদ্ভাবনী অন্তর্ভুক্ত করে, 14 শতকের ধ্রুপদী উত্সের উপর ভিত্তি করে শিক্ষার পুনরুত্থানের সাথে শুরু হয়, যা সমসাময়িকরা পেট্রার্ককে কৃতিত্ব দেয়; রৈখিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ এবং চিত্রকলায় আরও প্রাকৃতিক বাস্তবতা উপস্থাপনের অন্যান্য কৌশল; এবং ধীরে ধীরে কিন্তু ব্যাপক শিক্ষাগত সংস্কার। রাজনীতিতে, রেনেসাঁ কূটনীতির রীতিনীতি এবং প্রথার বিকাশে এবং বিজ্ঞানে পর্যবেক্ষণ এবং প্রবর্তক যুক্তির উপর নির্ভরতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। যদিও রেনেসাঁ অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সামাজিক বৈজ্ঞানিক সাধনার ক্ষেত্রে বিপ্লব দেখেছিল, সেইসাথে আধুনিক ব্যাঙ্কিং এবং অ্যাকাউন্টিং ক্ষেত্রের প্রবর্তন,[6] এটি সম্ভবত তার শৈল্পিক বিকাশ এবং লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মতো পলিম্যাথদের অবদানের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। মাইকেলেঞ্জেলো, যিনি "রেনেসাঁর মানুষ" শব্দটিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।[7][8]
ফ্লোরেন্স প্রজাতন্ত্রে রেনেসাঁ শুরু হয়েছিল, ইতালির অনেক রাজ্যের মধ্যে একটি। ফ্লোরেন্সের সেই সময়ের সামাজিক ও নাগরিক বৈশিষ্ট্য সহ বিভিন্ন কারণের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এর উত্স এবং বৈশিষ্ট্যগুলির জন্য বিভিন্ন তত্ত্বগুলিকে বিবেচনা করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে: এর রাজনৈতিক কাঠামো, এর প্রভাবশালী পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা, মেডিসি,[10][11] ] এবং উসমানীয় তুর্কিদের কাছে কনস্টান্টিনোপল পতনের পর গ্রিক পণ্ডিতদের এবং তাদের গ্রন্থের ইতালিতে অভিবাসন। অন্যান্য প্রধান কেন্দ্রগুলি ছিল উত্তর ইতালীয় শহর-রাজ্য যেমন ভেনিস, জেনোয়া, মিলান, বোলোগনা এবং রোম রেনেসাঁর যুগে বা ফ্লেমিশ শহর যেমন ব্রুজ, ঘেন্ট, ব্রাসেলস, লিউভেন বা এন্টওয়ার্প।
রেনেসাঁর একটি দীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাসগ্রন্থ রয়েছে এবং, বিচ্ছিন্ন সময়কালের সাধারণ সংশয়বাদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, ঐতিহাসিকদের মধ্যে 19 শতকের "রেনেসাঁ" এবং পৃথক সাংস্কৃতিক নায়কদের "রেনেসাঁর পুরুষ" হিসাবে গৌরব করার প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাতে অনেক বিতর্ক হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে। একটি শব্দ হিসাবে এবং একটি ঐতিহাসিক বর্ণনা হিসাবে রেনেসাঁর উপযোগিতা। কিছু পর্যবেক্ষক প্রশ্ন তুলেছেন যে রেনেসাঁ মধ্যযুগ থেকে একটি সাংস্কৃতিক "অগ্রগতি" ছিল কিনা, পরিবর্তে এটিকে শাস্ত্রীয় প্রাচীনত্বের জন্য হতাশাবাদ এবং নস্টালজিয়ার সময় হিসেবে দেখেন,[16] যখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদরা, বিশেষ করে লংউ ডুরে পরিবর্তে দুটি যুগের মধ্যে ধারাবাহিকতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে,[17] যা সংযুক্ত, যেমন প্যানোফস্কি পর্যবেক্ষণ করেছেন, "এক হাজার বন্ধন দ্বারা"।
নিক অর্থ হল পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগরণ বা নবজাগরণ। এই যুগের ব্যাপ্তিকাল ছিল আনুমানিক চতু্র্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত। আধুনিক ইউরোপের উদ্ভবের ক্ষেত্রে রেনেসাঁস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি মূলত একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাজ পরিবর্তন প্রক্রিয়া। এই রেনেসাঁসের ভেতর দিয়ে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার উত্থান ঘটেছে এবং একইসঙ্গে অবসান ঘটেছে মধ্যযুগের। প্রচলিত অর্থে রেনেসাঁস বলতে বোঝায় প্রাচীন যুগের গ্রিক ও রোমান সাহিত্য , সংস্কৃতি , দর্শন , প্রযুক্তি , বিজ্ঞান , শিল্পকলা , ভাস্কর্যকলা প্রভৃতি অধ্যয়ন করা এবং এসবের ভিত্তিতে জীবনকে পরিচালনা করা [২] এ যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাচীন পুস্তক অধ্যয়নের অনুশীলন বৃদ্ধি, রাজকীয় ও ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতার উত্থান[তথ্যসূত্র প্রয়োজন], চিত্রকলায় দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহার এবং বিজ্ঞানের সামগ্রিক উন্নতি। অর্থাৎ , আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার উন্মেষ ও বিকাশ এর মধ্য দিয়ে ইউরোপের সামাজিক জীবনে যে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা ঘটে , তাকেই বলা হয় রেনেসাঁস। ইসলামি স্বর্ণযুগ পরে, মধ্য এশিয়ায় তিমুরিদ রেনেসাঁ নবজাগরণ শুরু হয়, যা উসমানীয় তুর্কি, সাফাভিদ ইরান এবং মুঘল ভারতকে প্রভাবিত করেছিল।[৩][৪]
অর্থাৎ সহজভাবে বলতে গেলে, অতীত ও বর্তমানের সম্মিলনই রেনেসাঁ। গ্রিক ক্লাসিক্যাল যুগে যে-সব কালজয়ী মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তারা জ্ঞানের যে আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাকেই নতুন করে জাগিয়ে, নতুন করে বুঝে, নতুন জ্ঞানের আলো দিয়ে সেই শিক্ষাকে এই রেনেসাঁর মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়েছিল।[৫]
রেনেসাঁর সূত্রপাত
রেনেসাঁ ফরাসি শব্দ। এর অর্থ হলো পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগরণ। ইউরোপে মধ্যযুগীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছায়। যার ফলে কুসংস্কার, অজ্ঞতা, বিবেকহীনতার সৃষ্টি হয় এবং স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার দ্বার রুদ্ধ হয়। ফলে ব্যক্তি মানসিকতার বিকাশ ব্যাহত হয়। তাদের মধ্যে সুষ্ঠ চিন্তা-চেতনা, দূর্বার অনুসন্ধিৎসা ও অবারিত জ্ঞানের দ্বার না থাকায় ব্যক্তি মনের প্রকৃত বিকাশ অসম্ভব হয়। এ দুর্বিসহঃ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্যই রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়। আর এই রেনেসাঁ বলতে বুঝি অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগ থেকে উদ্ধার প্রাপ্তি।[৬]
ইতালিতে রেনেসাঁ সংঘটিত হওয়ার কারণ
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর কনস্টান্টিনোপলকে কেন্দ্র করে নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠে এবং তা পশ্চিম ইউরোপে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। এসমস্ত নগররাষ্ট্র একটি অপেক্ষা অন্যটি অধিকতর উন্নতি লাভ করতে থাকে। এতে যে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয় তাই রেনেসাঁ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে ইতালি এতে সর্বাগ্রে অবস্থান নেয়। প্রকৃতপক্ষে রেনেসাঁ সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই ইতালির অর্থনীতি যথেষ্ট শক্ত ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে। যদিও রেনেসাঁ শুধু ইতালিতেই নয় এর আহবান ইতালির সীমা ছাড়িয়ে আল্পস পর্বতের উত্তরে ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, হল্যান্ড, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশেও বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু প্রথমে ইতালিতেই রেনেসাঁ সংঘটিত হওয়ার পিছনে কতগুলো বিশেষ কারণ অবশ্যই ছিল।
১. ভৌগোলিক কারণ:
ইতালির ভৌগোলিক অবস্থান ইতালিবাসীকে রেনেসাঁর দিকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল। ভূমধ্য সাগরের মধ্যস্থলে অবস্থিত হওয়ার কারণে ঐ অঞ্চলের বাণিজ্য ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক কেন্দ্রস্থল ছিল ইতালি। ক্রুসেডের সূত্র ধরে ইউরোপ ও আরব দেশের মধ্যে যে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে ওঠেছিল তার সবচেয়ে বেশি সুযোগ গ্রহণ করেছিল ইতালি।
২. কনস্টান্টিনোপলের পতন:
১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দে উসমানীয় সাম্রাজ্য]] যখন কনস্টান্টিনোপল দখল করে তখন সেখানকার পন্ডিতগণ ইতালিতে চলে আসে। তাঁদের আগমন ইতালিতে রেনেসাঁ সৃষ্টির পথকে আরও অধিক সহজ করে দেয়। বোকাচ্ছিও, পেত্রার্ক প্রভৃতি হিউম্যানিষ্টদের চেষ্টায় ইতালিতে যে সাহিত্য ও শিল্পনুরাগ জেগেছিল কনস্টান্টিনোপল হতে পণ্ডিতদের আগমনের ফলে সেই অনুরাগ এক ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লাভ করে।
৩. ইতালীয় শহরের প্রভাব:
ইতালীয় শহরগুলো মধ্যযুগে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে। এই সকল শহরেই মধ্যযুগীয় সভ্যতা সর্বপ্রথম আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করতে শুরু করে।
৪. রোমান সভ্যতার সাথে যোগাযোগ:
ইতালিতে রেনেসাঁ শুরু হওয়ার অপর একটি কারণ ছিল ইতালির উপদ্বীপের সাথে রোম নগরের ঘনিষ্ঠতা। ইতালি উপর প্রাচীন রোমান সংস্কৃতি ও সভ্যতার গভীর প্রভাব ইতালিবাসীদের স্বভাবতই প্রাচীনকালের রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবান করে তুলেছিল। ইউরোপের অন্য দেশে প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে পঞ্চদশ শতাব্দীর চিন্তাধারার কোন প্রকার যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু ইতালিতে প্রাচীন গ্রিক রোমান সভ্যতা হতে পরবর্তী কালের ধ্যান-ধারণা একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়নি। তাই প্রাচীন সভ্যতার সাথে এই যোগাযোগ রেনেসাঁসের পথ সহজ করে দিয়েছিল অনেকটাই।
৫. ইতালির ধর্মাধিষ্ঠানের প্রভাব:
রোমান সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক একতা বিনষ্ট হওয়ার পরও রোমান খ্রীষ্ট ধর্মাধিষ্ঠান রোমের প্রাচীন ঐতিহ্য ও গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। এটি ভিন্ন রাজনৈতিক দুর্যোগে ধর্মাধিষ্ঠান গুলোর শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। লাতিন ভাষার উন্নতি সাধনে রোমের ধর্মাধিষ্ঠানের দান নেহাত কম ছিল না।
৬. হিউম্যানিষ্টদের প্রভাব:
রেনেসাঁসের পথ প্রদর্শকের অনেকেই ছিলেন ইতালিবাসী। সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতি প্রত্যেক দিক দিয়েই ইতালি প্রতিভাবান ব্যক্তিদের জন্মস্থানে পরিণত হয়েছিল। পেত্রার্ক, বোকাচ্চিও প্রভৃতি মানবতাবাদী সাহিত্যিকদের সকলেই ছিলেন ইতালির লোক।
৭. বিভিন্ন জাতির মিলন ক্ষেত্র হওয়ার প্রভাব:
রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের সময় (৪৭৬) হতে ইতালি গথ, লোম্বার্ড, ফ্রাঙ্ক, সারমেন, নর্মান ও জার্মান প্রভৃতি জাতির মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এই সূত্রে রোমান, বাইজান্টাইন, আরব, জার্মান প্রভৃতি বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সভ্যতার যোগাযোগের ফলে ইতালিতে এক নব চেতনা ও সংস্কৃতির ব্যাপক উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল।
৮. ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষাদান:
গির্জা এবং বিভিন্ন শহরে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষাদান শুরু হওয়ার ফলে মানুষের বাস্তব জীবনেও সুখকর, আধ্যাত্মিক উন্নতি ছাড়াও যে মানুষের জীবনের অপর একটি দিক রয়েছে এবং আত্মার অবনতি না ঘটেও যে মানুষ সহজ সরল সুখকর জীবন যাপন করতে পারে এই ধারণা ইতালির বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্রে সর্বপ্রথম জাগরিত হয়েছিল। এই ধারণাই ইতালিবাসীকে রেনেসাঁর বীজ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করে দিয়ে ছিল।
৯. রোমান সভ্যতার চিহ্ন:
রেনেসাঁ শুরু হওয়ার পর এর গতি এবং ব্যাপ্ততাকে সাহায্য করবার মত প্রাচীন সভ্যতা, সাহিত্য, শিল্প প্রভৃতির চিহ্ন ইতালিতে যথেষ্ট ছিল। ইতালির প্রায় সর্বত্রই ভাস্কর্য, স্থাপত্য, শিল্পকলার চিহ্ন ছিল।
১০. টাইপ মেশিন ও মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার:
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপে মুদ্রণযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হলে সাহিত্য ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় রচনা হয়। গুটেন বার্গের আবিষ্কার দ্বারা ১৪৫৪-৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ল্যাটিন ভাষায় বাইবেল ছাপানো হয়। মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার ছিল রেনেসাঁ বিস্তারে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা। ছাপাখানা স্থাপিত হবার ফলে প্রচুর পরিমাণে পুস্তক ছাপা হওয়ার ফলে সকলেই পড়াশোনা করার সুযোগ পায়। বই পুস্তক অধ্যয়নের ফলে অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের মধ্যে নবচেতনার জন্ম হয়।
১১. রেনেসাঁ যুগের চিত্রশিল্পীর প্রভাব:
এ সময়ে শিল্পকলায় জত্তো, মেসাচ্চিও, দোনাতেল্লো, জ্যান-ভ্যান আইক, ব্রুনেলেস্কি, মিকেল এঞ্জলো, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, রাফয়েল, গিবার্টি প্রমুখ শিল্পীর আবির্ভাব ঘটে। এঁদের মধ্যে জত্তো চিত্রকলায় ত্রিমাত্রিকতার সৃষ্টি করেন, ব্রুনেলেস্কি পরিপ্রেক্ষিত আর জ্যান-ভ্যান আইক তেল রং আবিষ্কারের ফলে চিত্রকলা এগিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। এই সময়ের শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছিল একাধারে চিত্রশিল্পী, স্থপতি, ভাস্কর, কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ ও বৈজ্ঞানিক। তিনি ছিলেন রেনেসাঁসের প্রতীকি স্বরূপ। তার আঁকা ‘মোনালিসা’ ও ‘শেষ ভোজ’ শিল্পীদের কাছে আজও বিষ্ময়ের বস্তু। রাফায়েলের ‘এঞ্জেল’ ও মিকেল এ্যাঞ্জেলোর ‘শেষ বিচার’ চিত্রগুলো শিল্পীদের অমূল্য সম্পদ।
১২. রেনেসাঁ যুগের বিজ্ঞান:
কোপার্নিকাস ছিলেন রেনেসাঁ যুগের বিজ্ঞানী। পৃথিবীসূর্যের চারদিকে ঘুরে এই সত্য তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। এই যুগে গ্যালিলিও সর্বপ্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র ও দোলক এবং স্যার আইজাক নিউটন তার বিখ্যাত ‘মহাকর্ষ নীতি’ আবিষ্কার করার মাধ্যমে জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুগান্তর আনয়ন করেন।
রেনেসাঁর কয়েকজন চিত্রশিল্পী:
১. লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি:
রেনেসাঁ যে ক’জন মহান ব্যক্তির সৃষ্টি করেছিল তার মধ্যে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ ছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। উচ্চ রেনেসাঁ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ তিনজন সৃজনশীল শিল্পীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য ও বিশ্বজনীন। তাঁকে শুধু রেনেসাঁ যুগেই নয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি এমন মানসিক শক্তিতে বলিয়ান ছিলেন যে সেসময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ছিলেন এক বিস্ময়। তার বুদ্ধিবৃত্তি এমন উচ্চস্তরের ছিল যে, সে সময়ের দেহ বিজ্ঞান, নৌ-বিদ্যা এবং বিংশ শতাব্দীর বহু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেপথ্য জনক ছিলেন তিনি। কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে তিনি স্থির থাকতে পারেননি। তার কাজের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর মূলে রয়েছে রঙের ব্যবহার, উদ্ভাবনী কৌশল, শরীরস্থান, আলো, উদ্ভিদতত্ত¡ এবং ভ‚-তত্ত¡ সম্পর্কে তার বিস্তারিত জ্ঞান। একাধারে কবি, দার্শনিক, প্রকৌশলী, স্থপতিবিদ, ভাস্কর, সঙ্গীতজ্ঞ, সমরযন্ত্রশিল্পী, দেহতত্ত¡বিদসহ অন্যান্য পরিচয়েও সুবিদিত এই মানব ইতিহাসের বহু আবিষ্কারের পথিকৃৎ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণোজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।[৭]
২. মাইকেল এঞ্জেলো:
মাইকেল এঞ্জেলো রেনেসাঁ যুগের একজন ইতালীয় ভাস্কর, চিত্রকর, স্থপতি এবং কবি। তার পুরো নাম মিকেল এঞ্জেলো দি লোদোভিকো বুনোরত্তি সিমোনি। তার বৈচিত্রময়তার ব্যাপ্তি এবং বিস্তৃতির কারণে তাঁকে রেনেসাঁ মানব বলে বর্ননা করা হয়। তার জীবিতকালেই তাঁকে শ্রেষ্ঠ জীবিত শিল্পী হিসেবে বিবেচনা করা হত এবং ইতিহাসেও তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীদের একজন হিসেবে ধরা হয়। ষোড়শ শতাব্দীর শিল্পীদের মধ্যে তারই বিভিন্ন কাজ ও খসড়া চিত্র বেশি পরিমাণে সংরক্ষিত আছে।
৩. রাফায়েল:
উচ্চ রেনেসাঁর শিল্পীগণের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী ছিলেন রাফায়েল। তার বেড়ে ওঠার ধরনটি ছিল অনেকটা পঞ্চদশ শতাব্দীর শিল্পীদের মতো। যদিও তিনি লিওনার্দো ও মিকেল এঞ্জেলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তথাপি তিনি নিজে এক স্বকীয় ধারা নির্মাণ করতে সক্ষম হন। উপরন্তু উচ্চ রেনেসাঁর শিল্পকর্মের সাথে তার শিল্পকর্ম যথেষ্ট সাযুজ্যপূর্ণ। যাঁর কাছ থেকেই শিখুন না কেন তার শক্তিশালী রীতি সবসময়ই তার শিল্পকর্মের মাঝে অনুধাবন করা যায়।
তথ্যসূত্র
↑Monfasani, John (২০১৬)। Renaissance Humanism, from the Middle Ages to Modern Times। আইএসবিএন978-1-351-90439-1।
↑Burke, P., The European Renaissance: Centre and Peripheries 1998)