রুয়ান্ডার গণহত্যা বলতে ১৯৯৪ সালে সেদেশের সংখ্যালঘু টাট্সি গোষ্ঠীর মানুষ এবং সংখ্যাগুরু হুটু গোষ্ঠীর মধ্যে উদার ও মধ্যপন্থীদের নির্বিচারে হত্যার ঘটনাকে বোঝায়। ৬ই এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই গণহত্যা সংঘটিত হয়। অন্তত ৫০০,০০০ টাট্সি এবং এক হাজারেরও বেশি হুটু নিহত হয়। অধিকাংশ সূত্রমতে মোট নিহতের সংখ্যা ৮০০,০০০ এর কাছাকাছি বা ১,০০০,০০০ এর কাছাকাছি। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা নানান খবরের ভিড়ে এই গণহত্যার সংবাদ আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে খুব কমই স্থান পেয়েছিল। এই সুযোগেই গণহত্যা বিভৎস রূপ ধারণ করেছিল।
সরকারি নির্দেশেই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিল দুটি হুটু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দল: এমআরএনডি (Interahamwe-এর অংশ) এবং সিডিআর (Impuzamugambi-এর অংশ)। রুয়ান্ডার ঔপনিবেশিক যুগের অবসান ও হুটু পাওয়ার সংস্কৃতির উত্থানের পর সেখানে যে গোষ্ঠীগত ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল তারই চূড়ান্ত পরিণাম এই গণহত্যা। অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল হুটু সরকার ও নির্বাসনে দণ্ডিত টাট্সিদের মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে হুটুদের সহায়তা করেছিল ফ্রান্স ও আফ্রিকার কিছু ফ্রাংকোফোন রাষ্ট্র। আর টাট্সিদের সহায়তা করেছিল উগান্ডা। ১৯৯০ সালে হুটুরা আগ্রাসনের মাধ্যমে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। টাট্সিরা বিদ্রোহী হয়ে উঠে। ১৯৯৩ সালে বৈদেশিক সহায়তায় হুটু ও টাট্সিদের মধ্যে একটি শান্তি ও নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রাথমিকভাবে আরুশা অ্যাকর্ড কার্যকর হয়। প্রথমে মনে হচ্ছিল কূটনৈতিকভাবে বিদ্রোহী ও সরকারের মধ্যে সংঘাতের অবসান হতে চলেছে। কিন্তু সরকারের মধ্যে অভিজাত ব্যক্তিরা বিদ্রোহীদের সাথে চুক্তির বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু সুসংগঠিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এর কোন বিকল্প ছিল না।
পুনরায় গৃহযুদ্ধের সূচনা এবং টাট্সি বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য হুটুদেরকে ফ্রান্স সরকারের সহযোগিতার কারণে গণহত্যা বিকট রূপ ধারণ করে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। ফলশ্রুতিতে হুটুরা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। যুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ফ্রান্সের সহায়তায় একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় হুটু শরণার্থীরা দক্ষিণ-পশ্চিমে পালাতে শুরু করে। টাট্সিরা এদের তাড়া করে। ফরাসি অবিযান শেষ হওয়ার পর এই হুটুরা সীমান্ত পেরিয়ে জায়ারে (বর্তমান গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র) আশ্রয় নেয়। এই শরণার্থীদের সাথে গণহত্যায় অংশগ্রহণকারী অনেকেও ছিল যারা উগান্ডা সীমান্তে বসবাস করছিল। এদের কারণেই পরবর্তীকালে প্রথম ও দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ এবং তাদের সাথে সরকারের সংঘর্ষ এখনও চলছে।
জাতিসংঘ এই হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অনিচ্ছুক ছিল। মিডিয়ায় সচিত্র সংবাদ পরিবেশন সত্ত্বেও জাতিসংঘের এমন ব্যবহারে সবাই মর্মাহত হয়েছিলেন এবং জাতিসংঘকে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এই অনীহার কারণেই রুয়ান্ডায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে গণহত্যা মোকাবেলার মত যথেষ্ট সৈন্য ও কর্মকর্তা ছিল না। Roméo Dallaire এর নেতৃত্বে এই শান্তিরক্ষী দলটি তাই কার্যকরী কিছু করতে পারেনি। একসময় রুয়ান্ডা থেকে সব বিদেশী লোকদেরকে সরিয়ে আনা হয়। কিন্তু সেখানকার অধিবাসীদের রক্ষার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম ও ফ্রান্স সরকারকে এ কারণে এখনও সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। রুয়ান্ডায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছিল United Nations Assistance Mission for Rwanda। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষিত না হওয়ায় তারা কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এক সময় সমগ্র রুয়ান্ডার জন্য মাত্র ৩০০ শান্তিরক্ষী মোতায়েন ছিল।ফ্রানকোফোন