বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব এবং স্নায়ুবিজ্ঞানের মত জৈবিক বিজ্ঞানসমূহের মাধ্যমে ভালোবাসার জৈবিক ভিত্তিকে অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। অক্সিটোসিনের মত বেশ কিছু নির্দিষ্ট রাসায়নিক যৌগকে ভালোবাসার সাথে সম্পর্কিত মানব অভিজ্ঞতা এবং আচরণে তাদের ভূমিকার দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করা হয়।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান বিগত সময়ে ভালোবাসা সম্পর্কিত বেশ কিছু তত্ত্বের প্রস্তাব করেছে। মানব সন্তান এবং শিশুরা একটি দীর্ঘ সময় তাদের পিতামাতার সাহায্যের উপর নির্ভরশীল থাকে। এ কারণে ভালোবাসাকে এই সুদীর্ঘ সময়ে শিশুর জন্য বাবামায়ের পারস্পরিক সহায়তার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা যায়। আরেকটি কারণ হল যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে যৌনরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি, স্থায়ীভাবে সন্তানধারণ ক্ষমতা লোপ পাওয়া, ডিম্বাশয়ে আঘাতপ্রাপ্তি এবং সন্তান জন্মের সময় অত্যধিক ঝুঁকি। এই বিষয়গুলো যৌন সম্পর্কিত রোগে (এসটিডি) জরিয়ে পড়ার ঝুঁকি কমিয়ে একচেটিয়াভাবে দীর্ঘ সময়ের সম্পর্ক তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।[১]
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, ভালোবাসা কীভাবে মানব বিবর্তনের দ্বারা গড়ে উঠেছে এর উপর ভিত্তি করে ভালোবাসার সাথে সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা এবং আচরণকে গবেষণা করা যেতে পারে।[২] উদাহরণস্বরূপ, ধারণা করা হয়েছে যে মানব ভাষা একটি সঙ্গী তৈরির সংকেত হিসেবে বিবর্তনকালীন সময়ে নির্বাচিত হয়েছে যা আদর্শ সঙ্গীদ্বয়কে পরস্পরের প্রজনন স্বাস্থ্যের যোগ্যতা ও দক্ষতা যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষমতা প্রদান করে।[৩] মিলার বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানকে বিভিন্ন অগ্রগামী গবেষণার একটি সূচনাস্থান হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন:
Cognitive neuroscience could try to localize courtship adaptations in the brain. Most importantly, we need much better observations concerning real-life human courtship, including the measurable aspects of courtship that influence mate choice, the reproductive (or at least sexual) consequences of individual variation in those aspects, and the social-cognitive and emotional mechanisms of falling in love.
ডারউইনের সময়কাল থেকেই আদর্শ সঙ্গীদের আকর্ষণ ও তাদের দক্ষতাকে বিচার করার আরও একটি আদর্শ সাংকেতিক পদ্ধতি হিসেবে সঙ্গীতে মানব আগ্রহের বিবর্তন সম্পর্কে একই রকম ধারণা বিবেচিত হয়ে আসছে।[৪] ধারণা করা হয় যে ভালোবাসার অভিজ্ঞতা নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষের সামর্থ্য তাদের আদর্শ সঙ্গীদের কাছে এমন একটি ইঙ্গিত আকারে প্রকাশিত হয় যে, তাদের সঙ্গী ভবিষ্যতে একজন ভাল বাবা কিংবা মা হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মে তাদের জিন পরিবহনে সহায়তা করতে আগ্রহী হবে।[৫] জীববিজ্ঞানী জেরেমি গ্রিফিথ ভালোবাসাকে 'নিঃশর্ত নিঃস্বার্থতা' হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন,[৬] যা আধুনিক মানব উত্তরসূরি অস্ট্রালোপিথেকাস(Australopithecus)-দেরকে বাচনিকভাবে একে অপরকে সহযোগিতা করার সহজাত প্রবৃত্তি গঠনে সহায়তা করেছে। বনবো(একটি বিশালাকারের শিম্পাঞ্জি যাকে পূর্বে পিগমি শিম্পাঞ্জি নামে ডাকা হতো)-দের উপর কৃত গবেষণাগুলো অতীতে মানুষের সমবায়ী জীবনযাপনের স্বপক্ষে পরোক্ষ প্রমাণ হিসেবে এখনো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।[৭]
স্নায়বিক-রসায়ন
জীববিজ্ঞানের প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি হল এই যে, ভালোবাসা, যৌন সামর্থ্য, ঘনিষ্ঠতা এবং সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান চালিকাশক্তি বিদ্যমান।[৮][৯] যে সকল প্রাথমিক নিউরোট্রান্সমিটার, যৌন হরমোন, এবং নিউরো-পেপটাইড বা স্নায়বীয় পেপটাইড এই চালিকাশক্তিকে পরিচালনা করে তারা হল টেস্টোস্টেরন, ইস্ট্রোজেন, ডোপামিন, অক্সিটোসিন, এবং ভেসোপ্রেসিন।[৮][১০]
কেন্দ্রীয় ডোপামিন পরিবহন ব্যবস্থা (সেন্ট্রাল ডোপামিনিক পাথওয়ে) সঙ্গীর পছন্দনীয় আচরণের গভীরতায় নিয়ে যায়, যখন কিনা ভেন্ট্রাল প্যালিডামে ভেসোপ্রেসিন এবং নিউক্লিয়াস অ্যাকুম্বেন্সে ও পারভেন্ট্রিকুলার হাইপোথ্যালামিক নিউক্লিয়াসে অক্সিটোসিন শুধু সঙ্গীর পছন্দের আচরণইই নয়, অন্তরঙ্গতার আচরণও ধারণ করতে সাহায্য করে। [৮][১১] প্রাথমিকভাবে যৌন সামর্থ্যের মাত্রা নির্ধারিত হয় মেসোলিম্বিক ডোপামিন পাথওয়ের (ভেন্ট্রাল ট্যাগ্মেন্টাল এরিয়া এবং নিউক্লিয়াস অ্যাকুম্বেন্স) কার্যক্রমের মাধ্যমে।[৮] ট্রেস অ্যামাইন-সমূহ (বিঃদ্রঃ ফেনেথ্যালামাইন এবং টাইরামাইন) কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে অর্থাৎ এ সকল পাথওয়ে বা পরিবহন পথে ডোপামিনার্জিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে একটি সূক্ষ্ম ও জটিল ভূমিকা পালন করে।[১২]
টেস্টোস্টেরন এবং ইস্ট্রোজেন ডোপামিন পাথওয়েজের ভেতর দিয়ে এই সকল চালিকাশক্তিতে অবদান রাখে।[৮] পুরুষ এবং নারী উভয়ের যৌন আচরণের জন্য মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডোপামিনের উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন।[১৩] নরেপিনেফ্রিন এবং সেরোটোনিনের ভূমিকার গুরুত্ব এবং অবদান খুব কম কারণ তারা কিছু নির্দিষ্ট পাথওয়েতে ডোপামিন এবং অক্সিটোসিন নিঃসরণের উপর নিউরমডুলারি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।[৮]
আবেগপ্রবণ ভালোবাসা এবং দীর্ঘস্থায়ী ঘনিষ্ঠতার জন্য দায়ী এই সকল রাসায়নিক উপাদানকে সে সকল কাজের জন্য অধিক কার্যকর বলে মনে করা হয় যে সকল বিশেষ কাজে উভয় সঙ্গীই অংশগ্রহণ করেন।[৯] যে সকল ব্যক্তি প্রেমে পড়েন তাদের মধ্যে প্রেমে পড়ার শুরুর দিকে উচ্চ মাত্রার কর্টিসলের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়।[১৪]
অঙ্গতন্ত্রের ভূমিকা
এ জেনারেল থিওরি অব লাভ (A General Theory of Love) বা ভালোবাসার একটি সাধারণ তত্ত্ব নামক তত্ত্বে, UCSF থেকে মনস্তত্ত্বের তিনজন বিশেষজ্ঞ ভালোবাসা, ঘনিষ্ঠতা এবং সামাজিক বন্ধনে অঙ্গতন্ত্রের ভূমিকা সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও আবিষ্কারসমূহের একটি বিস্তৃত বিবরণী তুলে ধরেন। তারা এই সিদ্ধান্তে অগ্রসর হন যে, আমাদের স্নায়বিক প্রক্রিয়া আমেদের নিজেদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং আমদের আশেপাশের মানুষ এবং আমাদের ঘনিষ্ঠদের দ্বারা প্রবহিত হয় এবং তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা যায়। এই সহানুভূতিটি, বিশেষজ্ঞগণ যাকে অঙ্গের প্রতিধ্বনি বলে ডেকে থাকেন, এটি হল এমন একটি দক্ষতা যা আমরা মস্তিষ্কের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রক এলাকাসমূহের শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাথে ভাগাভাগি করি।[১৫] এই গবেষণাটিতে ইতঃপূর্বে সঙ্ঘটিত সামাজিক এবং সচেতনতা গঠনে শারীরিক যোগাযোগ এবং স্নেহের গুরুত্ব নিয়ে পূর্ববর্তী গবেষণার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যেমন এর মধ্যে একটি হল হ্যারি হারলো কর্তৃক পরিচালিত রেসাস বানরের উপর কৃত পরীক্ষা, যা প্রথম একাকীত্বের জৈবিক ফলাফলকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
ব্রেইন ইমেজিং বা মস্তিষ্কের চিত্রগ্রহণ
মস্তিষ্কের স্ক্যানিং প্রক্রিয়াসমূহ যেমন ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রিজনেন্স ইমেজিং, এগুলো মস্তিষ্কের সে সকল এলাকাকে অনুসন্ধান করার জন্য ব্যবহৃত হয় যেগুলো মানুষের মাঝে ভালোবাসার অভিজ্ঞতা তৈরির কাজে সম্পৃক্ত থাকে।[১৬]
২০০০ সালে, ইউনিভারসিটি কলেজ লন্ডনের সামির জাকি এবং আন্দ্রেস বারটেলসের কৃত একটি গবেষণায় বলা হয় যে, ভালোবাসার সময় মস্তিষ্কের কমপক্ষে দুটি এলাকা অধিক সক্রিয় থাকে। এরা হল মিডিয়া ইন্সুলার ফসি, যা মস্তিষ্ককে সহজ হতে সাহায্য করে, এবং অপরটি হল অ্যান্টেরিওর সিঙ্গুলেট কর্টেক্স, যেটি ইউফোরিয়া বা উচ্ছল আনন্দের অনুভূতি জোগাতে কাজ করে।[১৭]
অরটিগ এট. অল. লক্ষ্য করে দেখেন যে, অন্তরঙ্গ সঙ্গীর নাম অবচেতন অবস্থায় উচ্চারণ করলে তা মস্তিষ্কের ঠিক সেই সকল স্থানকেই সক্রিয় করে তোলে যে সকল এলাকা সচেতন অবস্থাতেও সঙ্গীর মুখমণ্ডল দেখার সময় সক্রিয়তা প্রদর্শন করে।[১৮] অবচেতন দশায় কোন প্রিয় ব্যক্তি বা প্রিয় পেশার নাম উচ্চারণ করা হলে তা মস্তিষ্কের আবেগীয় ও অনুপ্রেরণাদায়ক অঞ্চলকে সচল করে, উক্ত অঞ্চলগুলো হলঃ কডেট নিউক্লিয়াস, ইন্সুলা, বাইলিটারাল ফুসিফরম এলাকা, প্যারাহিপ্পক্যাম্পাল গাইরাস, রাইট অ্যাঙ্গুলার গাইরাস, অকিপিটাল কর্টেক্স, এবং সেরেবেলাম। মোটকথা, ভালবাসের কিছুর নাম উচ্চারণ শখের কাজের নাম উচ্চারণের চেয়ে অধিক হারে বাইলিটারাল অ্যাঙ্গুলার গ্যিরি এবং বাইলিটারাল ফুসিফরম এলাকাকে জাগিয়ে তোলে। এই এলাকাগুলো সম্মিলিত বহির্মুখী উপস্থাপনায় সহায়তা করে, এবং কোন কোন ব্যক্তির অ্যাঙ্গুলার গাইরাস তাকে বহির্মুখীভাবে উপস্থাপন করতে সহায়তা করে। এছাড়াও লেখক ভালোবাসার বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক অনুভূতিকে পরিমাপ করে অ্যাঙ্গুলার গাইরাসের যে কোন এলাকা সক্রিয়করণের সাথে অতি আবেগপ্রবণ মাত্রার ভালোবাসার আন্তঃসম্পর্ক খুঁজে পান।[১৮]
ভালোবাসা এবং প্রণোদনা
ভালোবাসার সঙ্গী সম্পর্কিত সচেতন চিন্তাভাবনা মস্তিষ্কের পুরস্কার ও প্রেরণা সম্পর্কিত এলাকাগুলো সচল করে। অরটিগ এট আল. অনুসন্ধান করে দেখেন যে কোন অবচেতন দশাতেও সঙ্গীর নাম শুনতে পেলে ব্যক্তির প্রণোদনায় কোন প্রভাব পরে কি না। তারা দেখতে পান যে কোন ব্যক্তিকে তার কোন নিরপেক্ষ বন্ধুর দ্বারা ডাকালে সে যতটা না সহজে সাড়া দেয়, কোন তার প্রিয় ব্যক্তি বা প্রিয় শখের কাজের নাম বর্ণে ভেঙ্গে বা এক শব্দে উচ্চারণ করে ডাকলে উক্ত ব্যক্তি আরও দ্রুত ও ভালভাবে সাড়াদান করে। লেখক অভিমত প্রকাশ করেন যে, এটি একারণে ঘটে যে একটি প্রিয় নাম ব্যক্তিকে তার একটি লক্ষ নির্দেশিত অবস্থায় নিয়ে যায় এবং তা ডোপামিনারজিক-চালিত সহজীকরণ প্রতিক্রিয়া ("dopaminergic-driven facilitation effects") সৃষ্টি করে।[১৮]
↑The Handbook of Evolutionary Psychology, edited by David M. Buss, John Wiley & Sons, Inc., 2005. Chapter 14, Commitment, Love, and Mate Retention by Lorne Campbell B. and Bruce J. Ellis.
↑"Evolutionary psychology: the emperor's new paradigm" by D. J. Buller in Trends Cogn. Sci. (2005) Volume 9 pages 277-283.
↑Sussman, Robert W. (২০০৪)। The Origins and Nature of Sociality। Transaction Publishers। পৃষ্ঠা 432। আইএসবিএন978-0-202-30731-2।
↑ কখগঘঙচFisher HE, Aron A, Brown LL (ডিসেম্বর ২০০৬)। "Romantic love: a mammalian brain system for mate choice"। Philos. Trans. R. Soc. Lond., B, Biol. Sci.। 361 (1476): 2173–86। ডিওআই:10.1098/rstb.2006.1938। পিএমআইডি17118931। পিএমসি1764845। The sex drive evolved to motivate individuals to seek a range of mating partners; attraction evolved to motivate individuals to prefer and pursue specific partners; and attachment evolved to motivate individuals to remain together long enough to complete species-specific parenting duties. These three behavioural repertoires appear to be based on brain systems that are largely distinct yet interrelated, and they interact in specific ways to orchestrate reproduction, using both hormones and monoamines. ... Animal studies indicate that elevated activity of dopaminergic pathways can stimulate a cascade of reactions, including the release of testosterone and oestrogen (Wenkstern et al. 1993; Kawashima &Takagi 1994; Ferrari & Giuliana 1995; Hull et al. 1995, 1997, 2002; Szezypka et al. 1998; Wersinger & Rissman 2000). Likewise, increasing levels of testosterone and oestrogen promote dopamine release ...This positive relationship between elevated activity of central dopamine, elevated sex steroids and elevated sexual arousal and sexual performance (Herbert 1996; Fiorino et al. 1997; Liu et al. 1998; Pfaff 2005) also occurs in humans (Walker et al. 1993; Clayton et al. 2000; Heaton 2000). ... This parental attachment system has been associated with the activity of the neuropeptides, oxytocin (OT) in the nucleus accumbens and arginine vasopressin (AVP) in the ventral pallidum ... The activities of central oxytocin and vasopressin have been associated with both partner preference and attachment behaviours, while dopaminergic pathways have been associated more specifically with partner preference.উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: একাধিক নাম: লেখকগণের তালিকা (link)