ব্রুস মিচেল (ইংরেজি: Bruce Mitchell; জন্ম: ৮ জানুয়ারি, ১৯০৯ - মৃত্যু: ১ জুলাই, ১৯৯৫) ট্রান্সভালের জোহেন্সবার্গে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ছিলেন। ১৯২৯ থেকে ১৯৪৯ সময়কালে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের পক্ষে ৪২ টেস্টে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি।[১] দলে তিনি মূলতঃ ডানহাতি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতেন। এ সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রত্যেক টেস্টের সাথেই নিজেকে নিয়মিতভাবে জড়িয়ে রাখেন।
খেলোয়াড়ী জীবন শেষে তিনি ৩,৪৭১ টেস্ট রান নিয়ে অবসর গ্রহণ করেন যা ঐ সময়ে জাতীয় রেকর্ডরূপে বিবেচিত ছিল। সর্বমোট আটটি সেঞ্চুরি করেন যা কেবলমাত্র ডাডলি নোর্স ৯টি সেঞ্চুরি করে এগিয়েছিলেন।
প্রারম্ভিক জীবন
জনৈক চিকিৎসকের সন্তান মিচেলের শৈশবকাল কাটে জোহেন্সবার্গে। ছয় বছর বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক আর্নেস্ট হলিওয়েলের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পান। জোহেন্সবার্গের সেন্ট জোন্স কলেজ অধ্যয়নকালীন বিদ্যালয়ের ক্রিকেট কোচ এ. জি. ম্যাকডোনাল্ডের কাছ থেকে আরও প্রশিক্ষণ লাভ করেন। কিশোর অবস্থাতেই তিনি তার বৃহৎ আকৃতির হাতকে লেগ স্পিন বোলিংয়ের কাজে লাগান।[২]
প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অংশগ্রহণ
১৭ বছর বয়সে ট্রান্সভালের সদস্যরূপে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। বর্ডারের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত ঐ খেলায় লেগ ব্রেক ও গুগলি বোলিংয়ে ১১ উইকেট লাভ করেন। পরবর্তী মৌসুমে তার ব্যাটিংয়ের উত্তরণ লক্ষ্য করা যায়। ১৯২৭-২৮ মৌসুমে এমসিসি দল দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায়। ৩ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে তিনি ৪০ রানের ইনিংস খেলেন। ১৯২৮-২৯ মৌসুমে প্রস্তুতিমূলক খেলায় নাটালের বিপক্ষে তিনি তার অল-রাউন্ড নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। পরবর্তী একটি খেলায় গ্রীকুয়াল্যান্ডের বিপক্ষে লড়াকু সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন ও দলকে বিপর্যকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেন। শীর্ষ ছয় ব্যাটসম্যানের কেউই ১১-এর বেশি রান উঠাতে পারেননি।
ইংল্যান্ডে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে তিনি তার প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান। শেফিল্ডে অনুষ্ঠিত ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে তিনি এই সেঞ্চরি করেন। সফরের বাদ-বাকী সময়ে অধিকাংশ খেলাতেই তিনি ব্যাটিং উদ্বোধন করতেন। এ অবস্থানে থেকেই খেলোয়াড়ী জীবনের বাদ-বাকী সময় অতিবাহিত করেন।
টেস্ট ক্রিকেট
১৫ জুন, ১৯২৯ তারিখে এজবাস্টনে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক ঘটে ব্রুস মিচেলের। উভয় ইনিংসেই ব্যাটিং উদ্বোধনে নেমে রবার্ট ক্যাটারলের সাথে শতরানের জুটি গড়েছিলেন। খেলায় তিনি ৮৮ ও অপরাজিত ৬১ রান সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। তবে সিরিজের বাদ-বাকী টেস্টে তেমন সুবিধা আদায় করতে পারেননি। ঐ টেস্ট সিরিজটিতে ৩১.৩৭ গড়ে রান তুলেছিলেন।
১৯৩০-৩১ মৌসুমে ইংল্যান্ড দল দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আসে। নিম্নমূখী রান সংগ্রহের ১ম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৭২ রান তুলে দলের জয়ে প্রভূতঃ ভূমিকা রাখেন। নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত ২য় টেস্টে ব্যাটিং উদ্বোধনে নামেন। জ্যাক সিডলের সাথে ২৬০ রান তুলের জাতীয় রেকর্ড গড়েন। এতে তার অবদান ছিল ১২৩ রান। বাদ-বাকী তিন টেস্টে তিনি আরও তিনটি অর্ধ-শতক করেছিলেন। ঐ সিরিজে ৫০.৫৫ গড়ে ৪৫৫ রান তুলেন তিনি।
১৯৩১-৩২ মৌসুমের গ্রীষ্মকালে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সফরে যান। সফরের অধিকাংশ সময়ই তিনি অসুস্থ ছিলেন। ৩৪.৯৩ গড়ে ১,০৪৮ রান তুলেন। তন্মধ্যে, অ্যাডিলেডে ৭৫ ও ৯৫ রান এবং ব্রিসবেনে ৫৮ রান করেন।
ঐ তুলনায় নিউজিল্যান্ডে বেশ ভালো অবস্থানে ছিলেন। অকল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার পর ক্রাইস্টচার্চে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্টে তিনি ১১৩ রানের মনোজ্ঞ ইনিংস উপহার দেন।
১৯৩৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা দল যুক্তরাজ্য সফরে যায়। সফরের শুরুতে ৮টি খেলায় অংশ না নেয়ার পরও ৪৫.৩৪ গড়ে ১,৪৫১ রান সংগ্রহ করে দলের পক্ষে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করেন। পাশাপাশি ১৯.০২ গড়ে ৩৫ উইকেট নেয়ারও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। এরফলে বোলিং গড়ে দলের শীর্ষ উইকেট শিকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
টেস্ট খেলাগুলোয় ৬৯.৭১ গড়ে সর্বমোট ৪৮৮ রান তুলেন। লর্ডস ও ওভালে সেঞ্চুরির সন্ধান পেয়েছিলেন ব্রুস মিচেল। তন্মধ্যে লর্ডসের দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ১৬৪ রানের কল্যাণে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের মাটিতে তাদের প্রথম জয় পায়। এ সফরে তিনি আরও একটি ব্যক্তিগত সফলতা পান। ওভালে সারে দলের বিপক্ষে নিজস্ব সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস ১৯৫ রান তুলেন। এ সময় এরিক রোয়ানের সাথে উদ্বোধনী জুটিতে ৩৩০ রান তুলেন। এ জুটির সংগ্রহটি অদ্যাবধি ইংল্যান্ডের মাটিতে সর্বোচ্চ রানের জুটি হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকান রেকর্ডরূপে চিহ্নিত হয়ে আছে।
১৯৩৫-৩৬ মৌসুমে অস্ট্রেলীয়রা দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আসে। এবার তিনি ৭ খেলায় অংশ নিয়ে মাত্র একবার পঞ্চাশোর্ধ্ব রান সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। ঐ তুলনায় বোলিংয়ে বেশ সাফল্য লাভ করেন। দ্বিতীয় টেস্টে ৪/৫ লাভ করেন। তন্মধ্যে, একই ওভারে পেয়েছিলেন তিন উইকেট। কিংসমিডে অনুষ্ঠিত ৫ম টেস্টে ৫/৮৭ পান। এটিই তার খেলোয়াড়ী জীবনের একমাত্র ৫-উইকেট লাভের কীর্তিগাঁথা ছিল। যুদ্ধের কারণে তার খেলোয়াড়ী জীবনের সমাপণ ঘটে। এর পূর্বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে অংশ নেন। ৫৮.২৫ গড়ে ৪৬৬ রান তুলেন। তন্মধ্যে, কিংসমিডে সেঞ্চুরি করলেও দল পরাজয়ের সম্মুখীন হয়।
১৯৪৫-৪৬ মৌসুমে খেলার জগতে ফিরে আসেন। ঐ মৌসুমের ঘরোয়া আসরে ৪৭.৩৩ গড়ে ৪২৬ রান তুলেন। গ্রীকুয়াল্যান্ড ওয়েস্টের বিপক্ষে অ্যালান মেলভিলের সাথে সপ্তম উইকেট জুটিতে ২৯৯ রান তুলে নতুন দক্ষিণ আফ্রিকান রেকর্ড গড়েন।
১৯৪৭ সালে আবারও যুক্তরাজ্য সফরে যান। সর্বশেষ সফরের তুলনায় এ সফরটি অধিক ফলপ্রসূ ছিল। প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৬১.০৩ ব্যাটিং গড়ে ২,০১৪ রান তুলে শীর্ষস্থানে ছিলেন। এ রান সংগ্রহকালীন আটটি সেঞ্চুরিও হাঁকান তিনি। টেস্টে ৬৬.৩৩ গড়ে ৫৯৭ রান তুলে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার ঐ সফরে অবশ্য সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। ওভালে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত টেস্টে দ্বিতীয় দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার হিসেবে উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করার বিরল কীর্তিগাঁথা রচনা করেন। ১২০ ও অপরাজিত ১৮৯ রানের ইনিংস খেলার জন্য তাকে ১৩ ঘণ্টারও বেশি সময় ক্রিজে অবস্থান করতে হয়েছিল। তন্মধ্যে, ১৮৯ রানের অপরাজিত ইনিংসটি তার খেলোয়াড়ী জীবনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছিল।
ফিরতি সফরে ইংল্যান্ড দল দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায়। নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত তৃতীয় টেস্টে ১২০ রানের মনোরম ইনিংস খেলেন। এরফলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হার্বি টেলরের গড়া ৭ সেঞ্চুরির সাথে তিনিও যুক্ত হন। পোর্ট এলিজাবেথে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত টেস্টে তিনি ৯৯ ও ৫৬ রান তুলেছিলেন। এভাবেই তার বর্ণাঢ্যময় টেস্ট খেলোয়াড়ী জীবনের সমাপণ ঘটে; যদিও ৫০-এর দশকে জোড়া শূন্য রানের মাধ্যমে তার খেলোয়াড়ী জীবনের সূত্রপাত ঘটেছিল।