বিলাল ইবনে রাবাহ ছিলেন নবী মুহাম্মদ এর একজন ঘনিষ্ঠ ও প্রসিদ্ধ কৃষ্ণাঙ্গ সাহাবী। তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং আবিসিনিয় বা হাবাশী (বর্তমান ইথিওপিয়া) বংশোদ্ভুত ছিলেন।[১][৩][৪] তিনি ছিলেন মক্কার কুরাইশ নেতা উমাইয়া ইবনে খালফ-এর ক্রীতদাস। ইসলাম গ্রহণের কারণে তিনি তার মনিব দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত হন। পরবর্তীতে আবু বকর তাকে ক্রয় করেন দ্বাসত্ব ও অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন| হিজরতের পর মদীনায় থাকাকালীন অবস্থায় তিনিই সর্বপ্রথম আযান দেয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।[৫] নবী মুহাম্মদ এর সঙ্গী হিসেবে প্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী হওয়ার অগ্রিম সুসংবাদও তিনি নিজ জীবদ্দশাতেই নবী মুহাম্মদ এর কাছ থেকে পেয়েছিলেন।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
বিলাল ইবনে রাবাহ ৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে হেজাজের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন।[৬] তার পিতা রাবাহ ছিলেন একজন আরব দাস এবং তার মাতা হাম্মাহ ছিলেন একজন প্রাক্তন আবিসিনিয় রাজকুমারী, যাকে আমুল-ফিল এর ঘটনার সময় আটক করে দাসী করে রাখা হয়। দাস হিসেবে জন্মানোয়, বিলাল (রা:) কেও তার মনিব উমাইয়া ইবন খালাফ এর জন্য কাজ করতে হয়। কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন বলে বিলাল (রা:) একজন ভাল দাস হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং তার কাছেই আরবের পুতুলগুলোর ঘরের চাবি থাকতো। কিন্তু বর্ণবাদ এবং আরবের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে সেসময় তিনি সমাজের উচুস্তরে যেতে পারেননি।[৬]
ইসলাম গ্রহণ
মুহাম্মাদ যখন তার নবুয়াতের কথা ঘোষণা করে আল্লাহর বা ইসলাম ধর্মমতে এক ঈশ্বরের বাণী প্রচার করা শুরু করলেন, বিলাল তখন থেকে অবতীর্ণ সকল আয়াত মনোযোগ সহকারে শুনতেন। মুহাম্মাদের ধর্মপ্রচার বিলালকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করে এবং সে সময়ই তিনি ইসলাম গ্রহণ করে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম কয়েকজনের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন। বিলাল মূর্তিপূজাকে ত্যাগ করেন এবং ফলশ্রুতিতে নির্মম নির্যাতনের স্বীকার হন। [৭]
নির্যাতন ভোগ
বিলালের মনিব উমাইয়া ইবনে খালাফ তার ইসলাম গ্রহণের কথা জানতে পেরে তাকে ইসলাম ত্যাগ করার জন্য জোর করতে থাকেন এবং তাতে ব্যর্থ হয়ে তার উপর অমানবিক নির্যাতন করা শুরু করেন। উমাইয়ার নির্দেশে বিলালকে মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে শুইয়ে রাখা হতো এবং তার বুকের উপর একটি বড় আকারের ভারি পাথর রেখে দেয়া হতো, যে কারণে সে সময় তার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যেতো। এরপরেও সে ইসলাম ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানালে উক্ত পাথরের উপর একজন মানুষকে উঠিয়ে তাকে লাফাতে বলা হতো। এত কিছুর পরেও বিলাল অবিরাম "আহাদ, আহাদ" (এক ঈশ্বর, এক ঈশ্বর) বলে চিৎকার করতে থাকতো।[৭] পরে আবু বকর তাকে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন।[৮][৯]
হিজরত
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হিজরতের বছরে, বিলাল অন্যান্য মুসলিমদের সাথে ইয়াস্রিব বা মদিনায় হিজরত করেন। পরবর্তী এক দশক জুড়ে, তিনি মুহাম্মাদের সকল সামরিক অভিযানে তার সঙ্গ দিয়েছেন। বিলাল মুহাম্মাদ এর বর্শা বহনকারী হওয়ার সম্মাননা অর্জন করেন, যা তিনি ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নামাজের দিকনির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করতেন।
রাষ্ট্রীয় কোষাগার
মদিনা একটি উত্তমরূপে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র হিসাবে স্থায়িত্ব পাবার পর, মুহাম্মাদ বিলালকে মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেন।[১০] বায়তুল মালের তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ইসলামের প্রথম কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তি তৎকালীন ইসলামি রাষ্ট্রে বিলালকে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থান এনে দিয়েছিল।[১০] বায়তুল মালের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে বিলাল সকল লেনদেনের দেখাশোনা করতেন।[১০] পাশাপাশি, তিনি বিধবা, এতিম, মুসাফির, এবং অসহায় দরিদ্রদের বায়তুল মাল হতে অর্থ প্রদান করতেন।[১০][১১]
আযান
সুন্নিগণ এবং শিয়াগণ উভয়েই একমত যে, ১ম হিজরী সনে (সম্ভাব্য ৬২২-৬২৩ খ্রিষ্টাব্দ) মুহাম্মাদ আযান দেয়ার রীতি প্রতিষ্ঠিত করেন।[১২] তিনি বিলালকেই তার সুগভীর, সুমধুর ও সুরেলা কণ্ঠের জন্য প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে বেঁছে নেন। সুন্নি এবং শিয়াগণ উভয়ই বিলালকে প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে স্বীকার করেন।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগের সামরিক অভিযানসমূহ
বদরের যুদ্ধ, উহুদের যুদ্ধ এবং খন্দকের যুদ্ধসহ মুহাম্মাদের সকল সামরিক অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে, মুসলিমগণ কোন রক্তপাত ছাড়াই মক্কা পুনুরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। মুসলিম সেনাবাহিনী মক্কা দখল করার পরপরই, বিলাল কাবাঘরের উপরে উঠে পড়েন এবং আযান দেন। মক্কা শহরে এটাই ছিল মুসলিমদের প্রথম আযান।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর পর
মুহাম্মাদ এর মৃত্যুর পর আবু বকরের খিলাফতের সময়কাল থেকে বিলাল সিরিয়ায় সায়িদ ইবনে আমির আল-জুমাহি'র নেতৃত্বাধীন মুসলিম সেনাবাহিনীতে অংশ নেন।[১৩]
মুহাম্মাদের মৃত্যুর পর বিলাল আর কখনোই আযান দেন নি। খলিফা ওমর জেরুজালেম পরিদর্শন করার সময়, সাহাবাগণ ওমরকে অনুরোধ করেন তিনি যেন শেষবারের মত হলেও অন্তত একটিবার আযান দেন। যখন বিলাল আযান দিচ্ছিলেন, তখন সকল সাহাবা মুহাম্মাদের কথা মনে করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
মৃত্যু
৬৩০-৪০ এর দশকে বিলাল সিরিয়ার দামেস্কে মৃত্যুবরণ করেন। জর্ডানের আম্মানেও তার কবর হিসেবে দাবীকৃত একটি সমাধি রয়েছে, যা অনেকের মতে একটি নকল সমাধি। বিলালের মৃত্যুর সময় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করেন যে ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আবার অনেকের মতে ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু ঘটে। বলা হয়ে থাকে যে, মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৬৩ বছর।
বিলালের মৃত্যুর পূর্বলক্ষণ দেখতে পেয়ে তার স্ত্রী দুখে ভারাক্রান্ত হয়ে পরেছিলেন।[১৪] সে সময় তার স্ত্রী কেঁদে উঠে বললেন,
↑Riz̤vī, Sayyid Sa'eed Ak̲h̲tar. Slavery: From Islamic & Christian Perspectives. Richmond, British Columbia: Vancouver Islamic Educational Foundation, 1988. Print. আইএসবিএন০-৯২০৬৭৫-০৭-৭ Pg. 35-36
↑ কখJanneh, Sabarr. Learning from the Life of Prophet Muhammad: Peace and Blessing of God Be upon Him. Milton Keynes: AuthorHouse, 2010. Print. আইএসবিএন১৪৬৭৮৯৯৬৬৬ Pgs. 235-238
↑ কখSodiq, Yushau. Insider's Guide to Islam. Bloomington, Indiana: Trafford, 2011. Print. আইএসবিএন১৪৬৬৯২৪১৬০ Pg. 23
↑ কখগঘCharbonneau, Joshua (Mateen). The Suffering of the Ahl-ul-bayt and Their Followers (Shi'a) throughout History. Washington, D.C.: J. M. Charbonneau, 2012. Print.
↑Razwy, Ali A. A Restatement of the History of Islam & Muslims 570 to 661 CE. Stanmore, Middlesex, U.K.: World Federation of K S I Muslim Communities Islamic Centre, 1997. Print. Pg. 553
↑Ludwig W. Adamec (2009), Historical Dictionary of Islam, p.68. Scarecrow Press. আইএসবিএন০৮১০৮৬১৬১৫. Quote: "Bilal, ..., was the first muezzin."
↑Dr. Ali Muhammad As-Sallaabee The Biography of Abu Bakr As-Sideeq. Riyadh: Maktaba Dar-us-Salaam, 2007. Print. আইএসবিএন৯৯৬০-৯৮৪৯-১-৫
↑ কখগQušairī, Abd-al-Karīm Ibn-H̲awāzin Al-, and Abu'l-Qasim al-Qushayri. al-Qushayri's Epistle on Sufism: al-Risala al-Qushayriyya Fi 'ilm al-Tasawwuf. Trans. Alexander D. Knysh. Lebanon: Garnet & Ithaca Press, 2007. Print. আইএসবিএন১৮৫৯৬৪১৮৬৫ Pg.313
বই
H.M. Ashtiyani. Bilâl d’Afrique, le muezzin du Prophète, Montréal, Abbas Ahmad al-Bostani, la Cité du Savoir, 1999 আইএসবিএন২-৯৮০৪১৯৬-৪-৮টেমপ্লেট:Ref-fr
İbn Sa'd. et-Tabakâtü'l-Kübrâ, Beyrut 1960, III, s. 232
Avnu'l-Ma'bud. Şerh Ebû Dâvud, III,185, İbn Mâce, Ezan, 1, 3