বিবর্তন বা অভিব্যক্তি হলো এমন একটি জীববৈজ্ঞানিক ধারণা যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জীবের গাঠনিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ক্রমপরিবর্তনকে বুঝায়।[১][২] কোনো জীবের বংশধরদের মাঝে যে জিনরাশি ছড়িয়ে পড়ে তারাই বংশপ্রবাহে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে। জিনের পরিব্যক্তির মাধ্যমে জীবের নির্দিষ্ট কোনো বংশধরে নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হতে পারে বা পুরনো বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটতে পারে। যদিও একটি প্রজন্মে জীবের বৈশিষ্ট্যের যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তা খুবই সামান্য। কিন্তু কালক্রমে জীবগোষ্ঠীতে সেই পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য হয়ে দেখা দেয় এবং এমনকি একসময় তা নতুন প্রজাতির উদ্ভবেরও কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।[৩] বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যকার দৃশ্যমান বিভিন্ন অঙ্গসাংস্থানিক ও জিনগত সাদৃশ্যগুলো একটা ধারণা দেয় যে আমাদের পরিচিত সকল প্রজাতির প্রাণীই এক ধারাক্রমিক পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি "সাধারণ পূর্বপুরুষ" থেকে ধীরে ধীরে উৎপত্তি লাভ করেছে।[৪]
বিবর্তনের ভিত্তি হচ্ছে বংশপরম্পরায় জিনের সঞ্চারণ। যা একটি জীবের বংশগতভাবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য দায়ী, তা-ই জিন। এই জিনগুলোর বিভিন্নতার কারণে একটি জীবগোষ্ঠীর বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে বংশগত বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য বা প্রকরণ সৃষ্টি হয়। বিবর্তন মূলত দুটি বিপরীত নিয়ামকের ফল : একটি প্রক্রিয়ায় ক্রমাগতভাবে নতুন প্রকরণ সৃষ্টি হয়, আর অন্যটির প্রভাবে এই প্রকরণগুলোর কোনো কোনোটির সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং কোনো কোনোটির সংখ্যা হ্রাস পায়। নতুন প্রকরণ উৎপন্ন হয় দুটি প্রধান উপায়ে : ১. জিনগত মিউটেশন বা পরিব্যক্তির মাধ্যমে এবং ২. বিভিন্ন জীবগোষ্ঠী বা প্রজাতির মধ্যে জিনের স্থানান্তরের মাধ্যমে। "জিনেটিক রিকম্বিনেশনের" মাধ্যমেও নতুন বৈশিষ্ট্যসূচক জিন তৈরি হয় যা জীবগোষ্ঠীর মধ্যকার প্রকরণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
দুটি প্রধান মেকানিজম বা করণকৌশল নির্ধারণ করে কোন একটি ভ্যারিয়্যান্টের সংখ্যা বাড়বে কী কমবে। একটি হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন, যে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে একদিকে একটি জীবগোষ্ঠীর অস্তিত্বের অনুকূল বৈশিষ্ট্যের (যে বৈশিষ্ট্যগুলো কোনো একটি জীবের অধিককাল ধরে বেঁচে থাকা এবং সন্তান উৎপাদনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে) অধিকারী সদস্য বা মভ্যারিয়্যান্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও কালক্রমে তা ঐ জীবগোষ্ঠীর কমন বা সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয় এবং অন্যদিকে ক্ষতিকর বা কম সুবিধাদায়ক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভ্যারিয়্যান্টদের সংখ্যা হ্রাস করে, ফলে সেই ভ্যারিয়্যান্টগুলো ধীরে ধীরে বিরল হয়ে যায়। এর কারণ হচ্ছে, পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাপেক্ষে সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সদস্যগুলো অধিককাল বেঁচে থাকে এবং অধিক সংখ্যক সন্তান জন্ম দিতে পারে। ফলে বংশপরম্পরায় সেই বৈশিষ্ট্যগুলো বংশগতভাবে পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে বেশি পরিমাণে সঞ্চারিত হয়।[৪][৫] প্রজন্মান্তরে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ছোট ছোট র্যান্ডম বা দৈব পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যগুলো ক্রমান্বয়ে জীবগোষ্ঠীতে প্রকট হয়ে দেখা দেয় এবং এভাবে সেই জীবগোষ্ঠী তার পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হয়।[৬] বিবর্তনের আরেকটি প্রধান করণকৌশল হচ্ছে "জেনেটিক ড্রিফট", যে স্বাধীন পদ্ধতিতে গোষ্ঠীস্থিত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতির হার বা ফ্রিকোয়েন্সি অব ট্রেইটস দৈবাৎ পরিবর্তিত হয়।
বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে বিবর্তন সংঘটিত হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিবর্তনকে ব্যাখ্যাকারী তত্ত্বগুলোকে তারা যাচাই করে দেখেছেন, এগুলোর উন্নয়ন সাধন করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের গবেষণা শুরু হয়েছিল যখন ফসিল রেকর্ড আর প্রাণীবৈচিত্র্যের ভিত্তিতে অধিকাংশ বিজ্ঞানীই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সময়ের সাথে সাথে জীব প্রজাতি ক্রমশ পরিবর্তিত হয়েছে।[৭][৮] তবে বিবর্তন সংঘটিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি অস্পষ্ট বা বলতে গেলে অজানাই রয়ে যায় যতদিন না চার্লস ডারউইন ও আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস পৃথক পৃথকভাবে তাদের প্রাকৃতিক নির্বাচনতত্ত্ব উপস্থাপন করলেন। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস-এর মাধ্যমে ডারউইন যখন প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব প্রচার করলেন, তখনই তা বৈজ্ঞানিক মহলে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং সর্বসাধারণ কর্তৃক সমাদৃত হয়।[৯][১০][১১][১২][১৩] তারও অনেক পরে, ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ডারউইনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের সাথে মেন্ডেলীয় বংশগতিবিদ্যার মেলবন্ধনে প্রতিষ্ঠিত হয় বিবর্তনের আধুনিক সংশ্লেষণী তত্ত্ব বা মডার্ন এভুলিউশনারি সিনথেসিস, যা প্রাকৃতিক নির্বাচন ও মেন্ডেলীয় জেনেটিক্সের সাহায্যে সমন্বিতভাবে বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করে।[১৪]
বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানীরা ক্ষেত্র বা পরীক্ষাগার থেকে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে এবং গাণিতিক জীববিজ্ঞানের পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত উপাত্তগুলির উপর ভিত্তি করে তত্ত্ব এবং অনুকল্প গঠন এবং পরীক্ষা করে বিবর্তনের বিভিন্ন দিক অধ্যয়ন অব্যাহত রেখেছেন। তাদের আবিষ্কারগুলো কেবল জীববিজ্ঞানের বিকাশকেই প্রভাবিত করেনি বরং কৃষি, চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান সহ আরও অনেক বৈজ্ঞানিক ও শিল্প ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছে।[২৬]
এ সকল বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায়, এরিস্টটলবাদ সকল প্রাকৃতিক বস্তুকে নির্ধারিত প্রাকৃতিক সম্ভাবনার বাস্তবায়নরূপে বিবেচনা করেছিল, যা ফর্ম থিওরি বা গঠন তত্ত্ব নামে পরিচিত ছিল।[৩০][৩১] এটি ছিল প্রকৃতির মধ্যযুগীয় উদ্দেশ্যবাদী অনুধাবনের একটি অংশ, যাতে সকল বস্তু একটি স্বর্গীয়মহাজাগতিক আদেশে ভুকিকা পালনের জন্য উদ্দিষ্ট। উক্ত মতবাদের বৈচিত্র্যই মধ্যযুগে জ্ঞানের মানদণ্ডে পরিণত হয় এবং খ্রিস্টধর্মের শিক্ষার মাঝে একীভূত হয়, কিন্তু এরিস্টটল "প্রকৃত ধরনের জীব সর্বদা সুনির্দিষ্ট আত্মিক গঠনে অনন্য-এককভাবে আবির্ভূত হয়" এমনটা দাবি করেন নি এবং কীভাবে নতুন ধরনের জীবের উদ্ভব ঘটতে পারে, তিনি তার বিশেষায়িত উদাহরণ প্রদান করেন।[৩২]
প্রাক ডারউইনীয়
১৭শ শতাব্দীতে, আধুনিক বিজ্ঞানের নতুন পদ্ধতি অ্যারিস্টটলীয় প্রস্তাবনাকে প্রত্যাখ্যান করে। আধুনিক বিজ্ঞান সকল প্রাকৃতিক ঘটনাকে বস্তুবাদী তত্ত্বের পরিভাষায় ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিল যা সকল দৃশ্যমান বস্তুর জন্য এক হবে এবং তার জন্য কোন নির্ধারিত প্রাপৃতিক শ্রেনী কিংবা স্বর্গীয় মহাজাগতিক নির্দেশের প্রয়োজন পড়বে না। যাইহোক, এই নতুন পদক্ষেপ জীববিজ্ঞানের মত নির্ধারিত প্রাকৃতিক প্রকরণ মতবাদের সর্বশেষ ভিত্তিতে গেড়ে বসার পক্ষে অত্যন্ত ধীরগতির ছিল। জন রে পূর্বে ব্যবহৃত অধিক প্রচলিত পরিভাষা "প্রজাতি" কে উদ্ভিদ ও প্রানীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলেন, কিন্তু তিনি প্রতিটি জীবকে একটি আলাদা প্রজাতি হিসেবে কঠোররূপে শনাক্ত করলেন এবং প্রস্তাব করলেন যে, প্রতিটি প্রজাতিকেই সেসব বৈশিষ্ট্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যাবে যেগুলো তাদেরকে প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে বাঁচিয়ে রেখেছে।[৩৪] ১৭৩৫ সালে কার্ল লিনিয়াস কর্তৃক প্রবর্তিত জৈবিক শ্রেণিবিন্যাস সুস্পষ্টরূপে প্রজাতিমধ্যস্ত সম্পর্কের পর্যায়ক্রমিক প্রকৃতিকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু তখনও প্রজাতিকে স্বর্গীয় বিধান অনুযায়ী অপরিবর্তনীয় রুপে গণ্য করা অব্যহত ছিল।[৩৫]
এ সময়ের অন্যান্য প্রকৃতিবিদগণ প্রাকৃতিক আইন অনুসারে সময়ের সাথে সাথে প্রজাতির বিবর্তনীয় পরিবর্তন সম্পর্কে অনুমান করেছিলেন। ১৭৫১ সালে, পিয়েরে লুই মাউপারটুইস প্রজননের সময় ঘটা প্রাকৃতিক পরিবর্তনগুলির মাধ্যমে বহু প্রজন্ম পরে নতুন প্রজাতি উদ্ভবের কথা লিখেছিলেন।[৩৬]জর্জেস-লুই লেক্লার্ক, কম্তে ডি বাফন প্রস্তাব করেছিলেন যে কোনো প্রজাতির ভিন্ন জীবে অধঃপত হতে পারে এবং ইরাসমাস ডারউইন প্রস্তাব করেছিলেন যে সমস্ত উষ্ণ রক্তযুক্ত প্রাণী একটিমাত্র অণুজীব (বা "ফিলামেন্ট") থেকে অবতরণ করতে পারে।[৩৭]
বাবা-মা থেকে যে সন্তানটি জন্ম নেয়, তার বৈশিষ্ট্যগুলো তার বাবা-মা'র খুব কাছাকাছি হয়। কারণ, প্রজননের সময় বাবা-মা দুজনই তাদের DNA-এর প্রতিরূপ সৃষ্টি করে, যেটি তাদের সন্তানের মধ্যে গিয়ে পুনর্গঠিত হয়। ফলে সন্তানের DNA-এর গঠন তার পিতামাতা থেকে কিছুটা হলেও পৃথক থাকে। ফলে সেই সন্তানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও হয় পিতামাতা থেকে কিছুটা ভিন্ন। সন্তান কখনও তার পিতামাতার অবিকল প্রতিরূপ (ক্লোন, ইং: clone) হয় না; বাবা-মা আর সন্তান-সন্ততি প্রত্যেকেই ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়ে থাকে। যদি পিতামাতা আর তাদের সন্তানদের DNA হুবহু একই রকম হত, তাহলে জনগোষ্ঠী কখনও পরিবর্তিত হত না, অর্থাৎ বিবর্তন হত না।
DNA-র হুবহু প্রতিরূপ তৈরি করতে না পারার কারণ হল, DNA একটি অত্যন্ত জটিল অনু, আর প্রতিরূপের সময় সামান্য ত্রুটি (error) তথা মিউটেশন (mutation) বা পরিব্যক্তি হলেও তা সন্তানের দেহে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটায়। জেনেটিক বৈচিত্র্যের প্রধান উৎস আসলে যৌন প্রজনন। এই প্রক্রিয়ায়, পিতামাতা হতে আগত অনেকগুলো DNA অণু এলোপাথাড়িভাবে বিন্যস্ত হয়ে সন্তানের দেহে সম্পূর্ণ নতুন বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটায়। মায়োসিস (meiosis) বা হ্রাসমূলক বিভাজনের মাধ্যমে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু তৈরির সময় যথাক্রমে বাবা এবং মা উভয়ের DNA ভাগ হয়ে যায়। এরপর শুক্রানু দ্বারা ডিম্বানুর নিষিক্তকরণের সময় এ পৃথক DNA তন্তু (strand) মিলিত হয়ে সন্তানের জন্য সম্পূর্ণ নতুন DNA গঠন করে। একারণেই যৌনপ্রজননক্ষম প্রজাতির মধ্যে অযৌন জননক্ষম প্রজাতির চেয়ে বেশি বৈচিত্র্য দেখা যায়। একই কারণে যৌনপ্রজননশীল প্রজাতি, অযৌন প্রজাতির চেয়ে দ্রুত বিবর্তিত হয়।
একটা পপুলেশনের অন্তর্গত জীবগুলো বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে পরস্পর ভিন্ন হতে পারে দুটি প্রধান উপায়েঃ ১. বংশগতভাবে (genetically) এবং ২. পরিবেশের প্রভাবে, বিজ্ঞানের ভাষায় যাদেরকে বলা হয় যথাক্রমে প্রকৃতি ও প্রতিপালন ("Nature" and "Nurture")। কোন একটা জীবের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিবর্তিত হলে সেটি বেড়ে উঠবে ভিন্নভাবে। এটি বিবর্তন নয়। যেমনঃ- একটা কুকুরকে বেশি করে খেতে দিলে তার দৈহিক বৃদ্ধি ঘটবে, কিন্তু এ শারীরিক পরিবর্তন তার পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হবে না। অর্থাৎ কুকুরটি যদি বেশি খাওয়ার ফলে মোটা হয়ে যায়, তাহলে তার বাচ্চাও যে মোটা হবে, এমন কোন কারণ নেই। অন্যদিকে, "Nature" অংশটি একটা জীব বংশগতভাবে প্রাপ্ত হয়, আর এটিই বিবর্তিত হয় সময়ের সাথে প্রজন্মান্তরে। এধরনের জেনেটিক বিচিত্রতা বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে সরাসরি ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলোতে সঞ্চারিত হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য দায়ী থাকে জিন (gene) যা প্রাণিকোষের DNA-এর অভ্যন্তরে অবস্থিত। DNA তার প্রতিরূপ (replication) সৃষ্টির মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে এই জিনগুলোকে সঞ্চারিত করে। একটা পপুলেশনের অন্তর্গত বিভিন্ন সদস্যের DNA-এর গঠনে কিঞ্চিত পার্থক্য থাকে। এই পার্থক্য থাকা মানেই হচ্ছে জিনগত পরিবর্তন। আর এর ফলে সেই পপুলেশনের অন্তর্গত সমস্ত জীবই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরস্পর থেকে কমবেশি ভিন্ন হয়ে থাকে।
পরিব্যক্তি বা মিউটেশন (Mutation) হল কোষ জিনোমের ডিএনএ গঠনে পরিবর্তন। পরিব্যক্তি সংঘটিত হলে তা জিনের উপাদানে পরিবর্তন ঘটায়, অথবা জিনের কার্যক্রমে বাধাদান করে, অথবা কোন প্রতিক্রিয়াই ঘটে না। ড্রসোফিলা মাছিতে করা গবেষণার উপর ভিত্তি করে প্রস্তাব করা হয়েছে যে, মিউটেশনে যদি জিন কর্তৃক সৃষ্ট প্রোটিনে পরিবর্তন আসে, তবে তা ক্ষতিকারক হতে পারে, যেখানেউক্ত মিউটেশনের ৭০%-এই ক্ষতিকারক প্রভাব থাকে, এবং বাকি অংশ নিরপেক্ষ বা সামান্য উপকারী হতে পারে।[৩৮]
যৌনতা ও সংমিশ্রণ
জিন প্রবাহ
ক্রিয়াকৌশল
প্রজন্মের পর প্রজন্মে জীবের বংশগতভাবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর পরিবর্তনের মাধ্যমে বিবর্তন হয়। মূলত দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে বিবর্তন সংঘটিত হয়ঃ
১. ভ্যারিয়েশন (variation) বা প্রকরণঃ একটি পপুলেশন বা জীবগোষ্ঠীর অন্তর্গত সদস্য বা জীবদের পরস্পরের মধ্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য থাকবে।
২. হেরেডিটি (heredity) বা বংশগতিঃ এই বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে বংশগতভাবে (genetically) সঞ্চারিত হবে।
অর্থাৎ, যখন এই বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীব বা প্রকরণদের (variants) মধ্যে কোন কোন প্রকরণ সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় বা কোন কোনটি হ্রাস পায়, তখন এই পরিবর্তনের সাথে সাথে সমগ্র গোষ্ঠীই (population) পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই পরিবর্তনই হচ্ছে বিবর্তন। এর ফলে যেমন কোন কোন বৈশিষ্ট্য পুরোপুরিভাবে হারিয়ে যেতে পারে, আবার তেমনি নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য আবির্ভূত হতে পারে।
প্রাকৃতিক নির্বাচন (natural selection) হচ্ছে এমন একটি ঘটনা যার মাধ্যমে জীবগোষ্ঠীতে অধিকতর সবল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবের আধিক্য হয় এবং কম সবল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবের সংখ্যা হ্রাস পায়। কোন একটি প্রজাতির পপুলেশনে সেই বৈশিষ্ট্যগুলোই সাধারণ(common) হয়ে দেখা দেয়, যেগুলো বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে একটি জীবকে অধিক সংখ্যক সন্তান জন্মদানে সাহায্য করে। এটিকেই বলা হয় সিলেকশন বা নির্বাচন।
একটি জীব কী পরিমাণ টেকসই (viable) সন্তান উৎপাদন করতে সক্ষম, তা নির্ভর করে তার কিছু বৈশিষ্ট্যের উপর। প্রজন্মান্তরে সেগুলোর commonness বা uncommonness-ই হচ্ছে সিলেকশন। যে বৈশিষ্ট্যগুলো কোন জীবকে সন্তান উৎপাদনে অধিক সহায়তা করে, বংশগতভাবে সে বৈশিষ্ট্যগুলোই পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় এবং প্রজন্মান্তরে সেই বৈশিষ্ট্যগুলোই পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে বাড়তে থাকে। এভাবে বাড়তে বাড়তে এমন এক পর্যায় আসে যখন পপুলেশনের অন্তর্গত প্রতিটা জীবের মধ্যেই সেই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এটাকে বলা হয় "ফিক্সেশন" (fixation)।
নির্বাচন বিভিন্ন উপায়ে সংঘটিত হতে পারে। মানুষ যখন অন্য কোন জীবের প্রজাতিতে তার(মানুষের) কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবটিকে অধিক মাত্রায় সন্তান উৎপাদন করার সুযোগ করে দেয়, তখন তাকে বলা হয় কৃত্রিম নির্বাচন। অন্যথায় একে বলা হয় প্রাকৃতিক নির্বাচন। যৌন প্রজননক্ষম জীবের ক্ষেত্রে আরও একধরনের নির্বাচন পদ্ধতি দেখা যায়। একে বলা হয় সেক্সুয়াল সিলেকশন বা যৌন নির্বাচন। কোন জীবের একটি বৈশিষ্ট্য যদি সেই জীবটিকে তার বিপরীত লিঙ্গের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে, তাহলে সে বৈশিষ্ট্যটিই ঐ জীবকে অধিক সন্তান জন্মদানে সহায়তা করবে। এভাবে প্রজন্মান্তরে ঐ বৈশিষ্ট্যটি পপুলেশনে common হয়ে দেখা দেবে এবং একসময় ফিক্সেশন পয়েন্টে পৌঁছাবে।
ফিটনেস
DNA সেসব বৈশিষ্ট্য উৎপন্ন করে, তার সবগুলোই যদি সমানভাবে অনুকূল হত, তাহলেও বিবর্তন হতে পারতো, তবে তা হতো অত্যন্ত শ্লথ গতিতে এবং দৈবক্রমিক প্রক্রিয়ায় (randomly)। যেহেতু কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো তার বাহক জীবকে সংশ্লিষ্ট পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে, আবার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলোর উপস্থিতি তার বাহক জীবের খাপ খাওয়ানোতে কোন ভূমিকা রাখে না কিংবা তার জীবটির জন্য ক্ষতিকর, তাই ব্যাপারটা সাধারণত এমন হয় না।
ফিটনেস হচ্ছে একটা জীবের প্রজননের সামর্থ। শারীরিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি জীব প্রজননের ক্ষেত্রে যেমন দুর্বল হতে পারে, তেমনি শারীরিকভাবে দুর্বল একটি জীব আবার প্রজননের ক্ষেত্রে শক্তিশালী হতে পারে। একটি শারীরিক বৈশিষ্ট্য একটি জীবকে অধিক সংখ্যক টেকসই (viable) সন্তান উৎপাদনের সামর্থ্য দিতে পারে। এমনও হতে পারে যে, বৈশিষ্ট্যটি সেই জীবকে তার সন্তানের যত্ন নেওয়ার মত সক্ষমতা দেয়। আবার হয়ত কোন একটি বৈশিষ্ট্য সেই জীবটির বেঁচে থাকার থাকার সময়কালকে দীর্ঘায়িত করে, ফলে জীবটি অধিক হারে বংশবৃদ্ধি করতে পারে।
একটি বৈশিষ্ট্য কোন জীবকে বাড়তি বা কম সামর্থ্য দেবে কি দেবে না, তা পরিবেশ সাপেক্ষ বিষয়। যদি পরিবেশ পরিবর্তিত হয় বা জীবটি ভিন্ন কোন পরিবেশে স্থানান্তরিত হয়, তাহলে পরিবেশের তারতম্যের কারণে তার ফিটনেসেও পরিবর্তন আসবে। কারণ বেঁচে থাকা বা প্রজননের বিভিন্ন পন্থা পরিবেশভেদে বিভিন্ন হয়ে থাকে।
জীববিজ্ঞানে, অভিযোজন (Adaptation) হল কোন জীবের জীবদ্দশায় ভূমিকা রাখা একটি উপস্থিত কর্মসম্পাদনকারী বৈশিষ্ট্য, যা প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও বিবর্তিত হয়। অভিযোজন বলতে অভিযোজিত জীবের বর্তমান দশা এবং অভিযোজন পরিচালনাকারী সক্রিয় বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া উভয়কেই বোঝায়। অভিযোজন কোন জীবের ফিটনেস ও টিকে থাকার যোগ্যতাকে বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন জীব তাদের বৃদ্ধি ও বিকাশকালে বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয় এবং আরোপিত পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ নিজ ফিনোটাইপ বা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য পুনঃবিকশিত করার মাধ্যমে একটি অভিযোজনযোগ্য নমনীয়তায় নিজেকে সুসজ্জিত করে। যে কোন প্রদত্ত বৈশিষ্ট্যের জন্য প্রতিক্রিয়ার বিকাশভিত্তিক স্বাভাবিকতা অভিযোজনের সঠিকটার জন্য অত্যাবশ্যক কারণ এটি বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় পরিবেশে এক প্রকার জৈবিক নিরাপত্তা বা নমনীয়তার জোগান দেয়।
প্রজাত্যায়ন (Speciation) একটি বিবর্তনমূলক জীবপ্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি জীব প্রজাতি থেকে নতুন নতুন জীব প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। প্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে উত্তরপ্রজন্ম সৃষ্ট হয় তার প্রজাতিবৈশিষ্ট্য অগ্রজ থেকে ক্রমশ: ভিন্নতা লাভ করে। বংশানুক্রমে এই ভিন্নতা ব্যাপক হয়ে দাঁড়ালে নতুন প্রজাতি হিসাবে স্বীকৃতি ধার্য হয়ে পড়ে। তবে কখন নতুন প্রজাতি হিসাবে স্বীকৃতি ধার্য হবে তা বিতর্কিত বিষয়।[৪১] জীববিজ্ঞানী ওরেটর কুক খুব সম্ভবত speciation শব্দটি প্রথম বংশানুক্রমিক ভিন্নতা লাভ বোঝাতে ব্যবহার করেছিলেন।[৪২][৪৩]
প্রজাত্যায়নের পেছনে জিন প্রবাহের ভূমিকা বেশ বিতর্কিত। প্রজাত্যায়নের ভেতর দিয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীগুলো একটা আরেকটার থেকে ভৌগোলিকভাবে কতটা বিচ্ছিন্ন তার উপর ভিত্তি করে প্রকৃতিতে প্রজাত্যায়নের চারটি ভৌগোলিক ধরন পরিলক্ষিত হয়: এলোপেট্রিক, পেরিপেট্রিক, প্যারাপেট্রিক এবং সিমপ্যাট্রিক। পশু ব্যবস্থাপনা এবং গবেষণাগারে পরীক্ষার মাধ্যমেও প্রজাত্যায়ন উৎসাহিত করা হয়। প্রত্যেকটি ধরনের প্রজাত্যায়নের পর্যবেক্ষিত উদাহরণ নিবন্ধনের সর্বাংশে সরবরাহ করা হয়েছে।
জীববিজ্ঞান ও পরিবেশবিজ্ঞানে বিলোপন বা বিলুপ্তি (Extinction) বলতে কোন প্রজাতির নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বুঝায়। একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে বলতে বোঝায় যে সেই প্রজাতির কোনো জীবন্ত নমুনা প্রাকৃতিক পরিবেশ বা সংরক্ষণাগারে আর দেখা যায় না। প্রজাতির বিলুপ্তি বিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যকে প্রভাবিত করে।
জীবনের বিবর্তনীয় ইতিহাস
জীবনের ভিত্তি
সাধারণ পূর্বপুরুষ
পৃথিবীর সকল জীব একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ বা পূর্বপুরুষীয় জিন পুল হতে উৎপত্তি লাভ করেছে।[৪৫][৪৬] বর্তমান প্রজাতিগুলো হল প্রজাত্যায়ন ও বিলুপ্তি পর্বের দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্যময় ফসলস্বরুপ বিবর্তন প্রক্রিয়ার একটি পর্যায়।[৪৭] জীবকুল সম্পর্কিত চারটি সহজ বৈশিষ্ট্য থেকে এদের সাধারণ ও অভিন্ন পূর্বপুরুষ সম্পর্কে ধারণা করা হয়: প্রথমত, হাদের এমন ভৌগোলিক বিস্তার রয়েছে যা স্থানীয় অভিযোজন দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, জীববৈচিত্র্য কোন পূর্নাঙ্গ অনন্য জীবকুলের কোন সেট নয়, কিন্তু এমন অনেক জীব রয়েছে যারা নিজেদের মধ্যে অঙ্গসংস্থানিক সাদৃশ্য প্রদর্শন করে। তৃতীয়ত, কোন স্পষ্ট উদ্দেশ্যবিহীন নিষ্ক্রিয় বৈশিষ্ট্যসমূহ পূর্বপুরুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সদৃশ হয় এবং সবশেষে, এই জীবগুলোকে উক্ত সাদৃশ্য অনুসারে পর্যায়ক্রমিক গ্রুপে শ্রেণীবিন্যস্ত করা যায়, যা একটি পরিবার বৃক্ষের অনুরুপ।[৪৮]
বিবর্তন শুধুই একটি থিওরি (scientific theory) বা তত্ত্ব নয়। এটি পর্যবেক্ষণযোগ্য প্রাকৃতিক ঘটনা। বিবর্তন প্রকৃতপক্ষে একটি বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা (scientific fact) [৪৯]
। আর যে সুপ্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দিয়ে এই বিবর্তন নামের ফ্যাক্টটিকে ব্যাখ্যা করা হয় তাকে বলে বিবর্তন তত্ত্ব । অর্থাৎ একটি দৃশ্যমান প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে বিবর্তন কীভাবে ঘটে, তার ব্যাখ্যা দেয় বিবর্তন তত্ত্ব।[৫০][৫১] বিবর্তনতত্ত্বকে (theory of evolution) প্রায়ই সংক্ষেপে শুধু 'বিবর্তন' দ্বারা নির্দেশ করা হয়।
বিবর্তন বলতে জীবজগতের উন্নতি বোঝায় না; বিবর্তন হচ্ছে পরিবর্তন, সাধারণ পরিবর্তন নয়, ডারউইনের ভাষ্যমতে এটি "পরিবর্তন সংবলিত উদ্ভব" (descent with modification)। এই পরিবর্তন ইতিবাচক, নেতিবাচক কিংবা নিরপেক্ষ হতে পারে। এটি নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা পরিবেশের উপর। তবে সাধারণত বিবর্তনকে জীবজগতের উন্নয়ন বলে মনে হয়, কেননা হিতকর বা কোন একটি জীবকে বাড়তি সুবিধা প্রদানকারী বৈশিষ্ট্যগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে কম হিতকর বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে অধিক পরিমাণে দেখা যায়। অর্থাৎ হিতকর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সদস্যগুলোর সংখ্যা কম সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সদস্যদের তুলনায় সবসময়ই বেশি থাকে।
বিবর্তনের কোন সুনির্দিষ্ট্য লক্ষ্য নেই। 'বিপরীতমুখীন' কিংবা 'পশ্চাৎ বিবর্তন' (backward evolution or de-evolution) বলেও কোন জিনিস নেই; একইভাবে নেই 'সম্মুখ বিবর্তন'-এর মত কোন জিনিসও। অর্থাৎ বিবর্তন কোন নির্দিষ্ট দিকে চালিত হয় না। এমনকি প্রাকৃতিক নির্বাচনও সবসময় জীবজগতকে উন্নত করে না। কেননা কোন একটা পরিবেশের সাপেক্ষে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে একটা জীবগোষ্ঠী ঐ পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হয় ঠিকই, কিন্তু ভিন্ন পরিবেশে সেই অভিযোজিত বৈশিষ্ট্যগুলোই আবার ঐ জীবগোষ্ঠীর অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিবর্তন কোন তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া নয়। বিবর্তন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলমান প্রক্রিয়া। এটি একটি অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়া। একটি দৃশ্যমান বা চোখে পড়ার মত বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য সাধারণত লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যায়। একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হওয়ার জন্য একটি জীবগোষ্ঠীকে হাজার হাজার অন্তর্বতী অবস্থা (transitional forms) পার করতে হয়।
সর্বোপরি, বিবর্তন সরাসরিভাবে একটি পর্যবেক্ষণলব্ধ ঘটনা। যদিও বিবর্তনের ফলে জীবের অভিযোজন ঘটে, তবুও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিবর্তন সুনির্দিষ্টভাবে উপকারী হয় না। বিবর্তনের ফলে জীবজগতের নাটকীয় পরিবর্তন সাধিত হয় সত্যি, কিন্তু একটা ক্ষুদ্র কালখণ্ডের সাপেক্ষে এই পরিবর্তন খুবই ধর্তব্য নয়।
বিবর্তনের পক্ষে সাক্ষ্যপ্রমাণ অফুরন্ত বলে মনে করা হয়। বিবর্তন বা জৈব অভিব্যক্তির পক্ষে যে সমস্ত সাক্ষ্য হাজির করা যায় তা হলো : প্রাণ রাসায়নিক প্রমাণ, কোষবিদ্যা বিষয়ক প্রমাণ, শরীরবৃত্তীয় প্রমাণ, জীবাশ্ম বা ফসিলের প্রমাণ, সংযোগকারী জীবের (connecting link) প্রমাণ, ভৌগোলিক বিস্তারের (Geographical distribution) প্রমাণ, তুলনামূলক অঙ্গসংস্থানের প্রমাণ, শ্রেনীকরণ সংক্রান্ত প্রমাণ, নিষ্ক্রিয় বা বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গের প্রমাণ ইত্যাদি।[৫২]। এ ছাড়া তবে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে বিবর্তনের সপক্ষে সবচেয়ে জোরালো এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ পাওয়া গেছে ‘আণবিক জীববিদ্যা’ (molecular biology) এবং সাইটোজেনেটিক্স (cytogenetics) থেকে। আধুনিক জীববিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ববিজ্ঞান, জেনেটিক্স, জিনোমিক্স এবং আণবিক জীববিদ্যার সকল শাখাতেই বিবর্তনের পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে।[৫৩]। গুটিকয় প্রধান সাক্ষ্য উল্লেখ করা যেতে পারে -
সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতি উদ্ভূত হলে প্রজাতিগুলোর মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকবে, এ সমস্ত কিছুকে জাতিজনি বৃক্ষ (Phylogenetic tree) আকারে সাজানো যাবে। সেটাই দৃশ্যমান
জীবজগত রেপ্লিকেশন, হেরিটাবিলিটি, ক্যাটালাইসিস এবং মেটাবলিজম নামক সার্বজনীন মৌলিক প্রক্রিয়ার অধীন, যা জীবন প্রক্রিয়ার এক অভিন্ন উৎসের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে।
বিবর্তন তত্ত্ব থেকে যে সমস্ত সিদ্ধান্ত টানা হয় তা প্রত্নতত্ত্ব, জৈব রসায়ন, আণবিক জীববিদ্যা, কোষ বংশবিদ্যা কিংবা জেনেটিক ট্রেইটের থেকে পাওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সাথে মিলে যায়।
প্রাণীর ফসিলগুলো এই জাতিজনি বৃক্ষের ঠিক ঠিক জায়গায় খাপ খেয়ে যাচ্ছে। ট্রাঞ্জিশনাল ফসিল বা ‘মিসিং লিঙ্ক’ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে বহু ।[৫৪]।
তিমির পেছনের পা, ডলফিনের পেছনের ফিন, ঘোড়ার অতিরিক্ত আঙ্গুল বিশিষ্ট পা কিংবা লেজবিশিষ্ট মানব শিশু প্রকৃতিতে মাঝে মধ্যেই জন্ম নিতে দেখা যায়। এটা বিবর্তনের কারণেই ঘটে। কারণ কোন অঙ্গ লুপ্ত হয়ে গেলেও জনপুঞ্জের জীনে ফেনোটাইপ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ডিএনএ সেই তথ্য সংরক্ষণ করে। তার পুনঃপ্রকাশ ঘটতে পারে বিরল কিছু ক্ষেত্রে। ব্যপারটিকে বিবর্তনের পরিভাষায় আতাভিজম বলে ।
জীবজগতে প্রজাতির বিন্যাস বিবর্তনের ইতিহাসের ক্রমধারার সাথে সঙ্গতি বিধান করে। বিচ্ছিন্ন অন্তরিত দ্বীপে এমন সমস্ত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন প্রাণী পাওয়া যাচ্ছে যা মূল ভূখণ্ডে অনুপস্থিত, যা বিবর্তনের প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বিবর্তন তত্ত্ব অনুয়াযী পূর্ব বিকশিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকেই নতুন অঙ্গের কাঠামো তৈরির ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিভিন্ন মেরুদণ্ডী প্রাণীর সামনের হাত বা অগ্রপদের মধ্যে তাই লক্ষ্যনীয় মিল দেখা যায়। ব্যাঙ, কুমীর, পাখি, বাদুর, ঘোড়া, গরু, তিমি মাছ এবং মানুষের অগ্রপদের অস্থির গঠন প্রায় একই রকম।[৫৫],[৫৬] ।
একই ব্যাপার খাটে আণবিক স্তরেও। তাই ফ্রুটফ্লাই আর মানুষের মধ্যে বাহ্যিক পার্থক্য যতই থাকুক না কেন, এরা শতকরা সত্তুরভাগেরও বেশি ‘কমন জিন‘ শেয়ার করে। আর যে পূর্বপূরুষের সাথে কাছাকাছি সময়ে কোন প্রজাতি বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তাদের জিনগত নৈকট্যও তত বেশি থাকে। সেজন্যই মানুষের সাথে ওরাং ওটাং -এর ডিএনএ অণুর বেইস জোড়ের মধ্যে পার্থক্য মাত্র ২.৪%, গরিলার সাথে ১.৪%, আর শিম্পাঞ্জীর সাথে মাত্র ১.২%। বিবর্তন তত্ত্ব সঠিক না হলে এই ব্যাপারটি কখনোই ঘটতো না।
স্বতন্ত্র ভাবে কিংবা সমান্তরাল পথে ঘটা বিবর্তনও পরীক্ষিত। যেমন, পাখি, বাদুড় কিংবা পতঙ্গের পাখা উড়তে সহায়তা করলেও এদের গঠন এবং উদ্ভব ভিন্নভাবে হয়েছে ।
লেন্সকির পরীক্ষা সহ বহু পরীক্ষায় প্রজাতি গঠনের বিভিন্ন উদাহরণ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে [৫৭],[৫৮]।
আধুনিক বিজ্ঞানের কোন শাখা থেকে পাওয়া তথ্য বিবর্তনের বিপক্ষে যাচ্ছে না।
↑Board of Directors, American Association for the Advancement of Science (2006-02-16). "Statement on the Teaching of Evolution" (PDF). American Association for the Advancement of Science. http://www.aaas.org/news/releases/2006/pdf/0219boardstatement.pdf. from the world's largest general scientific society
↑Kutschera U, Niklas K (2004). "The modern theory of biological evolution: an expanded synthesis". Naturwissenschaften 91 (6): 255–76. doi:10.1007/s00114-004-0515-y. PMID 15241603.
↑"Erasmus Darwin (1731-1802)"। Evolution (Online exhibit)। Berkeley, California: University of California Museum of Paleontology। অক্টোবর ৪, ১৯৯৫। ২০১২-০১-১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০২-১১।
↑Bejder, Lars; Hall, Brian K. (নভেম্বর ২০০২)। "Limbs in whales and limblessness in other vertebrates: mechanisms of evolutionary and developmental transformation and loss"। Evolution & Development। Hoboken, NJ: Wiley-Blackwell on behalf of the Society for Integrative and Comparative Biology। 4 (6): 445–458। আইএসএসএন1520-541X। ডিওআই:10.1046/j.1525-142X.2002.02033.x। পিএমআইডি12492145।
↑Science and Creationism: A View from the National Academy of Sciences, Second Edition (1999), National Academy of Sciences (NAS), National Academy Press, Washington DC, 2006.
↑ড. ম. আখতারুজ্জামান, বিবর্তনবিদ্যা, বাংলা একাডেমী
↑বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর প্রকাশনা, ২০০৭ (পরিবর্ধিত সংস্করণ ২০০৮)
↑বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, মিসিং লিঙ্কগুলো আর মিসিং নেই অধ্যায় দ্রঃ
নারায়ন সেন, ডারউইন থেকে ডি. এন. এ, আনন্দ প্রকাশনা
সুশান্ত মজুমদার, চার্লস ডারউইন ও বিবর্তনবাদ, শৈব্যা প্রকাশন
Jerry A. Coyne, Why Evolution Is True, Viking Adult , 2009
Richard Dawkins, The Greatest Show on Earth: The Evidence for Evolution, Free Press, 2009
Richard Dawkins, The Ancestor’s Tale: A Pilgrimage to the Dawn of Evolution, Mariner Books, 2005
The Science of Evolution and the Myth of Creationism: Knowing What’s Real and Why It Matters, Ardea Skybreak, Insight Press; illustrated edition edition, 2006
Douglas J. Futuyma, Evolution, Sinauer Associates, 2005
Hennig, Willi (১৯৯৯) [Originally published 1966 (reprinted 1979); translated from the author's unpublished revision of Grundzüge einer Theorie der phylogenetischen Systematik, published in 1950]। Phylogenetic Systematics। Translation by D. Dwight Davis and Rainer Zangerl; foreword by Donn E. Rosen, Gareth Nelson, and Colin Patterson (Reissue সংস্করণ)। Urbana, Illinois: University of Illinois Press। আইএসবিএন978-0-252-06814-0। এলসিসিএন78031969। ওসিএলসি722701473।
Nardon, Paul; Grenier, Anne-Marie (১৯৯১)। "Serial Endosymbiosis Theory and Weevil Evolution: The Role of Symbiosis"। Margulis, Lynn; Fester, René। Symbiosis as a Source of Evolutionary Innovation: Speciation and Morphogenesis। Cambridge, Massachusetts: MIT Press। আইএসবিএন978-0-262-13269-5। এলসিসিএন90020439। ওসিএলসি22597587। "Based on a conference held in Bellagio, Italy, June 25–30, 1989"