বাউল

বাউলের প্রধান বাদ্যযন্ত্র একতারা ও ডুগি বাজিয়ে সংগীত পরিবেশন করছেন বাংলাদেশের সাধিকা সৃজনী তানিয়া। স্থান: রাজশাহী জেলার পুঠিয়ার শিবমন্দির ও জগন্নাথ মন্দির
২০১৮ সালে টুনটুন বাউলের গান

বাউল শিল্পী বা বাউল সাধক বা বাউল একটি বিশেষ ধরনের গোষ্ঠী ও লোকাচার সঙ্গীত পরিবেশক, যারা গানের সাথে সাথে সুফিবাদ, দেহতত্ত্ব প্রভৃতি মতাদর্শ প্রচার করে থাকে। বাউল সাধক বাউল সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকে। মূলত বাউল সংগীত একধরনের বাংলা সুফিবাদ সংগীত ছিল। বাউল গান পঞ্চদশ শতাব্দীতে লক্ষ্য করা গেলেও মূলত কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের গানের মধ্য দিয়ে বাউল মত পরিচিতি লাভ করে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের নিকট।[] বাউলদের সাদামাটা জীবন ধারণ ও একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউলদের বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। []

শাব্দিক অর্থ

বাংলার বাউল বা বাউল সংগীত অদ্যাবধি গবেষকেরা যেমন কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারেন নি। সাধারণত মানা হয় যে "বাউল" শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ "বাউর" থেকে, যার অর্থ স্বেচ্ছাচারী, বিশৃঙ্খল বা উন্মাদ।[]

তবে বাউলের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কোনো এক গবেষক বলেছেন- সংস্কৃত “বায়ু” থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তি, বাংলার যে সব লোক “বায়ু” অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার সাহায্যে সাধনার মাধ্যমে আত্মিক শক্তি লাভ করার চেষ্টা করেন, তারাই বাউল।[][]

কেউ কেউ বলেছেন, সংস্কৃত “বাতুল” শব্দ থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তি, এই গবেষকদের মতে- যে সব লোক প্রকৃতই পাগল, তাই তারা কোনো সামাজিক বা ধর্মের কোনো বিধিনিষেধ মানে না, তারাই বাউল।[] কেউ বলেছেন “বাউর” শব্দ থেকে বাউলের উৎপত্তি, এর অর্থ এলো-মেলো, বিশৃঙ্খল, পাগল।[]

উৎপত্তি

লালন

বাউল শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে মতান্তর রয়েছে। অতিপ্রাচীনকাল থেকে বাউল শব্দটির প্রচলন লক্ষ করা যায়। আনুমানিক সপ্তদশ শতক থেকে বাউল নামের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়, চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের আদিলীলা অংশে এর ব্যবহার লক্ষ করা করা যায়, চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে মহাপ্রভু, রামানন্দ রায় ও সনাতন গোস্বামীর নিকট কৃষ্ণ বিরহ বিধুর নিজেকে মহাবাউল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সেই থেকে অনুমান করা হয়,বাউল শব্দের উৎপত্তির কথা। বাউলের রয়েছে নানাবিধ শাখাপ্রশাখা, একেক সম্প্রদায়ের বাউলেরা একেক মত অনুসারী, সেগুলো তাদের সম্প্রদায়ভেদে ধর্মীয় উপাসনার একটি অংশ।

বাউলদের প্রকারভেদ

গৃহত্যাগী বাউল

বাউলদের মধ্যে দুটি শ্রেণি আছে গৃহত্যাগী বাউল ও গৃহী বা সংসারী বাউল। যারা গুরুর নিকট দীক্ষা (ভেক খিলাফত) নিয়ে গৃহত্যাগ করে, তাদেরকে ত্যাগী বা ভেকধারী বাউল বলা হয়। এই শ্রেণির বাউলরা পুরোপুরি সংসার ও সমাজ বিমুখ, ভিক্ষাই তাদের একমাত্র পেশা। তারা আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং সেখানে সাময়িকভাবে অবস্থান করে। পুরুষরা সাধারণত সাদা লুঙ্গি এবং সাদা আলখাল্লা এবং মহিলারা সাদা শাড়ি পরিধান করে। তাদের কাধে থাকে ভিক্ষার ঝুলি। তারা সন্তান ধারণ বা প্রতিপালন করতে পারে না।[] এই ধরনের জীবনকে বলা হয় ‘জ্যান্তে মরা’ বা জীবন্মৃত। মহিলাদেরকে বলা হয় সেবাদাসী। পুরুষ বাউল এক বা একাধিক সেবাদাসী রাখতে পারে। এই সেবাদাসীরা বাউলদের সাধনসঙ্গিনী। ১৯৭৬ সাল অবধি বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলায় ২৫২ জন ভেকধারী বাউল ছিল। ১৯৮২-৮৩ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৯০৫ জনে দাঁড়ায়। বর্তমানে সমগ্র দেশে ভেকধারী বাউলের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার।

সংসারী বাউল

গৃহী বা সংসারী বাউলরা স্ত্রী-পুত্র-পরিজনসহ লোকালয়ে একটি নিদিষ্ট আলাদা পাড়ায় বাস করেন। সমাজের অন্যদের সঙ্গে তাদের ওঠা-বসা, বিবাহ ইত্যাদি নিষিদ্ধ। ভেকধারী বাউলদের মতো তাদের কঠোর সাধনা করতে হয় না, বরং ‘কলমা’ বা ‘বীজমন্ত্র’ পাঠ এবং নির্দিষ্ট কিছু সাধন-ভজন প্রক্রিয়া অনুসরণ করলেই হয়। ভেকধারী বাউলরা গৃহী বাউলদের দীক্ষা দিয়ে থাকে। উভয়ের সম্পর্ক অনেকটা পীর-মুরিদের মতো। দীক্ষা নেওয়ার পর সন্তানধারণ নিষিদ্ধ, তবে গুরুর অনুমতিক্রমে কেউ কেউ সন্তান ধারণ করতে পারে। বর্তমানে কৃষিজীবী, তন্তুবায় এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে বাউল হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ব্যক্তির মধ্যে অনেকে কলকারখানার শ্রমিক ও দৈনন্দিন মজুর পর্যায়ভুক্ত। বাউলমতে দীক্ষিত হওয়ার পূর্বে বিবাহ হয়ে থাকলে নতুন করে কোনো অনুষ্ঠান করতে হয় না। ত্যাগী বাউলদের সেবাদাসী ‘কণ্ঠিবদল’ করে একজনকে ছেড়ে অন্য জনের সঙ্গে চলে যেতে পারে। বর্তমানে গৃহী বাউলদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিস্তৃতি

বাংলাদেশের কুষ্টিয়া-পাবনা এলাকা থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম-বোলপুর-জয়দেবকেন্দুলি পর্যন্ত বাউলদের বিস্তৃতি। বাউলদের মধ্যে গৃহীসন্ন্যাসী দুই প্রকারই রয়েছে। বাউলরা তাদের গুরুর আখড়ায় সাধনা করে। প্রতি বৎসর পৌষ সংক্রান্তির দিন বীরভূমের জয়দেব-কেন্দুলিতে বাউলদের একটি মেলা শুরু হয়, যা "জয়দেব বাউলমেলা" নামে বিখ্যাত।

দর্শন

বাউলেরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধক। তারা মানবতার বাণী প্রচার করে। বাউল মতে বৈষ্ণবধর্ম এবং সূফীবাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বাউলরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় আত্মাকে। তাদের মতে আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায়। আত্মা দেহে বাস করে তাই তারা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করে। সাধারণত প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও বাউলরা জীবনদর্শন সম্পর্কে অনেক গভীর কথা বলেছেন।

বাউল সাধক

বাউল সাধকদের শিরোমণি ফকির লালন সাঁই। লালন তার বিপুল সংখ্যক গানের মাধ্যমে বাউল মতের দর্শন এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রচার করেছিলেন। বাউল সমাজে তিনি "সাইজিঁ" ও তার গান "সাইজিঁর কালাম" হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও বাউল কবিদের মধ্যে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম, বাউল সম্রাট স্বাধক আব্দুল হালিম মিয়া, রশিদ উদ্দিন, হাছন রাজা, রাধারমণ দত্ত, সিরাজ সাঁই, পাঞ্জু শাহ, পাগলা কানাই, শীতলং শাহ, দ্বিজদাস, হরিচরণ আচার্য, মহর্ষি মনোমোহন দত্ত, লাল মাসুদ, সুলা গাইন, বিজয় নারায়ণ আচার্য, দীন শরৎ (শরৎচন্দ্র নাথ), রামু মালি, রামগতি শীল, মুকুন্দ দাস, আরকুম শাহ্‌, সৈয়দ শাহ নূর, উকিল মুন্সী, চান খাঁ পাঠান, তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, দুলু খাঁ, আবেদ আলী, উমেদ আলী, আবদুল মজিদ তালুকদার, আবদুস সাত্তার, খেলু মিয়া, ইদ্রিস মিয়া, আলী হোসেন সরকার, চান মিয়া, জামসেদ উদ্দিন, গুল মাহমুদ, প্রভাত সূত্রধর, আবদুল হেকিম সরকার, আবুল কাসেম তালুকদার, বাউল সুনীল কর্মকার, ক্বারী আমীর উদ্দিন আহমেদ, ফকির দুর্বিন শাহ, শেখ মদন, দুদ্দু সাঁই, কবি জয়দেব, কবিয়াল বিজয় সরকার, ভবা পাগলা, নীলকণ্ঠ, দ্বিজ মহিন, পূর্ণদাস বাউল, খোরশেদ মিয়া, সিরাজ উদ্দিন খান পাঠান, আব্দুল হাকিম, আলেয়া বেগম, দলিল উদ্দিন বয়াতি, মাতাল রাজ্জাক, মালেক দেওয়ান, খালেক দেওয়ান, আবুল সরকার,শাহ আলম সরকার ও আক্কাস দেওয়ান, জালাল বয়াতি মনির দেওয়ান, গোষ্ঠ গোপাল দাস প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

মহিলা বাউল

পুরুষদের পাশাপাশি বাংলায় প্রচুর মহিলা বাউল রয়েছেন। যারা পুরুষদের মতোই গুরু-শিষ্য পরম্পরায় বাউল সাধনা করেন এবং সংগীত পরিবেশন করে থাকেন। বাউল শিরোমণি লালন সাঁইয়ের আশ্রমে বহু মহিলা সাধিকা বাউল সাধনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখনও বিভিন্ন বাউলের আশ্রমে অসংখ্য মহিলা বাউলের অস্তিত্ব রয়েছে।

তথ্যসূত্র

  1. "Baul songs - UNESCO"ich.unesco.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-১৮ 
  2. "Baul philosophy and humanism - CineBuzz Times"। ২ জুলাই ২০২৩। 
  3. "বাউল/Baul"Sahapedia (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-১৮ 
  4. আহমদ শরীফ, বাউলতত্ত্ব, ঢাকা : পড়–য়া, ২০১৩, পৃ. ৪২ 
  5. মনসুর মুসা (সম্পাদিত), মুহম্মদ এনামুল হক রচনাবলী, প্রথম খ-, “বঙ্গে সূফি প্রভাব”, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯১, পৃ. ১৬০ 
  6. "বাউল - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১১-১৮ 


Strategi Solo vs Squad di Free Fire: Cara Menang Mudah!