বাংলার প্রারম্ভিক কৃষি সম্প্রদায় হল বাংলার তাম্রপ্রস্তরযুগীয় কৃষকদের একটি গোষ্ঠী, যারা বাংলায় কৃষি কাজ শুরু (১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে) করেছিল। তাম্রপ্রস্তরযুগের পূর্ববর্তী নব্যপ্রস্তরযুগে ব্যাপক আকারে কৃষিকাজের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[১]
বাংলার সমগ্র অঞ্চল জুড়ে (পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ) প্রারম্ভিক কৃষি সম্প্রদায় অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি, এদের অস্তিত্ব দক্ষিণ-পশ্চিম অংশেই (পশ্চিমবঙ্গ) খুঁজে পাওয়া যায়।[১]
বিবরণ
প্রারম্ভিক কৃষি সম্প্রদায়ের বসতি ছোটনাগপুর মালভূমির পাদদেশ থেকে ভাগীরথী-হুগলী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত সমতল ভূমিতে গড়ে উঠেছিল। এই কৃষি সম্প্রদায় কর্তৃক ধান চাষের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। মালভূমির পাদদেশ থেকে পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রদায়ের মধ্যে কৃষিকাজের সঙ্গে অধিক সম্পৃক্ততার প্রমান পাওয়া যায়। প্রধানত ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, কাসাই ও রূপনারায়ণ নদী বিধৌত বাংলার এই অঞ্চলটিতে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের[২] দিকে বাংলায় প্রথম কৃষি সম্প্রদায়ের বিকাশ ঘটেছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা লালগড় ফরমেশনের লালমাটি এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীকালে পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়েছিল।[১]
বসতি
উত্তরে গঙ্গা থেকে দক্ষিণে সুবর্ণরেখা নদী ও বঙ্গোপসাগর এবং পূর্বে ভাগীরথী-হুগলী নদী থকে পশ্চিমে ছোটনাগপুর মালভূমির পাদদেশ দ্বারা সীমাবদ্ধ এলাকায় বাংলার প্রারম্ভিক কৃষি সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের পাওয়া গিয়েছে। তাদের অধিক সংখ্যক বসতি অজয় ও দামোদর উপত্যকায় পরিলক্ষিত হয়। বসতি এলাকাটিকে ভূমিগঠন ও বসতির সমকাল অনুসারে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা - লাল মাটি অঞ্চল, প্রাচীন পললভূমি অঞ্চল ও নতুন পললভূমি অঞ্চল।[১]
লাল মাটি অঞ্চল
এই অঞ্চলে প্রারম্ভিক কৃষি সম্প্রদায় প্রথম বসতি গড়েছিল। এখানকার প্রধান বসতিগুলি হল ভরতপুর, মহিষদল, ডিহর, হরইপুর ও তুলসীপুর। বসতিগুলি থেকে প্রাপ্ত সামগ্রীসমূহ প্রমাণ করে যে এই অঞ্চলের কৃষি সম্প্রদায় কৃষিকাজের পাশাপাশি শিকার জীবিকার অন্যতম প্রধান অবলম্বন ছিল। এই অঞ্চলের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য ব্যাপক আকারে পশুপালন করত। উচ্চ প্রটিনযুক্ত প্রাণীখাদ্যই ছিল তাদের খাদ্যের প্রধান উপাদান। কৃষি ছাড়াও পশু পালন ছিল তাদের জীবিকার অন্যতম প্রধান ভিত্তি।[১]
প্রকৃতপক্ষে, এই অঞ্চলের হাজার বছরের ইতিহাসে অর্থনীতি মোটামুটিভাবে অপরিবর্তিতই ছিল। অর্থনীতির স্থবিরতার প্রধান কারণ হলো সম্ভবত মাটির কম উর্বরতা, আর তার সঙ্গে স্বল্প বৃষ্টিপাত। ফলে প্রারম্ভিক কৃষি সম্প্রদায়ের দ্বারা গড়ে তোলা কৃষি ও শিকার ভিত্তিক সভ্যতা তাদের চাহিদা অনুযায়ী ভাল হয়ে থাকলেও তা পরবর্তী উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য পরিমিত সম্পদ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই ঐতিহাসিক যুগের অব্যবহিত পূর্বে বা পরেই এই অঞ্চলে কৃষি ভিত্তিক সম্প্রদায়ের অবলুপ্তি ঘটেছিল।[১]
প্রাচীন পললভূমি অঞ্চল
এই অঞ্চলের মাটি ছিল ধান চাষের জন্য অত্যন্ত উর্বর, এবং বৃষ্টিপাতের হারও ছিল মোটামুটি ভাল। এই এলাকার কৃষি সম্প্রদায় পশুপালনের চেয়ে কৃষিকাজে বেশি মনোযোগী ছিল।[৩] বাসিন্দারা দুটি ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিল। একদিকে কৃষি পরিবেশ একটি কৃষি জীবিকা গড়ে তুলেছিল, অন্য দিকে আধা-শহুরে পরিবেশ তাদের শহুরে চাহিদা মেটাতে বাধ্য করেছিল।
এই অঞ্চলে খননকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলি হল পাণ্ডু রাজার ঢিবি, মঙ্গলকোট, বানেশ্বরডাঙ্গা ও পোখরনা। পাণ্ডু রাজার ঢিবি থেকে প্রাপ্ত লোহার কাস্তে এবং মঙ্গলকোট থেকে আবিষ্কৃত কুড়াল ও বাটালি এই অঞ্চলের কৃষি ও কৃষি অর্থনীতির প্রমাণ দেয়। এই এলাকা থেকে খননকার্য প্রাপ্ত জিনিসপত্রগুলি হল ফুলদানি, বড় পান পাত্র, ছোট পাথরের পুঁতি, হাতির দাঁতের চিরুনি, লকেট, পুঁতি, সুরমা কাঠি ইত্যাদি নাগরিক, যা নাগরিক জীবনকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে।[৪]
নতুন পললভূমি অঞ্চল
এই অঞ্চলটি নিম্ন বঙ্গের সমতল বদ্বীপ অঞ্চলের অংশ। এখানকার মাটি একটি স্থিতিশীল কৃষি অর্থনীতির জন্য ছিল মোটামুটি কার্যকর। বসতিগুলি মূলত ভাগীরথী-হুগলি নদী ও রূপনারায়ণ নদের তীরে গড়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলের প্রধান বসতি হল তমলুক বা তাম্রলিপ্তি।[৫]
সমুদ্র উপকূলবর্তী এরেন্দায় কৃষিকাজের তাম্রযুগীয় (চ্যালকোলিথিক) চাষের সংস্কৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যা বাংলার প্রারম্ভিক কৃষি সম্প্রদায়ের দ্বারা গড়ে উঠেছিল।[৬]
তথ্যসূত্র
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ অশোক দত্ত (২০১২)। "কৃষি সম্প্রদায়, প্রাথমিক যুগ"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ "Ancient site and remains of Pandu-Raja Dhibi"। commons.wikimedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
- ↑ Sanyal, Rajat; Chattopadhyay, R.K.; Bandyopadhyay, Kumkum। "Early Village Farming Settlements of Eastern India: A Fresh Appraisal" (পিডিএফ): ৭৮।
- ↑ Asok Datta। "Subsistence Strategies of The Chalcolithic People of West Bengal: an appraisal."। www.citeseerx.ist.psu.edu। কলকাতা: প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সংগ্রহের তারিখ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
- ↑ Dilip K. Chakrabarti (২০০১)। Archaeological Geography of the Ganga Plain: The Lower and the Middle Ganga। Orient Blackswan। পৃষ্ঠা 125। আইএসবিএন 978-81-7824-016-9।
- ↑ গঙ্গোপাধ্যায়, কৌশিক; হালদার, বিধান; চৌধুরী, সপ্তর্ষি (২০১৭)। চক্রবর্তী, শর্মি, সম্পাদক। "Chalcolithic Pottery from Erenda (West Bengal): A Preliminary Assessment" [এরেন্দা (পশ্চিমবঙ্গ) থেকে প্রাপ্ত তাম্রযুগীয় মৃৎপাত্র: একটি প্রাথমিক মূল্যায়ন]। প্রত্ন সমীক্ষা (ইংরেজি ভাষায়)। কলকাতা: প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পূর্ব ভারত, কলকাতা। ৮: ১৩২। আইএসএসএন 2229-7979। সংগ্রহের তারিখ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩।