পলিমারেজ শৃঙ্খল বিক্রিয়া (ইংরেজি: polymerase chain reaction) বা পিসিআর হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়া ব্যবহার করে একটি ডিএনএ অণুর অসংখ্য প্রতিলিপি তৈরি করা হয়। এ প্রক্রিয়ার সূচকীয় হারে একটি ডিএনএ অনুর অনেকগুলো প্রতিলিপি তৈরী করে ডিএনএকে বিস্তারিত ভাবে অধ্যয়ন করা যায়। এই প্রক্রিয়ার আবিষ্কারক ক্যারি মুলিস (১৯৮৪)। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাচীন ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংক্রামক এজেন্টও শনাক্ত করা যায়।
বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণাগার থেকে শুরু করে বায়োমেডিকাল গবেষণা, ফরেনসিক মেডিসিন তদন্তসহ সব পর্যায়ে এই প্রক্রিয়া ব্যবহার হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে পলিমারেজ চেইন রিএকশন পদ্ধতি তাপীয় চক্র নামক
প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। তাপীয় চক্র বিক্রিয়ক গুলোকে বারবার ঠান্ডা ও গরম করে এবং বিভিন্ন তাপমাত্রার দ্বারা প্রভাবিত বিক্রিয়ার মুখোমুখি করে। যার মাঝে ডিএনএ বিগলন ও এনজাইম প্রভাবিত ডিএনএ প্রতিলিপিকরণ উল্লেখযোগ্য। এই বিক্রিয়ায় দুটি মূল বিক্রিয়ক ব্যবহার হয়। এর একটি প্রাইমার আরেকটি হচ্ছে ডিএনএ পলিমারেজ। প্রায় সব ধরনের পলিমারেজ চেইন রিএকশনে তাপ-সহ্যকারী এক ধরনের ডিএনএ পলিমারেজ এনজাইম ব্যবহার করা হয় যার নাম Taq Polymerase এনজাইম। এই এনজাইম Thermus Aquaticus নামক এক প্রকারের থার্মোফাইল ব্যাকটেরিয়া থেকে আলাদা করা হয়।[১][২][৩]
মূলনীতি
পিসিআর ডিএনএ স্ট্র্যান্ডের (টার্গেট ডিএনএ) একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে প্রসারিত করে। বেশিরভাগ পিসিআর পদ্ধতি ০.১ থেকে ১০ কিলো বেস জোড়া (কেবিপি) এর ডিএনএ টুকরা প্রসারিত করে যদিও কিছু কৌশল ৪০ কেবিপি দৈর্ঘ্য পর্যন্ত ডিএনএ টুকরো প্রশস্ত করার অনুমতি দেয়।
একটি মৌলিক পিসিআর সেট-আপের জন্য বেশ কয়েকটি উপাদান এবং রিএজেন্ট প্রয়োজন, যার মধ্যে রয়েছে:
একটি ডিএনএ টেমপ্লেট
ট্যাক ডিএনএ পলিমারেজ এনজাইম
দুটো প্রাইমার। যাদের সিকোয়েন্সগুলো টার্গেট ডিএনএ এর দুই প্রান্তের সিকোয়েন্সের সম্পূরক।
পিসিআর সাধারণত ২০-৪০ পর্যাবৃত্তিক তাপমাত্রা পরিবর্তনের একটি সিরিজ নিয়ে গঠিত। যাকে তাপীয় চক্র বলা হয়। প্রতিটি চক্র সাধারণত দুই বা তিনটি বিচ্ছিন্ন তাপমাত্রা পদক্ষেপ নিয়ে গঠিত। সাইক্লিং খুব উচ্চ তাপমাত্রায় (>৯০°সি ;১৯৪°এফ) হয়ে থাকে। ব্যবহৃত তাপমাত্রা এবং প্রতিটি চক্রে প্রয়োগ করা সময়ের দৈর্ঘ্য বিভিন্ন পরামিতির উপর নির্ভর করে। যার মধ্যে রয়েছে ডিএনএ সংশ্লেষণের জন্য ব্যবহৃত এনজাইম, প্রতিক্রিয়ায় দ্বিযোজিত আয়ন, ডিএনটিপির ঘনত্ব, এবং প্রাইমারদের গলনাঙ্ক তাপমাত্রা (টিএম)। অধিকাংশ পিসিআর পদ্ধতির জন্য সাধারণত নিচের আদর্শ পদ্ধতিগুলো ব্যবহৃত হয়:
প্রারম্ভ: এই ধাপটি ডিএনএ পলিমারেজের জন্য প্রয়োজন। এটি ৯৪-৯৬ °সে (২০১-২০৫ °ফারেনহাইট), অথবা ৯৮ °সি (২০৮ °এফ) তাপমাত্রায় রিঅ্যাকশন চেম্বার গরম করে থাকে। এক্ষেত্রে অত্যন্ত তাপস্থিতিশীল পলিমারেজ ব্যবহার করা হয়। যার আণবিক গঠন ১-১০ মিনিট পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থাকে।
বিগলন: এই ধাপটি দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে নিয়মিত সাইক্লিং ইভেন্ট অন্তর্ভুক্ত এবং দ্বিতীয় অংশে প্রতিক্রিয়া চেম্বারটি ৩০ সেকেন্ডের জন্য ৯৪-৯৮ °সি (২০১-২০৮ °এফ) তাপমাত্রায় গরম করা হয়। এর ফলে পরিপূরক ক্ষারগুলোর মধ্যে হাইড্রোজেন বন্ধন ভেঙে ডিএনএ বিগলিত হয় বা ডিন্যাচারেশন হয়। ফলে দুটি একক স্টান্ডবিশিষ্ট ডিএনএ অণু উৎপন্ন হয়।
অ্যানিলিং: এই ধাপে, প্রতিক্রিয়া তাপমাত্রা ২০-৪০ সেকেন্ডের জন্য ৫০-৬৫ °সে (১২২-১৪৯ ফারেনহাইট) হ্রাস করা হয়। যা একক-আটকে থাকা ডিএনএ টেমপ্লেটগুলির প্রতিটিতে প্রাইমারের অ্যানিলিং করে। ফলে পলিমারাইজেশনের সূত্রপাত ঘটে।
শিকল বর্ধিতকরন: এই ধাপের প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা ব্যবহৃত ডিএনএ পলিমারেজের উপর নির্ভর করে। ট্যাক পলিমারেজ এর তাপস্থিতিশীল ডিএনএ পলিমারেজ জন্য সর্বোত্তম তাপমাত্রা প্রায় ৭৫-৮০ °সি (১৬৭-১৭৬ °ফারেনহাইট) যদিও ৭২ °সি (১৬২ °ফারেনহাইট) তাপমাত্রা সাধারণত এই এনজাইমের সাথে ব্যবহৃত হয়। এই ধাপে, ডিএনএ পলিমারেজ ডিএনএ টেমপ্লেট স্ট্র্যান্ডের পরিপূরক একটি নতুন ডিএনএ স্ট্র্যান্ড সংশ্লেষণ করে এবং মিশ্রণ থেকে ডিএনটিপি যুক্ত করে। যা 5'থেকে-3' দিকে টেমপ্লেটের পরিপূরক। নবজাতক (দীর্ঘায়িত) ডিএনএ স্ট্র্যান্ডের শেষে 3'-হাইড্রোক্সি গ্রুপের সাথে ডিএনটিপিগুলির 5'-ফসফেট গ্রুপকে ঘনীভূত করে।
চূড়ান্ত বর্ধিতকরন: এই একক ধাপটি ঐচ্ছিক। তবে ৭০-৭৪ °সি (১৫৮-১৬৫ °ফারেনহাইট) তাপমাত্রায় পিসিআর-এ ব্যবহৃত বেশিরভাগ পলিমারেজের সর্বোচ্চ ক্রিয়াকলাপের ফলে শেষ পিসিআর চক্রের পরে ৫-১৫ মিনিটে কোনও অবশিষ্ট আটকে থাকা ডিএনএ সম্পূর্ণরূপে দীর্ঘায়িত হয়।
চক্রের পুনরাবৃত্তি: চূড়ান্ত পদক্ষেপটির পরে চক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং শিকল বিক্রিয়ার মতো প্রক্রিয়াটি এগিয়ে যায়।
ব্যবহার
১.অপরাধী শনাক্তকরণ
২.সন্তানের প্রকৃত পিতা-মাতা শনাক্তকরণ
৩.আগুনে পুড়ে যাওয়া নিহত ব্যক্তির প্রকৃত অভিভাবক শনাক্তকরণ
সুবিধা
পিসিআর-এর বেশ কয়েকটি সুবিধা রয়েছে। এটি ব্যবহার করা মোটামুটি সহজ, এবং দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায়। সিকোয়েন্সিং, ক্লোনিং এবং বিশ্লেষণের জন্য একটি নির্দিষ্ট এজেন্টের লক্ষ থেকে কোটি কোটি অনুলিপি উৎপাদনের জন্য কৌশলটি অত্যন্ত কার্যকর এবং সংবেদনশীল। কিউআরটি-পিসিআর, পিসিআর-এর মতোই একটি পদ্ধতি যেখানে সংশ্লেষিত এজেন্টের পরিমাণনির্ধারণের জন্য অতিরিক্ত সুবিধা রয়েছে। টিউমার, জীবাণু বা অন্যান্য রোগের জিন অভিব্যক্তি মাত্রার পরিবর্তন বিশ্লেষণ করার জন্য এর ব্যবহার রয়েছে।[৪]
পিসিআর একটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ব্যবহারিক গবেষণা সরঞ্জাম। পিসিআর দ্বারা অনেক রোগের অজানা সিকোয়েন্সিং খুঁজে বের করা হচ্ছে। পিসিআর পদ্ধতি পরিচিত ভাইরাস গুলির সাথে সম্পর্কিত পূর্বের অজানা ভাইরাসগুলির ক্রম সনাক্ত করতে সহায়তা করে এবং এভাবে রোগটি সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা দিতে পারে। যদি পদ্ধতিটি আরও সরলীকৃত করা যায় এবং সংবেদনশীল অ-রেডিওমেট্রিক সনাক্তকরণ সিস্টেমগুলি বিকাশ করা যায় তবে পিসিআর আগামী বছরগুলিতে ক্লিনিকাল ল্যাবরেটরিতে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করবে।
সীমাবদ্ধতা
পিসিআর-এর একটি প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো টার্গেট এজেন্টের প্রান্তীয় সিকোয়েন্স সম্পর্কে পূর্ব তথ্য জানা থাকতে হয়। যাতে এজেন্টরির সম্পূরক প্রাইমার তৈরি করা যায়। এর অর্থ হল, সাধারণত, পিসিআর ব্যবহারকারীদের অবশ্যই দুটি একক-আটকে থাকা টেমপ্লেটের প্রতিটিতে লক্ষ্য অঞ্চলের উপরের দিকে সুনির্দিষ্ট ক্রমগুলি জানতে হবে। যাতে ডিএনএ পলিমারেজ সঠিকভাবে প্রাইমার-টেমপ্লেট হাইব্রিডের সাথে আবদ্ধ থাকে। পরবর্তীতে ডিএনএ সংশ্লেষণের সময় পুরো টার্গেট সিকোয়েন্স উৎপন্ন করে।
সমস্ত এনজাইমের মতো, ডিএনএ পলিমারেজও ত্রুটিপ্রবণ। যা পরবর্তীতে উৎপন্ন পিসিআর খণ্ডগুলিতে মিউটেশন ঘটায়।
পিসিআর-এর আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো ট্রেস পরিমাণ ডিএনএও এই পদ্ধতিতে প্রসারিত করা যেতে পারে। যার ফলে বিভ্রান্তিকর বা অস্পষ্ট ফলাফল আসতে পারে। দূষণের সম্ভাবনা হ্রাস করার জন্য, তদন্তকারীদের রিএজেন্ট প্রস্তুতি, পিসিআর এবং পণ্যের বিশ্লেষণের জন্য পৃথক কক্ষ সংরক্ষণ করা উচিত। রিএজেন্টগুলি একক ব্যবহারের আলিকোটগুলিতে বিতরণ করা উচিত। ডিসপোজেবল প্লাঞ্জার এবং অতিরিক্ত দীর্ঘ পিপেট টিপস সহ পাইপটরগুলি নিয়মিতভাবে ব্যবহার করা উচিত। ল্যাব সেট-আপ যাতে একমুখী কর্মপ্রবাহ অনুসরণ করে তা নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়। পিসিআর এবং বিশ্লেষণ কক্ষগুলিতে ব্যবহৃত কোনও উপকরণ বা রিএজেন্টকে কখনও সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত না করে পিসিআর প্রস্তুতি কক্ষে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়।
↑Saiki RK, Scharf S, Faloona F, Mullis KB, Horn GT, Erlich HA, Arnheim N (ডিসেম্বর ১৯৮৫)। "Enzymatic amplification of beta-globin genomic sequences and restriction site analysis for diagnosis of sickle cell anemia"। Science। 230 (4732): 1350–54। ডিওআই:10.1126/science.2999980। পিএমআইডি2999980। বিবকোড:1985Sci...230.1350S।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
↑Saiki RK, Gelfand DH, Stoffel S, Scharf SJ, Higuchi R, Horn GT, ও অন্যান্য (জানুয়ারি ১৯৮৮)। "Primer-directed enzymatic amplification of DNA with a thermostable DNA polymerase"। Science। 239 (4839): 487–91। ডিওআই:10.1126/science.239.4839.487। পিএমআইডি2448875। বিবকোড:1988Sci...239..487S।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)