নৃত্য শব্দটি সাধারণত শারীরিক নড়াচড়ার প্রকাশভঙ্গীকে বোঝায়। এ প্রকাশভঙ্গী সামাজিক, ধর্মীয় কিংবা মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রে দেখা যায়। গীতবাদ্যের ছন্দে অঙ্গভঙ্গির দ্বারা মঞ্চে চিত্রকল্প উপস্থাপনের ললিত কলাই নৃত্য বা নাচ।[১]
নৃত্যকলার সংজ্ঞা নির্ভর করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নন্দনতত্ত্বিক, শৈল্পিক এবং নৈতিক বিষয়ের উপর। এই আন্দোলনের নান্দনিক এবং প্রতীকী মূল্য আছে।[২] নৃত্যকে বিভিন্নভাবে শ্রেনীবিভাগ করা যায়। কোরিওগ্রাফি, আন্দোলনের ধরন, ঐতিহাসিক সময়কাল বা উৎপত্তিস্থল উল্লেখযোগ্য। যদিও থিয়েটার ও সামাজিক নৃত্যকে সবসময় আলাদা শ্রেণীতে ভাগ করা হয় না, তবুও এর উদ্দেশ্যে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে।
পরিবেশনা এবং অংশগ্রহণ
মঞ্চে পরিবেশিত নৃত্য-এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রদর্শনী, একে সঙ্গীতানুষ্ঠানের নৃত্যও বলা যায়। এই নৃত্য সাধারণতঃ গুণী শিল্পীদের মঞ্চে মঞ্চ পরিবেশনার মাধ্যমে মঞ্চস্থ হয়। এই নাচগুলোতে বেশীরভাগ সময়েই কোন না কোন গল্প বলা হয়। আর এই গল্পগুলি বলা হয় মুকাভিনয়, পোশাক ও দৃশ্যপটের সাহায্যে, কখনো কেবল সঙ্গীতের মাধ্যমে এই নৃত্যগুলি পরিবেশন করা হয়। এই সঙ্গীত বিশেষভাবে কেবল মঞ্চে নাচ পরিবেশনের জন্য তৈরী ও পরিবেশন করা হয়, যদিও এই গানের বিষয়টি কোন বাধ্যতামূলক কিছু নয়। পশ্চিমা ব্যালে ও আধুনিক নৃত্য, ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য যেমন, ভরতনাট্যম, চীন ও জাপানের গান এবং নৃত্যনাট্য যেমন ড্রাগন নৃত্য এই ধরনের সঙ্গীতের সাথে নাচের উদাহরণ। বেশীরভাগ শাস্ত্রীয নৃত্য কেবল নাচের জন্য হলেও পরিবেশনার জন্য নৃত্য অপেরা এবং অন্যান্য সঙ্গীতপ্রধান নাট্যে পরিবেশিত হয়।
নৃত্যকলার ইতিহাস
প্রাচীন মানুষের ছেড়ে যাওয়া বিভিন্ন বস্তু নিদর্শনের মতো নৃত্যকলার তেমন কোন বস্তু না পাওয়া গেলেও নৃত্যকলা প্রাচীন মানবের বিভিন্ন আচার উৎসবে নৃত্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে প্রগৈতিহাসিক কালে নৃত্যকলার প্রমাণ পাওয়া যায়। খৃষ্টপূর্ব ৩৩০০ সালে মিশরীয় দেয়াল চিত্রে এবং ভারতের গুহা চিত্রে নৃত্যকলার ভঙ্গী উৎকীর্ণ রয়েছে। দেয়ালচিত্রে খোদিত ভঙ্গীগুলো হতে মনে হয় যে কিংবদন্তির কাহিনী পরিবেশনের জন্যই ঔ চিত্রগুলো উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে লিখিত বর্ণমালা প্রচলনের আগে নৃত্যকলার এই পদ্ধতির মাধ্যমেই এই সব গল্প বংশ পরম্পরায় চলে আসতো।[৩]
নৃতকলার আরো একটি প্রাচীন প্রকাশ দেখা যায় অতীন্দ্রিয় চেতনায় বিভিন্ন কু-প্রভাব হতে মুক্ত করার আচার অনুষ্ঠানে। আজো নৃত্যকলার এই ব্যবহার ব্রাজিলীয়চিরহরিৎ বনাঞ্চলের সংস্কৃতি হতে কালাহারি মরুভুমির সংস্কৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত।[৪]
সঙ্গীত
সাধারণতঃ নৃত্য পরিবেশিত হয় সঙ্গীত সহযোগে, যদিও এমনটাই একচেটিয়া কোন নিয়ম নয়। তাছাড়া সঙ্গীতের সাথেই একই সময়ে নৃত্য পরিবেশিত নাও হতে পারে। কিছু নাচ,সঙ্গীতের সাথে অতিরিক্ত হিসেবে তার নিজের শ্রবণযোগ্য শব্দ যোগ করে নাচের সময়(যেমন ট্যাপ ড্যান্স বা ট্যাপ নৃত্য)। নৃত্যের পূর্বের ধরনগুলোতে নৃত্য ও সঙ্গীত একটি আরেকটির পরিপূরক হিসেবে তৈরী হয়েছিল এবং নিয়মিত পরিবেশিত হত। এই ধরনের সঙ্গীত ও নৃত্যের সম্মিলনে নাচের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো জিগ, ওয়াল্টয, ট্যাংগো, ডিসকো ও সালসা। কিছু সঙ্গীত ঘরাণার আবার সমান্তরাল নৃত্যশৈলী আছে, যেমন বারোকী সঙ্গীত ও বারোকী নৃত্য। অন্য ধরনগুলোর কিছু বৈশিষ্ট্য এক থাকলেও আলাদাভাবে সঙ্গীত ও নৃত্যধারা বিকশিত হয়েছে,শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও শাস্ত্রীয় ব্যালে নাচের কথা এক্ষেত্রে বলা যায়। নৃত্যবিন্যাস ও নাচের গান যেন একে অন্যের সহচর, যা নৃত্য নির্দেশক ও নৃত্যশিল্পীরা তাদের নাচের মধ্যের গল্প বা কাহিনী বলার জন্য একসাথে মিলিয়ে পরিবেশন করেন।
ছন্দ
ছন্দ ও নৃত্য গভীরভাবে এক অন্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত, ঐতিহাসিকভাবে এবং প্রচলিত অর্থে। যুক্তরাষ্ট্রের নৃত্যশিল্পী টেড শন লিখেছেন “ছন্দের ধারণা, নৃত্যের সকল পাঠের সাথে মিশে আছেে এমনভাবে যে এই বিষয়ে অনন্তকাল কথা বললেও তা শেষ হবে না।” একটি সঙ্গীতের ছন্দের দুটি প্রধাণ উপকরণ থাকে, প্রথমটি হলো একটি নিয়মিতভাবে পুনরাবৃত্ত স্পন্দন (যাকে তাল বা টাকরাও বলা হয়), যে স্পন্দন গানের লয় বা গতি ঠিক করে দেয়। অপরটি হলো বিরতি ও শব্দাংশের একটি নির্দিষ্ট নমুনা,যা মৌলিক ছন্দের দৈর্ঘ্য ঠিক করে দেয়। সাধারণতঃ মূল ছন্দ সব সময় সমান দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট সহজ প্রকৃতির হয়ে থাকে। নৃত্যশিল্পীদের সাধারণতঃ গতি ও ছন্দের একটি নির্দিষ্ট ধরন থাকে। উদাহরণস্বরুপ ট্যাংগোর কথা বলা যায়, যেখানে প্রতি মিনিটি মোটামুটিভাবে ৬৬ তালের ৪ ভাগের ২ ভাগ ছন্দের আবর্তনে নাচতে হয়। মৌলিক ধীর পদক্ষেপ, যাকে ‘ধীর’ বলা হয়, তা এক আবর্তন পর্যন্ত স্থায়ী হয়, যার অর্থ হচ্ছে একটি পুরো বাম থেকে ডান পর্যন্ত পদক্ষেপ একটি ছন্দের ৪ ভাগের ২ ভাগ দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে। নাচটির মৌলিক আরেকটি পায়ের কাজ সামনে ও পেছনে চলা একইভাবে “ধীর-ধীর” ছন্দে গণণা করা হয়, যেখানে অনেক অতিরিক্ত হাতের বা পায়ের কাজকে “ধীর-দ্রুত-দ্রুত” ছন্দে গণনা করা হয়। বারবার পুনরাবৃত্ত শারিরীক আন্দোলন প্রায়ই ‘শক্তিশালী’ ও ‘দুর্বল’ পৌরুষচিত নড়াচরার সাথে তুলনীয়, ঠিক যেমন সঙ্গীতের ছন্দকে সবল ও দুর্বল তাল দিয়ে বোঝানো যায়। এটা খুবই প্রাকৃতিক যে, অনেক নাচ ও সঙ্গীতের তালের দৈর্ঘ্য দুই বা চার মাত্রার হয়। এটা অনেকটা মানুষের শরীরের দ্বি প্রতিসাম্যতার মত, যেমন ডান-বাম, সম্মুখ-পশ্চাৎ ও উত্থান-পতন। কিছু নৃত্যের ছন্দ আবার সাধারণভাবেই তিন মাত্রার ছন্দে পড়ে। যেখানে কোন কোন মুদ্রার প্রকাশে অন্য ছন্দের মাত্রার তুলনায় বেশী সময়েরর মাত্রার প্রয়োজন হয়, যেমন একটি হাতুড়ীকে তোলার জন্য হাতুড়ীটি দিয়ে আঘাত তরার চেয়ে বেশী সময় প্রয়োজন। ক্ষেত্রবিশেষে, ঐতিহ্যগতভাবেই জটিল ছন্দের নৃত্যশৈলী দেখা যায়, যেমনটা আমরা দেখি বলকান অঞ্চলের লোক নৃত্যের বেলায়। জটিল মুদ্রা ও তাল বিশিষ্ট নৃত্যের জন্য সর্ব সময় নির্দিষ্ট সুর ও কথার সমন্বয়ে নির্দিষ্ট ক্রমের শারিরীক আন্দোলন ও পদচালনার মিশ্রণে নৃত্যটি নির্মাণ করা হয়। নাচের মুদ্রা, পদসঞ্চালন ছন্দোময় তালের প্রাথমিক কাঠামো তৈরী করে, যেটা যেকোন নেপথ্য সঙ্গীতের তৈরী করার শক্তি নেই। সঙ্গীতের মত নৃত্যেরও সময়কে বেধে রাখার ক্ষমতা প্রয়োজন হয়, দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য। হাঁটা, খনন করা, কিছু টেনে নিয়ে যাওয়া এই সকল বিষয়ের পরিবেশনের পরিশীলিত রূপ নৃত্যের মান তৈরী করে। এই সকল কাজের সঠিক পুনরাবৃত্ত প্রধান উপস্থাপনের চেয়ে নান্দনিক প্রকাশ নাচের জন্য জরুরী। একদম প্রথমদিকের নৃত্যগুলোর মধ্যেই সঙ্গীতের সহযোগ নাচের সাথে দেখা যায়। প্রাচীন মিশরীযরা দেবতা এ্যাথোটাসের থেকে নৃত্যের উৎসকে সম্পর্কিত করে। বলা হয়ে থাকে যে, এই দেবতা ধর্মীয় রীতি পালনের সময় গানের সাথে উপাসকদের ছন্দোবদ্ধ নড়াচড়ার বিষয়টি লক্ষ্য করেন। এই নড়াচড়ার বিষয়টি আবার নির্দিষ্ট অনুপাতে হয়ে থাকে। নৃত্য যে, সঙ্গীতের ছন্দের থেকে উৎপন্ন হয়েছে, এই ধারণা এখনো ইউরোপীয় রেনেসায় মনে করা হয়। নৃত্য গুরু গুইগিয়েলমো এবরিও ডা পেসারো এর কাজে তা দেখা যায়। পেসারো বলেন যে, নৃত্য একটি শারিরীক আন্দোলনের প্রকাশ, যা কাঠামো তৈরী করে, আন্দেলিত শরীরের সাথে পরিবর্তনশীল মানসিক অবস্থার প্রকাশ করে। সঙ্গীতের সাথে শারিরীক আন্দোলন ও আত্মিক পরিবর্তনের পরিমাপ একটি নিখুত সম্মিলন হিসেবে শ্রোতার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে।
পন্থা
থিয়েটার
সঙ্গীতানুষ্ঠানের নৃত্য, যেমন অপেরায়, সাধারণত বড় আয়োজনের নৃত্য হয়। কারণ অপেরার বর্ণণামূলক নাটকীয় ধরন, যার জন্য বৃহত পরিসরের নাচের প্রয়োজন পড়ে। এই ধরনের নৃত্যের মুদ্রা ও অঙ্গভঙ্গি গুলো অপেরার চরিত্রগুলোর নিজস্বতা ও ব্যক্তিত্বকে অনুসরণ করে এবং চরিত্রগুলোর কাহিনীতে যে ভূমিকা বা গুরুত্ব আছে সেই অনুযায়ী নৃত্যের মু্দ্রা হয়ে থাকে। অপেরার নৃত্যের দীর্ঘ ও অপেক্ষাকৃত ব্যাকরণ মুক্ত মুদ্রার কারণ অপেরার চরিত্র অনুযায়ী নৃত্যের উপস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা। অপরদিকে যে সকল নৃত্যের এই ধরনের বর্ণনাত্মক চরিত্রকে তুলে ধরতে হয় না, তাদের নৃত্যের মুদ্রা অপেক্ষাকৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী হয়ে থাকে। আবার যে ছন্দোবদ্ধ বিরতিযুক্ত যে ব্যালে নাচের বিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটেছে ১৯ শতক জুড়ে, ২০ শতকে সেই নাচ পরিণত হয়েছে সম্পূর্ণ কাহিনী বিবর্জিত পরিবেশনায়। যার ফলে সম্ভব হয়েছে ব্যালে নৃত্যে দ্রুত ছন্দের পদচালনার অন্তর্ভুক্তি ঘটানো, যার খুব পরিচিত একটি উদাহরণ ‘দি সিগনেট নৃত্য’ যা ‘সোয়ান লেক” এর দ্বিতীয় অঙ্কে দেখা যায়।
সকল ভারতীয় নৃত্য জন্ম নিয়েছে নাট্যশাস্ত্র থেকে। যারফলে প্রত্যেকেরই একরকম সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন হাতের ভঙ্গিতে (মৃুদ্রা), আঙ্গিক অবস্থানে, পদ সঞ্চালনে এবং নাটকীয় মুখভঙ্গিতে যাকে অভিনয় বলা হয়। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সহযোগে নৃত্যগুলি পরিবেশিত হয়, প্রায় সকল নৃত্যশৈলীর শিল্পীরা পায়ের গোড়ালীর চারপাশে ঘন্টা বাধেন, এই ঘন্টাগুলোর সংঘর্ষে যে শব্দ হয় তার মাধ্যমে সঙ্গীতের বিপরীতে নৃত্য শিল্পী উত্তর দেন।
আজকাল ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের অনেকগুলো আঞ্চলিক ধরন দেখা যায়।“অদরা মাগাধী” নৃত্যটি দীর্ঘদিনের বিতর্কের পর বর্তমান সময়ের ওড়িশ্যা,মিথিলার আঞ্চলিক নৃত্য ওডিসি(ওড়িশি)র সাথে সম্পর্কিত বলা হচ্ছে। এই ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল, যা নৃত্যের প্রভাবে হয়েছে।
ভাংরা নাচের এলাকা হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত পাঞ্জাব। এটি একই সাথে নৃত্য ও সঙ্গীতের ধরন বলে পরিচিত। এটা প্রাচীন ফসল উৎপাদনের উৎসবের সাথে সম্পর্কিত। ভাংরায় এর সাথে আরও দেখা যায় প্রেম, দেশপ্রেম অথবা সামাজিক ঘটনার উপস্থিতি। ঢোল নামের একটি বাদ্যযন্ত্র ভাংরায় ব্যবহুত হয়।
শ্রীলংকার নৃত্যের মধ্যে রয়েছে শয়তান নৃত্য। এই নাচের শিকড় অনেককাল আগের শ্রীলংকান প্রাক বৌদ্ধ সময়কালে। সতর্কতার সাথে এই নৃত্যে ধর্মীয় রীতির পালন করা হয়।
ইন্দোনেশিয়ার নৃত্য ইন্দোনেশিয়ার সমৃদ্ধ নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও বৈচিত্রময়তা তুলে ধরে। ইন্দোনেশিয়ায় ১৩০০ এরও বেশি নৃগোষ্ঠী আছে। এ্যাষ্ট্রোনেশিয়ান ও মেলানিসিয়ান জনগোষ্ঠী হতে এই সংস্কৃতি জন্ম নিয়েছে।
আফ্রিকা
আফ্রিকায় নৃত্য সমাজ ও গোষ্ঠীগুলোর বড় বড় ঘটনার সাথে মিশে আছে। প্রায়ই নৃত্যের মাধ্যমে গোষ্ঠী ও সমাজ তাদের সামাজিক উৎসবের প্রকাশ করে থাকে।
কারো জন্ম হলে নৃত্য পরিবেশিত হয়, কেউ মৃত্যুবরণ করলেও তা নৃত্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যুদ্ধের জন্য নৃত্য আছে, আছে বিয়ের নাচও। ঐতিহ্যবাহী নাচগুলোতে সাংস্কৃতিক নীতির প্রকাশ পায়। এরমধ্যে থাকে ধর্মীয় রীতিনীতি ও যৌনতার মানদন্ড। অবদমিত আবেগকে এই নৃত্যের মাধ্যমে মুক্তভাবে প্রকাশ করা হয়, যেমন শোক। সমাজ বা গোষ্ঠীর সদস্যদের পারস্পারিক সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য উদীপ্ত করে এই সকল নৃত্য। অন্যদিকে লড়াই অথবা শস্য মাড়াই জাতীয় নাচের মাধ্যমে ঐশ্বরিক বা ধর্মীয় আচারকে প্রতিষ্ঠিত করা হয় যাতে করে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়।
মহাদেশ জুড়ে প্রচুর ভিন্ন ভিন্ন নৃত্য পরিবেশন করা হয়ে থাকে। এই নাচগুলোকে ঐতিহ্যবাহী, নব্য চর্চাকৃত ঐতিহ্য এবং শাস্ত্রীয় নৃত্য হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করা যায়।
শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে আছে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর লোক নৃত্য, ঐতিহ্যবাহী নৃত্য শৈলীর অনুকরণে সাম্প্রতিককালে সৃষ্ট নৃত্যধারা এবং বিদ্যালয় বা ব্যক্তিগতভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অধিক বিধিবদ্ধ নৃত্য। আফ্রিকান নৃত্যশৈলী নানাভাবে বাইরের বিভিন্ন প্রভাবক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ইউরোপীয় ধর্মপ্রচারক ও ঔপনিবেশিক সরকারের কথা এক্ষেত্রে বলা যায়। যাদের কাছে স্থানীয় নৃত্য যৌনানুভূতিপূর্ন অভব্য ধরনের অথবা মনোযোগ বিক্ষেপণকারী বলে মনে হত। যার ফলে তারা স্থানীয় নৃত্যকে নানাভাবে দমিয়ে রাখতে চাইতো। সমসাময়িক আফ্রিকান সংস্কৃতিতে নৃত্য এখনো তার ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, তবে নতুন অবয়বে। নৃত্য এখন পরিবেশিত হয় হাসপাতালের উদ্বোধনে, গ্রামীন জনগোষ্ঠীর নতুন অপরিচিত শহরে অভিবাসনের পর বা খিষ্ট্রীয়ান উপাসনালয়ের উৎসবে।
ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা
অঞ্চলভেদে ইউরোপে লোকনৃত্যের ধরনে ভিন্নতা দেখা যায়। কিছু কিছু লোকনৃত্য শত বছর কিংবা হাজার বছরেরও পুরোনো। যদিও এগুলোর মধ্যে সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, যেমন ক্যারলস নৃত্যে একজন আহ্বানকারীর নেতৃত্বে দলগত অংশগ্রহণের ব্যপারটি। যেখানে পরস্পর হাত ধরাধরি তরে অথবা বাহুর সাথে বাহু যুক্ত করে নির্দিষ্ট সঙ্গীতের ধরনের সাথে নৃত্য থাকে। কিছু নৃত্য , যেমন মেপোল, অনেক জাতীর মধ্যে প্রচলিত। আবার পোলকা বা সেলিধ নৃত্য কোন একটি নির্দিষ্ট জাতী বা সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে প্রোথিত। স্কয়ার নৃত্যের মত কিছু ইউরোপিয়ান নৃত্য নতুন বিশ্বের নিকট পরিচিত হয়ে ওঠার সাথে সাথেই যুক্তরাষ্ট্রর সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে।
প্রথমে ইতালী ও তার পরে ফ্রান্সে ব্যালে নাচের প্রসার ঘটে। অভিজাত শ্রেনীর দর্শকদের জন্য সঙ্গীত, কাব্য, নাট্য, গান, পোশাক ও নৃত্যের সমন্বয়ে ব্যালে পরিবেশিত হত। রাজসভার অভিজাত ব্যক্তিরা পরিবেশনায় অংশ নিতেন। চতুর্দশ লুই ছিলেন একজন নর্তক। তার রাজত্বকালে নৃত্য বিধিবদ্ধ নিয়মে আসতে শুরু করে। আনাড়ী অভিজাতদের পরিবর্তে পেশাদার নৃত্যশিল্পীরা পরিবেশনায অংশ নিতে থাকেন। ব্যালে শিক্ষকদের ফ্রান্স সরকার দ্বারা অনুমোদন প্রদান করা শুরু হয়।
১৬৬১ সালে প্যারিসে প্রথম ব্যালে নৃত্য শেখার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে। যার নাম ছিল আকাদেমী রয়্যাল দে দানস ( রাজকীয় নৃত্যচর্চা কেন্দ্র)। এই কেন্দ্র হতে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যালে নাচের দল গঠন করা হয়। এই দল কোন নারী নৃত্য শিল্পী ছিলো না। নারী নৃত্যশিল্পী অন্তর্ভুক্ত শুরু হয় ১৬৮১ সালে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মঞ্চে পরিবেশিত নৃত্য শৈলীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে, তুলনামূলক ব্যাকরণমুক্ত নৃত্য পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য উদ্ভাবনের মাধ্যমে। আধুনিক নৃত্য বলতে আমরা যা বুঝি, তারশুরুর দিকের পথপ্রদর্শকরা ছিলের লোয়ী ফুলার, ইসাডোরা ডানকান, ম্যারী উইগম্যান ও রুথ সেইন্ট ডেনিস। এমিল জাকোইস-ডালক্রোজ এমন যন্ত্র তৈরী করেন যেটা সঙ্গীতের সাথে নৃত্যের সম্পর্ককে শিক্ষার্থীদের নিকট সহজভাবে বোধগম্য করে তুলতে পারে। এর নাম হচ্ছে ইয়োরহিথমিকস। এই যন্ত্র আধুনিক নৃত্য ও আধুনিক ব্যালে নৃত্যের প্রসারের জন্য ম্যারী রামবার্ট ও এ ধরনের শিল্পীদের জন্য এক প্রেরণাময় ব্যাপার ছিলো। রুডলফ ষ্টেইনার ও মেরী ষ্টেইনার-ভন সেভার্স ইউরিদমীর পরিবর্ধন করেন, পূর্বের প্রচলিত কেতাবী উপাদানের সাথে মুক্ত প্রকৃতির ধারার মিশ্রণে নৃত্যের পরিবর্তন আনেন। সেইসাথে নৃত্যের নতুন জটিল পরিভাষার প্রচলন ঘটান। ১৯২০ এর দশকে নতুন ধারা ব্যালের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবক যেমন মার্থা গ্রাহাম ও ডরিস হামফ্রে তাদের কাজ শুরু করেন। এই সময় হতে এক বিস্তৃত ও বৈচিত্রময় নৃত্যশৈলীর বিবর্ধন শুরু হয়। আধুনিক নৃত্য, আফ্রিকান আমেরিকান নৃত্য প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠতে শুরু করে, নৃত্য ষ্টুডিও, পেশাদার নৃত্যদল বা নৃত্য শিক্ষা কেন্দ্রগুলির বাইরে নৃত্য হয়ে ওঠে জীবনাচারের অংশ। ট্যাপ নৃত্য, জ্যজ, সুইং নৃত্য, হিপ-হপ, লিন্ডি হপ, ডিসকো প্রভৃতি নৃত্যগুলির রক-এন-রোল ধারার সঙ্গীতের সাথে মিশ্রণের কারণে রক-এন-রোল নৃত্য পুরো বিশ্বে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। একবিশ্ব শতকে আভির্ভাব হয় হিপলেট নৃত্যের। যেখানে শাস্ত্রীয় ব্যালের নৃত্য পদ্ধতি আফ্রকান-আমেরিকান নৃত্যের সাথে মিলে নতুন নৃত্যধারার সূচনা করে।
লাতিন আমেরিকা
লাতিন আমেরিকার সামাজিক জীবন ও সংস্কৃতিতে নৃত্য একটি কেন্দ্রীয স্থান নিয়ে আছে। ব্রাজিলের সাম্ভা, আর্হেন্টিনার ট্যাঙ্গো, কিউবার সালসা সারা দুনিয়ায় জনপ্রিয় যুগল নৃত্য। অন্যান্য জাতীয় নৃত্যগুলিও তাদের দেশের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই নৃত্যগুলির মধ্যে আছে মেরেনগি, চুকা, জারাবি, জোরোপো, মারিনেরা, কাম্বিয়া, বাছাতা ও আরও কিছু নৃত্য। ঐতিহ্যবাহী উৎসব উদযাপনে এইনব নৃত্যগুলির সংমিশ্রণে উৎসবের আনএন্দর মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।
লাতিন আমেরিকার অনেক নৃগোষ্ঠী ও আদিবাসী সংস্কৃতির সমষ্টিগত পরিচিতি বিনির্মাণে নৃত্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই অঞ্চলের অনেক আফ্রিকান, ইউরোপীয়ান ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংহতি তৈরীতে নৃত্য ভূমিকা রাখে। লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে নির্দিষ্ট ধারার নৃত্য শৈলী যেমন ক্যাপোইরা, এবং নির্দিষ্ট শারিরীক মুদ্রা যেমন কিউব্রাডাস বা শরীরের নিম্নাংশের আন্দোলন বিভিন্ন সময় নিষিদ্ধ হয়েছে আবার উদযাপিতও হয়েছে।
শিক্ষা
নৃত্যকলা বিষয়ে অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কলা ও মানবিক বিষয়ক শিক্ষাক্রমের অধীনে পড়ার সুযোগ আছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নৃত্যকলা বিভাগে স্নাতক হওয়ার এবং আরও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেয়। নৃত্য বিষয়ে শিক্ষাক্রম বৈচিত্রময় ও বিশাল পরিসরে বিষয় ও পাঠ্যবস্তু নিয়ে তৈরী হয়। এই সকল বিষয়ের মধ্যে যেমন থাকে নৃত্য পরিবেশনা, নৃত্য নির্দেশনা, নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব নৃত্যধারা তেমনি আরও থাকে নৃত্য ও শরীরের সম্পর্ক বিষয়ক জ্ঞান, নৃত্যের গঠন ও নৃত্য ব্যবহার করে চিকিৎসা পদ্ধতি বিষয়ক পাঠক্রম। পাঠ বুঝতে সমস্যা হয় এ ধরনের শিশুদের, আচরণগত/আবেগগত সমস্যা সম্পন্ন শিশুদের এবং মনোযোগ প্রদানে মারাত্মক সমস্যা সম্পন্ন শিশুদের গণিতের পাঠ বোঝাতে নৃত্যের সাহায্যে শরীরকে ব্যবহার করার বিষয়টি খুব সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে। এমনকি ক্যান্সার রোগীদের জন্য নৃত্য থেরাপি বর্তমানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নৃত্য বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের জন্য বাংলাদেশ, ভারত, জার্মানি সহ বিশ্বের অনেক দেশে নৃত্যবিভাগ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।
পেশা
নৃত্যশিল্পী
পেশাদার নৃত্যশিল্পীরা সাধারণতঃ চুক্তিভিত্তিক কাজ করে থাকেন। এই চুক্তি নির্দিষ্ট প্রযোজনার জন্যও হতে পারে আবার নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী হতে পারে। পেশাদার নৃত্যশিল্পীদের জীবন মূলত ক্রমাগত পরিবর্তনশীল কার্যপরিবেশের সমষ্টি । যে জীবনে আছে তীব্র প্রতিযোগিতারে চাপ আর নিম্ন পারিশ্রমিক । সঙ্গতকারণে পেশাদার নৃত্যশিল্পীদের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করতে হয়। যুক্তরাস্ট্রে অনেক পেশাদার নৃত্যশিল্পী বিভিন্ন শ্রম সংগঠনের সাথে যুক্ত(যেমন আমেরিকান গিল্ড অব মিউজিক্যাল আর্টিষ্ট, স্ক্রীণ আ্যক্টরস গিল্ড ও আ্যকটরস ইকুয়িটি এসোসিয়েশন)। এই শ্রম সংগঠনগুলো সদস্যদের কাজের নিরাপদ পরিবেশ ও ন্যুনতম মজুরীর নিশ্চয়তা প্রদান করে। পেশাদার নৃত্যশিল্পীদের শারিরীকভাবে সুঠাম ও সবল হতে হয়। সফল ক্যারিয়ারের জন্য নৃত্য শিল্পীদের বিভিন্ন নৃত্যশৈলীতে পারদর্শী হতে হয়। সেই সাথে থাকতে হয় কারিগরী বিষয়ের উপরে ভালো ধারণা। বিভিন্ন শারিরীক কসরতের উপরে প্রশিক্ষণ থাকাটাও জরুরী, যাতে করে স্বাস্থ্যবান ও শারিরীকভাবে যোগ্য থাকা যায়।
শিক্ষক
নৃত্য নির্দেশক
নৃত্য নির্দেশক হলেন সেই ব্যক্তি যিনি একটি নৃত্যের মধ্যে কি ধরনের নৃত্য হাতের ও পায়ের কাজের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হবে , তা নির্ধারণ করেন। বেশিরভাগ নৃত্য নির্দেশক বিশ্ববিদ্যালয় বা এধরনের অন্য প্রতিষ্ঠান হতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সাধারণত নৃত্য নির্দেশকরা নির্দিষ্ট কোন প্রকল্পের জন্য নিয়োগ পেয়ে থাকেন। তবে এমনও দেখা যায় যে, কোন কোন নৃত্য নির্দেশক পেশাদার নৃত্য দলের সাথে সার্বক্ষণিক নৃত্য নির্দেশক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করেন।
প্রতিযোগিতা
নৃত্য প্রতিযোগিতায় বা একাধিক বিচারকের সামনে প্রতিযোগিরা নৃত্য পরিবেশন করেন। এধরনের প্রতিযোগিতায় সাধারণত পুরস্কার দেওয়া হয়, কখনো আর্থিক পুরস্কারও থাকে। বেশ কিছু বড় পরিসরের নৃত্য প্রতিযোগিতা আছে। এ প্রতিযোগিতাগুলোকে সাধারণত নৃত্যের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পরিবেশনা করার প্রকৃতি দিয়ে আলাদা করে চেনা যায়। বড় নৃত্য প্রতিযোগিতাগুলোর মধ্যে নিচের প্রতিযোগিতাগুলোর কথা বলা যায় -
ড্যান্সস্পোর্ট , বিশেষভাবে বলরুম ও লাতিন নৃত্যের উপরে নজর দেয়।
প্রতিযোগিতামূলক নৃত্য,মিলনায়তনে প্রদর্শন উপযোগী নৃত্যের প্রতিযোগিতা, যেখানে সচরাচরএক্রো, ব্যালে, জ্যাজ, হিপ-হপ, লিরিক্যাল, ট্যাপ প্রভৃতি নৃত্য প্রদর্শন করতে হয়।
একক ধরনের নৃত্য প্রতিযোগিতা, যেমন হাইল্যান্ড নৃত্য, দলীয় নৃত্য এবং আইরিশ নৃত্য, যেখানে কেবল একটি নৃত্যশৈলী দেখানো যায়।
উন্মুক্ত নৃত্য প্রতিযোগিতা, যেকোন ধরনের নৃত্যের প্রতিযোগিতা, এই ধরনের উদাহরণ টেলিভিশন অনুষ্ঠান সুতরাং তুমি মনে কর যে তুমি নাচতে পারো (সো ইউ থিংক ইউ ক্যান ড্যান্স)
অলিম্পিক, নৃত্য অলিম্পিক ক্রীড়া হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে ১৯৩০ সাল হতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এর বাইরে অগুণতি নৃত্য প্রতিযোগিতা আছে যেগুলো টেলিভিশন ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে প্রচইরত হচ্ছে।
গ্যালারি
ফোক ড্যান্স
তথ্যসূত্র
উইকিমিডিয়া কমন্সে নৃত্য সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে।
↑Nathalie Comte. "Europe, 1450 to 1789: Encyclopedia of the Early Modern World". Ed. Jonathan Dewald. Vol. 2. New York: Charles Scribner's Sons, 2004. p94-108.
↑Guenther, Mathias Georg. 'The San Trance Dance: Ritual and Revitalization Among the Farm Bushmen of the Ghanzi District, Republic of Botswana.' Journal, South West Africa Scientific Society, v30, 1975-76.