নিউ হ্যাভেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেটিকাট অঙ্গরাজ্যের একটি উপকূলীয় শহর। লং আইল্যান্ড সাউন্ডের (আটলান্টিক মহাসাগরের জোয়ারের ফলে সৃষ্ট বিশেষ নদীমুখ) উত্তরে, নিউ হ্যাভেন পোতাশ্রয়ে শহরটির অবস্থান। এটি নিউ ইয়র্ক মেট্রোপলিটন এলাকার অংশ। ২০১০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী নিউ হ্যাভেনের জনসংখ্যা ১,২৯,৭৭৯। [১] জনসংখ্যায় নিউ হ্যাভেন কানেটিকাটের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর।
নিউ হ্যাভেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পরিকল্পিত শহর। [২] ১৬৩৮ সালে ইংরেজ সংস্কারপন্থীরা এ শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন। চার বনাম চার গ্রিডে নিউ হ্যাভেনের আটটি সড়কের নকশা করা হয়। এ নগর-পরিকল্পনা "নয় সরণি পরিকল্পনা"(Nine square plan) নামে পরিচিত। নিউ হ্যাভেনের কেন্দ্রস্থলে নিউ হ্যাভেন গ্রিন নামে একটি সরণি অবস্থিত, যার আয়তন ১৬ একর। "নিউ হ্যাভেন গ্রিন" গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। [৩]
নিউ হ্যাভেন শহরে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়টি শহরের সর্বোচ্চ করদাতা। এছাড়াও এখানে নিউ হ্যাভেন শহরের সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ কাজ করে।[৪] শহরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
১৭০১ থেকে ১৮৭৩ পর্যন্ত নিউ হ্যাভেন ও হার্টফোর্ড কানেটিকাটের সহ-রাজধানী ছিল। ১৮৭৩ সালে রাজ্য সরকারের সম্পূর্ণ কার্যক্রম হার্টফোর্ড শহরে স্থানান্তরিত হয়। তখন থেকেই নিউ হ্যাভেনের নতুন পরিচয় হয়ে ওঠেছে "কানেটিকাটের সাংস্কৃতিক রাজধানী।"[৫] আমেরিকার প্রথম সরকারি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি এ শহরেই গৃহীত হয়। এজন্য নিউ হ্যাভেনের অপর নাম "এলম গাছের শহর।"[৬]
ইতিহাস
ইউরোপীয়দের আগমনের পূর্বে কুইনিপিয়াক গোত্রের মানুষ এখানে বসবাস করত। ১৬১৪ সালে ডাচ অভিযাত্রী আদ্রিয়ান ব্লক এখানে পৌঁছান। ডাচরা আদিবাসী আমেরিকানদের সাথে বিভারের (লোমশ দাঁতওয়ালা মাংসাশী প্রাণী) চামড়া বিক্রির ব্যবসা করে। কিন্তু ডাচরা এখানে কোনো স্থায়ী বসতি স্থাপন করেনি।
১৬৩৭ সালে একদল সংস্কারপন্থী সম্পূর্ণ নিউ হ্যাভেন এলাকা নিরীক্ষা করেন। ১৬৩৮ সালে পাঁচশ সংস্কারপন্থী ম্যাসাচুসেটস বে উপনিবেশ ছেড়ে চলে আসেন। রেভারেন্ড জন ড্যাভেনপোর্ট ও লন্ডনের ব্যবসায়ী থিওফিলাস ইটনের নেতৃত্বে তারা এ বন্দরে এসে পৌঁছান। তাঁরা ধর্মতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি বন্দর হিসেবে এর অমিত সম্ভাবনার পূর্ণ ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কুইনিপিয়াকরা পেকুয়েট আদিবাসীদের সাথে যুদ্ধ করছিল। তাই নিরাপত্তার বিনিময়ে তারা সংস্কারপন্থীদের কাছে নিজেদের ভূমি বিক্রয় করে দেয়।
১৬৪০ সালে নয় সরণি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। শহরটির নাম দেওয়া হয় "হ্যাভেন" বা বন্দর। এটি নবগঠিত নিউ হ্যাভেন উপনিবেশের রাজধানী হয়। সংস্কারপন্থী ব্যতিরেকে অন্য কোন মতবাদ অনুসারী চার্চ প্রতিষ্ঠা নিউ হ্যাভেন শহরে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
১৬৪৬ সালে নিউ হ্যাভেন শহর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ইংল্যান্ডে শহরটি একটি পণ্যবোঝাই জাহাজ প্রেরণ করে। কিন্তু জাহাজটি গন্তব্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে নিউ হ্যাভেনের অর্থনৈতিক প্রগতির চাকা মন্থর হয়ে পড়ে।
১৬৬০ সালে জন ড্যাভেনপোর্টের ইচ্ছানুসারে ও এডওয়ার্ড হপকিনসের অর্থায়নে হপকিন স্কুল প্রতিষ্ঠিতত হয়।
১৬৬১ সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লস রাজা প্রথম চার্লসের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিদের শাস্তি দানের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। এদের মধ্যে দুইজন- এডওয়ার্ড হোয়ালে ও উইলিয়াম গোফে পালিয়ে নিউ হ্যাভেনে চলে আসেন। ড্যাভেনপোর্ট ওয়েস্ট রক পার্বত্য এলাকায় তাদের আত্মগোপন করে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। পরবর্তীতে আরেকজন স্বাক্ষরকারী, বিচারক জন ডিক্সওয়েল তাদের সাথে যোগ দেন।
১৬৬৪ সালে ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক চাপের মুখে নিউ ইংল্যান্ড ও কানেটিকাট একীভূত হয়। ১৭০১ সালে একে কানেটিকাটের সহ-রাজধানী করা হয়। ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত এর সহ-রাজধানী স্বীকৃতি বহাল ছিল।
১৭১৬ সালে ওল্ড সেব্রুক থেকে নিউ হ্যাভেনে কলেজিয়েট স্কুল স্থানান্তরিত হয়। ১৭১৮ সালে মাদ্রাজের প্রাক্তন গভর্নর ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়ী এলিউ ইয়েল বিশাল অংকের অনুদান প্রদান করলে এর নাম হয় "ইয়েল কলেজ।"
আমেরিকান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ডেভিড উস্টার ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ আশা করেছিলেন, কোনরূপ বিদ্রোহ ছাড়াই ব্রিটিশ সরকারের সাথে বিবাদ মীমাংসা করা সম্ভব হবে। ১৭৭৫ সালের ২৩ এপ্রিল গভর্নরস ফুট গার্ড বাহিনীর সেকেন্ড কোম্পানির সৈন্যরা ব্রিটিশ সংসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বেনেডিক্ট আর্নল্ডের নেতৃত্বে এক দল সৈন্য বারুদখানায় প্রবেশ করে নিজেদের অস্ত্রসজ্জিত করে তুলে। দিনটি আজও নিউ হ্যাভেনে "বারুদখানা দিবস"রূপে পালিত হয়। তারা এখান থেকে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের কেমব্রিজ শহরে যাত্রা করে। তদুপরি তারা জর্জ ওয়াশিংটন নিউ হ্যাভেন আগমন করলে তাকে সুরক্ষা প্রদান করে।
১৭৭৯ সালের ৫ জুলাই নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের গভর্নর উইলিয়াম ট্রায়োনের নেতৃত্বে ২,৬০০ ব্রিটিশপন্থী ব্যক্তি নিউ হ্যাভেন আক্রমণ করে। তবে ড্যানবুরি, ফেয়ারফিল্ড কিংবা নরওয়াক শহরের মতো এখানে তারা অগ্নিসংযোগ করেনি, যার ফলে অনেক ঔপনিবেশিক স্থাপনা আজও টিকে আছে।
ভূগোল
আদমশুমারি ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, নিউ হ্যাভেন শহরের আয়তন ২০.১ বর্গমাইল। এর ১৮.৭ বর্গমাইল স্থল ও ১.৪ বর্গমাইল জল।[১]
তিনটি নদী শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এগুলো হলো- ওয়েস্ট, মিল ও কুইনিপিয়াক।
জলবায়ু
নিউ হ্যাভেনের জলবায়ু গ্রীষ্মকালে উষ্ণ ও আর্দ্র এবং শীতকালে ঠাণ্ডা। বছরের ৭০ দিন দৈনিক তাপমাত্রা ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়। নিউ হ্যাভেনে একাধিকবার ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছে। এগুলো হলো- লং আইল্যান্ড এক্সপ্রেস (১৯৩৮), ক্যারল (১৯৫৪) ও গ্লোরিয়া (১৯৮৫)।
জনমিতি
২০১০ সালে নিউ হ্যাভেনের জনসংখ্যা ছিল ১,২৯,৭৭৯। এখানে ২৫,৮৫৪টি পরিবার বসবাস করে। শহরে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২,৬৪৮.৬ জন। বাসিন্দাদের ৪২.৬% শ্বেতাঙ্গ, ৩৫.৪% আফ্রিকান আমেরিকান, ০.৫% আদিবাসী আমেরিকান, ৪.৬% এশীয় ও ০.১% প্রশান্ত মহাসাগরীয়। বাসিন্দাদের ২৭.৪% হিস্পানিক অথবা লাতিনো।
শহরের পরিবারগুলোর গড় আয় ৩৫,৯৫০ ডলার। পুরুষদের গড় আয় ৩৩,৬০৫ ডলার ও নারীদের গড় আয় ২৮,৪২৪ ডলার। শহরের মাথাপিছু আয় ১৬,৩৯৩ ডলার। ২০.৫% পরিবার ও ২৪.৪% বাসিন্দা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এদের মধ্যে ৩২.২% এর বয়স ১৮ এর নিচে এবং ১৭.৯% এর বয়স ৬৫ এর সমান বা বেশি।[৭]