নাক্ষত্রিক নিউক্লিওসংশ্লেষণ হলো তারার ভেতরে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে রাসায়নিক মৌল উৎপাদনের প্রক্রিয়া। নাক্ষত্রিক নিউক্লিওসংশ্লেষণ তখন থেকে ঘটে আসছে যখন বিগ ব্যাং এর ফলে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও লিথিয়াম উৎপন্ন হয়। নাক্ষত্রিক নিউক্লিওসংশ্লেষণ তত্ত্বটি একটি ভবিষ্যদ্বাণী বিষয়ক তত্ত্ব। অর্থাৎ, আগামীতে এই তত্ত্বের সত্যতা যাচাই হবে- বিজ্ঞানীরা এরূপ মন্তব্য করে থাকেন। তত্ত্বটি কোনো মৌলের কি পরিমাণ প্রাচুর্যতা থাকবে তার নির্ভুল অনুমান নির্দেশ করে। কোনো মৌলের প্রাচুর্যতা কেনো পরিবর্তিত হয় ও কিছু মৌল ও তাদের আইসোটোপ কেন অন্যান্যদের থেকে বেশি নাক্ষত্রিক নিউক্লিওসংশ্লেষণ তত্ত্বটি তার বর্ণনা দেয়। শুরুতে তত্ত্বটি প্রস্তাব করেন ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েল ১৯৪৬ সালে যা পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালে তিনিই সংশোধন করেন। [১] এর পরে ১৯৫৭ সালে তত্ত্বটির মানোন্নয়ন করেন মার্গারেট বারবিজ, জেফ্রে বারবিজ, উইলিয়াম আলফ্রেড ফাওলার এবং ফ্রেড হয়েল। তাঁরা তাঁদের তত্ত্বটি B²FH পেপারে উল্লেখ করেন। [২] যা পরবর্তীতে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্বৃত দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।
তারাদের জীবনচক্রে তারাদের বিবর্তন ঘটে। এ বিবর্তন হয় তাদের মধ্যকার গাঠনিক উপাদানের প্রাচুর্যতার ফলে। শুরুতে হাইড্রোজেন পুড়তে থাকে, এরপরে হিলিয়াম এবং ক্রমান্বয়ে বড় মৌলসমূহ পুড়তে থাকে। যা হোক, এই প্রক্রিয়া মহাবিশ্বে অবস্থিত পদার্থসমূহের পরিমানের কোনো পরিবর্তন করে না যেহেতু উপাদানগুলো তারাদের মধ্যেই থাকে। তারা বা নক্ষত্রটির জীবনচক্রের পরবর্তী কোনো ধাপে স্বল্প ভরের তারাটি তার বায়ুমন্ডল ধীরে ধীরে তৈরি করে৷ তখন উক্ত বায়ুমন্ডল থেকে নাক্ষত্রিক বায়ু নির্গত হয় যা মূলত গ্যাসের প্রবাহ। এটির ফলে প্ল্যানেটারি নেবুলা (পিএন) বা গ্রহ নীহারিকার সৃষ্টি হয়৷ অন্যদিকে ভারী নক্ষত্র হঠাৎ করে ভর নির্গত করে এবং এই ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়াটি সুপারনোভা হিসেবে পরিচিত। সুপারনোভা নিওক্লিওসংশ্লেষণ শব্দদ্বয় ব্যবহৃত হয় ভারী নক্ষত্র বা শ্বেত বামনের মধ্যে সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় কোনো নতুন রাসায়নিক মৌল গঠন প্রক্রিয়াকে বর্ণনার জন্য।
ফুয়েল দহনের ক্রম নিয়ন্ত্রিত হয় মহাকর্ষীয় পতন (যার ফলে মহাকর্ষীয় কোনো বস্তুর সংকোচন ঘটে) ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট উত্তপ্ততা দ্বারা যার দরুন পরবর্তীতে কার্বন, অক্সিজেন ও সিলিকন পুড়তে থাকে। যা হোক, যে সব মৌলের ভরসংখ্যা ২৮-৫৬ (সিলিকন থেকে নিকেল) সেসব মৌলের নিউক্লিওসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া সংঘটিত হয় যখন কোনো নক্ষত্রের উঁচু স্তরসমূহ বাইরের দিকে ঘাত তরঙ্গ (Shock wave) নির্গত করে ভেতরের মূল স্তরের দিকে দ্রুত পতিত হয় (সুপারনোভা)। উক্ত ঘাত তরঙ্গ তাপমাত্রা মোটামুটিভাবে ৫০% তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে দেয় যার ফলে উক্ত স্থানে কয়েক সেকেন্ড ধরে ভয়ানক দহন হতে থাকে। ভারী নক্ষত্রের এই দহন নাক্ষত্রিক নিউক্লিওসংশ্লেষণের শেষ ধাপ এবং এই ধাপটিকে সুপারনোভা নিউক্লিওসংশ্লেষণ বা বিস্ফোরণ নিউক্লিওসংশ্লেষণ বলা হয়৷
জগতে পদার্থসমূহের প্রাচুর্যতার ভিন্নতার আবিষ্কার নাক্ষত্রিক নিউক্লিওসংশ্লেষণ তত্ত্বের উন্নয়নের উদ্দীপনা হিসেবে ধরা যায়৷ সৌরজগতে তুলনামূলকভাবে আইসোটোপ ও রাসায়নিক মৌল এর প্রাচুর্যতা উক্ত তত্ত্বটির বিস্তারিত বিবরণ প্রদানে ভূমিকা রাখে। কোনো মৌলের সেই প্রাচুর্যতাকে যখন পারমাণবিক সংখ্যার হিসেবে কোনো গ্রাফে স্থাপন করা হয় তখন একটি খাঁজকাটা করাতের মত আকৃতি পাওয়া যায়। তবে উক্ত গ্রাফটির উক্ত আকৃতি ১০ মিলিয়ন ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে।[৩] অর্থাৎ, কোনো ফ্যাক্টর বা রাশির পরিবর্তন হলে উক্ত গ্রাফেও পরিবর্তন দেখা দিবে। এই গ্রাফ কাগজের করা পরীক্ষাটি নাক্ষত্রিক নিউক্লিওসংশ্লেষণকে একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া হিসেবে নির্দেশ করে তবে প্রক্রিয়াটি কোনো এলোমেলো প্রক্রিয়া নয়। পরবর্তীতে ২০ শতকে নাক্ষত্রিক নিউক্লিওসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া কীভাবে সংঘটিত হয় তা জানার উদ্দেশ্যে নতুন করে গবেষণা শুরু হয়, এটি শুরু হয় তখন থেকে যখন জানা যায় যে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার ফলে নির্গত শক্তি সূর্যের দীর্ঘায়ু ও জগতের সকল আলো এবং তাপের জন্য দায়ী। [৪]