আমাদের নিজস্ব ছায়াপথ এবং অন্যান্য ছায়াপথ জুড়ে গ্যাস, প্লাজমা ও ধূলিকণার বিশাল জমাট বাঁধা অঞ্চলই মূলত নক্ষত্রমণ্ডলীয় মেঘ বা তারকাজালীয় মেঘ বা অন্তরাকাশের মেঘ (Interstellar Cloud)। অন্যভাবে বললে, তারকাজালীয় মেঘ হলো নক্ষত্রমণ্ডলের মধ্যবর্তী স্থানে (আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যম) অবস্থিত পদার্থ ও বিকিরণের অপেক্ষাকৃত ঘন অঞ্চল। আকার, ঘনত্ব ও তাপমাত্রার তারতম্যের উপর ভিত্তি করে এই মেঘের হাইড্রোজেন নিরপেক্ষ (HI অঞ্চল), আয়নিত (প্লাজমা, HII অঞ্চল), কিংবা আণবিক (আণবিক মেঘ বা ঘন মেঘ) অবস্থায় থাকতে পারে। নিরপেক্ষ ও আয়নিত মেঘকে কখনও কখনও অস্পষ্ট মেঘও বলা হয়। একটি লোহিত দানব তারকার অন্তিম জীবনকালে ছিটকে পড়া গ্যাস ও ধূলিকণা থেকেই তারকাজালীয় মেঘ গঠিত হয়।
রাসায়নিক উপাদান
নক্ষত্রমণ্ডলীয় মেঘের রাসায়নিক উপাদান নির্ধারণ করা হয় সেখান থেকে নির্গত তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। এই বিকিরণের পরিসর রেডিও তরঙ্গ থেকে শুরু করে দৃশ্যমান আলো হয়ে গামা রশ্মি পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশালাকার রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে আকাশে নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (যা অনেক অণুর অনন্য বৈশিষ্ট্য) বিকিরণের তীব্রতা স্ক্যান করা যায়। কিছু কিছু নক্ষত্রমণ্ডলীয় মেঘ তুলনামূলকভাবে শীতল হয় এবং সেগুলি সাধারণত দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ নির্গত করে। এই সমস্ত অণুর বিস্তৃতির একটি মানচিত্র তৈরি করা যেতে পারে, যা থেকে আমরা এই মেঘগুলোর বিভিন্ন রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে জানতে পারি। অপরদিকে, উত্তপ্ত মেঘের রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণের জন্য দৃশ্যমান এবং অতিবেগুনী আলোতে অবস্থিত বিভিন্ন উপাদানের তৈরি বর্ণালী (spectra) পর্যবেক্ষণ করা হয়।
এছাড়াও, রেডিও দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে, মানচিত্রে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তীব্রতা পরিমাপ করা যেতে পারে, যা নির্দেশ করে ওই মেঘে কোন কোন অণু বা পরমাণু বেশি পরিমাণে রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যে যত বেশি তীব্রতা পাওয়া যাবে, সেই নির্দিষ্ট অণু বা পরমাণুর আপেক্ষিক উপস্থিতি তত বেশি হবে বলে ধরে নেওয়া হয়।[২]
অন্তরাকাশের মেঘে অপ্রত্যাশিত রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে
এতদিন পর্যন্ত, বিজ্ঞানীরা ধারণা করতেন যে অন্তরাকাশের মেঘের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো খুব ধীরগতিতে ঘটে। এর কারণ এই মেঘের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব অনেক কম। কিন্তু পর্যবেক্ষণে এমন জৈব অণু পাওয়া গেছে যাদের এমন পরিবেশে থাকার কথা নয়। যেমন, ফরমালডিহাইড, মিথানল, এবং ভিনাইল অ্যালকোহল। পৃথিবীর গবেষণাগারে অনেক উচ্চ তাপমাত্রা এবং চাপের মধ্যেই শুধুমাত্র এই যৌগগুলোর সৃষ্টি সম্ভব। সেই যৌগগুলোর উপস্থিতি ইঙ্গিত করে যে, অন্তরাকাশের মেঘে এসব রাসায়নিক বিক্রিয়া আসলে অনুমিত গতির থেকে অনেক দ্রুততর – হয়তো এমন গ্যাসীয়-দশার বিক্রিয়ায় যেগুলো পৃথিবীর জৈব রসায়নবিদ্যায় অপরিচিত।[৩]CRESU পরীক্ষণে এই ধরনের বিক্রিয়াগুলি নিয়েই গবেষণা করা হচ্ছে।
এছাড়াও, বিজ্ঞানীরা মহাকাশে বিভিন্ন ধাতুর উপস্থিতি ও তাদের অনুপাত পর্যবেক্ষণ করতে এই অন্তরাকাশীয় মেঘগুলিকে ব্যবহার করেন। এই ধাতুগুলির উপস্থিতি ও আনুপাতিক তারতম্য বিজ্ঞানীদের এই উপাদান সৃষ্টির তত্ত্বগুলি বুঝতে সাহায্য করে। বিশেষত, নক্ষত্রের ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে যে ধাতু-অনুপাত তৈরির কথা, যখন তা পর্যবেক্ষণের সাথে মেলে না, তখন অন্যান্য উৎস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় – যেমন মহাজাগতিক রশ্মিজনিত ভাঙন (cosmic ray spallation)।[৪]
উচ্চ-বেগের মেঘ
আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ঘূর্ণনের গতিবেগের চাইতেও বেশি গতিতে চলাচল করে বলে, আন্তঃনাক্ষত্রিক এই মেঘগুলিকে উচ্চ-বেগের মেঘ (High-velocity clouds) বলা হয়। সংজ্ঞা অনুসারে, এই মেঘগুলির অবশ্যই একটি vlsr (স্থানীয় প্রমিত স্থির বেগ) থাকতে হবে যা 90 km s−1 এর চেয়ে বেশি। এই ধরনের মেঘগুলো মূলত নিরপেক্ষ হাইড্রোজেনের 21 সেমি রেখায় সনাক্ত করা হয়, এবং সাধারণত আকাশগঙ্গার আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘের তুলনায় এগুলোর ভারী মৌলের অংশ কম থাকে।
এই অস্বাভাবিক মেঘগুলির উৎস ব্যাখ্যা করতে যে তত্ত্বগুলি প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে বলা হয় - এগুলি হয়তো ছায়াপথ গঠনের সময় অবশিষ্ট পদার্থ, অথবা অন্যান্য ছায়াপথ বা স্থানীয় দলের (Local Group) সদস্যদের থেকে জোয়ারের টানে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা উপাদান। দ্বিতীয় তত্ত্বের একটি উদাহরণ হল ম্যাজেলানিক স্রোত (Magellanic Stream)। এই মেঘগুলির উৎপত্তি সম্পর্কে আরও সঠিক ধারণা পেতে, এদের দূরত্ব এবং ধাতবতা সম্পর্কে আরও ভালভাবে বোঝা প্রয়োজন।
উচ্চ-বেগের মেঘগুলিকে একটি HVC উপসর্গ দিয়ে শনাক্ত করা হয়, যেমন HVC 127- 41-330।
↑Project Leader Dr. Lochner (নভেম্বর ২০০৯)। "Spectra and What Scientists Can Learn From Them"। Goddard Space Flight Center, NASA। নভে ৯, ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১০।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)