তানোট মাতা মন্দির বা 'শ্রী মাতেশ্বরী তানোট রায় মন্দির' (হিন্দিতে: श्री मातेश्वरी तनोट राय मन्दिर) ভারতের পশ্চিম সীমান্ত-রাজ্য রাজস্থানেরজয়সলমের জেলার তানোট গ্রামে অবস্থিত একটি হিন্দু মন্দির।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় লঙ্গেওয়ালা যুদ্ধক্ষেত্রের নিকটে হওয়ায় সমসাময়িক লোককাহিনীতে যুদ্ধের ফলাফলের জন্য তানোট মাতার মহিমা প্রকাশ পায়। [১][২]
মামাদজি চারণের (গধবী) এক কন্যা দেবী আওয়াদ তানোট মাতা হিসাবে পূজিতা হন এবং তিনি কর্ণী মাতার পূর্বসূরি ছিলেন। এই অঞ্চলের অন্যান্য লোকদেবীরা হলেন- টেমদে রাই, কর্ণী মাতা, দেগ রাই এবং খোদিয়ার ইত্যাদি। দেবী আওয়াদ চারণ জাতির অন্তর্ভুক্ত এবং যোদ্ধা-ঋষির জীবনযাপন করতেন।
প্রাচীনতম চারণ সাহিত্য অনুসারে, তানোট মাতা হলেন পাকিস্তানের বালুচিস্তানে সতীপীঠে অধিষ্ঠিত ঐশ্বরিক দেবী হিংলাজ মাতার এক অবতার এবং যুদ্ধের দেবী।
জেলা ও সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগাম প্রাসঙ্গিক নথি ও বিশেষ অনুমতিপত্র না পেলে পর্যটকরা ভারত-পাক সীমান্ত দেখার অনুমতি পান না। বর্তমানে এটি ভারতের রাজস্থানে এক অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। এলাকাটিতে তেল ও গ্যাসের মজুত রয়েছে বলে জানা গেছে।
ইতিহাস
মন্দিরের এক পুরোহিতের বয়ান অনুসারে কথিত আছে যে,বহুকাল আগে মামাদজি চারণ (গন্ধবী) নামে একজন এখানে বসবাস করতেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। সন্তানলাভের আশায় তিনি সাত-আটবার পায়ে হেঁটে বর্তমানে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে অবস্থিত হিংলাজ মাতার মন্দিরে যান সন্তান লাভের আশায় পূজা দিতে, প্রার্থনা জানাতে। তারপর কোনও এক রাতে, হিংলাজ মাতা স্বপ্নে মামাদজিকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কী চাও– ছেলে না মেয়ে? চারণ বললেন, তুমিই আমার ঘরে কন্যারূপে জন্মগ্রহণ কর। হিংলাজ মাতার কৃপায় চরণের সাত কন্যা ও এক পুত্রের জন্ম হয়।এদের মধ্যে এক কন্যা ছিলেন আওয়াদ মাতা, যিনি তানোট মাতা নামেই বেশি পরিচিত। [৩]
লোকশ্রুতিকে বিশ্বাস করেই বহুকাল ধরেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই কাহিনী বর্ণিত হয়ে চলেছে।পরবর্তীতে স্থানীয় শাসক ভাটি রাজপুত রাজা তনু রাও ৮২৮ খ্রিস্টাব্দে একটি মন্দির নির্মাণ করে মাতার মূর্তি স্থাপন করেন।[৪] সেই থেকে, মন্দিরটিতে তানোট মাতা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভাটি রাজপুত এবং জয়সলমেরের জনগণের দ্বারা পূজিত হয়ে আসছেন। [৫]
১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের পর তানোট মাতার মন্দিরের আখ্যানে যুক্ত হল এক নতুন অধ্যায়। যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সীমান্তের সাদেওয়ালা পোস্টের কাছে হামলা শুরু করে [৩] তানোট আক্রমণ করতে মন্দির লক্ষ্য করে তারা তিন হাজার গ্রেনেড ও বোমা বর্ষণ করে। গোটা গ্রাম পাক বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেলেও আশ্চর্যজনকভাবে মন্দিরের দিকের গ্রেনেড এবং বোমাগুলির প্রতিটিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং একটিও বিস্ফোরিত হয়নি। [৬] সেই থেকে স্থানীয় গ্রামবাসী ও ভারতীয় সেনা বাহিনীর বিশ্বাস তানোট মাতার অলীক ক্ষমতার প্রদর্শনে বা মহিমার কারণেই মন্দির রক্ষা পায়। [৭] যুদ্ধের পর থেকেই বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এর জওয়ানরাই এখানে পুজো ও আরতিসহ মন্দিরের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। [৮]
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তানোট আবার আক্রমণ করা হয়, কিন্তু এবার আক্রমণকারী ট্যাঙ্কগুলি আকস্মিক ভাবেই বালিতে আটকে পড়ে, যার ফলে ভারতীয় বিমান বাহিনী সেগুলি ধ্বংস করতে সমর্থ হয়। [৫][৬]১৯৭১-এর যুদ্ধের পর, ভারতীয় সেনাবাহিনী লংগেওয়ালার যুদ্ধ বিজয়ের স্মরণে মন্দির প্রাঙ্গণের ভিতরে একটি বিজয় স্তম্ভ (বিজয় টাওয়ার) তৈরি করে। [৮]
অবস্থান
মন্দিরটি স্বর্ণনগরী নামে পরিচিত মরুশহর জয়সলমের হতে জাতীয় সড়ক-৬৮ বরাবর ১১৯ কিলোমিটার (বা ৭৬ মাইল) দূরে তানোট গ্রামে অবস্থিত। গ্রামটির অবস্থান কোড হল ০৮৫৮০৭। জয়সলমের শহর হতে সড়ক পথে পৌঁছাতে প্রায় দুই ঘন্টা সময় লাগে। এই এলাকায় বাতাসের গতি লক্ষনীয় ভাবে উচ্চ হওয়ার কারণে এখন এই এলাকায় প্রচুর সংখ্যক বায়ু-ভিত্তিক পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি প্রকল্প রয়েছে। তানোটের রাস্তাটি মাইলের পর মাইল বালির টিলা আর বালির পাহাড়ে ঘেরা। এলাকার তাপমাত্রা ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছায়। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এই স্থানটি পর্যটকদের জন্য আদর্শ সময়।
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে লঙ্গেওয়ালা সীমান্তে ভারত-পাক সেনার সংঘাতের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় বিখ্যাত বলিউড ছবি - বর্ডার। ছবিতে সীমান্ত এলাকায় দু-হাজারেও বেশি সেনাকে ১২০ জন ভারতীয় সেনা পরাস্ত করা এবং তানোট মাতার উপর ভারতীয় সেনার ভরসার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। [৯]
হিন্দি ভাষার সংবাদ চ্যানেল- 'জি নিউজ' এবং 'আজ তক' ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ভারত-পাক যুদ্ধের উপর যে তথ্যচিত্র সম্প্রচার করে সেখানেও তানোট মাতার মহিমা স্থান পেয়েছে।