1তালিবানের শাসনাধীন ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তান (যার অধীনে ছিল আফগানিস্তানের ৯০% ভূমি) আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধে নিরপেক্ষতা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তালিবানদের বেশ কয়েকটি দল তাজিক বিদ্রোহীদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।[৩]
তাজিকিস্তানের গৃহযুদ্ধ (তাজিক: Ҷанги шаҳрвандии Тоҷикистон, Jangi şahrvandi‘i Tojikiston/Çangi şahrvandiji Toçikiston); যেটি তাজিক গৃহযুদ্ধ অথবা তাজিকিস্তানের যুদ্ধ নামেও পরিচিত, শুরু হয়েছিল ১৯৯২ সালের মে মাসে, যখন তাজিকিস্তানের গার্ম এবং গরনো-বাদাখশান অঞ্চলের জাতিগুলো রাষ্ট্রপতি রাহমোন নাবিয়েভের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। বিদ্রোহীরা ছিল মূলত ওয়াহাবি মতবাদ অনুসারী ইসলামপন্থী। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি নাবিয়েভের সরকার গঠিত হয়েছিল খোজান্দ এবং কুলিয়াব অঞ্চলের লোকেদের নিয়ে। রাজনৈতিকভাবে, উদার গণতান্ত্রিক সংস্কারবাদীরা[৬] এবং ইসলামপন্থীরা বিদ্রোহীদের পরিচালিত করছিল। ইসলামপন্থী ও সংস্কারবাদীরা সরকারের বিরুদ্ধে একজোট হয় এবং 'ইউনাইটেড তাজিক অপোজিশন' বা 'সম্মিলিত তাজিক বিরোধীপক্ষে'র পতাকার অধীনে যুদ্ধ করে। ১৯৯৭ সালের জুন পর্যন্ত যুদ্ধের ফলে ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ মানুষ নিহত হয়।[৭][৮]
১৯৯৭ সালের ২৭ জুন রাষ্ট্রপতি এমোমালি রাহমোন, বিরোধীদলীয় নেতা সাঈদ আব্দুল্লোহ নূরি এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি গের্ড মেরেম রাশিয়ারমস্কোয়তাজিকিস্তানে শান্তি ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা বিষয়ক সাধারণ চুক্তি এবং মস্কো চুক্তি স্বাক্ষর করেন, এবং এর মধ্য দিয়ে পাঁচ বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে।[৯]
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত তাজিকিস্তানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য ১৯৯২ সালের বসন্তকালে বিরোধী দলের সদস্যরা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে এবং সঙ্কটের সূচনা ঘটে। তাজিকিস্তানের রাষ্ট্রপতি রাহমোন নাবিয়েভ এবং তাজিক সুপ্রিম সোভিয়েতের স্পিকার সফরালি কেনজায়েভ সরকারপন্থী মিলিশিয়া বাহিনীগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ করেন, অন্যদিকে বিরোধী পক্ষ সামরিক সহায়তার জন্য আফগানিস্তানের বিদ্রোহীদের দ্বারপ্রান্ত হয়।
১৯৯২ সালের মে মাসে সরকারের সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বিরোধী পক্ষে ছিল গার্ম এবং গর্নো-বাদাখশান অঞ্চলের জাতিগত ও ধর্মীয় দলসমূহ (গর্নো-বাদাখশানের লোকেরা 'পামিরি' নামেও পরিচিত ছিল)। আদর্শগতভাবে, বিরোধীপক্ষে গণতান্ত্রিক উদার সংস্কারপন্থী এবং ইসলামপন্থী উভয় দলই ছিল। অন্যদিকে, তাজিক সরকারে খোজান্দ অঞ্চলের লোকেদের আধিপত্য ছিল। কুলাইব অঞ্চলের লোকেরাও সরকারকে সমর্থন করে। বহু সংঘর্ষের পর খোজান্দিরা একটি সমঝোতা মেনে নিতে এবং একটি নতুন জোট সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়। নতুন সরকারে বিরোধীপক্ষের প্রাধান্য ছিল[১০]। ১৯৯২ সালের ৭ সেপ্টেস্বরে নাবিয়েভকে বিরোধীদলীয় প্রতিবাদকারীরা বন্দি করে এবং বন্দুকের নলের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে[৮][১১]। রাজধানী দুশানবের বাইরে বিশৃঙ্খলা ও দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চরমে পৌঁছে।
১৯৯২ সালের প্রথম ও শেষদিকে রাশিয়া ও উজবেকিস্তানের সামরিক সহায়তায় লেনিনাবাদি-কুলাইবি পপুলার ফ্রন্ট বিরোধীপক্ষকে পরাজিত করে। রাজধানীর জোট সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে সুপ্রিম সোভিয়েত (যেখানে আগাগোড়াই খোজান্দি-কুলাইবি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল) এমোমালি রাহমোনের নেতৃত্বে একটি নতুন সরকার গঠন করে। এর মধ্য দিয়ে তাজিকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্র খোজান্দ থেকে কুলাইবে স্থানান্তরিত হয়, কারণ রাহমোন কুলাইব থেকেই এসেছিলেন[১২][১৩]।
১৯৯২–১৯৯৩ সাল থেকে তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয় এবং কুলাইবি মিলিশিয়া বাহিনীগুলোকে অনেক বিরোধী দলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। এদের মধ্যে ছিল তাজিকিস্তান ইসলামি রেনেসাঁ পার্টি এবং গর্নো-বাদাখশানের জাতিগত সংখ্যালঘু পামিরিদের বাহিনী। বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সামরিক সাহায্যের বলে কুলাইবিরা বিরোধীপক্ষকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করতে সক্ষম হয় এবং পামিরি ও গার্মি জাতির লোকেদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ অভিযান শুরু করে দেয়[১৪]। এই অভিযান রাজধানীর দক্ষিণের অঞ্চলগুলোতে কেন্দ্রীভূত ছিল এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের হত্যাকাণ্ড, গণহত্যা, গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও পামিরি ও গার্মি জনসাধারণকে আফগানিস্তানে বহিষ্কার এই অভিযানের অংশ ছিল। এর ফলে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয় অথবা আফগানিস্তানে পালিয়ে যায়[১২][১৩][১৫][১৬]।
বিরোধীপক্ষের পুনর্গঠন
আফগানিস্তানে বিরোধীপক্ষ জামিয়াত-ই-ইসলামির সহযোগিতায় পুনর্গঠিত ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়। দলটির নেতা আহমদ শাহ মাসুদ তাজিক বিরোধীপক্ষের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। পরবর্তীতে বিরোধী দলগুলো ইউনাইটেড তাজিক অপোজিশন বা ইউটিও নামে পুনর্গঠিত হয়। ইউটিও-র অংশবিশেষ (বিশেষত তাবিলদারা অঞ্চলে) উজবেকিস্তানের ইসলামি আন্দোলন-এ পরিণত হয়, যদিও ইউটিও-র নেতারা এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন[১৭]। ইরান এই যুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে, কিন্তু তাজিক বিদ্রোহীদেরকে আদর্শিক সমর্থন প্রদান করে।
অচলাবস্থা এবং শান্তি
ইউটিও ছাড়াও তাজিকিস্তানে আরো সশস্ত্র দলের আবির্ভাব ঘটে। এদের আনুগত্য কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি ছিল না বরং তাজিকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব ভেঙ্গে পড়ার ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার সুযোগে এসব দলের সৃষ্টি হয়েছিল। যুদ্ধে চলাকালে জাতিসংঘ তাজিকিস্তানে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করে। যুদ্ধের প্রথম দিকের অধিকাংশ সংঘর্ষ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঘটেছিল, কিন্তু ১৯৯৬ সালের দিকে বিদ্রোহীরা রাজধানী দুশানবেতে রুশ সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। উত্তর আফগানিস্তানের ইসলামি চরমপন্থীরাও এ অঞ্চলে রুশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যস্থতায় আন্ত:তাজিক সংলাপ শুরু হয় এবং এর মাধ্যমে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে ক্ষমতায় খোজান্দ অঞ্চলের প্রভাব সম্পূর্ণরূপে লোপ পায়। ১৯৯৯ সালের ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯৭ সালের ২৩ জুন ইউটিও জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান এবং তাজিক রাষ্ট্রপতি এমোমালি রাহমোনকে লিখিত চিঠিতে সতর্ক করে দেয় যে, প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তিতে বন্দি বিনিময় ও জোট সরকারে অন্তর্ভুক্তির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত না হলে তারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না। ২৬ জুন ইউটিও-এর উপপ্রধান আকবর তুরাজোনজোদা এই সতর্কবাণীর পুনরাবৃত্তি করেন, তবে তিনি বলেন যে উভয়পক্ষ আলোচনা করছে। রাহমোন, ইউটিও-এর প্রধান সাঈদ আব্দুল্লো নূরি এবং রুশ রাষ্ট্রপতি বোরিস ইয়েলৎসিন ২৬ জুন মস্কোয় শান্তিচুক্তি সম্পর্কিত আলোচনা সমাপ্ত করার জন্য মিলিত হন। তাজিক সরকার কেবল শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পরেই আলোচ্য বিষয়গুলোর সমাধানের ওপর জোর দিয়েছিল।