মাজদ আদ-দীন উসামা ইবনে মুরশিদ ইবনে আলি ইবনে মুনকিজ আল-কিনানি আল-কালবি[১] (আরবি: أسامة بن منقذ) (৪ জুলাই ১০৯৫ – ১৭ নভেম্বর ১১৮৮[২]) ছিলেন উত্তর সিরিয়ারশাইজারের বনু মুনকিজ বংশীয় মধ্যযুগের একজন মুসলিম কবি, লেখক, ফারিস ও কূটনৈতিক। তার জীবনকালে কয়েকটি মুসলিম রাজবংশের উত্থান হয়েছে। এছাড়াও এসময় প্রথম ক্রুসেড সংঘটিত হয় এবং ক্রুসেডার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
উসামা শাইজারের আমিরের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী ছিলেন। কিন্তু ১১৩১ খ্রিস্টাব্দে তিনি নির্বাসিত হন। বাকি জীবন তিনি অন্যান্য নেতাদের অধীনে কাজ করেছেন। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় তিনি বুরি, জেনগি ও আইয়ুবীয় দরবারের সদস্য ছিলেন এবং ইমাদউদ্দিন, নুরউদ্দিন ও সালাহউদ্দিনকে সহায়তা করেছেন। এছাড়াও তিনি কায়রোতে ফাতেমীয় দরবারে ও হিসন কাইফায়অরতুকিদের অধীনে দায়িত্বপালন করেছেন। তিনি অনেক আরব অঞ্চল সফর করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে মিশর, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, টাইগ্রিস নদী। তিনি হজ্জের জন্য মক্কায় গিয়েছিলেন। তিনি দরবারের কার্যক্রমে কয়েকবার হস্তক্ষেপ করেছিলেন। তাকে দামেস্ক ও কায়রো উভয় স্থান ত্যাগ করতে হয়েছিল।
জীবনকালে ও মৃত্যুপরবর্তী সময়ে তিনি একজন কবি ও আদিব হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি কবিতা সংকলন প্রণয়ন করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে কিতাব আল-আসা, লুবাব আল-আদাব ও আল-মানজিল ওয়াল-দিয়ার। তার নিজস্ব কবিতার সংকলনও রয়েছে। বর্তমানকালে তাকে তার কিতাব আল-ই'তিবার নামক গ্রন্থের জন্য স্মরণ করা হয়। এতে ক্রুসেডারদের বর্ণনা রয়েছে। বিভিন্ন উপলক্ষে ক্রুসেডারদের সাথে তার সাক্ষাত হয়েছিল। কিছু ক্রুসেডারদেরকে তিনি বন্ধু হিসেবে দেখলেও সামগ্রিকভাবে তাদের অশিক্ষিত বিদেশি হিসেবে দেখতেন।
১১৫৭ খ্রিস্টাব্দে শাইজারে সংঘটিত ভূমিকম্পে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হন। ১১৮৮ খ্রিস্টাব্দে ৯৩ বছর বয়সে তিনি দামেস্কে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রারম্ভিক জীবন
উসামা ছিলেন শাইজারের আমির নাসেরের ভ্রাতুষ্পুত্র। তার বাবার নাম মুরশিদ।
শাইজার কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সিরিয়ার ভেতরের অংশে প্রবেশের ক্ষেত্রে শাইজার ছিল প্রবেশপথ। মুসলিমদের সিরিয়া বিজয়ের সময় এই অঞ্চল মুসলিমদের হাতে আসে। গুরুত্বের কারণে বেশ কয়েকবার আরব ও বাইজেন্টাইন পক্ষের মধ্য এই অঞ্চলের হাতবদল হয়েছে। ৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইনরা এখানে শাসন করত। ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে হামার শাসক সালেহ আল-মুরদাসি কর্তৃক বনু মুনকিজ গোত্রকে শাইজারের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে স্থান বরাদ্দ দেয়া হয়। সময় পরিক্রমায় তারা স্থান সম্প্রসারণ করে এবং দুর্গ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ১১৮০ খ্রিস্টাব্দে উসামার দাদা ইজউদ্দৌলা আল-মুরহিফ নাসের শাইজার দখল করেন।[৩]
১০৯৮ খ্রিস্টাব্দে নাসের মারা যাওয়ার পর উসামার বাবা মাজদ আল-দীন আবি সালামা মুরশিদ শাইজার ও পার্শ্ববর্তী শহরসমূহের আমির হন।[৩] পরে তিনি তার ভাই ও উসামার চাচা সুলতান ইবনে মুনকিজকে শাসনভার অর্পণ করেন। মুরশিদ রাজনীতির চেয়ে ধর্মীয় বিষয়াদি অধ্যয়ন, কুরআন লেখা ও শিকারের প্রতি আগ্রহী ছিলেন।[৩][৪]
উসামার চাচার শাসনামলে শাইজারের উপর আলেপ্পোর কালব গোত্র, হাশাশিন, বাইজেন্টাইন ও ক্রুসেডারদের আক্রমণ ঘটে। ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইনরা দশদিন ধরে অবরোধ যন্ত্র দিয়ে অবরোধ করে রেখেছিল। ক্রুসেডাররা বেশ কয়েকবার হামলা চালায়। তবে দুর্গের দেয়াল ছাড়াও প্রাকৃতিক বাধার কারণে শহরের কখনো পতন হয়নি।[৩]
উসামা শৈশবে লুলুয়া নামক এক নারীর তত্ত্বাবধানে বড় হয়েছেন। পরে তিনি উসামার সন্তানদেরও তত্ত্বাবধান করেছেন।[৫] উসামার পিতা তাকে হাফিজ হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন এবং তাকে কাফারতাবের ইবনে মুনিরা ও টলেডোর আবু আবদুল্লাহ আল-তুলাইতুলির অধীনে পড়াশোনা করিয়েছেন। যৌবনের অধিকাংশ সময় তিনি পরিবারের সাথে শিকার ও যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রতিবেশি ক্রুসেডার রাজ্য কাউন্টি অফ ত্রিপলি এবং প্রিন্সিপালিটি অফ এন্টিওক, মুসলিম প্রতিবেশী হামা, হিমস এবং শাইজারের নিকটে ঘাঁটি স্থাপনকারী হাশাশিনদের বিরুদ্ধে তার প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে।[৬]
প্রথমদিকে সুলতানের কোনো পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকায় উসামার পরবর্তী শাসক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।[৭] সুলতান তাকে অন্য ভাইদের থেকে পৃথক করে শিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়াও ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবেও উসামাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।[৩] তবে সুলতানের নিজের পুত্র হওয়ার পর তিনি উসামা বা তার অন্য ভাইদের তেমন গুরুত্ব দেননি। উসামার মতে ১১৩১ খ্রিস্টাব্দে একটি সফল শিকার অভিযান শেষে স্মারক হিসেবে সিংহের একটি বিশাল মস্তক নিয়ে শহরে প্রবেশ করার পর সুলতান তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হন। এ ঘটনা তার চাচার উপর প্রভাব ফেলতে পারে এমনটা তার দাদি তাকে সতর্ক করেছিলেন[৮] তবে এরপরও উসামা তার আত্মজীবনীতে তার চাচার প্রশংসা করেছেন এবং তার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে তুলে ধরেছেন।[৯] ১১২৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাময়িকভাবে শাইজার ত্যাগ করেছিলেন। ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দে তার বাবার মৃত্যুর পর এই প্রস্থান স্থায়ী হয়।[৩]
১১৫৪ খ্রিস্টাব্দে তার চাচা সুলতান মারা যান এবং সুলতানের পুত্র তাজউদ্দৌলা নাসের আল-দীন মুহাম্মদ শাসক হন। ১১৫৭ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পের সময় তিনি ছিলেন উত্তরাধিকারের ধারার শেষ ব্যক্তি।
দামেস্ক ও মিশর
উসামা হিমস চলে আসেন। এখানে তিনি মসুল ও আলেপ্পোর আতাবেগ ইমাদউদ্দিন জেনগির বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে বন্দি হন। ইমাদউদ্দিন ইতঃপূর্বে নিকটবর্তী হামা অধিকার করেছিলেন। বন্দী হওয়ার পর তিনি ইমাদউদ্দিনের অধীনে কাজ শুরু করেন। এসময় তিনি সিরিয়া, ইরাক ও আর্মেনিয়ায় জেনগি প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ১১৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাগদাদের বাইরে আব্বাসীয় খলিফার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ১১৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি দক্ষিণে হামায় ফিরে আসেন। এখানে জেনগি সেনাপতি আল-ইয়গিসিয়ানি গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন। ১১৩৭ খ্রিস্টাব্দে তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি শাইজার আসেন। ১১৩৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে বাইজেন্টাইন সম্রাট দ্বিতীয় জন কমনেনাস শাইজার অবরোধ করার পর তিনি পুনরায় শাইজার এসেছিলেন।[১০]
শাইজারের অবরোধ ব্যর্থ হলেও শাইজারের বেশ ক্ষতি হয়েছিল। অবরোধের পর উসামা ইমাদউদ্দিনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে দামেস্ক চলে আসেন। দামেস্কে এসময় বুরি রাজবংশেরআতাবেগমুইনউদ্দিন উনুর শাসন করছিলেন। ইমাদউদ্দিন দামেস্ক জয় করতে মনস্থির করার পর উসামা ও উনুর ক্রুসেডার জেরুজালেম রাজ্যের কাছে সহায়তা চান। ১১৩৮ খ্রিস্টাব্দে তাকে একটি প্রাথমিক সফরে জেরুজালেম পাঠানো হয়। ১১৩৯ খ্রিস্টাব্দে ইমাদউদ্দিন জেনগি বালবিক জয় করেন। ক্রুসেডারদের সাথে সন্ধি করার জন্য ১১৪০ খ্রিস্টাব্দে উনুর পুনরায় উসামাকে জেরুজালেম পাঠান। ১১৪০ থেকে ১১৪৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তারা দুইজন কয়েকবার তাদের নতুন মিত্রপক্ষের সাথে সাক্ষাত করেছেন। পরবর্তীতে উনুরের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্রে উসামা জড়িত আছেন সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার পর উসামা ১১৪৪ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে ফাতেমীয়কায়রো পালিয়ে যান।[১১]
কায়রোতে তিনি একজন সম্পদশালী সভাসদ হয়ে উঠেন। সেখানে তিনি ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১১৪৯ খ্রিস্টাব্দে আল-জাফির খলিফা হন এবং ইবনে আস-সালার উজির হন। এসময় উসামা অন্যতম উপদেষ্টা হয়েছিলেন। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে ইমাদউদ্দিনের পুত্র নুরউদ্দিন জেনগির সাথে সন্ধি করার জন্য আস-সালার উসামাকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আলোচনা ব্যর্থ হয়। মিশরে ফেরার পথে আসকালানের বাইরে ক্রুসেডারদের সাথে সংঘটিত যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন এবং তিনি চলে যাওয়ার পর তার ভাই আলি গাজায় নিহত হন।[১২]
১১৫৩ খ্রিস্টাব্দে আস-সালার মিশরে নিহত হন। এতে তার পুত্র আব্বাস, আব্বাসের পুত্র নাসের ও খলিফা আল-জাফির জড়িত ছিলেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ আলি ইবনে আসিরের বর্ণনা অনুযায়ী উসামা এই হত্যার প্ররোচনাদানকারী ছিলেন।[১৩] ১১৫৪ খ্রিস্টাব্দে আব্বাস কর্তৃক আল-জাফিরের হত্যায়ও উসামা জড়িত থাকতে পারেন। আল-জাফিরের আত্মীয়রা তাদের এক সমর্থক ইবনে রুজিককে ডেকে পাঠায়। তিনি কায়রোর বাইরে আব্বাসের পিছু নেন। উসামাও কায়রো ত্যাগ করেছিলেন। কায়রোতে উসামার সহায়সম্পদ হাতছাড়া হয়। দামেস্কে আসার সময় তার দলের উপর ক্রুসেডার ও বেদুইন যাযাবরদের হামলা হয়। কিন্তু ১১৫৪ খ্রিস্টাব্দের জুনে তিনি নিরাপদে দামেস্ক পৌঁছান। নুরউদ্দিন জেনগি ইতঃপূর্বে দামেস্ক অধিকার করেছিলেন। উসামার পরিবারের বাকি সদস্যরা তখনো কায়রোতে ছিল বলে ইবনে রুজিক তাকে কায়রো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু উসামা ১১৫৬ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডারদের অঞ্চলের মধ্য দিয়ে তাদের দামেস্ক ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। ক্রুসেডাররা তাদের নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু দলটি যাত্রাপথে হামলার সম্মুখীন হওয়ায় উসামা তার গ্রন্থাগারটি হারান।[১৪]
পরবর্তী বছরসমূহ
১১৫৭ খ্রিস্টাব্দে একটি ভূমিকম্পে শাইজার ধ্বংস হয়। এসময় উসামার আত্মীয়দের অধিকাংশ মারা যান। এর আগে সুলতানের উত্তরসূরি হিসেবে আমির হওয়া উসামার চাচাত ভাই মুহাম্মদের পুত্রের খতনা উপলক্ষে তারা সেখানে ছিল। এসময় শুধুমাত্র আমির মুহাম্মদের স্ত্রী বেঁচে গিয়েছিলেন। উসামা দামেস্কে প্রায় অবসর জীবনযাপন করতে থাকেন। ১১৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হজ্বে যান। ১১৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নুরউদ্দিনের সাথে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযানে যান। ১১৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত হারিমের যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছেন। সেই বছর উসামা নুরউদ্দিনের চাকরি ছেড়ে দেন এবং উত্তরের দিকে হিসন কাইফারঅরতুকি আমির কারা আরসালানের দরবারে আসেন।[১৫]
হিসন কাইফায় তার জীবন বেশি জানা যায় না। তবে তিনি সমগ্র অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন। তার অধিকাংশ রচনাকর্ম তিনি এখানে সম্পাদন করেছেন এমন হতে পারে। ১১৭৪ খ্রিস্টাব্দে সালাহউদ্দিনের অধীনে কাজ করার জন্য তাকে দামেস্কে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সালাহউদ্দিন উসামার পুত্র মুরহাফের বন্ধু ছিলেন। হিসন কাইফার মত উসামা এখানেও প্রায় অবসর জীবন কাটিয়েছেন। তিনি সালাহউদ্দিনের সাথে প্রায়ই সাক্ষাত করতেন এবং সাহিত্য ও যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতেন। দামেস্কে তিনি হাদিস ও কাব্যের উপর পাঠদান করে থাকতে পারেন। সালাহউদ্দিন ও তার প্রধান ব্যক্তিগণ যেমন আল-কাদি আল-ফাদল ও ইমাদউদ্দিন আল-ইসফাহানির জন্য তিনি কবিতার আসরের আয়োজন করতেন।[১৬] ১১৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর তিনি মারা যান।[১৭] দামেস্কের কাসিউন পর্বতে তাকে দাফন করা হয়েছে। তবে তার কবর বর্তমানে খুজে পাওয়া যায় না।[১৮]
পরিবার
উসামার তিন ভাই ছিল। তারা হলেন মুহাম্মদ, আলি ও মুনকিজ। তার চাচা শাইজারের আমির সুলতানের এক পুত্রের নামও মুহাম্মদ ছিল এবং সুলতানের পর মুহাম্মদ আমির হন। উসামার এক পুত্রের নাম ছিল মুরহাফ। আরেক পুত্রে নাম ছিল আবু বকর তবে এই পুত্র শৈশবে মারা যায়। উম্মে ফারওয়া নামে তার এক কন্যা ছিল। তিনি তার অন্যান্য সন্তানদের ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন তবে সেসব সন্তান এবং তার স্ত্রীগণের নাম জানা যায় না।[১৯]
তার পিতার সম্পর্কে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে তার পিতা পৃথিবী সম্পর্কে কম আগ্রহী একজন ধার্মিক ব্যক্তি প্রতীয়মান হয়। তিনি দিনের অধিকাংশ সময় কুরআন তিলাওয়াত, রোজা ও শিকার করে কাটাতেন এবং রাতের বেলা কুরআনের পাণ্ডুলিপি তৈরী করতেন। নিজ আত্মজীবনী কিতাব আল-ই'তিবারে উসামা ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে কিছু যুদ্ধে তার পিতার অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন।[২০]
ধর্ম
উসামাকে কখনো কখনো শিয়া মতাবলম্বী হিসেবে ধারণা করা হয়। তার পরিবার ফাতেমীয় এবং অন্যান্য শিয়া রাজবংশসমূহকে সহায়তা করেছে। তিনি নিজেও মিশরে ফাতেমীয়দের অধীনে কাজ করেছেন। ফিলিপ খুরি হিট্টির মতে শিয়াদের প্রতি উসামার "গোপন সহানুভূতি" ছিল।[২১] পল এম. কোবের মতে উসামার শিয়া বা সুন্নি মতাবলম্বন সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না, তবে তার ধারণা যে উসামা শিয়া প্রবণতাবিশিষ্ট সুন্নি ছিলেন।[২২]রবার্ট আরউইনের মতে বনু মুনকিজ গোত্র দ্বাদশবাদি শিয়া মতাবলম্বী ছিল।[২৩] উসামা খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীদের প্রশংসা করেছেন। সুফিদেরকে তিনি পছন্দ করতেন।[২৪]
রচনাবলি
১১৭১ খ্রিস্টাব্দের দিকে হিসন কাইফায় থাকার সময় উসামা কিতাব আল-আসা লিখেছেন। একটি কবিতা সংকলন। এছাড়া তিনি আল-মানাজিল ওয়াল-দিয়ার গ্রন্থটিও রচনা করেছেন। ১১৮০ এর দশকের প্রথমদিকে দামেস্কে থাকাবস্থায় তিনি আরেকটি সংকলন লুবাব আল-আদাব রচনা করেছেন। তিনি তার কিতাব আল-ই'তিবার গ্রন্থের জন্য বেশি বিখ্যাত। ১১৮৩ খ্রিস্টাব্দে সালাহউদ্দিনের প্রতি উপহার হিসেবে এই গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এতে আত্মজৈবনিক উপাদান থাকলেও এটি ঠিক স্মৃতিকথা নয়।[২৫] এটি দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল।[২৬]
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে হার্টউইগ ডেরেনবর্গ প্রথম কিতাব আল-ই'তিবার আবিষ্কার করেন। মাদ্রিদের এস্কুরিয়ালে এর একটিমাত্র পাণ্ডুলিপি টিকে ছিল। ডেরেনবর্গ সর্বপ্রথম এই বইয়ের একটি আরবি সংস্করণ (১৮৮৬), উসামার একটি জীবনী (১৮৮৯) এবং একটি ফরাসি অনুবাদ (১৮৯৫) প্রকাশ করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে হিট্টি একটি উন্নততর আরবি সংস্করণ এবং একটি ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে কাসিম আস-সামারাই আরেকটি আরবি সংস্করণ প্রকাশ করেছেন।[২৭]
উসামা "মধ্য আরবি" ভাষাশৈলীতে লিখেছেন। এটি ধ্রুপদি আরবির চেয়ে কম প্রচলিত ভাষাশৈলী।[২৮]
খ্যাতি
উসামা অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করার কারণে পরিচিত ছিলেন। এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলাম অনুযায়ী তার কর্মজীবন দুর্যোগপূর্ণ ছিল এবং এসবের জন্য তার কাজ অনেকাংশে দায়ী।[২৯]
সমসাময়িক এবং পরবর্তী মধ্যযুগীয় মুসলিমদের নিকট তিনি তার কবিতা ও কবিতা সংকলনের জন্য পরিচিত ছিলেন।[৩০] ১৪শ শতাব্দীতে জীবন অভিধান লেখক ইবনে খালিকান তাকে "মুনকিজ পরিবারের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, শিক্ষিত ও নির্ভিক সদস্যদের অন্যতম" বলে অভিহিত করেছেন এবং তার কবিতা বিষয়ে দীর্ঘ লেখা লিখেছেন।[৩১]
উসামা তার সামরিক ও শিকার সংক্রান্ত কার্যকলাপের জন্যও পরিচিত ছিলেন। আলি ইবনে আসির হারিমের যুদ্ধে তার উপস্থিতিকে উল্লেখ করে তাকে "সাহসিকতার সর্বোচ্চ" বলে বর্ণনা করেছেন।[৩২]
আধুনিক পাঠকদের কাছে তিনি কিতাব আল-ই'তিবার গ্রন্থ এবং ক্রুসেডের প্রথমদিকে সিরিয়ায় তার জীবনের বর্ণনার জন্য পরিচিত। এটি রসাত্মক ও নৈতিক গল্প আকারে লেখা হয়েছে যা আত্মজীবনীতে দেখা যায় না।[৩৩] তবে আরবি সাহিত্যের আদাব শৈলীতে বাস্তব ঘটনার উল্লেখ জরুরি নয় বলে ইতিহাসবিদরা উসামার ঐতিহাসিক উপাদান সবসময় গ্রহণ করেন না। ক্রুসেডারদের নিয়ে তার লেখা কখনো কখনো কৌতুক এবং অতিরঞ্জিত হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।[৩৪]ক্যারল হিলেনব্র্যান্ড লিখেছেন যে তার গ্রন্থের লেখা শুধুমাত্র আক্ষরিক অর্থে ধরে নেয়া ঠিক না।[৩৫]
গ্রন্থপঞ্জি
আরবি উইকিসংকলনে এই নিবন্ধ সম্পর্কে আদি লেখা রয়েছে:
Ousama ibn Mounkidh, un emir Syrien au premier siècle des croisades (1095–1188), ed. Hartwig Derenbourg. Paris, 1889.
An Arab-Syrian Gentleman and Warrior in the Period of the Crusades; Memoirs of Usāmah ibn-Munqidh (Kitab al i'tibar), trans Philip K. Hitti. New York, 1929.
Memoirs Entitled Kitāb al-I'tibār, ed. Philip K. Hitti (Arabic text). Princeton: Princeton University Press, 1930.
Lubab al-Adab, ed. A. M. Shakir. Cairo: Maktabat Luwis Sarkis, 1935.
Diwan Usama ibn Munqidh, ed. A. Badawi and H. Abd al-Majid. Cairo: Wizarat al-Ma'arif al-Umumiyya, 1953.
Kitab al-Manazil wa'l-Diyar, ed. M. Hijazi. Cairo: Al-Majlis al-A'la li-l-Shu'un al-Islamiyya, 1968.
Al-Badi' fi-l-Badi', ed. A. Muhanna. Beirut: Dar al-Kutub al-'Ilmiyya, 1987.
Kitab al i'tibar, ed. Qasim as-Samarra'i. Riyadh, 1987.
"Usama ibn Munqidh's Book of the Staff (Kitab al'Asa): autobiographical and historical excerpts," trans. Paul M. Cobb. Al-Masaq: Islam and the Medieval Mediterranean 17 (2005).
"Usama ibn Munqidh's Kernels of Refinement (Lubab al-Adab): autobiographical and historical excerpts," trans. Paul M. Cobb. Al-Masaq: Islam and the Medieval Mediterranean 18 (2006)
The Book of Contemplation: Islam and the Crusades, trans. Paul M. Cobb. Penguin Classics, 2008.
Niall Christie, "Just a bunch of dirty stories? Women in the memoirs of Usamah ibn Munqidh." Eastward Bound: Travel and Travellers, 1050–1550, ed. Rosamund Allen. Manchester: Manchester University Press, 2004, pp. 71–87.
Paul M. Cobb, Usama ibn Munqidh: Warrior-Poet in the Age of Crusades Oxford: Oneworld, 2005.
Paul M. Cobb, "Infidel dogs: hunting crusaders with Usamah ibn Munqidh." Crusades 6 (2007).
Lawrence I. Conrad, "Usama ibn Munqidh and other witnesses to Frankish and Islamic medicine in the era of the crusades." Medicine in Jerusalem throughout the Ages, ed. Zohar Amar et al. Tel Aviv: C. G. Foundation, 1999.
Carole Hillenbrand, The Crusades: Islamic Perspectives. Routledge, 2000.
R. S. Humphreys, Munkidh, Banu. Encyclopaedia of Islam, 2nd. ed., vol. VII (Leiden: Brill, 1960–2002).
Robert Irwin, "Usama ibn Munqidh: an Arab-Syrian gentleman at the time of the Crusades reconsidered." The Crusades and their sources: essays presented to Bernard Hamilton ed. John France, William G. Zajac (Aldershot: Ashgate, 1998) pp. 71–87.
Adnan Husain, "Wondrous Crusade Encounters: Usamah ibn Munqidh's Book of Learning by Example," in Jason Glenn (ed), The Middle Ages in Texts and Texture: Reflections on Medieval Sources (Toronto, University of Toronto, 2012),
D. W. Morray, "The genius of Usamah ibn Munqidh: aspects of Kitab al-I'tibar by Usamah ibn Munqidh." Working Paper. University of Durham, Centre for Middle Eastern and Islamic Studies, Durham, 1987.
I. Schen, "Usama ibn Munqidh's Memoirs: some further light on Muslim Middle Arabic." Journal of Semitic Studies 17 (1972), and Journal of Semitic Studies 18 (1973).
G. R. Smith, "A new translation of certain passages of the hunting section of Usama ibn Munqidh's I'tibar." Journal of Semitic Studies 26 (1981).
Stefan Wild, "Open questions, new light: Usama ibn Munqidh's account of his battles against Muslims and Franks." The Frankish Wars and their Influence on Palestine, edd. Khalil Athamina and Roger Heacock (Birzeit, 1994), pp. 9–29.
The Chronicle of Ibn al-Athir for the Crusading Period from al-Kamil i'l-Ta'rikh, Part 2: The Years 541–589/1146–1193: The Age of Nur al-Din and Saladin, trans. D.S. Richards. Crusade Texts in Translation 15. Aldershot: Ashgate, 2007.
তথ্যসূত্র
↑Majd ad-Din is an honorific title meaning "glory of the faith". His given name, Usama, means "lion". Murshid was his father, Ali his grandfather, and Munqidh his great-grandfather. The Munqidh family belonged to Kinanah from Kalb from the Qudhaa. Paul M. Cobb, Usama ibn Munqidh: Warrior-Poet in the Age of Crusades (Oxford: Oneworld, 2005), p. 4.
↑The Chronicle of Ibn al-Athir for the Crusading Period from al-Kamil i'l-Ta'rikh, Part 2: The Years 541–589/1146–1193: The Age of Nur al-Din and Saladin, trans. D.S. Richards. Crusade Texts in Translation 15 (Aldershot: Ashgate, 2007), p. 62.
↑An Arab-Syrian Gentleman and Warrior in the Period of the Crusades; Memoirs of Usamah ibn-Munqidh (Kitab al i'tibar), trans Philip K. Hitti (New York, 1929), introduction, p. 14.
↑Robert Irwin, "Usamah ibn Munqidh: An Arab-Syrian gentleman at the time of the crusades reconsidered." The Crusades and their Sources: Essays Presented to Bernard Hamilton, eds. John France and W.G. Zajac (Aldershot: Ashgate, 1998), p. 78.