তুরস্কের শহর ইস্তানবুল একটি বৃহৎ সংখ্যক গৃহহীন বিড়াল (তুর্কি ভাষায়: sokak kedisi, অর্থাৎ "রাস্তার বিড়াল") ধারণ করে, যেখানে প্রায় এক লাখ থেকে শুরু করে এক মিলিয়নেরও বেশি গৃহহীন বিড়াল থাকতে পারে বলে অনুমান করা হয়। অনেক তুর্কি নাগরিক রাস্তার প্রাণীদেরকে ঐতিহ্যগতভাবে গৃহহীন মনে না করে, বরং একটি কমিউনিটির পোষা প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করেন। তুরস্কে গৃহহীন প্রাণীদের প্রতি কোনো ধরনের হত্যা বা বন্দি না করার নীতিমালা কার্যকর রয়েছে।[১]
ইতিহাস
ইস্তানবুলের বিড়ালের প্রতি ভালোবাসার ইতিহাস উসমানীয় যুগের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করেন "ক্যাটস অফ ইস্তানবুল"-এর আয়সে সাবুঞ্চু। তখন ইস্তানবুলের বেশিরভাগ বাড়িই কাঠের তৈরি ছিল, যা ইঁদুর ও ধেড়ে ইঁদুরের জন্য আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করত এবং তাদের সংখ্যা বাড়াতে সহায়ক হতো। এই পরিস্থিতি বিড়ালের উপস্থিতিকে শহরে এক প্রয়োজনীয় ব্যাপার করে তুলেছিল।[২] বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তুরস্কে বিড়ালের প্রতি ইতিবাচক মনোভাবকে ইসলাম ধর্মের সাথে সংযুক্ত করেছে (ইসলামে বিড়াল দেখুন),[৩][২] যা তুরস্কে সর্বাধিক প্রচলিত ধর্ম।
স্বাস্থ্য
২০১১ সালের এক গবেষণায় ইস্তানবুলের গৃহহীন প্রাণীদের মধ্যে টেপওয়ার্ম সংক্রমণ পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায় যে, পরীক্ষায় অংশ নেওয়া বিড়ালদের মধ্যে ৪.৬৫% জয়েউক্সিয়েলা ইস্টার সংক্রমণে আক্রান্ত ছিল।[৪] এছাড়া, গৃহহীন ও বাহিরে থাকা বিড়ালদের মধ্যে ফেলাইন ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস এবং ফেলাইন লিউকেমিয়া ভাইরাস সংক্রমণ সাধারণত দেখা যায়।[৫] যদিও গৃহহীন বিড়ালরা জলাতংক ছড়ানোর মাধ্যম হতে পারে, ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে তুরস্কে নথিভুক্ত হওয়া ২১টি রেবিজ সংক্রমণের ঘটনাগুলোর মধ্যে বিড়াল ও মানুষের মধ্যে কোনো সংক্রমণের ঘটনা ছিল না।[৬]
স্থানীয়রা বিড়ালদের প্রকাশ্যে খাবার খাওয়ায়, যা কিছু পশুচিকিৎসকের সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। ২০১৫ সালে রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণাপত্রে বলা হয় যে, এই ধরনের একত্রে খাওয়ানো প্রাণীদের নির্দিষ্ট এলাকায় মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং তাদের ঘনত্ব বাড়ায়। ফলে, কিছু রোগের সংক্রমণ সহজ হয়ে যায়। অসুস্থ প্রাণীদের ব্যবহৃত খাবার এবং পানির পাত্রের মাধ্যমে সুস্থ বিড়ালদের মধ্যে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা আরেকটি উদ্বেগের বিষয়।[৭]
আইন
২০২১ সালের আগে তুরস্কের আইনে গৃহপালিত ও গৃহহীন প্রাণীদেরকে "জীবন্ত প্রাণী" নয়, বরং "পণ্য" হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছিল। এই শ্রেণীবিভাগ পশু অধিকার কর্মীদের সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এটি প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতার জন্য তুলনামূলকভাবে হালকা শাস্তির পথ খুলে দিত। ২০২১ সালে গৃহীত এক প্রস্তাব অনুযায়ী, গৃহপালিত এবং গৃহহীন প্রাণীদেরকে "জীবন্ত প্রাণী" হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে প্রাণীর বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য ছয় মাস থেকে চার বছর পর্যন্ত জেল-শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আইনটি তুরস্কে সব গৃহহীন প্রাণীর নির্বীজনকেও বাধ্যতামূলক করেছে।[৮][১]
২০১৯ সালে এক জাপানি নাগরিক তুরস্ক থেকে বহিষ্কৃত হন, কারণ তিনি কুচুকচেকমেজে এলাকায় ৫টি গৃহহীন বিড়াল মেরে মাংস খেয়েছেন বলে স্বীকার করেন। এই ঘটনা তুরস্ক এবং জাপান উভয় দেশেই ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।[৯]
ইস্তানবুলে বিড়ালের জীবন
স্থানীয়রা ইস্তানবুলের রাস্তাগুলো প্রায় ১,২৫,০০০ বিড়ালের সঙ্গে ভাগাভাগি করেনেন। শুধু গৃহহীন বিড়ালদের সংখ্যাই এটি। ঘরের পোষা বিড়ালগুলো মিলিয়ে অনুমান করা হয় যে, এই শহরে প্রায় ২,০০,০০০ বিড়াল বাস করে। এই শহরে বিড়ালদের একটি আরামদায়ক জীবনযাপনের জন্য বেশ পরিচিতি রয়েছে।[১০]
সাধারণত, ইস্তানবুলের প্রতিটি রাস্তার স্থানীয়দের পরিচিত কিছু বিড়াল থাকে। এই রাস্তাগুলিতে গৃহহীন বিড়ালদের জন্য ছোট ছোট "বিড়ালের ঘর" তৈরি করা হয়েছে। আশপাশের বাসিন্দারা নিজেদের বাড়ির সামনে খাবার ও পানির পাত্র রেখে গৃহহীন বিড়ালদের খাবারের ব্যবস্থা করেন।[১০]
ইস্তানবুলের পৌরসভা শহরের বিভিন্ন স্থানে বিড়াল ও কুকুরদের জন্য স্বয়ংক্রিয় খাবার মেশিন স্থাপন করেছে। এই মেশিনগুলোর চারপাশে অনেক বিড়াল দেখা যায়। পথচারীরা এই মেশিনে কয়েন ফেলে, যা বিড়াল ও কুকুরদের খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করে।[১০]
ইস্তানবুলের বিভিন্ন জায়গায় গৃহহীন বিড়ালদের দেখা যায়, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষ, ফেরি, বাসের সিট বা পাতাল রেলে। এখানে কেউই তাদের বিরক্ত করে না।[১০]
জনপ্রিয় সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমে
ইস্তানবুলের গৃহহীন বিড়ালদের বিভিন্ন গণমাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে ইস্তানবুলের বিড়ালরা বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।[২]
২০১৬ সালের সমালোচকদের প্রশংসিত তুর্কি ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র বিড়াল ইস্তানবুল শহরের কয়েকটি গৃহহীন বিড়ালকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে।[১১]Etsuko Shundo [jp]-এর ২০১৫ সালের শিশুতোষ বই ইস্তানবুলে বিড়াল খোঁজা (জাপানি: イスタンブルで猫さがし) একটি তুর্কি ভ্যান বিড়াল খোঁজার বিষয়ে, যেখানে ইস্তানবুল জাপানি স্কুলের শিক্ষার্থীরা একটি গৃহহীন বিড়ালকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে।[১২]
তোমব্লি নামের একটি বিড়াল আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি অর্জন করে তার একটি ছবির মাধ্যমে, যেখানে তাকে রাস্তার পাশে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। তার মৃত্যুর পর তাকে সম্মান জানিয়ে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়।[১৩][১৪]
গ্লি নামের আরেকটি বিড়াল আয়া সোফিয়াতে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে উঠেছিল, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করত।